আগের রাতে জরিমন বুড়ির অবিশ্বাস্য ত্যাগের ইতিহাস পড়ে তামিমের মন যখন ডিমের কুসুমের মতো পেলব, ঠিক তার পরদিন ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইকে সালাম না দেওয়ার অপরাধে অস্বাস্থ্যকর এক র্যাগ খেল সে। অথচ মফস্সলের এই ক্যাম্পাসে তার ছাত্রত্বের বয়স মাত্র এক মাস। এক মাসের মাথায় এই ক্যাম্পাস যে কান ধরে উঠ–বস করার মতো বিশ্রী এক লাঞ্ছনা তার কপালে লিখে ফেলবে, ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি সে। জরিমন বুড়ির জন্য মন আগেই বিষণ্ন ছিল, এখন এই অস্বাস্থ্যকর র্যাগ খেয়ে মন তার কাতর হয়ে উঠল। তামিম সেই বিষণ্ন ও কাতর মন নিয়ে ক্যাম্পাসের পুকুরপাড়ে গিয়ে বসল। কৃষ্ণচূড়ার একটা ডাল নামাজের রুকুর মতো ঝুঁকে ছিল পানির ওপর। যেন জলের আয়নায় গাছটির মুখ দেখার চেষ্টা। এই মন খারাপের দিনে গাছটির মুখ দেখার ঢঙ ভালো লাগল না তামিমের। ও পানিতে একটা ঢিল ছুড়ে আয়না ভেঙে দিল। সিদ্ধান্ত নিল—আজ আর সে ক্লাস করবে না। সময় কাটাতে ও ব্যাগ থেকে গত রাতের বইটা বের করল। বইয়ের কয়েক পাতা ওলটানোর পর মনে পড়ল, বইটার শেষ পৃষ্ঠা সে গত রাতেই পড়ে ফেলেছে। তার স্মৃতিপটে তখন বীরাঙ্গনা জরিমনের নামটি ভেসে উঠল। শুধু ভেসেই উঠল না, জরিমন নামের অচেনা-অনাত্মীয় নারীটির জন্য ওর বুকের ভেতর দুঃখ বাজতে লাগল। র্যাগ খাওয়ার দুঃখ আর জরিমনের দুঃখে যখন ওর হৃদয়নদী একাকার, হঠাৎ খেয়াল হলো, কেউ একজন সন্তর্পণে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। চমকে উঠে পেছনে ফিরল সে। সুন্দরী এক মেয়ে, যার চেহারাভর্তি সহানুভূতি, দাঁড়িয়ে আছে দুই হাত বুকে বেঁধে, তামিমের ঘাড়ের ওপর।
‘আমি পলি। থার্ড ইয়ার। নাম না জানলেও চেহারায় আমাকে চেনার কথা তোমার।’ মেয়েটি তামিমের দিকে পূর্ণ চোখে তাকিয়ে কথাটা বলল।
তামিম দৃষ্টি নামিয়ে ম্রিয়মাণ গলায় বলল, ‘আপু, চিনি আপনাকে। আমাদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন।’
‘অনুষদ ভবনের দোতলার বারান্দা থেকে আমি সব দেখেছি। আসলে নতুন এসে আমিও র্যাগ খেয়েছিলাম। তাই কাউকে র্যাগ খেতে দেখলে খারাপ লাগে। তার ওপর তুমি আমার ডিপার্টমেন্টের ছোট ভাই।’
এর প্রত্যুত্তরে কী বলা যায়, ভেবে পেল না তামিম। সে চুপ করে রইল। তখন পলির চোখ পড়ল তামিমের হাতের বইয়ের ওপর। সে খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘বইটা পড়েছ?’
‘গত রাতে শেষ করেছি।’
‘বইয়ের কোন অধ্যায়টা তোমাকে বেশি স্পর্শ করেছে?’
