সামনে পরীক্ষা।
সময় চলে যাচ্ছে দ্রুত। পরীক্ষার বিভীষিকা ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসছে। পরীক্ষার সময় সময়ের কাঁটা এত দ্রুত চলে! এত দ্রুত সামনে এসে দাঁড়ায় যমদূতের মতো!
শেষ রাতের দিকে ঘুম থেকে উঠেছে জ্যোতি। গলা শুকিয়ে গেছে, বুক দুরুদুরু করছে। টেবিলে বসেছে পড়তে। পড়ার ঘরে এখন একা। কিছুক্ষণ আগে টিউব লাইটের সুইচ অন করেছে। আলোয় ভেসে গেছে চারদিক। জানালার ফাঁক গলিয়ে সেই আলো ছড়িয়ে পড়েছে বাইরেও।
বই খুলে শিউরে উঠল। প্রিপারেশন খুব খারাপ। মনে হলো এত দিন যা পড়েছে, সব গুলিয়ে গেছে, কিছুই মনে নেই। বইয়ের পাতায় মনস্থির করার চেষ্টা চালাল এবার।
হঠাৎ দুটি কাক কা কা ডাক জুড়ে দিয়েছে। রাতের নির্জনতা দূর করে দিচ্ছে। ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই।
উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। দুশ্চিন্তার বোঝা ক্রমশ ভারী হচ্ছে, মগজে চাপ তৈরি হচ্ছে। দুর্ভাবনা দ্রুত বাড়ছে; গভীরে শিকড় বিস্তার করছে, দ্রুত নিঃশেষ করে দিচ্ছে মগজের উর্বর উপাদান। শূন্যতা ক্রমশ ঘিরে ফেলছে।
টেবিলে রয়েছে বিশাল সাইজের একটি গ্লোব-ম্যাপ।
ওটার গায়ে হাত বোলাল। মসৃণ গ্লোবের স্ট্যান্ডটাও আকর্ষণীয়; অর্ধবৃত্তের মতো চাকতির একটা বিন্দুতে বসে আছে।
হাত দিয়ে ধাতব ম্যাপটা ঘোরাতে শুরু করল জ্যোতি―মুহূর্তের ঘূর্ণনে এশিয়া চলে যাচ্ছে, আসছে ইউরোপ, আসছে আমেরিকা। সময়ের মাইক্রো-বিন্দুতে চড়ে আটলান্টিক মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর মিলিয়ে যাচ্ছে।
দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে গেল জ্যোতির হাতের গতি।
গ্লোবটাও ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে লাগল। একটু থমকাল। মনে হলো পৃথিবী নামক গ্রহটি প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে ঘোরানো যাচ্ছে। হাত তুলে নেওয়ার পরও মনে হলো সৌরজগৎকে কেন্দ্র করে পৃথিবী যে গতিতে ঘুরছে, তার চেয়ে বেশি গতি পেয়ে গেছে গ্লোবটা। এবার স্ট্যান্ডটা শক্ত করে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে ওর দেহ-মনেও সমান গতির সঞ্চার হয়ে গেল। তবে কি স্থির বর্তমান থেকে নিজেই দ্রুতগতিতে ছুটে যাচ্ছে মহাশূন্যের দিকে?
আইনস্টাইনের ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’ তো তা-ই বলে।
স্বাভাবিক অবস্থায় যে গতিতে আবর্তিত হচ্ছি, ছুটছি, তার চেয়ে দ্রুততর গতি লাভ করতে পারলে যাওয়া যাবে ভবিষ্যতে। সেই গতি হতে হবে আলোর গতির চেয়ে বেশি। বর্তমানে কয়েক যুগ পার হয়ে গেলেও সেই ভবিষ্যতের মাত্র এক বছর অতিক্রান্ত হবে, পাওয়া যাবে যৌবনের দীর্ঘ সময়ের স্বাদ।
সেই যৌবন কি আছে ভবিষ্যতে!
সত্যিই!
