রাইনখোলা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শুক্রবারের সকালের আলসেমিটাকে জড়িয়ে ধরে রাখি দুপুর পর্যন্ত। তেমনি আলসেমি নিয়ে বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিলাম। তখনই সেলফোনটি বেজে উঠল। ওপাশের কণ্ঠ অপরিচিত। পরিচয় দিলেন অধ্যাপক গোবিন্দ কুমার নাথ, আমার কলেজজীবনের শিক্ষক। পরিচয় পেয়ে সালাম দিলাম। তিনি জানালেন আজকের সাহিত্য সাময়িকীতে আমার গল্পটি পড়েছেন, ভালো লেগেছে। আমাকে একটি অনুরোধ করলেন তিনি, জানালেন রাইনখোলা নামের একটি জায়গা নিয়ে গল্প লিখতে পারি কি না। কথা শেষ না হতেই লাইনটি কেটে গেল। জানা হলো না কোন রাইনখোলা, কোথায় রাইনখোলা? মনের মাঝে একটা খচখচানি রয়ে গেল। আজকাল নেটওয়ার্কের অবস্থা খুবই খারাপ। তবে এটা আমাকে অবাক করেছে, ম্যাথের সেই রাশভারী শিক্ষকটি আমাকে মনে রেখে ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করেছেন, কেননা সাত বছর হলো কলেজ ছেড়েছি। আমি বেশ উৎফুল্ল বোধ করলাম। তবে সেই আবেগ-উৎফুল্লতার থেকে বেশি যে কথাটা কানে গুনগুন শুরু করল, তা হলো রাইনখোলা। আমার জায়গাটার নাম খুব পছন্দ হয়ে গেল। আমি সারা দিন রাইনখোলা নিয়ে ভেবে চললাম।

গত সাত দিন অফিসে খুব ব্যস্ততা গেল। যাবতীয় কাজের মধ্যে ডুবে থাকলেও আমি রাইনখোলাকে ভুলতে পারলাম না। জার্মানির রাইন নদীটি আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আর তাই অনবরত চোখে এল সেই ছবি। তবে আমি নিশ্চিত এই রাইনখোলা কোনো নদী নয়, এটা অবশ্যই বাংলাদেশের কোনো অজপাড়াগাঁ, যেখানে বিদ্যুৎ নেই আজও, আছে কেবলই শ্যামলতা, কুলবধূর আলতার পায়ের ছাপ, রাখালের করুণ বাঁশি, ঝনঝন পাতাঝরা শব্দ আর পাখির জ্যামিতিক কোলাহল, যা দেখে গম্ভীর অধ্যাপক গোবিন্দ কুমার নাথ প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে আমাকে উৎসাহিত করতে চেয়েছেন। এসব ভাবনার মধ্যে রাইনখোলা এখন আমার কাছে ছবির মতো ফুটে উঠেছে। আমি রাইনখোলা নামের গল্পটি লিখতে বসে গেলাম।

রাইনখোলার হাটটা ছোট হলেও এই মধুপুর গ্রামের প্রাণ হয়ে আছে। রাইনখোলার দক্ষিণে ভুবনেশ্বর নদ তার জলদেহে রাইনখোলাকে ছুঁয়ে আছে যুগ যুগ ধরে পরস্পর সখা হয়ে। নদী আর ঘাটের একটা চিরন্তন সম্পর্ক রয়েছে এখানে। এটা মূলত একটা গঞ্জ এলাকা। যদিও ভুবনেশ্বর তার সেই পুরোনো দাপট হারিয়েছে, তবু আমার গল্পের নায়ক শহুরে যুবক, সদ্য প্রভাষক হিসেবে মধুপুর কলেজে যোগদানের পর এই ভুবনেশ্বরের ঘোলাজলে নিজের ছায়া দেখতে খুব পছন্দ করে। রাইনখোলার পশ্চিমে বুকের মাঝে ক্ষত নিয়ে যে লাল ইটের সড়কটি চলে গেছে বিরামপুরের দিকে, তার দুধারে গড়ে উঠেছে পনেরো-বিশটি মনিহারি দোকান। রাইনখোলা হাটের মাঝের অংশে উঁচু মাটি তোলা জায়গাটি এই দক্ষিণ অঞ্চলের বিখ্যাত মাছের আড়ত। তার পাশে বেশ কিছু ভুসিমালের দোকানের একটিতে কাজ করে মহি নামের যুবক, যার সঙ্গে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রভাষক রফিকের একটা আলাপ-আলাপ সম্পর্ক চলছে। রাইনখোলা বাজারের তরতাজা সবজিগুলো ভুবনেশ্বরের বুকে চেপে দূরের শহরে চলে যায়।

