দুধমা

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

গাড়ি থেকে নামতেই মুক্তি ছুটে আসে হাত থেকে ব্যাগ নিতে। ধমকে ওঠে উপমা—উপমা চক্রবর্তী। মা ও শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক একটি প্রজেক্টের কান্ট্রি ম্যানেজার। ‘আমার ব্যাগ আমি নিতে পারব’, বলার দৃঢ় অভিব্যক্তিতে উপমা চক্রবর্তী স্পষ্টই বুঝিয়ে দেয়, তার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।  

উপমা চক্রবর্তী আসার আগে হেড অফিস সতর্ক করে দিয়েছে এই বলে যে ‘দিদি কিন্তু খুব কড়া। অনিয়ম একদম পছন্দ করেন না।’ অবশ্য বুঝেশুনে নিয়মমতো চলতে পারলে রিপোর্টে বরং দু-কথা বেশি সুপারিশ করে দেন, যাতে অফিসের সবার বেতনে বাড়তি ইনক্রিমেন্ট যোগ হতে পারে। 

উপমা চক্রবর্তী আসার আগে এরিয়া ম্যানেজারও সবাইকে নিয়ে মিটিং করে সাবধান করে দিয়েছে। মুক্তি বেগমও ছিল সেই মিটিংয়ে। কারণ, উপমার থাকা-খাওয়ার পুরো ব্যাপারটার জন্যই নির্ভর করতে হবে মুক্তির ওপর। বড় স্যার-ম্যাডামদের কত যে বাহারি বাহানা! হাতের আঙুলের মতো পড়ে ফেলতে পারে মুক্তি।

কিন্তু এই মহিলা যে এই মাত্রার বদমেজাজি, মুক্তি আঁচ করতে পারেনি। যা কিছু করতে যায়, মহিলা কপাল কুঁচকে বলে, ‘লাগবে না, যাও।’ সকালের নাশতায় কী খাবে, জিজ্ঞেস করতেই মহিলা এমন ভ্রু কুঁচকে তাকাল যে মুক্তির মনে হলো জিজ্ঞেস করাটা সাংঘাতিক অন্যায় হয়েছে।

ভেজানো এক গ্লাস চিয়া সিড খেয়ে বের হয়ে গেল মহিলা। এই চিয়া সিড শহুরে স্যার-ম্যাডামদের অভ্যাসে নতুন যুক্ত হওয়া উপাদান। এ-ও রাখা আছে রেস্টহাউসে। কিন্তু মহিলা মনে হলো নিজের কোনো কিছুর দায়িত্বই আর কাউকে দিতে পছন্দ করে না। তবে বেরোনোর সময় মুক্তিকে নির্দেশ দিয়ে গেল, তার মাকে যেন সকাল ১০টার ভেতর মাড়গলা ভাত আর আলুসেদ্ধ দিয়ে খেতে দেওয়া হয়।

বৈশাখ মাত্র শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। এ সময় কোথাও যাওয়া খুব যন্ত্রণাদায়ক। অভিজ্ঞতা থেকে উপমা চক্রবর্তী জানে, ঢাকার বাইরে রেস্টহাউসগুলোয় প্রায়ই এসি থাকে না। গাছগাছালিঘেরা প্রকৃতি গরমের তীব্রতা হয়তো কমিয়ে রাখে অনেকটাই। কিন্তু সারা বছর কৃত্রিম শীতলযন্ত্রের আশ্রয়ে থেকে এই প্রাকৃতিক শীতলতাকে বিন্দুমাত্র আরামদায়ক মনে হয় না। উল্টো গাছগাছালি, ঝোপ-জংলায় উপজাত হিসেবে থাকে মশার প্রচণ্ড উৎপাত।