বড় লোভ জাগে জ্যোতির, চির যৌবন লাভ করার লোভ।
বর্তমানে থাকতে ইচ্ছা করছে না, ছুটে যেতে ইচ্ছা করছে ভবিষ্যতে।
অচেনা, অজানা ভবিষ্যৎ কেমন?
তোলপাড় ঢেউ উঠল বুকের ভেতর, যেন পেয়ে গেছে দুর্বার গতি, এই গতি আলোর গতিকে হার মানায়। ও জানে মহাজগৎ চতুর্মাত্রিক, চার মাত্রাকে একত্রে বলা হয় স্থান-কাল বা স্পেসটাইম। এই মুহূর্তে হঠাৎ মনে হলো মহাশূন্যে সময়ের চতুর্মাত্রিক স্তরে ক্লোজ টাইম কার্ভ নামে যে বলয় রয়েছে, তার মাধ্যমে নিজেই পরিভ্রমণ শুরু করেছে।
হাত দিয়ে ধাতব ম্যাপটা ঘোরাতে শুরু করল জ্যোতি―মুহূর্তের ঘূর্ণনে এশিয়া চলে যাচ্ছে, আসছে ইউরোপ, আসছে আমেরিকা। সময়ের মাইক্রো-বিন্দুতে চড়ে আটলান্টিক মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর মিলিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে গেল জ্যোতির হাতের গতি।
শাঁ করে বিশাল অন্ধকার সাম্রাজ্যে তলিয়ে গেল জ্যোতি।
চারদিকে কেবলই অন্ধকার! ভুতুড়ে অন্ধকারের গভীরতা এত বেশি! এটিই কি তবে ব্ল্যাক হোল? এই কালো গহ্বর নিয়েই কি তবে বিজ্ঞানীদের এত হইচই?
দীর্ঘ অন্ধকারের জমাট স্তর পেরিয়ে জ্যোতি এসে পড়ল আলোর জগতে। এখন চারদিকে আলো, বিপুল আলোর ঝলকানি। আলোর ঢলে ভাসতে ভাসতে পেয়ে গেল একটা প্যাঁচানো সিঁড়ি।
সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে, অনেক ওপরে।
এ মা! এ কোন জগৎ? এ কোন ভবিষ্যৎ?
গাছগাছালির রং সবুজ নয়,―তামাটে, লালচে। গাড়িগুলোর আকার বিশাল। রাস্তাগুলো পিচঢালা নয়; গোল গোল পাথর দিয়ে গড়া, উঁচু-নিচু।
রাস্তায় অগণিত ট্যাংক চলছে। মনে হচ্ছে কোনো যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে যাচ্ছে। ট্যাংকগুলো চলছে পাথরের রাস্তা মাড়িয়ে। কোনো শব্দ নেই, ধোঁয়া নেই। রাস্তার উভয় পাশে বিরাট বিরাট অট্টালিকা, পাথরে গড়া। জমাট পাথর উঠে গেছে ওপরে। কোনো জানালা নেই, দরজা নেই। খোপে খোপে কেবল এয়ারকুলার চোখে পড়ছে। পুরু গ্লাসও আছে। মনে হলো গ্লাস নয়, ধবধবে সাদা পাথর আলোর প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। ঝলমল করছে চারদিক। কোথাও মানুষজন চোখে পড়ছে না। নির্জনতায় গা ছমছম করে উঠল। এ কোথায় এল? মাথায় হাত দিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল জ্যোতি।
একটা ট্যাংক সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
ওপরের ঢাকনি খুলে গেছে। তিনজন দ্রুতগতিতে বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। দুজন বেঁটেমতো। ওরা পুরুষ। একজন লম্বাটে। তার শরীর বেশ পুরুষ্টু। চুল ছাঁটা, ছোট ছোট। প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল পুরুষ। না, পুরুষ নয়। বুকের উচ্চতা স্পষ্ট বলে দিচ্ছে সে নারী।
তার পরনে আছে যুদ্ধের পোশাক। উদ্ধত পায়ে সামনে এসে প্রশ্ন করল, কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ?
জ্যোতির মুখে রা নেই, বাক্রুদ্ধ।
আবারও ধমকে উঠল মেয়েটি।
কথা বলো। কে তুমি?