হাটের ঢালে একটা মাচা বানানো আছে। রাতদিন সেখানে আড্ডা জমে। দু-একজন আছে, যারা মাচায় বসে নদীতে বড়শি ফেলে আর বাকি সবাই দিনরাত তাস পেটাতে থাকে। রাত গভীর হলে এই মাচাটির এক পাশে চলে চোলাইকৃত সস্তা মদের আড্ডা। বিশেষ করে সোম ও শুক্রবার হাটের দিন, এসব দিনে দু-তিন গ্রামের লোক আসে এখানে। সেই সঙ্গে দু-একটা কেরুর বোতল জোগাড় হয়ে যায়—জমে ওঠে আসর। মধুপুর গ্রামের গায়েন বাহাদুর তার বাবরি চুলে ঝাঁকি দিয়ে যখন দুলে দুলে গেয়ে ওঠে, ‘পরানের বান্ধব রে...’ আর পায়ের থপথপ দাপানি দেয়, তখন শহুরে যুবক রফিকের গা কেঁপে কেঁপে ওঠে। মনে হয়, এই বুঝি ভেঙে গেল। বিশেষত তার ভয়, কারণ সে সাঁতার জানে না। রাইনখোলা হাটের ছোট ছোট খুপরির শ খানেক দোকানের সবই মাটির আর খড়ের ছাউনি। শুধু উত্তরের রেন্ডিকড়াইগাছের গোড়ায় পাকা বেদি। সেখানে বেণু নামের জটাধারী এক পাগল তার চটের আলখাল্লা গায়ে ঝিমাতে থাকে। রফিক তাকে গত তিন মাসে এর বাইরে দেখেনি। রাইনখোলা হাটের সামনের রাস্তা দিয়ে ভ্যানে করে গাঁয়ের বধূদের যাতায়াত থাকলেও হাটের মধ্যে তাদের যাতায়াত বলতে তিনটি সোনা-রুপার দোকান, তা–ও কালেভদ্রে। দোকান তিনটিকে সোনার দোকান না বলে শুধু রুপার দোকান বলা যেতে পারে, কেননা এই সব দোকানে সোনা নেই, তবে দোকানের মালিকেরা স্বর্ণকার নামে পরিচিত।

রফিক এই তিন মাসে মধুপুরে চেনাজানা বলতে খুঁজে পেয়েছে ওর স্কুলবন্ধু নেহালের বাবার এক ফুফাতো বোনকে। কলেজের কাছেই সেই ফুফুর বাসা। ফুফুটিকে দেখে রফিকের মনে হয়েছে, তিনি নানি কিংবা দাদি হলেই বেশি মানাত। সাদামাথার এই মহিলার ঝুলে পড়া চামড়া বেশ হলদে রঙের। মহিলা এই এলাকার পুরোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারের গৃহিণী, যদিও তার বাপের বাড়ি টাউনে, এই গল্প তিন মাসে সে তিরিশবার শুনিয়েছে। কলেজের পাশে বাড়ি হওয়ায় তার আবদার, তার বাড়িতে যেন রফিক থাকে। তাতে তার ভালো লাগবে আর রফিকেরও যত্নআত্তি হবে। কেননা তার পালিত কন্যা সুফিয়া ভালো রান্না করে আর তার নাতি সোমা ভালো ঘর গোছায়। রফিক এই বুড়ির খবরদারির হাত থেকে বাঁচতে রাইনখোলা বাজারের পাশে মহির একচালা ঘরে একটি চৌকি পেতে নেয়। ফলে মহির সঙ্গে বন্ধুত্বও বেড়ে যায় রফিকের। রাইনখোলা আর রাইনখোলার চায়ের আড্ডা থেকে মদের গন্ধ—সবই রফিকের কাছের ভুবন।