তার স্মৃতিপটে তখন বীরাঙ্গনা জরিমনের নামটি ভেসে উঠল। শুধু ভেসেই উঠল না, জরিমন নামের অচেনা-অনাত্মীয় নারীটির জন্য ওর বুকের ভেতর দুঃখ বাজতে লাগল। র্যাগ খাওয়ার দুঃখ আর জরিমনের দুঃখে ওর হৃদয়নদী একাকার।
পলি আপুর জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে তামিমের মস্তিষ্কে আবার ফিরে আসে জরিমন। সে তখন জরিমনের গল্পের ওপর হাঁটতে থাকে। জরিমন, একাত্তরে যে ছিল তরুণী এবং যার স্বামী গিয়েছিল যুদ্ধে, তার করুণ-বিধুর গল্প গত রাতে ঘুমাতে দেয়নি তামিমকে। জরিমনের স্বামী হাশেম, তার যুদ্ধফ্রন্ট ছিল বাগমারি। যুদ্ধের এক ফাঁকে, দুদিনের বিরাম পেলে বউ আর ছেলেটাকে দেখার জন্য তার মন কেমন করছিল। বউ-ছেলেকে একনজর দেখবে বলে কমান্ডারের কাছ থেকে এক রাতের ছুটি নিয়ে সে রওনা হয়েছিল বাড়ির উদ্দেশে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হাশেমের, সে জানত না, নিরুদ্দেশ হওয়ার পরপরই তার বাড়ির পাশে নিযুক্ত হয়েছে দেশীয় গুপ্তচর। ফলে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসে পাকিস্তানি আর্মির হাতে ধরা পড়ে হাশেম। স্বামীর সঙ্গে আটক করা হয় স্ত্রী জরিমনকেও। পরদিন সকালে দয়াগঞ্জ স্কুলমাঠে বুক বরাবর গুলি করে হত্যা করা হয় হাশেমকে। আর তার স্ত্রী জরিমনকে বাধ্য করা হয় স্বামীর তাজা রক্তের ওপর পা দাবিয়ে হাঁটতে। কিন্তু এই নিষ্ঠুর কাজ কীভাবে করবে জরিমন, সংসারযাপনের অসাবধানতায় স্বামীর গায়ে সামান্য পা লাগলেই যেখানে সে সালাম করে অস্থির হয়ে যায়। কিন্তু মহাপরাক্রমশালী পাকিস্তান আর্মি, অসম্ভবকে সম্ভব করাই যাদের কাজ, তারা এক অবলা সদ্য বাঙালি বিধবার জেদের কাছে পরাজিত হতে পারে না। তারা কঠোর হয়। অবিরাম কিল-থাপ্পড় আর বেল্টের চাবুকে তারা জরিমনের জীবন বিপন্ন করে তোলে। আঘাতে আঘাতে জরিমন কয়েক দিনের বাসি শাকের আঁটির মতো নেতিয়ে পড়ে মাটিতে। সেই বোধলুপ্ত অবস্থায় জরিমনের মস্তিষ্কের ওপর যখন হেঁটে বেড়ায় ধূসর কুয়াশার পিপীলিকা, সেই পিপীলিকা মাথায় নিয়ে স্বামীর রক্তের ওপর হেঁটে চলে জরিমন কিংবা হাঁটতে বাধ্য হয়। ধূসর কুয়াশায় ঢাকা মস্তিষ্ক দিয়েও সে উপলব্ধি করে, রক্ত নয়, সে হেঁটে চলেছে এক আগুনভরা নদীর ওপর। সেই নদীর দৈর্ঘ্য ফুরায় না, তার আগেই পুরোপুরি সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে জরিমন। তার শাড়ি, তার বাহু, তার মুখমণ্ডল মাখামাখি হয়ে যায় স্বামীর উষ্ণ রক্তে আর তার স্বামী হাশেমের লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় একাত্তরের রক্তনদীর জলে। ঘটনা এলাকায় এমন তোলপাড় তোলে, সন্ধ্যা নামার আগেই হাশেমের সহযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে যায় খবর। তারা প্রতিজ্ঞা করে—হাশেমের জীবনের বদলা