চমক খেল জ্যোতি, নড়ে উঠল। উদ্ভ্রান্তের মতো বলল, আমি জ্যোতি। পৃথিবী থেকে এসেছি।
পৃথিবী থেকে?
হ্যাঁ।
কবে? কখন?
কিছুক্ষণ আগে আমার রিডিংরুমে বসে পড়ছিলাম। পৃথিবীর গ্লোব ঘুরাচ্ছিলাম। তারপর কী হলো জানি না―এখন আমি কোথায়?
কী বলছ তুমি! পৃথিবী তো বহু বছর আগে ধ্বংস হয়ে গেছে, মানুষকে মানুষই গণহারে হত্যা করেছে আর দেশে দেশে যুদ্ধে যুদ্ধে গুঁড়িয়ে গেছে, পরিবেশদূষণ এবং জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের কারণে বিলীন হয়ে গেছে।
না, আমি বিশ্বাস করি না,―জ্যোতির কণ্ঠে জোর ফিরে এল।
বিশ্বাস-অবিশ্বাস তোমার ব্যাপার। তবে পৃথিবীর স্থির বর্তমান থেকে তুমি শত বছর সামনে এই পাথুরে সাম্রাজ্যে চলে এসেছ। টের পাচ্ছ না কিছু?
কিছু তো টের পাচ্ছি। সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছে। মনে হচ্ছে আমার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে।
অচেনা নারী এগিয়ে এল আরও কাছে।
ভয়ে কাঁপতে লাগল জ্যোতি।
ভয় পাচ্ছ কেন? ভয়ের কিছু নেই। তোমার বুদ্ধিবিভ্রম হয়নি। সব ঠিক আছে। তুমি আমাদের জগতে চলে এসেছ। এ জগতে সবকিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই তোমাকে, এসো। বলতে বলতে মেয়েটি জ্যোতির কম্পমান হাত আলতো করে ধরে ফেলল।
জ্যোতি একবার হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। পারল না। ওর মনে হলো কঠিন এক পাথরের চাপে থেঁতলে যাচ্ছে কোমল হাত।
শোনো, আমার নাম রেমিংটন ফ্লোরা। ওরা আমার দুই পুরুষ বন্ধু, টমি ও র্যাগ।
বন্ধু দুজন যেন গোল পাথরের ছোটখাটো পিলার, যন্ত্রদানব। অনুভূতি বলে কোনো সত্তা এদের আছে বলে মনে হলো না।
জ্যোতির ভয় কিছুটা কাটলেও, বিস্ময় কাটেনি। পুরুষ দুজনকে ভয়াবহ মনে হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে কি ওরা ওর গলা চেপে ধরবে? চোখ বড় বড় করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে।
ভয় পেয়ো না। ভয়ের কিছু নেই। ওরা তোমার কোনো ক্ষতি করবে না। আমার হুকুমের এক পা–ও বাইরে যাবে না।
তুমি কি ওদের দলনেতা? শাসক?
ঠিক দলনেতা নই। তবে ওরা আমার সেবক। আমার ইচ্ছা পূরণ করা ওদের প্রধান কাজ।
আমিও কি তবে ওদের দলের একজন হয়ে গেলাম?
