আলোকবর্ষ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আষাঢ় মাসের ২৭ তারিখ আজ। গরম পড়েছে প্রচণ্ড। বিকেলে জুনিয়রদের সঙ্গে নিয়ে টিএসসি এসেছি। ওরা আমার কাছে বায়না ধরেছিল ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পল্লবী থেকে মেট্রোতে করে আসার সময় এসির হাওয়ায় অবশ্য কেউ টেরও পাইনি যে বাইরে কতটা গরম।

আমার সঙ্গে থাকা দুই জুনিয়র মেয়েই মফস্‌সল শহরের বাসিন্দা। পড়াশোনার জন্য ঢাকায় এসেছে। এদিকটায় কখনোই আসা হয়নি এর আগে ওদের। তাই আজ দুজনেই বলল ঘুরতে নিয়ে যেতে। ওরাই বের হওয়ার জন্য আমাকে জোরাজুরি করছিল, আর এখন নিজেরাই গরমে ঘেমেনেয়ে অস্থির। আমার অবশ্য গত কয়েক মাসে নানা ঘটনার ধকলে ওজন অতিরিক্ত কমে যাওয়াতেই হয়তো গরমটা একটু কম লাগছে। টিএসসির ভেতরে ঢুকে একটা কোনায় গিয়ে বসলাম তিনজন। আমার সাথিরা খানিকটা পথ হেঁটেই একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছে। একটু ‘ঠান্ডা’ কোথাও বসার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছে ওরা। কিন্তু সে রকম কোনো জায়গা নেই আশপাশে। বিল্ডিংয়ের ছায়ার নিচে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসলাম তিনজন। ‘আপু, আইসক্রিম খাব’, ওদের মধ্যে একজন বলে উঠল। ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিল সে। গরমে তাদের যেন নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছে। আমি বাইরে থেকে ওদের জন্য দুটো আইসক্রিম নিয়ে এলাম। তা খেয়ে ওরা একটু যেন স্বস্তি বোধ করল।

‘আর কোথায় যাওয়া যায়?’ আইসক্রিম শেষ করে বলল একজন। এই রোদে ওরা কেউই তেমন হাঁটতে চাইছিল না। ভেবেছিলাম, চা খাব সবাই মিলে, কিন্তু এ অবস্থায় আর চা খাওয়া হবে না বুঝলাম। ‘আচ্ছা, হাকিমের চত্বর জায়গাটা কোন দিকে?’, অন্যজন বলল। সে নাকি বন্ধুদের ফেসবুক স্টোরিতে দেখেছে ওখানে সবাই লাচ্ছি আর হালিম খেতে যায়।

টিএসসির ভেতরে ওরা ফোনে একে অপরের কিছু ছবি তোলার পর আমরা তিনজন এগোলাম হাকিম চত্বরের দিকে। সেখানে গিয়ে সবাই লাচ্ছি খেয়ে নিলাম। তাতেও মনে হয় ওদের গরম লাগা কমল না। আর থাকতে চাইছিল না ওরা ওখানে। ‘আপু, আজকে বাসায় চলে যাই। আরেক দিন আসব নাহয়।’, বলল একজন। অন্যজনও সায় দিল। বলল যে একটা রিকশায় করে সোজা হোস্টেলে ফিরে যাওয়াই হয়তো ভালো হবে। আমার একটু হাসিই পেল। অনেক জ্বালিয়েছিল আমাকে এখানে নিয়ে আসার জন্য দুজনেই। মুখে কিছু বললাম না। ‘আমি মনে হয় আরও কিছুক্ষণ থেকে যাব এ এলাকায়। একলাই ঘুরব। তোমরা যাও।’ ওদের বললাম আমি।

এই রোদে ওরা কেউই তেমন হাঁটতে চাইছিল না। ভেবেছিলাম, চা খাব সবাই মিলে, কিন্তু এ অবস্থায় আর চা খাওয়া হবে না বুঝলাম। ‘আচ্ছা, হাকিমের চত্বর জায়গাটা কোন দিকে?’, অন্যজন বলল। সে নাকি বন্ধুদের ফেসবুক স্টোরিতে দেখেছে ওখানে সবাই লাচ্ছি আর হালিম খেতে যায়।

