মোমের দেয়ালের ভেতর প্রথমবার যখন একটি অস্ফুট মৌমাছি চোখ খোলে, তখনো তার শরীর অসম্পূর্ণ। আধেক ডানায় ছাইয়ের গন্ধ, আধেক শরীরে অন্ধকারের দাগ। সে জানে না নাম কী, শুধু জানে সে এক ‘পিউপা’; একটি অপেক্ষমান প্রাণ, যে সময়ের গর্ভে তৈরি হচ্ছে। চারপাশে ঘন কুয়াশার মতো মৌচাকের গুঞ্জন, যেন দূরের কোনো সমুদ্রের ডাক। সে ডাকে ঘুমায়, সেই ডাকে জাগে। প্রতিটি নিশ্বাসে যেন মধুর অণু জমে তার শিরায়।
এক দিন, দুদিন, তিন দিন। ডানায় আসে শক্তি, চোখে আসে আলো। পিউপা নড়ে, তার ছটফটে যে মন হয়েছে সে মন ভাবে, এই অন্ধকারের বাইরে কী আছে এমন, আছে কোনো পৃথিবী, যেখানে ডানাগুলো মুক্তভাবে উড়তে পারে? লার্ভাদের ঘরেই একদিন দেখা হয় তার সঙ্গে এক ক্ষীণকণ্ঠের মৌমাছির, যার মাথার মুকুট এখনো নরম মোমের মতো। সবাই বলে, ওটা রানি হবে। পিউপা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে; রানি বলে কিছু তার ধারণায় নেই। শুধু জানে, কেউ কেউ জন্মেই অভিজাত হয়, আবার কেউ করে যায় কাজ নিরন্তর বিরতিহীন। পিউপা ভাবে আর ভাবে।
ছোট রানি হেসে বলে, ‘তুমিও কি রানি হতে চাও?’
পিউপা লজ্জায় বলে, ‘পুরুষ আমি, রাজ্য আর রাজত্ব দেবে?’
কনিষ্ঠ রানি হাসে, ‘রাজ্য মানে যদি ফুল হয়, নিয়ো। তবে মনে রেখো, প্রেম মানে কিন্তু শাসন।’
‘করবে? করো। কিন্তু মনে রেখো, রানি হলেই কিন্তু পুরুষ বেঁধে রাখা যায় না।’
মোমঘরে দুজনই হাসে খিলখিল।
কিন্তু তাদের এই হাসি বেশি দিন টেকে না। এক সকালে যখন মধুর গন্ধ আরও গাঢ় হয়, চাকের ভেতর হঠাৎ গুঞ্জনের ঢেউ ওঠে। বড় রানির সৈন্যরা এসে ছোট রানির মাথা ছিঁড়ে ফেলে। কারণ, এক চাকেতে দুটি রানি থাকে কেমন করে? অনিবার্য মৃত্যু দাও বলহীনে। ঠুকরে খাও মাথা, উপড়ে ফেলো চোখ। হায়! পিউপা দেখে, তার ছোট্ট বন্ধু যেন আলোয় আলোয় গলে যাচ্ছে। রক্ত নয়, বের হয়ে যাচ্ছে স্রোতের মতো সোনালি মোমরস।
রানি ঘোষণা দেয়, ‘ও ছিল বিদ্রোহিনী। ওকে মনে রাখবে যে, তারও গর্দান যাবে।’ কর্মীরা নিশ্চুপ হয়। রানির জন্য আনে প্রোটিন সেঁক, রাজকীয় জেলি। কেউ আর প্রশ্ন করে না। এই এক গর্দানের পৃথিবীতে কে আর বলবে কথা!
যে জীবনে কোনো রানি ছিল না, ছিল না আদেশ, সে জীবনে ঈশ্বরের সঙ্গে বসে নিজেই তৈরি করেছে আপন রূপরেখা; সে জীবনের বিভ্রম ঘুচে যাওয়ার শোকে কাতর হয়ে পিউপা। অন্যদিকে আবার জীবনের আহ্বানই তাকে পূর্ণাঙ্গ শরীর দিচ্ছে। কৃতজ্ঞ হওয়া প্রয়োজন, কিন্তু তা–ও পারছে না। পিউপার ভেতরে দ্বিধা, মৌ-পৃথিবী কেমন?