ভয় পাচ্ছ কেন? ভয়ের কিছু নেই। তোমার বুদ্ধিবিভ্রম হয়নি। সব ঠিক আছে। তুমি আমাদের জগতে চলে এসেছ। এ জগতে সবকিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই তোমাকে, এসো। বলতে বলতে মেয়েটি জ্যোতির কম্পমান হাত আলতো করে ধরে ফেলল। জ্যোতি একবার হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। পারল না।
না, তুমি ওদের দলের কেউ হবে না। কারণ, তুমি হচ্ছ কোমল পুরুষ। কোমল পুরুষ আমাদের অর্থাৎ পাথুরে সাম্রাজ্যের মেয়েদের খুব পছন্দ। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে, এখন তুমি আমার। এ জগতের এটাই নিয়ম। তোমাদের পৃথিবীর উল্টো। এখানে নারীরা কঠিন। পুরুষেরা নারীদের ব্যবহার্য সামগ্রীর মতো। কোমল না হলে পুরুষদের আমরা গোনার মধ্যে রাখি না। আমরা, এখানকার মেয়েরা কেবল কোমল পুরুষ সন্ধান করে বেড়াই। কারও ভাগ্যে জোটে, কারও ভাগ্যে জোটে না। একজন কোমল পুরুষ জোগাড় করতে মেয়েদের বহু বছর লেগে যায়। কোমল পুরুষেরাই আমাদের ভালোবাসা পায়। যারা ভুল করে আলোর গতির চেয়ে দ্রুতগতিতে পৃথিবী থেকে ভবিষ্যতের পাথুরে সাম্রাজ্যে চলে আসে তাদের আমরা বুদ্ধিমান মনে করি। মনে করি, ওরাই কেবল পারে আমাদের নারীত্বের পূর্ণতা দিতে। তুমি এখন আমার কাছে তেমনই একজন। আমার সম্পদ। কারণ, তোমাকে আমি আগে পেয়েছি।
আঁতকে উঠল জ্যোতি।
এত উৎকণ্ঠিত হচ্ছ কেন? উৎকণ্ঠার কিছু নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসব। আদর করব। আমার অধিকার কেউ ছিনিয়ে নিতে আসবে না। জীবন থাকতে পারবেও না।
জ্যোতির জিহ্বা শুকিয়ে গেল। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছে না। মেয়েটি ওর বাঁ কবজি টেনে অগ্রসর হচ্ছে। এক পা এক পা করে ওকেও অগ্রসর হতে হচ্ছে।
রেমিংটন ফ্লোরার চোখ দুটো শক্ত পাথরের মতো, আনন্দে চিকচিক করছে; কোমল নরম দেহলোভী চোখ দিয়ে জ্যোতিকে গিলছে কেবল।
মহাশূন্যের অসীম সাম্রাজ্যে বসবাসরত ভবিষ্যতের এই পাথুরে মেয়েটির মনেও কি তবে ভালোবাসা আছে? দুঃখ আছে? যন্ত্রণা আছে? আছে কি যৌবনের উত্তাপ? আছে কি আবেগের প্রকাশ কিংবা বিরহ যাতনা?
বোঝার চেষ্টা করেও বুঝতে পারল না জ্যোতি।
মেয়েটি কেবলই কি জড় পদার্থরূপী পাথুরে মানুষ? নাকি পৃথিবীর মানুষের মতোই ছিল? সৌর-প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কি এই অবস্থা হয়েছে?
জড়রূপ কি এ কারণেই?
ও পদার্থবিদ্যার ছাত্র।
সাইকোকাইনেসিস নিয়ে একসময় প্রচুর পড়াশোনা করেছে, কাজ করেছে। জানে, জড় পদার্থের ওপর মানসিক শক্তির প্রয়োগকে সাইকোকাইনেসিস বলে।
ভাবল, এই বিদ্যার অল্প কিছু জ্ঞান কাজে লাগানো যাক। নিজেকে শক্ত করে ফেলল। মন শক্ত হয়ে গেল। মেয়েটিকে জড় পদার্থ ভাবতে লাগল। নিজের মনের প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করতে লাগল। সাইকোকাইনেসিসের মাধ্যমে মেয়েটির অণু-পরমাণুর চরিত্র বোঝার চেষ্টা করল।
তাজ্জব বনে গেল জ্যোতি।
রেমিংটন ফ্লোরার বাইরের আবরণটিই শুধু কঠিন, ভেতরে রয়েছে অণুতে অণুতে আসক্তি। চুম্বকীয় গুণাবলি। এই চুম্বকত্বই কি নারীকে পুরুষের দিকে টানে? পুরুষকে নারীর দিকে?