সমাজবিজ্ঞান অনুষদের গেট দিয়ে বের হয়ে দুজনের জন্য একটা রিকশা খুঁজে দিলাম। ভাড়া নিয়ে খানিক দামাদামি করে উঠে পড়ল ওরা। দুজনকে রিকশায় তুলে দেওয়ার সময় হঠাৎ আমার চোখ পড়ল উল্টো দিকে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। একটা পথ চলে গেছে তার ভেতর দিয়ে। এই পথই তো। এখান দিয়েই একদিন আমি আর প্রাঞ্জল হেঁটেছিলাম একসঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গেই ঘোর ভেঙে গেল জুনিয়রদের ডাকে। বিদায় জানাচ্ছে আমাকে ওরা। দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রিকশার দিকে তাকিয়ে ওদের হাত নেড়ে বিদায় দিলাম। ওদের নিয়ে রিকশাটা চলে গেল। সেটা দূরে মিলিয়ে যেতেই আবার ফিরে তাকালাম উদ্যানের ভেতরের সেই পথটার দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল যেন বুকের ভেতর থেকে। ভাবলাম, এলামই যখন এদিকটায়, ওখানে গিয়ে একটু হেঁটে আসি কিছুক্ষণ।

কালীমন্দিরের দিকের গেটটা খোলাই ছিল। সেটা দিয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। হাঁটতে হাঁটতে সবুজ ঘাসে ভরা মাঠটার দিকে চলে গেলাম। কয়টা ছেলে ক্রিকেট খেলছে সেখানে। কয়েকজনকে আবার দেখলাম, পছন্দের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে এসেছে। একসাথে হেঁটে বেড়াচ্ছে। একবার প্রাঞ্জলের সঙ্গে পুরো উদ্যান হেঁটেছিলাম। খুব সুন্দর সেই দিনের স্মৃতি। খানিকটা নোংরা হয়ে আছে পুরোটা জায়গা এখন। প্লাস্টিকসহ নানা রকম ময়লা দিয়ে ভরা প্রতিটি জায়গা। তবে চোখ বন্ধ করে পাখিদের ডাক আর বাতাসের শব্দ শুনলে মনে হচ্ছে যে তিন বছর আগের সেই দিনে আবার ফিরে গেছি।

প্রাঞ্জলের সঙ্গে আমার হালকা প্রেম হয়েছিল। সিচুয়েশনশিপ যাকে বলে এখন সবাই। তিন বছর আগে যখন আমরা প্রেম করি, তখনো অবশ্য শব্দটি শুনিনি। কিন্তু বেশি দূর আর গড়ায়নি ব্যাপারটা। ওর মিথ্যাচার আর প্রতারণা করার স্বভাবের কথা বেশি দিন অজানা রইল না আর আমার। এরপর আর কথা হতো না। ‘প্রাঞ্জল’ নাম হওয়ার পরও কীভাবে ও এমন স্বভাবের হলো—এ নিয়ে প্রায়ই হাসাহাসি করতাম বন্ধুদের সঙ্গে।

সূর্য অস্ত যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একটা গাছের নিচে এসে দাঁড়ালাম আমি। সেখানে অনেকগুলো পাখি একসঙ্গে কিচিরমিচির করে ঘরে ফিরছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম ওদের এই নীড়ে ফিরে যাওয়া। আমিও বাড়ি ফিরে যাব কি না ভাবছিলাম। হঠাৎ ভাবলাম, কারওয়ান বাজারে যাই। র‌্যাপিড পাস ছিল সঙ্গে, তাই আর টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়ানোর কোনো চিন্তা নেই।

প্রাঞ্জলের সঙ্গে আমার হালকা প্রেম হয়েছিল। সিচুয়েশনশিপ যাকে বলে এখন সবাই। তিন বছর আগে যখন আমরা প্রেম করি, তখনো অবশ্য শব্দটি শুনিনি। কিন্তু বেশি দূর আর গড়ায়নি ব্যাপারটা। ওর মিথ্যাচার আর প্রতারণা করার স্বভাবের কথা বেশি দিন অজানা রইল না আর আমার।