এই সবকিছু ভেবে আপাতত ট্যুরটা বাতিলই করে দিয়েছিল উপমা। কিন্তু মায়ের কারণে আসতেই হলো। একাত্তরের যুদ্ধের সময় তার বাবা চাকরি করতেন এই মহকুমা শহরে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা সদরের ট্রেজারি লুট করে অস্ত্র নিয়ে গেলে মহকুমার সব সরকারি কর্মকর্তা বিপদে পড়ে যান। মায়ের মুখে উপমা শুনেছে, আলী আকবর খান নিজেই নাকি ট্রেজারি খুলে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। সরকারি কর্মকর্তারা যে যেভাবে পারেন, পালিয়ে রক্ষা করেছেন নিজেদের। বাবা হবিগঞ্জ চুনারুঘাটের বাল্লা সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরায় এসেছিলেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে।

এ শহর ঘিরে তাই উপমার মায়ের অনেক স্মৃতি। স্বাধীনতার পর আর আসা হয়নি। মায়ের মুখে শুনতে শুনতে প্রায় মুখস্থ হয়ে যাওয়া শহর হবিগঞ্জ। তখন মহকুমা ছিল, এখন জেলা। তিনকোনা পুকুরপাড়, চন্দ্রনাথ পাঠশালা, পুরান মুন্সেফ রোড...। মা গল্প করেন প্রায়ই, শহর ঘেঁষে খোয়াই নদ। আষাঢ়ে ঢল নামলে ঘুমাত না শহরের মানুষগুলো। যখন-তখন ত্রিপুরার পাহাড় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে যেত শহরটা। নিরিবিলি, ছিমছাম শহর। কী সহজ-সরল মানুষ। আর মাছ! হাওরের মাছ। জিবে লেগে থাকা সেই স্বাদ নাকি জীবনে আর পাননি মা।

মুক্তির মায়ের ড্যাবডেবে দৃষ্টি শিশুর মতো নিষ্পাপ। এসবের কিছুই যে তার স্মৃতিতে নেই, তাই কোনো সন্দেহই সৃষ্টি করে না তার নির্বিকার বসে থাকার ভঙ্গি।

কত মানুষের গল্প যে মা স্মৃতির ঝুলি উল্টে ছড়িয়ে দেন অবসর সময়ে! আহসান ডাক্তারের মেয়েটা যে কী অসাধারণ গান গাইত! মিলন মাস্টার প্রতিবছর স্কুলে নাটক করাত...স্থানীয় মেয়েদের নাটকে পাওয়া যেত না। তাই বড়দিকে নেওয়ার জন্য বাবার অফিসে গিয়ে বসে থাকত। সিরাজ উদ্দৌলা নাটকে বড়দি আলেয়া চরিত্রে অভিনয় করে এমন নাম করেছিল যে ওর আসল নাম হারিয়েই গিয়েছিল, সবাই ওকে ডাকত আলেয়া নামে।

 মায়ের দৃষ্টিতে কী মিষ্টি বিভ্রম, মনে হতো ঘড়ির কাঁটা ঘোরেনি। মাঝখানে পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে একটা শহর ফসিল হয়ে ছিল। যেমন রেখে এসেছিলেন, সেই একতলা বাংলো বাড়ি, গেটের পাশে মাধবীলতার ঝোপ, বাঁশের বেড়া ঘেঁষে মিষ্টি বরইগাছ, বড়দিকে পাড়ার রোমিওদের ছুড়ে দেওয়া চিঠি...। ঘরের ভেতর আলমারিভর্তি বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্রের বই...পাঁচ দশকে যে পরতে পরতে বিস্মৃতি জমে সব বিলীন হয়ে গেছে, মাকে এ কথা মনে করিয়ে দেওয়ার অপরাধ করতে পারে না উপমা।

কাজটা বাল্লা সীমান্তে। সীমান্ত পার হয়েই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই শহর। উপমা মনে মনে পরিকল্পনা করে, এখানকার কাজটা এক দিনে শেষ করেই হবিগঞ্জ সদরে চলে যাবে তারা।

থাকার ব্যবস্থা যা-ই হোক, এখানে সবচেয়ে বিরক্ত লাগছে মুক্তি নামের মেয়েটার বাড়াবাড়ি। এই রেস্টহাউসের মাস্টার রোলের কেয়ারটেকার। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বেশি করছে সে। সারাক্ষণ রুমের পাশে ওত পেতে বসে থাকাই শুধু নয়, মিনিট পাঁচেক পরপর জানতে চাওয়া কী লাগবে উপমার। আরে উপমা কি ছুটি কাটাতে এসেছে এখানে! নেহাত সারা দিন মাকে একা রেখে অফিসের কাজগুলো সারতে হবে, নইলে মুক্তিকে একেবারে আসতে নিষেধ করে দিত উপমা।