মেয়েটির কঠিন ড্রেসের আবরণ সহজ ভাবতে পারছে না। নিজের উপলব্ধিকেও নিশ্চিত ভাবতে পারছে না। তবে জ্যোতির স্মৃতির দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। নিগারকে নিয়ে পুরোনো একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল।
রেমিংটনের ভেতরের সত্তার সঙ্গে নিগারের চরিত্রের একটা মিল খুঁজে পেতে চেষ্টা করল।
নিগার ওর বান্ধবী। ক্লাসমেট।
নারীত্বের সকল সৌন্দর্য যেন নিগারের শরীরে নিখুঁতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তার শরীরের বাঁকগুলো আলোড়ন তোলে, চোখ ধাঁধিয়ে যায়। হাসির আকর্ষণ উপেক্ষা করা কঠিন। দুর্বার আসক্তি জ্যোতিকে প্রতিক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায়। একদিন দেখতে না পেলে বুকের ভেতর ওঠে উদ্বেগ, অশান্তির ঢেউ। এই ঢেউ সামাল দেওয়া ভীষণ কষ্টকর।
নিগারও একা পেতে চায় জ্যোতিকে।
জ্যোতি চেষ্টা করে, ধাপে ধাপে পা রাখে। সিঁড়ি ভাঙে।
নিগারের মুখে হাসি ফোটে, শান্তির হাসি। সেই হাসি ব্যাকুল করে জ্যোতিকে, কাতর করে। তৃপ্ত মুখেই বলে, তোমাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হয়। চলো বিয়ের বাঁধনটা সেরে ফেলি।
কী? ভুরু বাঁকিয়ে, কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করে নিগার।
জ্যোতি চুপসে যায়। থমকায়। আবারও বলে, বিয়ে করি, চলো ঘর বাঁধি। তাহলে সারাক্ষণ তোমাকে কাছে পাব।
হাসতে শুরু করে নিগার।
বিয়ে হচ্ছে পচা শেওলার মতো। একবার পায়ে লাগলে লেপ্টে থাকে, পিচ্ছিল, বিরক্তিকর। তা ছাড়া সব সময় কাছে পেলে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলবে, একঘেয়ে লাগবে আমার উপস্থিতি। তার চেয়ে এ-ই ভালো। এখন তোমাকে ভালো লাগে, তুমি আছ। যখন তোমাকে ভালো লাগবে না, থাকবে না। অন্য কেউ আসবে, অন্য কেউ। বলতে বলতে হাসিতে গড়াগড়ি খায়।
দেখো, এত কঠিন হয়ো না। বাজে চিন্তা বাদ দাও। ওতে সুখ নেই। কদিন পর শরীরে ভাটা পড়বে। শরীরটাই সব নয়। মনটাই বড়। তা ছাড়া সন্তান, মাতৃত্ব বিয়ে ছাড়া পূর্ণ হয় না, বৈধ হয় না।
বৈধতার জন্য কাগজের মোড়কে আবদ্ধ হতে হবে? মানি না। প্রমাণ করব, বিয়ে ছাড়াও মাতৃত্ব পূর্ণ হয়। সন্তানের পূর্ণ অধিকার নারীরা পাবে, ধারণ করবে। দেখে নিয়ো। জেনারেশন বদলে যাচ্ছে। সেই বদলের হাওয়া কি আমরা উপেক্ষা করব?
হতবুদ্ধি হয়ে যায় জ্যোতি। নিজস্ব প্রিকগনিশন তথা ভবিষ্যদ্দৃষ্টি জ্বলজ্বল করে ওঠে। ভবিষ্যতের অনেক কিছুই চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
নিগারের ভবিষ্যৎ রূপ দেখতে পায় জ্যোতি।
লন্ডভন্ড অন্য এক নিগার এক যুগ সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হতাশা ব্যর্থতা ওকে ঘিরে আছে। কাঁদছে সে। কঠিন দেয়ালের ঘেরাটোপ ওর জীবন বন্দী করে রেখেছে।
কী ভাবছিলে পৃথিবীর যুবক? রেমিংটন ফ্লোরা আচমকা প্রশ্ন করল। সে হাত ধরে আছে জ্যোতির, ট্যাংকের মতো গাড়িটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
জ্যোতি বিচলিত হয়ে নিগারকে নিয়ে পুরোনো প্রিকগনিশন দৃশ্যটির মিল খুঁজে পেতে চেষ্টা করতে লাগল।
নারীতে নারীতে মৌলিক একটা মিল আছে। কোথায় এই মিল, ভালো করে বুঝতে পারল না।
রেমিংটন কি আসলেই নিগারের ভবিষ্যৎ রূপ! তবে কি নিগার মহাশূন্যের ‘ক্লোজটাইম কার্ভ’ বলয়ে পরিভ্রমণ করে তার আগেই এ জগতে চলে এসেছে? এই রূপ ধারণ করেছে? হতেই পারে না।
মাথা ভোঁ ভোঁ করে উঠলেও বুকে সাহস জেগেছে, শক্তি প্রয়োগ করে থমকে দাঁড়াল। জোরালো কণ্ঠে প্রশ্ন করল, পুরুষ নিয়েই কি কেবল তোমাদের কারবার? কোমল পুরুষদের কি কেবলই তোমাদের সম্পদ মনে করো?