পিউপার দিন যায় বিমর্ষতায়। লার্ভা জীবনের ঘুম, উষ্ণ নিশ্চুপ আরাম তাকে ছেড়ে যাচ্ছে। হুহু করে বুক। কী ভীষণ একা সে। কী নিঃসঙ্গ। যে জীবনে কোনো রানি ছিল না, ছিল না আদেশ, সে জীবনে ঈশ্বরের সঙ্গে বসে নিজেই তৈরি করেছে আপন রূপরেখা; সে জীবনের বিভ্রম ঘুচে যাওয়ার শোকে কাতর হয়ে পিউপা। অন্যদিকে আবার জীবনের আহ্বানই তাকে পূর্ণাঙ্গ শরীর দিচ্ছে। কৃতজ্ঞ হওয়া প্রয়োজন, কিন্তু তা–ও পারছে না। পিউপার ভেতরে দ্বিধা, মৌ-পৃথিবী কেমন? নিজের জন্য বাঁচার সুযোগ হবে তো তার? নাকি তাকে মেটাতে হবে অন্যের ক্ষুৎপিপাসার প্রয়োজন। পিউপা কি বিরহী হবে পূর্বশোকে নাকি নতুন করে খুঁজবে প্রণয়ী?
রানি, কর্মী, ড্রোন—এই তার পরিবার। পিউপার কেমন কেমন লাগে। কর্মী মৌমাছিদের ব্যস্ততা অসীম। কেউ ডানা শুকায়, কেউ পরাগ নিয়ে ফেরে, কেউ যত্ন নেয় রানির না ফোটা ডিমগুলোর। কেবল তারই ক্লান্তিহীন ঘুম। জেগে উঠলে নিঃসার দেখে যায়, চাকের বাইরের প্রহরী মৌমাছিরা প্রতিদিন কলহ বাধাচ্ছে নিজেরা নিজেরা। ওরা নিজেদের ‘যোদ্ধা’ ভাবে, যদিও যুদ্ধ বলে কিছু নেই। তাদের অস্ত্র শুধু হুল আর ভেতরে জমে থাকা বিষ। একদিন ফুলের বনে যাওয়ার সময় পিউপা শুনল দুই সৈন্য মৌমাছির তর্ক।
একজন বলছে, ‘আমরা নইলে রানি বাঁচত না।’
অন্যজন বলে, ‘রানি না থাকলে আমরা বাঁচতাম না।’
তাদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে অমীমাংসিত প্রশ্ন, দ্বিধা; কার জন্য এই শ্রম, এই প্রহরা, এই মধু? পিউপা বুঝতে পারে, মৌচাকের ভেতরেও এ এক এমন রাষ্ট্র, যার তল–অতলে কেবলেই ধোঁয়াশা।
একবার এক সৈন্য পিউপার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি কাজ করো না কেন ঠিকমতো? রানিকে ভয় নেই?’
পিউপা চুপ করে। শোনা যায় না এমন ফিসফিস করে বলে, ভয় নয়, তার কেবল ক্লান্ত লাগে এই অন্তহীন আনুগত্যে।
বিকট ব্যথায় তখনই পিউপা অবশ হয় সৈনিকের আঘাতে। তার কি জেল হবে? শীত এল বলে, অকেজে হলে ক্ষতি তো রানিরই হবে।
পিউপা ভেবে পায় না, বিগত জন্মের অভিশাপেই কি তার এই হিংস্র জনম? হয়তো। হতে পারে সে কোনো অতৃপ্ত ঝিঁঝি ছিল অথবা ঘাসফড়িং; দুমুঠো আলো আর ঘাসের অতৃপ্তিতে এই মধুপ জীবন।
পিউপার ভাবনা হয়, এ জীবনেও সে কী চায়? মধু নাকি আলো নাকি ঘাস? না না, পিউপা জানে সে সবই চায়, কেবল উড়তে চায় না ফুলের ওপাশে, যেখানে রেণুরা সময়ের ধূলিকণা হয়ে ভেসে থাকে।
এক দিন, দুদিন, তিন দিন কেটে যায় পিউপার এসব ভেবে ভেবে। রানি মৌমাছি তার দিকে তাকায় নিস্পৃহ চোখে, মেপে দেখে তার পৌরুষ। তাঁর গর্বিত চোখের গভীরতায় প্রজননের অনিবার্যতা। পিউপা ভাবে, রানির কি শুধু শরীর হলেই হয়? মগজ লাগে না, লাগে না হৃদয়, প্রেম? বেঁচে যায় পিউপা পূর্ণাঙ্গ না হওয়ার অগৌরবে।