সুসজ্জিত অফিস রুমে বসে থাকতে থাকতে উপমা টের পায় কোথাও কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। কথায়, কাগজে আর বাস্তবতায় দুস্তর পার্থক্য। এখনো ডাক্তার নয়, আনাড়ি ধাই দিয়ে বাচ্চা ডেলিভারি হয় অধিকাংশ মহিলার। প্রতি মাসে দুই-চারটা নবজাতক মারা যায়। সব মিলিয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় উপমা চক্রবর্তীর। লাখ লাখ টাকা ঢালছে এ-সংক্রান্ত সচেতনতা তৈরির জন্য। মনে হচ্ছে তিন দিনেও সঠিক ডেটা নেওয়া শেষ হবে না। এই পরিবেশে তিন দিন থাকতে হবে, মনে হতেই মেজাজ চড়ে যাচ্ছে উপমার।

হবিগঞ্জ শহরে যাওয়ার জন্য এসেছেন মা। মনে মনে ঠিক করে, কালই মাকে নিয়ে জেলা সদরে সার্কিট হাউসে চলে যাবে। কাউকে বলে একটা গাড়ি ম্যানেজ করে দিলে মা দুই দিনে ঘুরে ঘুরে শহরটা দেখে ফেলবে। আর ও নিজে কাজ সেরে বিকেলে জেলা সদরের সার্কিট হাউসেই থাকবে রাতটা।

বিকেলে রেস্টহাউসে ফিরে মাকে না পেয়ে ভীষণ অবাক হয় উপমা, মা কই গেল! এই অজানা-অচেনা জায়গায়?

মুক্তিকে বারকয়েক ফোন দেয় উপমা। চারবারের মাথায় ফোন রিসিভ করে ওপাশ থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তর দেয় মুক্তি, ‘টিউবল থিক্কা খালাম্মার জন্য ঠান্ডা পানি আনতে গেছলাম গো আফা।’

‘মা তোমাদের বাসায়’, বিস্ময় গোপন করার চেষ্টা হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়ে উপমার কণ্ঠস্বরে।

মুক্তির কণ্ঠে তৃপ্তিময় নির্লিপ্ততা, ‘হ, খালাম্মা তো সকাল থেইক্কাই এহানে। দুপুরে খাওয়াদাওয়াও করেছেন এহানে।’

উপমা এবার আর উৎকণ্ঠা লুকানোর কোনো চেষ্টাই করে না, ‘মা ওখানে খেয়েছে মানে? কী দিয়ে খেয়েছে? মা তো নরম ভাত আর মরিচ ছাড়া ঝোল খান।’

‘আপনে চিন্তা কইরেন না আফা। ছোডো মাছের ছালুন দিয়া খুব মজা কইরা খাইছইন খালাম্মা।’

কার বাসায়, কেমন বাসায়, কীভাবে মা সারা দিন সেখানে কাটিয়ে দিলেন—মোটেই বুঝতে পারে না উপমা। কী ভীষণ শুচিবাইগ্রস্ত মা। এক থালা খাবার আগে তিনবার ধুয়ে নেন। নিজের থালা ছাড়া কারও থালায় খান না। তিনি মুক্তির বাসায় খেয়েদেয়ে পুরো দিন কাটিয়ে দিলেন! ব্যাপারটা নিজের চোখে গিয়ে দেখে আসতে চায় উপমা।

মুক্তির বাড়িতে ঢুকে উপমার চোখ একেবারে ছানাবড়া। বারান্দার বাঁশের পাল্লায় হেলান দিয়ে বসে বসে মুক্তির মায়ের চুল আঁচড়ে দিচ্ছে মা। একাত্তরে বাবাকে মেরে ফেলার পর চার ভাইবোন নিয়ে মায়ের যে যুদ্ধ, ছেলেমেয়ে কিংবা আর কারও চুল আঁচড়ে দেওয়া দূরে থাক, মা কোনো দিন নিজের চুল আঁচড়েছেন, এমন দৃশ্যও চোখে পড়েনি উপমার!

মাকে তাড়া দেয় সে, ‘চলো মা, আজই আমরা হবিগঞ্জে চলে যাব। তুমি দুদিনে ঘুরে ঘুরে সব দেখে নেবে, ব্যবস্থা করে রেখেছি। আর আমি এদিকে অফিসের কাজটা সেরে নেব।’

কিন্তু উপমাকে বিস্ময়ের অথই সাগরে ছুড়ে দিয়ে নির্লিপ্ত গলায় উত্তর দেন মা, ‘আমার আর হবিগঞ্জে যাওয়ার দরকার নেই, আমি হবিগঞ্জে যাব না। তোর যত দিন লাগে কাজ শেষ কর। আমি এখানেই থাকি।’

এবার উপমার কৌতূহল ভদ্রতার বাঁধ না মেনে উপচে ওঠে। মুক্তির মা ডিমেনশিয়ার রোগী। তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই। তাই মুক্তির কাছেই উত্তর খোঁজে উপমা, ‘তোমার আব্বার নাম কী?’

‘জি আবদুল হাদী...।’

উপমা স্মৃতি হাতড়ায়। মায়ের মুখে হবিগঞ্জের অনেকের নাম শুনেছে সে। কিন্তু আবদুল হাদীর নাম শুনেছে বলে মনে করতে পারে না কিছুতেই। তাই আরও সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করে নিশ্চিত কিছু জানতে চায় উপমা, ‘তোমরা কখনো হবিগঞ্জে ছিলে, মাকে চিনতে আগে থেকে?’

‘না গো আফা। হারা জীবন আমরা এহানেই। আম্মা চিনোইন কি না হুনি নাই তো কুনো সময়।’

মুক্তির মায়ের সঙ্গে তার মায়ের এমন মগ্নতায় একাত্ম হয়ে যাওয়ার সমীকরণ উপমা কিছুতেই মেলাতে পারে না।

কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার দিন সব গোছগাছ করে গাড়িতে ওঠার সময় মা উপমাকে নিয়ে শেষবারের মতো যান মুক্তির বাসায়। ওর হাত ধরে ধরে বাড়ির এ-মাথা ও-মাথা হাঁটেন। যেন অতীত-বর্তমান সময়ের বিভেদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তার স্মৃতি থেকে। মা বলতে থাকেন, ‘এই যে ছনের ঘরটা, এই ঘরটাতে চার দিন মরার মতো পড়ে ছিলাম রে। তোর বড়দির উঠতি বয়স, রান্নাঘরে তালাবন্ধ করে রাখত তোর বড়দিকে। মেজ আর সেজকে বুকে আগলে নিয়ে ঘুমাত রাতে। আর ডায়রিয়ায় আমি যখন মরতে বসি, তোকে বুকের দুধ খাওয়ানোর শক্তি ছিল না শরীরে। এই মুক্তির দুধ, মুক্তির ভাগের বুকের দুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে তোকে সাত দিন।’

মুক্তির মায়ের ড্যাবডেবে দৃষ্টি শিশুর মতো নিষ্পাপ। এসবের কিছুই যে তার স্মৃতিতে নেই, তাই কোনো সন্দেহই সৃষ্টি করে না তার নির্বিকার বসে থাকার ভঙ্গি।

মুক্তির মুখের দিকে এবার ভালো করে তাকায় উপমা। মুক্তি ওর সমবয়সী।

জীবনের সব রূঢ়তা ধারণ করা উপমার দৃষ্টিতে পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের ক্লান্তি আছে, তবে সেই ক্লান্তিতে এখন চকচক করে নতুন এক সত্য আবিষ্কারের বিস্ময়। ভারী চশমা আর মেকআপে যা যত্ন করে ঢেকে রাখতে পারে উপমা।