হ্যাঁ, ওরা কেবল নারীদের সম্পদ। নারীদের মনোরঞ্জনই তাদের প্রধান কাজ। এ ক্ষেত্রে আমরা পৃথিবীর নারীদের উল্টো চরিত্র ধারণ করেছি। পরিবেশ, প্রকৃতির কারণে নারীদের ক্রোমোজোম এবং জিনের স্বরূপ পাল্টে গেছে। এখনকার নারীরা তাই ক্ষমতাধর, পুরুষেরা নারীদের অধীন।
রেমিংটনের আচরণে এখনো নিষ্ঠুরতার কোনো প্রমাণ পায়নি, তবে উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। নারীর বশে থাকার প্রস্তাব কিছুতেই মানতে পারছে না। নিজস্ব জিনের প্রকৃতি কিছুতেই তা মেনে নিতে পারবে না। তাই পালানোর চিন্তা মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে শুরু করল।
ওরা ট্যাংকের মতো বদ্ধ গাড়িতে ওঠাল জ্যোতিকে। ওকে শক্ত করে ধরে বসে আছে রেমিংটন। শরীরের সঙ্গে শরীর ঘেঁষে বসেছে, যেন শরীরের উত্তাপ নিচ্ছে মেয়েটি। টমি ও র্যাগ মেয়েটির ইশারায় গাড়িতে ওঠায় বিরত হলো। গাড়িতে এখন কেবল ওরা দুজন, জ্যোতি ও রেমিংটন ফ্লোরা।
রেমিংটন মৃদু হেসে বলল, পালানোর চিন্তা বাদ দাও। পালাতে হয়তো পারবে, কারণ তুমি বুদ্ধিমান। তবে পালিয়ে আগের পৃথিবীতে যেতে পারবে না, যেতে চাইলে যেতে পারবে ভয়াল কোনো জগতে, সেখানে ধ্বংস হয়ে যাবে। অলৌকিকভাবে যদি পৃথিবীতে পৌঁছতে পারো, দেখবে তোমার বান্ধবী বুড়িয়ে গেছে, তার বয়স বেড়ে গেছে কয়েক যুগ বেশি। এখানে ভয় পেয়ো না। আমরা শুধু কোমল পুরুষদের অধীন করে রাখি না, ভালোবাসাও দিই।
জ্যোতির কপালে ঘাম জমে গিয়েছিল। বাঁ হাত দিয়ে ঘাম মুছল। ও বড় বেশি ভালোবাসার কাঙাল। রেমিংটনের মুখে আবারও ভালোবাসার কথা শুনে আতঙ্ক কমে এল।
ওরা গাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। ইশারায় টমি ও র্যাগকে কী যেন বলল। সঙ্গে সঙ্গে তারা জ্যোতিকে ঘিরে ধরল।
ভীতিকর অবস্থা। কাঁপুনি টের পাচ্ছে। নিজের অজান্তেই পাথুরে হাত শক্ত করে চেপে ধরে নির্ভরতা খুঁজল রেমিংটনের কাছে।
নির্ভরতা সহজে এল না। যেখানে ভয়-আতঙ্ক পদে পদে জড়িয়ে থাকে, নির্ভরতা সেখানে পালিয়ে যায়।
উপায়হীন জ্যোতি কঠিন হাতের স্পর্শে দ্বিধাগ্রস্ত।
টেলিপ্যাথি তথা মমতার অদৃশ্য সুতো বাঁধার চেষ্টা করল মেয়েটির মনের সঙ্গে। এ–ও একপ্রকার শক্তি, অর্জন করতে হয়। বিপদে পড়লে মানুষ অলৌকিক অনেক কিছুই পেয়ে যায়। জ্যোতিও পেয়ে গেল সেই শক্তি।
রেমিংটন কী ভাবছে, বোঝার চেষ্টা করতে লাগল।
হ্যাঁ, বুঝতে পারছে।
কঠিন পাথুরে মেয়েটির জেনোম সিকোয়েন্স তথা জেনেটিক কোডের পূর্ণ মানচিত্র দেখা যাচ্ছে। এ নারীর সঙ্গে আদিমতম নারীর কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধুই খোলসে, বহিরাবরণে, শক্তিমত্তায়।