পিউপা ভাবে, সে হয়তো থাকবেই না এই আনন্দহীন জগতে। কিন্তু উত্তরী বাতাস তাকে ফিসফিস করে জানিয়ে যায়, প্রকৃতিই তাকে আনন্দ দেবে, বৃক্ষ দেবে সুর, সূর্য দেবে পরিজন, ফুল দেবে জীবিকা। তাকে খুঁজতে হবে ক্লান্তির সঙ্গে আনন্দ। জীবন মানে তা–ই। পিউপা তাগিদ পায়, জানতে চায়, কেমন জীবন সুন্দর! বাতাস জানায় প্রেমের জীবন, সুরের জীবন, জীবন কেন, স্বার্থহীন হলে মরণও সুন্দর। দৈবকথায় পিউপা ডানা মেলে নতুন উচ্ছ্বাসে, কিন্তু মৌচাকের দেয়াল তাকে থামিয়ে দেয়। প্রশমিত ব্যথায় আবার ফোটায় সতর্কতার হুল। ঘুম ঘুম জাগরণে সে শোনে—
হাজার হাজার কর্মী মৌমাছির সুশৃঙ্খল গুঞ্জন
তার কানে এক মহাকাব্যিক প্রার্থনায় বলছে—
কোথাও কবিতা দেখলে থামবে না, দেখবে না কোনো দাম্পত্য সুখ। নরম ত্বকের শিশু নিষিদ্ধ। দেখবে কেবল জংলা। মনে রেখো, কাঁটাসমেত ক্যাকটাসেও কখনো কখনো ফুল হয়।
পিউপা বুঝে যায়, যতই সে যা ভাবুক, এই চাক আসলে একটা বৃত্ত, যার শুরু নেই, শেষও নেই।
আছে শুধু এক পুনরাবৃত্তি, যেখানে প্রতিটি জন্মই একেকটি মৃত্যুর প্রতিধ্বনি।
মধুর গন্ধে তার বিবমিষা হয়।
সে ভাবে, আমি সোনালি মধু নয়, সোনালি রোদ হতে চাই; যার গায়ে লেগে লেগে বাজবে মাধু বাসন্তী, অর্কেস্ট্রার তালে পাখা উড়িয়ে সে মিলবে রংধনুর সঙ্গে। মেঘে ভাসবে, বৃষ্টিতে ভিজবে। এমন কোনো পৃথিবী কি নেই, যেখানে ফুলেরা বাঁচে হেসে। মাছেরা বাঁচে খেলে। সমুদ্র হয় না উত্তাল। ধ্বংসের আয়োজনে সবাই থাকে নিশ্চুপ। আছে নিশ্চয়ই কোথাও সে পৃথিবী। পিউপাই কেবল তার খোঁজ জানে না।
এক দিন, দুদিন, তিন দিন কেটে যায় পিউপার এসব ভেবে ভেবে। রানি মৌমাছি তার দিকে তাকায় নিস্পৃহ চোখে, মেপে দেখে তার পৌরুষ। তাঁর গর্বিত চোখের গভীরতায় প্রজননের অনিবার্যতা। পিউপা ভাবে, রানির কি শুধু শরীর হলেই হয়? মগজ লাগে না, লাগে না হৃদয়, প্রেম?
বেঁচে যায় পিউপা পূর্ণাঙ্গ না হওয়ার অগৌরবে।
দিন কেটে যায়, মোমের দেয়ালের রং বদলায়। পিউপার গায়ের রং আরও বাড়ে। গাঢ় খয়েরি পাখায় শক্তি এখন অনেক।
একদিন সূর্যালোকে পিউপা ডানা মেলে উড়তে থাকে। তার ভেতরে দহন জাগে, বেরোবে বাইরে। দেখতে চায়, দেয়ালের ওপাশে কী আছে। দেখতে চায় সময়ের ওপাশ; কিন্তু চাকের প্রহরা কঠিন। সৈন্যরা তার পথ আটকে বলে, ওখানে মানুষের পৃথিবী, পদে পদে মৃত্যু।
পিউপা হাসে, ‘আমি মানুষ দেখতে চাই,’ বলেই দে ছুট।
পিউপা ছিটকে আসে কুসুম জগতের বাইরে; শুনতে পায় মানুষের কথা, গাড়ির হর্ন আর এক অদ্ভুত ধ্বনি: কবিতা, বইয়ের পাতা ওল্টানোর শব্দ।
ওদের চাকটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন ভবনের কার্নিশে।
ওখানেই থাকে এক তরুণ শিক্ষক, যে রোজ বিকেলে জানালার পাশে বসে বই পড়ে। কবিতার বই। চোখ শান্ত, ঠোঁটে তার অল্প হাসি, পাশে এক জোড়া বেড়াল ঘুমায়।
লোকটা বইয়ের পাতায় আঙুল ছুঁয়ে যেন আলো ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। পিউপার মনে হয়, পৃথিবীর সব আলো ছেঁকে কেবল ওই আলোটাই তার ভেতরে পৌঁছায়। মনে মনে খুব আক্ষেপ হয় তার, ‘ইশ, আমি যদি ওর জানালার বেড়াল হতাম!’
মৌমাছিদের সমাজে এই রকম চিন্তা পাপ।
ওরা কাজ ছাড়া কিছু ভাবতে জানে না।
কিন্তু পিউপার চিন্তা থামে না।
রাতে ঘুমের মধ্যে সে দেখে, ফুলেরা কথা বলছে তার সঙ্গে পরস্পরে, ‘তুই কেন উড়বি না?’
‘আমার ডানা এখনো ভিজে।’
‘তাহলে বেড়াল হবি?’
‘হলে, আদর পাব মানুষের কোলে?’
‘মানুষ আর আদর! হি হি হি হি....’ দূর থেকে ভেসে আসা বিদ্রুপবাণে ভেঙে যায় এমন কত ঘুম।
একদিন পিউপা অযাচিতভাবে স্বপ্নবাজ লোকটার ঘরে ঢুকে যায়।
তার মনে হয়, জানালার ফাঁকটা যেন কোনো অলৌকিক দরজা, যেখানে মৌচাক আর মানুষজগৎ মিলেমিশে গেছে। আছে এক অনির্ণেয় বাস্তবে। কিন্তু ঢুকেই সে দেখে, অন্ধকারের মধ্যে এক ভয়ংকর ছায়া, রাগান্বিত এক মুখ। লোকটার বন্ধু হবে হয়তো। দানবের মতো এগিয়ে আসে ক্রোধে। মধুর গুঞ্জনের প্রতিদানে পাখায় ছু্ড়ে মারে রবি ঠাকুর।
একটি শব্দ, একটি আঘাত, একটি মোমের দাগ; ছটফটিয়ে পিউপা পড়ে যায় মেঝেতে।
পিউপা রোজ আসে। পুরোনো নোনা ওঠা দেয়াল তার হয়, কাঠের জানালায় বাজে গুনগুন গুঞ্জন। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় ভাষাহীন। পিউপা আনে সুগন্ধ, সংগীত, নৃত্য; তরুণ চোখ দেয় মমতা আর্দ্র। কিন্তু লোকটার বেড়াল ভয় পায় তাকে, তেড়ে আসে, যেন অন্য কারও স্নেহের ভাগ সহ্য করা বেড়ালের স্বভাবে নেই। মিউ মিউ শব্দ যেন বিষ হয়ে কেবল ধাবমান ষাঁড়ের মতো পিছু হটায় তাকে।
সময় নিস্তব্ধ হয়ে বয়ে যায় কিছুকাল। অতঃপর লোকটি, যার চোখে থাকে কবিতার মতো দুঃখ, সে তাকে তুলে নেয় হাতে। পাখায় রাখে আঙুল, পিউপার নরম তুলোশরীরে ছড়িয়ে দেন মমতার আদর। পিউপা শোনে, লোকটি তার সহবাসীকে বলছে,
‘মাছিটাকে মারলে কেন?’
‘যদি হুল ফোটায়।’
‘যদি! সে তো আর মানুষ না। কারণ ছাড়া হুল ফোটাবে।’
পিউপার অন্তরে তখন কলকল করে ওঠে স্নেহের স্রোত। যেন সে কোনো পুরোনো ধর্মগ্রন্থে খুঁজে পেয়েছে নিজের নাম, স্বীকৃতি। মানুষ তবে ভালোবাসে! পরের জন্মে পিউপা তবে মানুষই হবে।
অতঃপর পিউপা রোজ আসে। পুরোনো নোনা ওঠা দেয়াল তার হয়, কাঠের জানালায় বাজে গুনগুন গুঞ্জন। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় ভাষাহীন। পিউপা আনে সুগন্ধ, সংগীত, নৃত্য; তরুণ চোখ দেয় মমতা আর্দ্র। কিন্তু লোকটার বেড়াল ভয় পায় তাকে, তেড়ে আসে, যেন অন্য কারও স্নেহের ভাগ সহ্য করা বেড়ালের স্বভাবে নেই। মিউ মিউ শব্দ যেন বিষ হয়ে কেবল ধাবমান ষাঁড়ের মতো পিছু হটায় তাকে। পিউপা বুঝে যায়, মৌমাছির শত্রু শুধু মৌমাছি নয়, স্বার্থে আঘাত পড়লে বেড়ালও হয়।
একদিন পিউপা দেখে, ছেলেটার হাতে ব্যান্ডেজ।
সে ভাবে যে হাত বই ধরে, যে হাত ছোঁয় নরম প্রাণ, তাতে এত ব্যথা? কেন? ‘ভোঁ ভোঁ ভোঁ?’
লোকটা বলে, ‘একটা বানর কামড়েছে। ইনজেকশন নিতে হয়েছে।’
‘কেন কেন কেন? ভোঁ ভোঁ ভোঁ?’
‘ও ভয় পেয়েছিল মানুষের কোলাহল দেখে।’
‘মানুষকে দেখে? ভোঁ ভোঁ ভোঁ?’
‘হুঁ! মানুষকে দেখে।’
লোকটার কণ্ঠে ক্লান্তি, এক অজানা অপরাধবোধ। পিউপা ভাবে, মানুষ ভয় পায় বলে মারে, আর প্রাণীরা মারে কারণ মানুষ চেনে না। পিউপার ভয় হয় লোকটা নিশ্চয়ই রাগ করেছে। সে তার সাধ্যমতো ভোঁ ভোঁ করে বোঝায়, ‘সব প্রাণীই মানুষকে বিশ্বাস করে। মানুষও ভালোবাসে প্রাণী। এই দেখো, তোমার কোলে বেড়াল আছে, জানালায় আছি আমি। ভয় কোথায়? আমরা পরস্পরে বিবদমান হলেও তোমাকে ভালোবাসি।’
ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘ভালোবাসা! ক্ষুধা আর অনিশ্চয়তার পৃথিবীতে তোদের আশ্রয়ের অপর নামই হয়তো ভালোবাসা।’
লোকটা আবার মন খারাপ করে। তার হাতে একটা বই। সেখানে একগাদা দাড়ি–গোঁফওয়ালা একটা লোকের ছবি। লোকটা চিনিয়েছে একদিন। এর নাম কার্ল মার্ক্স। ইদানীং এসব বই পড়ে লোকটা। বেড়ালটা থাবা দিলেও পিউপা লোকটার খুব কাছে গিয়ে বেশ কবার ঘুরপাক খায়। লোকটা দেখে এসব। বিষণ্ন স্বরে বলে ওঠে, ‘বানরটাকে ওরা মেরে ফেলেছে। বলেছে, জঙ্গলে ফেলে এসেছে। কিন্তু আমি জানি, ও নেই।’
পিউপা অবাক হয়ে জানতে চায়, ‘মেরে ফেলেছে? কারা মেরেছে? মৌমাছি না বেড়াল?’
‘ধুর, ওরা কেন মারবে? মেরেছে মানুষ।’
‘মানুষ! কেন? তোমরা তো এমনি অনেক শক্তিশালী, তোমাদের ক্ষুধা নিবারণের কত কী আছে, আছে আশ্রয়। নিরাপদ ঘরের থেকে কেন তোমরা ঘরহীন অবলার প্রাণ নেবে?’
‘নিই তো আমরা, প্রাণী হত্যায় আমাদের অনেক আনন্দ হয়রে। তা ছাড়া বানরটারও দোষ আছে। চিৎকার করেছে যে, কামড়েছেও অনেককে। জঙ্গল থেকে মানুষ দেখতে এসেছিল তো। মরুক।’
ও আচ্ছা। পিউপা বোঝে, মানুষ তবে শব্দই ভয় পায়। ভয় পায় আঁচড়। না না, তা–ও তো না। গাছেরা–মাছেরা তো শব্দহীন, আঁচড়ও কাটে না। তবে?
লোকটা মাথা নাড়ে, অক্ষমতায় হাসে। বলে তাকে, ‘ওরা ওকে মেরে ফেলেছে, কারণ এই পৃথিবী শুধু মানুষের। তোরা এসে কেন অপ্রয়োজনে জঞ্জাল বাড়াস?’
পিউপার মন ভারী হয়ে যায়। লোকটা তো মিথ্যে বলবে না। তার মানে, এই পৃথিবী যদি কেবল মানুষেরই হয়, তাহলে ফুলেদের, পাখিদের, মাছিদের কী হবে? যদি ফুল না ফোটে, বৃক্ষ যদি ফল না দেয়, তবে মানুষ বাঁচবে কী করে?
মানুষ তখন হয়তো মানুষই খাবে!
চাকে ফিরে এসেও পিউপা শান্তি পায় না।
রানির আদেশ, কর্মীদের গুঞ্জন, পিউপা নাকি পাগল। কবিদের মতো ভাবে। কবি হলে ঘর পরিষ্কার, লার্ভাকে খাওয়ানো, মধু সংগ্রহ করবেটা কে?
অবশ্য শাস্তিকে পিউপা ভয় পায় না। মারুক তাকে, কাটুক তাকে, দোষ হয় হোক, সে তবে লেখকই হবে, ফড়িং জীবন, জোনাক জীবন না হোক। চাকের ভেতর থেকেই লিখবে ‘মধু দুঃখের ইতিহাস’।
আসন্ন শীত আসার আগেই সে বুঝেছে, এখন সে পূর্ণাঙ্গ পুরুষ।
অন্তহীন প্রজননের শাস্তি এখন তাকে পেতে হবে। রানির গর্ভে সন্তান রেখে মরে যাওয়ার এই পুনঃপৌনিকতায় সুখ নেই, হাসি নেই, নেই বিশ্রাম। তার হৃদয় কেঁদে ওঠে অপরাপর মাছিদের গোপন দীর্ঘশ্বাস ভেবে।
পিউপা ভাবে, ‘এই সভ্যতা পুরুষের নয়, শুধু নারীর।’ নারীর পৃথিবীতে এক পুরুষ হয়ে সে ঘৃণা জানায় পৃথিবীর নির্যাতনকারী সকল নারীতন্ত্রকে।
পিউপা স্বপ্নে দেখে, একদিন এই মাছিদের জীবন আর মানুষের জীবন এক হয়ে যাবে। সেখানে থাকবে না কোনো রানি বা পোষা বেড়াল। থাকবে না হুল ফোটানো কোনো সৈনিক। সে আর সেই লোকটা বাগানে ঘুরবে শুধু।
ফুলের ঘ্রাণে, আলোর স্রোতে ভাসবে তারা। কোনো একদিন সব বৈষম্য ঘুচে যাবে।
লোকটার কোলের বেড়ালটাও আর মাছ দেখে লোভী হবে না, তাকে দেখেও জ্বালাবে না চোখে শিকারি আগুন। সেই মুহূর্তেই পৃথিবীর পুনর্জন্ম দেবে তারা। লোকটার বইয়ের ওপরে ভেসে থাকা কার্ল মার্ক্সও আসবেন সঙ্গে। তিনিও আর খেপবেন না। এসব সুখস্বপ্নে বিভোর হতে হতেই রানির গর্জনে ঘোর ভাঙে। শিকারি এসেছে।
চাক ভেঙে ফেলার শব্দ, ধোঁয়ার গন্ধ, মানুষ এসেছে মধু নিতে।
তাদের শ্রম, তাদের স্বপ্ন, তাদের ঘর।
পিউপা দেখে, একে একে সব ভাই, পিতা, বন্ধু সঙ্গী ধোঁয়ায় ভেসে যাচ্ছে।
আকাশ মৃত্যুপুরী, মধুগন্ধে ভারী।
আতঙ্কে পিউপা ছুটে যায় তার একমাত্র আশ্রয়ে—লোকটার জানালায়। ঘরে চলছে আলাপ। ভেতরে আলো, বেনিয়া মানুষের কণ্ঠ, ‘স্যার, মধু কাটছি। নিবেন? হাফ কেজি নয় শ।’
লোকটা গন্ধ শুঁকে বলে, ‘মিষ্টি।’
তার জিবে ঝিলিক খেলে যায় স্বাদ।
পিউপা জানালার কাচে আছড়ে পড়ে। দেখে, তাদের জীবনের সমস্ত সঞ্চয় গলে যাচ্ছে মানুষের মুখে। চুষে নিচ্ছে, যতক্ষণ না তিতকুটে লাগে।
পিউপা শেষবারের মতো ডানা ঝাপটায়, শব্দ করে যেন সেই কম্পনে শুনতে পায় কেউ তার অভিমান, ‘ও মানুষ, তোমরা মধু নিলে, কিন্তু প্রেম নিলে না।’
কিন্তু জানালার অভেদ্য কাচের ওপারে তার অভিমান কোথাও পৌঁছায় না।