রফিকের ভার্সিটিতে ‘গুহামানব’ নামে বিশেষ পরিচিতি ছিল। বন্ধুদের আড্ডায় চুপচাপ শ্রোতা ছাড়া সে কখনো সরব হয়নি। যদিও রাতের পর রাত সে তাস পিটিয়ে কখনো বা কম্পিউটারে গেম খেলে কাটিয়েছে। স্বল্পভাষী বলে কেউ কেউ তাকে অহংকারী ভাবত। নিজের খেয়ালখুশিমতো চলায় রফিকের অভ্যাস। নিজ খেয়ালে শহর ছেড়ে এই অজপাড়াগাঁয়ে চাকরি নিয়েছে সে। প্রথম প্রথম রফিক ছুটি পেলেই বাড়ি দৌড়ে যেত। আজকাল সেটাও কমে গেছে। বছরখানেক হলো মধুপুরের রাইনখোলা রফিককে বেঁধে ফেলেছে।

আজ ছুটির দিন। মহি বেরিয়ে গেছে সকালেই। রফিক দুপুরের খাবার শেষে চলে আসে জয়নালের দোকানে। দুপুর বলে বেশ ফাঁকা। শুধু রাইনখোলার সবচেয়ে বৃদ্ধ করিম সওদাগর তার দাঁতহীন চোয়ালে চায়ের কাপ ঠেকিয়ে চুকচুক শব্দ তুলে চা খাচ্ছে। রফিক বুড়োর পাশে গিয়ে বসে। জয়নালকে বলতে হয় না, চা দিয়ে যায় আপনা থেকে।

সওদাগর কাঁপা হাতে কাপটি নামিয়ে রেখে বলে, ‘কী মাস্টার, আইজ বন্ধ?’

রফিক চায়ে চুমুক দিয়ে মাথা নাড়ে।

বুড়ো বলে, ‘বাড়ি যাও নাই? মায়ায় ধরছে?’

রফিক হাসে। বুড়ো বলতে থাকে, ‘এই জায়গাডা বড় অদ্ভুত! সেই ইংরেজ গো আমলের কথা। রাইন নামের সাদা সাহেব এইহানে আইসা মায়ায় পড়ছিল। ওই যে বেণু পাগলা বসে, সেইহানেই আস্তানা গাড়ে রাইন সাহেব। আমার দাদায় কইছে হেই কালে গেরামের মানুষে সাদা সাহেব বেশি দেহে নাই। ওই রাইন সাহেব যখন এহানে আস্তানা গাড়ল, মাইষের মুখে মুখে খালি তার নাম। হেই থ্যাইকা এইডা রাইনখোলা। বুঝলা মাস্টার, এই জায়গাডার একটা আলাদা মায়া আছে। ওই দেহ বেণু পাগলা, কোথায় বাড়ি, কোথায় ঘর, কেউ কইবার পারে না। সেই যেইবার সওদা লইয়া আইলাম এই রাইনখোলা, সেই থ্যাইকা দেখতাসি এহানে বসা।’

রফিক আনমনে শুনতে থাকে বুড়োর কথা। তারও কি মায়া পড়ে গেছে! এই রাইনখোলার মায়ায় যে পড়ে, সে আর ছেড়ে যেতে পারে না। রফিকের মন শীতের দুপুরের মতো নির্জন একা একা লাগে। মধুপুর গ্রাম, ধানখেত, গাছপালা, রাইনখোলা, ভুবনেশ্বর—সব কেমন দূরের মনে হয়। মনে কষ্ট লাগে, এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও গেলেও শূন্যতা, বাঁশের চোঙার ওপর বসে থাকা মাছরাঙা পাখিটির মতো একলা অনুভব, রাইনখোলাকে হারাবার অনুভবে রফিকের ভেতরে অকারণ অশ্রুপাতে মন ভিজে যায়। সে উঁচু মাচার ওপর বসে ভুবনেশ্বরের ক্ষীণদেহে সবুজ কচুরিপানা ভেসে যেতে দেখে।

রফিক চাইলেই মধুপুর কলেজ ছেড়ে যেতে পারে অন্য কোথাও। তার নিজের শহরে কিংবা ঢাকায়, যেখানে রাইনখোলা হাট নেই, ভুবনেশ্বর নেই, অলস স্রোতের বয়ে যাওয়া সময় নেই। মা আজকাল খুব বিয়ের কথা বলছে। এই কেরোসিনের গ্রামে নাকি কোনো শিক্ষিত মেয়েই ঘর করতে আসবে না! আসলে এই কুপি জ্বালানো গ্রাম, হ্যাজাকের সাদা আলোর গ্রামে কেন সে পড়ে আছে? না, সে কথাটা সে নিজেও জানে না। সে বেণু পাগলের নিস্তব্ধতাকে ভালোবাসে। মহির বোকা হাসি আর বাহাদুরের বাবরি চুলের দোলা আর খড়খড়ে গলার গান, ভুবনেশ্বরের শীর্ণদেহ, রাইনখোলার মেছো গন্ধ—সেই সাথে রেন্ডিকড়াইয়ের কালো শরীর—এসব তার খুব প্রিয়।

রফিক এখন এই গ্রামের নতুন আগন্তুক নয়, সে এখন রাইনখোলার মাস্টার সাব। বাহাদুরের পায়ের কাঁপনে তার প্রাণ কাঁপে না। তাই আজকাল গানের আসরে সে আর মাঝপথে উঠে যায় না। আজ গানের আসর। রফিক আগেভাগেই এসে মাচার খুঁটির সঙ্গে ঠেস দিয়ে বসে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোক বাড়ে আসরে। রফিক আর মহি গ্লাসের পর গ্লাস মদ খেতে থাকে। বাহাদুরের গলা খরতা মেশানো রাতের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে। গানের সঙ্গে সঙ্গে রফিকের মাথাও দুলতে থাকে। বিগত পাঁচ বছরের রপ্ত করা অভ্যাসের কাছে রফিক যেন হেরে যায়। চাঁদের ভুবনেশ্বরের জলরূপ ঝিলিক দেয়। জেলেপাড়া থেকে ছুটে আসা মিটমিটে হারিকেনের আলো নদীতে সাঁতরিয়ে এগিয়ে আসে। রফিক ভাবে, মৎস্যশিকারিরা নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। কানাকুয়োর ডাক বাঁশঝাড় ছেড়ে চলে আসে রাইনখোলার ঘাট পর্যন্ত। রফিকের অদ্ভুত লাগে, এ যেন এক অন্য ভুবন। আজ হাটবার ছিল, তাই মাচায় ভিড় একটু বেশি। রফিক খুব চেপেচুপে বসে আছে। হঠাৎ আকাশে তারাছুট দেখে বুকে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে। মহি একটা গ্লাস হাতে এসে রফিকের ধ্যানস্থ ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলে। ঠাস করে হাতের গ্লাসটা নামিয়ে বলে:

‘নাও মাস্টার, কেরুর মাল, আমি আজ একটু কোমর দোলামু।’

রফিক গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দেয়। মাঝরাতে বাহাদুরের সঙ্গে নাচতে থাকে মহি, জয়নাল, বশিরসহ জনা দশেক। রফিক দেখে, মহি কী অদ্ভুত ভঙ্গিতে লাফাচ্ছে! বাঈদাপাড়ার নেওয়াজ নামের ছেলেটি মাথায় ঘোমটা তুলে মেয়েদের মতো এর-ওর গায়ে ঢলে পড়ছে। এই সরল মানুষগুলো কী আনন্দে রাতের সঙ্গে সঙ্গে জেগে ওঠে, রফিক ভেবে পায় না। তাদের এই উচ্ছ্বসিত হইচইয়ে পাশের গ্রামের একটি মোরগ বাঁক দিয়ে ওঠে। সারা মাচা দুলিয়ে তারা নাচে। বাহাদুর তার গলা বাড়িয়ে দিয়েছে যেন মধুপুর ছেড়ে হিজলতলী পর্যন্ত। রফিকের আজ নেশা ধরে, একের পর এক গ্লাস খালি করে চলে সে। আলেক মাঝি আড়চোখে চুপচাপ বসে রফিককে দেখতে থাকে। রফিকের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সেখানে তার ফেলে আসা ক্যাম্পাসের আড্ডা ভেসে ওঠে। অদ্ভুতভাবে লক্ষ করে সে আড্ডায় বসে আছে বেণু পাগল। তার চোখের সামনে দুলতে থাকে নেহালের ফুফু, সেই হলদে বুড়ির মুখ। এ রকম হাজারো মিশ্রণ দৃশ্য আর মাথার মাঝে শূন্যতা নিয়ে রফিক মধুপুরের খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে দেখতে থাকে। আজ যেন এই পা’গুলো পাগল হয়ে রাইনখোলাকে কাঁপায়। রাতের উৎসবে সবাই মত্ত। তখনই হঠাৎ পুরোনো বাঁশের মাচা মটমট শব্দে এক অংশ লাফিয়ে পড়ে ভুবনেশ্বরের বুকে।

এত দিনে সবকিছু রপ্ত করলেও রফিক জলকাটা শেখেনি।

গল্পটা শেষ হতে স্যারের কথা খুব মনে হলো। সেদিন রাইনখোলা নিয়ে এতই ডুবেছিলাম যে স্যারের মোবাইল নম্বরটাও সেভ করা হয়ে ওঠেনি। আজ সেই জন্য আফসোস হলো। শেষ পর্যন্ত ভাবলাম গল্পটা পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দিই। ছাপা হলে স্যার খুশি হবেন। গল্পটা শেষ করার পর রাইনখোলা শব্দটি আমাকে যেন মুক্তি দিল তার ভাবনা থেকে।

মাসখানেক পরের কথা। আজ শুক্রবার। সকালে বিছানায় শুয়ে দেখতে পেলাম আমার রাইনখোলা গল্পটি ছাপা হয়েছে। একধরনের ভালো লাগল। তারপর যথারীতি বইয়ের মধ্যে ডুবে গেলাম। বেলা বারোটায় ফোন এল:

‘হ্যালো।’

‘জি স্যার।’

ওপাশ থেকে অধ্যাপক গোবিন্দ কুমার নাথ বলেন, ‘তোমার গল্প পড়েছি। ভালো লিখেছ।’

‘স্যার আপনি বলেছিলেন রাইনখোলা...।’

‘হ্যাঁ, দেখেছি। থ্যাংক ইউ। আচ্ছা, তোমার কি আজ সময় হবে?’

‘কখন, স্যার?’

‘এই বিকেলের দিকে। চলো আজ তোমাকে রাইনখোলা দেখাতে নিয়ে যাব।’

রাইনখোলা শোনার পর আমি বেশ উৎসাহিত হয়ে রাজি হয়ে গেলাম। বিকেল চারটায় শাহবাগ থেকে স্যার তাঁর গাড়িতে তুলে নিলেন আমাকে। গাড়ি চলা শুরু করে ফার্মগেট-বিজয় সরণি পেরিয়ে আমি স্যারকে জিজ্ঞাসা করলাম:

‘গাবতলী হয়ে যাবেন?’

স্যার হেসে বললেন, ‘চলো দেখি।’

আমাদের গাড়ি মিরপুর দশ নম্বরের গোলচত্বর পেরিয়ে বামে মোড় নিল। সনি সিনেমা হলের সামনে দিয়ে চিড়িয়াখানা রোডে এগোতে লাগল। কিছু দূর গিয়ে স্যার গাড়ি থামালেন একটা বাজারের সামনে। ঢাকা শহরের বাজার যেমন হয়, তেমনি একটি বাজার। গাড়ি থেকে নেমে আমাকে বললেন:

‘এই হচ্ছে রাইনখোলা। বাঁয়ে এগিয়ে গেলে কমার্স কলেজ আর সোজা গেলে চিড়িয়াখানা। আসলে ঢাকা শহরের মধ্যে এমন একটি নাম জেনে আমার বেশ অবাক লেগেছে তাই তোমাকে বলেছিলাম। তুমি অবশ্য বেশ তাড়াতাড়ি লিখে ফেলেছ। যাও খোঁজ নিয়ে দেখো, রাইনখোলা সম্পর্কে কিছু তথ্য পাও কি না।’

বলেই সেই সাত বছর আগের মতো রাশভারী মুডে গাড়িতে চড়লেন। আমি অবাক হয়ে একবার রাইনখোলা আর একবার স্যারের ছুটন্ত গাড়ির দিকে চেয়ে রইলাম। নিজেকে আগের মতোই অঙ্কে কাঁচা বলে মনে হলো। মাথাটা শূন্য শূন্য লাগছে। কিছু না ভেবেই পত্রিকা অফিসে ফোন দিলাম:

‘হ্যাঁ ভাই, দেখেছি কিন্তু আমার একটা রিকোয়েস্ট ছিল।’

ওপাশ থেকে বললেন, ‘কী?’

আমি বললাম, ‘আমার রাইনখোলা গল্পের সংশোধনী ছাপা যাবে?’

ওপাশে বেশ জোরে হাসি দিলেন সম্পাদক সাহেব:

‘আরে, আপনারা কবি-সাহিত্যিকেরা দেখছি আসলেই পাগল। গল্পের আবার সংশোধনী কী? এটা কি নিউজ? প্রয়োজনে নতুন একটা গল্প লেখুন।’