টেলিপ্যাথির সাহায্যে কল্পনায় মেয়েটির কোমল রূপ দেখা শুরু করে বুঝল, ভেতরের রূপ অপূর্ব। বিস্ময়কর সৌন্দর্য ঝলসে উঠছে। রূপতরঙ্গ দৃষ্টিশক্তিকে ঘোলাটে করে দিচ্ছে। মস্তিষ্কে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে, পজিটিভ স্পন্দন জেগে উঠছে। তবে কি মেয়েটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছে?
নিজেকে সামলে নিল জ্যোতি।
টেলিপ্যাথির ঘোর থেকে বের হয়ে খোলা চোখে রেমিংটনকে ভালো করে পরখ করতে লাগল।
উহ্! এত কুৎসিত মেয়েটির মুখের বাইরের ছাঁচ!
কুৎসিত মুখের আদল মুহূর্তে কেড়ে নিল মনের সৌন্দর্য।
চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে উঠল জ্যোতি। শরীরের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল ঘৃণায়, রি রি করে উঠল পুরো শরীর। ঘৃণায় বিকৃত হয়ে এল মুখ।
বিকৃত উচ্চারণ শুনে রেমিংটন শক্ত করে ধরে রাখল জ্যোতিকে। কবজিতে জোরে চাপ দিল। ব্যথা পেয়ে সংবিৎ ফিরে পেয়ে দ্রুত পরবর্তী পদক্ষেপের কথা ভাবতে লাগল জ্যোতি।
ভেতরের রূপের প্রয়োজন আছে ঠিকই, কিন্তু বাইরের কুশ্রী রূপ মেনে নেওয়া কঠিন।
নিজের ভেতর আবারও সন্ত্রস্ত ভাব জেগে ওঠায় মস্তিষ্কের অনুরণন টের পেল। পালানোর চিন্তা দুর্বার হচ্ছে। কোনোমতেই কুৎসিত মেয়েটির সঙ্গে জড়ানো যাবে না।
ওরা ট্যাংকের মতো বদ্ধ গাড়িতে ওঠাল জ্যোতিকে। ওকে শক্ত করে ধরে বসে আছে রেমিংটন। শরীরের সঙ্গে শরীর ঘেঁষে বসেছে, যেন শরীরের উত্তাপ নিচ্ছে মেয়েটি। টমি ও র্যাগ মেয়েটির ইশারায় গাড়িতে ওঠায় বিরত হলো। গাড়িতে এখন কেবল ওরা দুজন, জ্যোতি ও রেমিংটন ফ্লোরা।
গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে রেমিংটন। স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। ঝড়ের বেগে ছুটছে গাড়ি। চালক সামনের দিকে তাকাচ্ছে না, তাকিয়ে আছে জ্যোতির দিকে।
ফ্লোরার চোখে নেশা। মাদকাসক্তির নেশার চেয়েও তীব্র, ভয়ংকর। যেন শুষে নিচ্ছে জ্যোতির বিধ্বস্ত পুরুষত্ব।
চোখ বন্ধ করে বসে আছে জ্যোতি। বিপদে ধৈর্যহারা হয়নি, বরং দুঃসাহসী হয়েছে। জড়বস্তুর ওপর প্রভাববিস্তারী সাইকোকাইনেসিস শক্তি এ মুহূর্তে পুরোপুরিই নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রয়োগ করতে থাকায় যান্ত্রিক গাড়ি হঠাৎ থেমে উল্টো দিকে চলতে শুরু করল। গতি এখন জ্যোতির করায়ত্তে। ছুটছে, দ্রুততম গতিতে। আলোর গতির চেয়ে বেশি গতি পেয়ে গেছে গাড়িটা। মহাকালের ক্লোজ টাইম কার্ভের উল্টোরথে এখন ছুটছে ওরা অতীতের দিকে।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে...অনন্তের পথে।