তারা নেবেই। সপ্তাহখানেক পর অক্টোবরের এক অমাবস্যার রাতে আক্রান্ত হয় দয়াগঞ্জ ক্যাম্প এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহসিকতায় নিহত হয় সব সৈন্য। পরদিন সকালে ক্যাম্প বিজয়ের আনন্দে উল্লাস করতে করতে স্কুলমাঠে হাজির হয় এলাকাবাসী। তাদের চোখে-মুখে শুধু উচ্ছ্বাসই নয়, অপার বিস্ময়ও। মহাপরাক্রমশালী পাকিস্তান আর্মিও যে এইভাবে পরাভূত হতে পারে, তা তাদের কল্পনার অতীত। লোকদের বিস্ময় ফুরায় না, তার আগেই মুক্তি কমান্ডার আর্মির লাশ নিয়ে হাশেমের বাড়ি যাওয়ার ঘোষণা দেয়।
ততক্ষণে হাশেমের সদ্য বিধবা বউ জরিমনের কানেও পৌঁছে গেছে ক্যাম্প বিজয়ের খবর। সেই খবরে আনন্দের বদলে বেদনায় চুরমার হয়ে যায় জরিমন। আর্মিরা সেই মরলই, তার স্বামীটা মরার পর মরল। তার বুকের ভেতর মাথা কুটে মরে আফসোস। স্বামীর রুহের মাগফিরাতের জন্য বারান্দায় কোরআন খুলে বসে সে। তার বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠের ওপর দিয়ে কচুরিপানার ফুলের মতো ভেসে যায় সুরা ইয়াসিনের সুর।
জরিমনের সেই বেদনাভরা সুরা ইয়াসিনের সকালে তার বাড়ির আঙিনায় উপস্থিত হয় কমান্ডারসহ গ্রামবাসী। একসঙ্গে এত লোক দেখে ঘাবড়ে যায় জরিমন। কোরআন শরিফ বন্ধ করে একটা চুমু খেয়ে সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকে জনতার দিকে। তার চোখে কান্নার দাগ।
কমান্ডার এগিয়ে যায়। বিনীত ভঙ্গিতে বলে, ‘বোন, আপনের যা হারাইছে, পৃথিবীর সব আনে দিলেও তার ক্ষতিপূরণ হবে না। তারপরও আপনের জন্য আমরা কিছু উপহার আনছি।’
‘উপহার!’ বিড়বিড় করে জরিমনের ঠোঁট।
‘তোমরা লাশগুলো বোনের পায়ের কাছে ফ্যালো।’
দুর্ভাগ্য হাশেমের, সে জানত না, নিরুদ্দেশ হওয়ার পরপরই তার বাড়ির পাশে নিযুক্ত হয়েছে দেশীয় গুপ্তচর। ফলে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসে পাকিস্তানি আর্মির হাতে ধরা পড়ে হাশেম। স্বামীর সঙ্গে আটক করা হয় স্ত্রী জরিমনকেও।
মুহূর্তে ভ্যাবাচেকা জরিমনের পায়ের কাছে আর্মির লাশের স্তূপ তৈরি হয়। কমান্ডার লাশগুলোর দিকে ইশারা করে বলে, ‘এরাই আপনের স্বামীরে হত্যা করছে। এখন আপনে যা খুশি ওদের সাথে করতে পারেন। কিছু না করে আপনে যদি ওদের মুখে থুতুও মারেন, আমরা বড় শান্তি পাব।’
কমান্ডারের প্রস্তাবে জনতা হতভম্ব হয়। কিন্তু জরিমন নির্বিকার। সে বলে, ‘আমার যা কষ্ট ছিল, জ্যান্ত মানুষগুলোর ওপর ছিল। এখন তো ওরা মরেই গেছে। তবে একটা অনুরোধ, লাশগুলোকে আপনেরা নদীতে ফেলবেন না। ওই নদীতে আমার স্বামী ঘুমায়ে আছে। আমি চাই না এদের নাপাক রক্ত আমার স্বামীকে বিরক্ত করুক।’
‘আমার সাথে এক জায়গায় যাবে?’ জরিমনের ঘোর থেকে বেরোতে না বেরোতে পলি আপুর হঠাৎ প্রস্তাবে থতমত খায় তামিম। ত্রস্ত কণ্ঠে বলে, ‘কোথায়?’
‘আমাদের বাড়িতে। সেখানে একটা জিনিস তোমাকে দেখাতে চাই। আজ তোমার মন খারাপ। সেটা দেখলে, আমার ধারণা, তোমার ভালো লাগবে। যদিও সেটাও আরেক মন খারাপের জায়গা।’
দুই.
গ্রামের এত গভীরেও যে নায়িকার মেকআপ করা ত্বকের মতো মসৃণ পাকা রাস্তা থাকতে পারে, ভাবেনি তামিম। পলি আপুর সাথে ভ্যানের সামনে পা ঝুলিয়ে বসেছে সে। শীর্ণ এক নদীর কোল ঘেঁষে এগিয়ে গেছে পথ। যেন নদী আর পথের বহুকালের বন্ধুত্ব।
কিছু দূর যাওয়ার পর নদীর সঙ্গে পথের বিচ্ছেদ ঘটল। নদীকে একলা ফেলে পথ ঢুকে গেল লোকালয়ের ভেতর। সামনে একটি মোড়। কতগুলো মুদিদোকান। একটি দোকানের সামনে ভ্যান থামল। তামিম ভাড়া চোকাতে গেলে পলি চোখ পাকিয়ে বলল, ‘বড় আপু থাকতে তুমি কেন ভাড়া দেবে!’
মোড় পেরিয়ে কাঁচা রাস্তা। পাঁচ মিনিট এগোতেই বিরাট আমগাছের নিচে আধা পাকা এক পুরোনো বাড়ি। সামনে জোড়া নারকেলগাছ। পলি আপু জোড়া নারকেলগাছের ফাঁক দিয়ে তামিমকে নিয়ে সেই বাড়িতে ঢুকল।
‘এটা আমাদের বাড়ি। আমার কোনো ছোট ভাই নেই। আজ তোমাকে ছোট ভাই মিন করে ধরে এনেছি।’
‘কারে ধরে আনলি?’ টিনের গেটের মুখে মাথায় আঁচল তোলা মাঝবয়সী এক নারীর মুখ উঁকি মারে।
পলি উচ্ছ্বল কণ্ঠে বলে, ‘মা, ও তামিম। আমার ভার্সিটির ছোট ভাই।’
তামিমকে দেখে মহিলার মুখ গ্রামীণ সরলতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
জরিমনের পায়ের কাছে আর্মির লাশের স্তূপ তৈরি হয়। কমান্ডার বলে, ‘এরাই আপনের স্বামীরে হত্যা করছে। এখন আপনে যা খুশি ওদের সাথে করতে পারেন। কিছু না করে আপনে যদি ওদের মুখে থুতুও মারেন, আমরা বড় শান্তি পাব।’
পুবভিটের তুলনামূলক নতুন ছাদওয়ালা এক ঘরে তামিমকে নিয়ে যায় পলি। ঘরটা নতুন হলেও ভেতরটা বেশ অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে। ঘরের দুই পাশে দুটো চৌকি পাতা। জানালার ধারে চেয়ার-টেবিল। টেবিলে বইপুস্তক, ছড়ানো খাতা। বইয়ের নামধাম দেখে তামিম বোঝে, এটাই পলি আপুর পড়ার টেবিল। কিন্তু এখানে কেন আনা হলো ওকে! এ তো মন ভালো হওয়ার মতো আকর্ষণীয় কোনো জায়গা নয়। ও অপ্রসন্ন গলায় বলে, ‘এখানে কেন আনলেন?’