মেট্রোতে হ্যাঙ্গিং স্ট্র্যাপ ধরে ঝুলতে ঝুলতে শুধু প্রাঞ্জলের কথাই ভাবছিলাম। ওর সাথে প্রথম দেখা, আমাদের প্রথম একসাথে রিকশায় চড়া, প্রথম হাত ধরা…ট্রেন কারওয়ান বাজার স্টেশনে এসে থামতেই ঘোর কাটল। নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। প্রাঞ্জলের আগের অফিসটা এদিকেই। বছর তিন আগে মাঝে মাঝে বিকেলে ওর অফিস শেষ হলে এদিকটায় এসে ওর সাথে ঘুরতে বেরোতাম। এটা–সেটা খেতাম রাস্তার নানা ফুডকোর্ট থেকে। মাঝে মাঝে আবার ওর অফিসের আশপাশের কোনো দোকান থেকে কিছু কিনে নিয়ে ওর অফিসের বিল্ডিংয়ের সিঁড়িঘরে বসেই খেতাম আর কথা বলতাম। শিঙাড়া, রেড ভেলভেট কেক, পেস্ট্রি—যা–ই পেতাম, কিনে নিয়ে ওখানটায় বসতাম।

এই তিন বছরে ওর অফিসটা কোন দিকে, তা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এদিক–ওদিক একটু খুঁজে পেয়ে গেলাম শেষমেশ। কারওয়ান বাজারের বেশির ভাগ বিল্ডিংয়ের মতোই এই বিল্ডিংয়েও অনেকগুলো অফিস। ওর অফিসটা ছিল লিফটের পাঁচে। এটা এখনো মনে আছে। এই লিফটে একবার একা দুজন একসাথে উঠে কী নিয়ে যেন খুব হাসছিলাম। গত তিন বছরে অনেক স্মৃতিই ঝাপসা হয়ে এসেছে। লিফটের শব্দটা এখনো আগের মতোই। শুধু মাথার ওপর যে দুটো আলো জ্বলজ্বল করত, সেটার একটা নিভে গেছে।

পাঁচতলায় এসে আগের মতোই শব্দ করে লিফটের দরজাটা খুলে গেল। লিফট থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটতে লাগলাম সেই অফিসের দরজার সামনের প্যাসেজ দিয়ে। একসময় প্রাঞ্জল এখান দিয়েই হেঁটে গিয়ে ওর অফিসের মূল দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকত। অফিসের লোগোসহ স্টিকার লাগানো সেই অস্বচ্ছ কাচের পুশ-পুল ডোরটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। কী মনে করে যেন বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম। দেখলাম, ভেতরে রিসিপশন টেবিলের পেছনেই ওপরের দিকে একটা কালো ব্যানার ঝুলছে। সেখানে প্রাঞ্জলের কটা ছবি পাশাপাশি। নিচে লেখা—‘আমাদের সাবেক কর্মী মাহতাব হাসান প্রাঞ্জলের অকালমৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।’

প্রাঞ্জল চলে যাওয়ার পর থেকে আমি যেন আর আগের মতো নেই। শুধু আমাদের ঘুরে বেড়ানো জায়গাগুলোই তখনকার মতো রয়ে গেছে অনেকটা। বেশিক্ষণ আর দাঁড়ালাম না বা দাঁড়াতে পারলাম না। বুকটা ভারী ভারী লাগছে। জলে ভরা চোখ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম।