ধ্যানমগ্ন জ্যোতির হঠাৎ হুঁশ ফিরে এল। পাশে বসা কঠিন মেয়েটির কাঠিন্য টের পাচ্ছে না। ওর ঘাড় শক্ত। সামনে তাকিয়ে আছে। আড়চোখে রেমিংটনকে দেখার চেষ্টা করল।
বিস্ময়ে হতবাক, চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল।
পেশিবহুল পাথুরে মেয়েটির স্বরূপ বদলে গেছে।
একবারেই বিবসনা এক নারী তার পাশে বসা। তার মায়াবী মুখের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। উন্নত গ্রীবা, চিকন কটিদেশ, অনিন্দ্য সুন্দর বুকের উপত্যকা জ্যোতির চেতনাশক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছে।
বোকার মতো নিজের দেহের দিকেও তাকাল।
সে–ও নগ্ন, শরীরের সুঠাম পুরুষালি গঠন তাকেও বদলে দিয়েছে। মহাকালের রহস্যময় চতুর্মাত্রিক স্তরের ঘূর্ণিপাকে কত বছর কাটিয়েছে ওরা? কত যুগ?
তবে কি ওরা আদিম নর-নারীতে বদলে গেছে আবার? অতীত যুগে চলে এসেছে?
নতুন রেমিংটনের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে আছে। তাকিয়ে আছে জ্যোতির চোখের দিকে। আনন্দে উদ্বেলিত উভয়ই।
দুজনেই বাইরে তাকাল এবার।
এ কোন জগৎ!
এ পৃথিবী নয়, পাথুরে সাম্রাজ্য নয়, অতীত নয়, বর্তমানও নয়।
ওরা ভাসছে মহাকালের চতুর্মাত্রিক স্তরেই। অনন্ত যাত্রাপথে হারিয়ে যাওয়া দুজন নর-নারী নতুন পথের সন্ধান চায় না, ওরা কেবল অনন্তের নিঃসীম শূন্যতায় চায় একে অপরকে, চায় অনন্ত যৌবন।
দুই বাহু বাড়াল জ্যোতি।
রেমিংটন ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর সুঠাম বুকে।
রেমিংটনকে বুকে নিয়ে কি স্থান-কাল বা স্পেসটাইমের সময়-চাকায় সেঁটে গেল জ্যোতি? পেয়ে গেল কি অনন্ত যৌবন?
হঠাৎ প্রবল শব্দ করে সজোরে তীব্র ঝাঁকুনি খেল উভয়ে। ঝনঝন করে কেঁপে উঠল চারদিক। বিদ্যুৎ–সংযোগ কি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল? অন্ধকার লাগছে কেন। মাথা ঘুরে উঠল ভোঁ ভোঁ করে। সজোরে চোখ বুজে ফেলল জ্যোতি।
একটু পরই চোখ খুলে চমকে উঠে চারদিক তাকাল। চোখে বিস্ময় ঝরে পড়ছে।
কোথায় রেমিংটন? এটা তো তার পড়ার ঘর। বাইরে ভোরের কাঁচা রোদ। হালকা বাতাসে জানালার পর্দা উড়ছে।
তবে কি এতক্ষণ নিজের টেবিলেই বসেছিল? বিজ্ঞানের সূত্রগুলোই কি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অনন্ত সময়ের দেশে?