‘ওই বিছানার দিকে তাকাও।’ পলির কণ্ঠে বড় আপুসুলভ নির্দেশ।
বিছানায় কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে এক শীর্ণ বৃদ্ধা। ‘কে উনি?’
‘জরিমন নামে কারও কথা মনে পড়ে?’
‘জরিমন?’ তামিম একটু ভাবে। তারপর বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়ছে। তখন যে বইটা দেখলেন, ওখানে তার ইতিহাস পড়েছি।’
‘তুমি আমার দাদির ইতিহাসই পড়েছ।’
‘এ কী বলছেন! ইনিই সেই!’
‘হ্যাঁ। আমার দাদিই ইতিহাসের সেই জরিমন। তবে যে ইতিহাস তুমি জানো না, সেটা বলার জন্য তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি।’
‘একাত্তরের জরিমনকে স্বচক্ষে দেখছি, এই তো আমার জীবনের সেরা বিস্ময়। এরপর আবার কী ইতিহাস থাকতে পারে!’ তামিম তার কণ্ঠের কম্পন লুকাতে পারে না।
মুক্তি কমান্ডার সেই যে পাকিস্তান আর্মির লাশ এনে দাদির পায়ের কাছে ছুড়ে মেরেছিল আর বলেছিল, যেমন খুশি তেমন প্রতিশোধ নিতে, কিন্তু দাদি প্রতিশোধ নেননি। শুধু বলেছিলেন, আর্মির লাশ যেন নদীতে ফেলা না হয়। কারণ, নদীতে তার স্বামী ঘুমিয়ে আছে।
‘এটা পড়ে আমি শিউরে উঠেছিলাম। এক শহীদ স্বামীর প্রতি এক গ্রামীণ স্ত্রীর গভীর ভালোবাসা ও সমীহবোধ আমাকে অবাক করেছিল।’
‘কিন্তু তুমি যা জানো না, সেটা হলো, সেদিনের পর থেকে দাদি কখনো এই বাড়ির বাইরে যাননি। এই বাড়ির বাইরের কোনো মাটি তিনি পা দিয়ে মাড়াননি। স্বজনদের কেউ মারা গেলে জায়নামাজে বসে দোয়া করেছেন, তবু তার মরা মুখটা দেখেননি।’
‘এ–ও কি সম্ভব?’
‘তোমার মতো যে-ই শুরুতে এটা শোনে, বিশ্বাস করে না। কিন্তু এটাই বাস্তব।’
‘কেন তিনি বাড়ির বাইরে যাননি?’
‘কীভাবে যেন তার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের সবখানেই তার স্বামীর রক্ত ছড়িয়ে আছে। তিনি যেখানেই পা দেবেন, শহীদের রক্ত মাড়াবেন। শহীদের রক্ত মাড়ানোর ভয়ে তিনি বাড়ির বাইরে যান না। একাত্তরে তার বয়স ছিল মাত্র সতেরো। কিশোরী। ওই বয়সে স্বামীকে হারিয়েছেন। কোলে এক সন্তান। বাবার বাড়ির লোকজন তাকে বিয়ে দিতে চেয়েছে, এখান থেকে নিয়ে যেতে চেয়েছে, তিনি রাজি হননি। বরং ছেলেকে নিয়ে এই দীর্ঘ সময় তিনি বৃত্তবন্দী জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। একাত্তরের পর এই বাড়ি, এই ঘরের বাইরে তার কোনো পৃথিবী নেই।’
কাঁপতে কাঁপতে বৃদ্ধার পাশে বসে পড়ে তামিম। ত্যাগ ও ভালোবাসার এ কোন অভূতপূর্ব গল্পের সামনে এনে তাকে ফেলল সময়! এ যে রূপকথাকেও হার মানায়!
‘কীভাবে যেন তার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের সবখানেই তার স্বামীর রক্ত ছড়িয়ে আছে। তিনি যেখানেই পা দেবেন, শহীদের রক্ত মাড়াবেন। শহীদের রক্ত মাড়ানোর ভয়ে তিনি বাড়ির বাইরে যান না।
পলি-তামিমের কথোপকথন বৃদ্ধার ঘুম অথবা স্মৃতির মগ্নতা ভেঙে দেয়। মৃদু বাতাসে কাশবন দুলে ওঠার মতো নড়ে ওঠে তার কাঁথা। বহু যুগের ওপার থেকে তিনি চোখ পিটপিট করে তাকান। বুঝতে পারেন, কেউ তার ঘরে ঢুকেছে। কিন্তু কে? অভিব্যক্তি বলে, তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি ভঙ্গুর গলায় বলেন, ‘কিডা?’
‘আমি পলি।’
‘আর কিডা?’
‘আর কেউ নেই।’ পলি তামিমের কথা তুলতে চায় না। তুললেই অনেক কথা বলতে হবে। দাদির কানের যে অবস্থা, চেঁচিয়ে বলতে হবে।
‘চৌকির ওপর কিডা বসে আছে?’ বৃদ্ধা বিছানা হাতড়ে তামিমের দিকে হাত বাড়ান। একটু পর তামিমের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলেন, ‘কিডা তুমি?’
‘আমি তামিম।’
‘ভারী মানান ছাওয়াল। তা পলি, এর সাথেই কি তোর বিয়ে হবি? তোর বিয়ে দেখার বড় শখ। মরার আগে এই একটা শখই বাকি।’
লজ্জায় লাল হয়ে যায় তামিম। পলি হয় বিরক্ত। সে ঝনঝন করে বলে, ‘বিয়ে ছাড়া তোমার মাথায় কিছু নেই। সারাক্ষণ খালি বিয়ে আর বিয়ে!’
‘তালি ও কিডা?’
‘ও আমার কলেজের ছোট ভাই। তোমাকে দেখতে এসেছে।’
‘আমাক দেকতি আয়চে! আমি আবার দেখার জিনিস!’ বৃদ্ধার দৃষ্টিহীন চোখে বিস্ময় ফুটে ওঠে।
তামিম বৃদ্ধার দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে। তারপর খুব আন্তরিকতা নিয়ে বলে, ‘আপনি শুধু দেখার জিনিস না, আপনি বাংলাদেশের সেরা দর্শনীয় নারী। সারা বাংলাদেশের উচিত আপনাকে দেখা। অনেক অর্থ খরচ করে আমরা দুনিয়া ঘুরি, দর্শনীয় বস্তু দেখি। অথচ ঘরের পাশের শিশির বিন্দুর মতো আপনাকে আমাদের দেখা হয় না।’
বৃদ্ধা তামিমের কথা বুঝতে পারেন না। তিনি ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকেন ঘরের ছাদের দিকে।
তামিম পলির দিকে তাকায়। আনত কণ্ঠে অনুমতি নেওয়ার ঢঙে বলে, ‘আমি ওনার পায়ে একটু হাত দিই? একাত্তরের শহীদের জন্য ভালোবাসায় যে পা পৃথিবী মাড়ায়নি, সেই পায়ের একটু ছোঁয়া নিই?’
পলি দাদির পায়ের ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে দেয়। তামিমের রক্তের ভেতর বিদ্যুৎস্পন্দন খেলে যায়। যেন পা নয়, উঁকি মারে ইতিহাসের সোনালি অক্ষর। সেই অক্ষরের দিকে তাকিয়ে তামিমের চোখ ছলছল করে। ও বৃদ্ধার পায়ের তালুতে পরম আদরে হাত বোলায়। তারপর সেই হাত নিজের মাথায় ছোঁয়ায়, সারা গায়ে মাখে। তখন ওর এক ফোঁটা অশ্রু টুপ করে ঝরে পড়ে বৃদ্ধার পায়ের তালুতে।