হ্যাঁ, ছয় মাস আগে একটা দুর্ঘটনায় গাড়িচাপা পড়ে মারা গেছে প্রাঞ্জল। ঘটনার দুদিন বাদে খবরটা পেয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। প্রাঞ্জল যে খুবই খারাপ একটা মানুষ ছিল, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। তবু আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো দিনগুলোর মধ্যে কিছু কাটিয়েছি আমি ওর সাথে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। প্রাঞ্জলের জন্য আমার কোনো গভীর প্রেমের অনুভূতি নেই। কখনো হয়তো ওভাবে ভালোবাসিওনি আমি ওকে। কিন্তু একটা মায়া সব সময়ই ছিল। এবং সেটা কখনোই যায়নি। ও যত দিন বেঁচে ছিল, কোথায় যেন বাক্সবন্দী করে রেখেছিলাম সেই মায়ার অনুভূতিগুলো। ও চলে যেতেই যেন সেই বাক্স একেবারে খুলে গেল, আর বন্ধ হলো না।

প্রাঞ্জল এখন আর নেই। এই অফিসে নেই, ঢাকার কোনো রাস্তায় নেই। কোত্থাও নেই। তবু আজ কিসের খোঁজে যে একলা এসেছি এখানে, জানি না।

ফায়ার এক্সিটের দরজা দিয়ে আলোছায়া সিঁড়িঘরটায় এসে দাঁড়ালাম। অতীতের ঘটনাগুলো যেন সেখানে এখনো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কারওয়ান বাজারের গাড়িঘোড়ার আওয়াজ এখনো একই রকম আছে। সিঁড়িঘরটাও বদলায়নি। সবকিছুই তিন বছর আগে যেমন ছিল, ঠিক তেমনটাই রয়ে গেছে। শুধু আমরা নেই। আমরা আর এই সিঁড়িতে বসে হাসি না, গল্প করি না। বিধ্বস্ত কী কী ঘটে গেছে, তা জানার ভারে ভারাক্রান্ত আমি শুধু একলা দাঁড়িয়ে। প্রাঞ্জল চলে যাওয়ার পর থেকে আমি যেন আর আগের মতো নেই। শুধু আমাদের ঘুরে বেড়ানো জায়গাগুলোই তখনকার মতো রয়ে গেছে অনেকটা। বেশিক্ষণ আর দাঁড়ালাম না বা দাঁড়াতে পারলাম না। বুকটা ভারী ভারী লাগছে। জলে ভরা চোখ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম।

রাতে ঘরে ফিরে ফেসবুক স্ক্রল করছিলাম। হঠাৎ বিজ্ঞান নিয়ে কনটেন্ট বানানো একটা ছেলের রিল চোখে পড়ল। ইংরেজিতে সে যা বলে যাচ্ছে, তার অর্থ অনেকটা এমন, ‘আমরা যদি পৃথিবী থেকে কয়েক লাখ আলোকবর্ষ দূরের কোনো ছায়াপথের দিকে তাকাই, তাহলে বুঝতে হবে যে সেই ছায়াপথের আলো এসে এখানে পৌঁছে আমাদের চোখে ধরা দিতে সময় লেগেছে কয়েক লাখ বছর। এত দিনে সেই ছায়াপথ আর আগের অবস্থায় নেই। সেটার অবস্থান, রূপ বদলে গেছে। যেসব তারা আমরা রাতের আকাশে দেখতে পাই, তাদের অনেকগুলো মরেও গেছে। অর্থাৎ আমরা সেই অনেক আলোকবর্ষ দূরে থাকা ছায়াপথের বর্তমান অবস্থা নয়, বরং তার লাখ লাখ বছর আগের অবস্থাটাই দেখছি। এবং এর উল্টোটাও সত্য। সেই হিসাবে সাত কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনো ছায়াপথ থেকে এখন যদি কোনো ভিনগ্রহবাসী খুব শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকায়, তাহলে সে ডাইনোসরদের দেখতে পাবে।’

ভাবলাম, তাহলে নিশ্চয়ই খুব বেশি আলোকবর্ষ দূরে যেতে হবে না। সেখান থেকে পৃথিবীর দিকে ফিরে তাকালেই হয়তো দেখব—আমি আর প্রাঞ্জল। এখনো সেই সিঁড়িতে বসে; হাসছি, কথা বলছি। শুরুর দিকের মুহূর্তগুলোর মতোই মিষ্টি রেড ভেলভেট কেকে কামড় বসাচ্ছি। এখনো জানি না আমরা, কী অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতে…