দেয়াল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অর্চি ও তার সঙ্গীরা প্রতিদিন সকালে শিয়া মসজিদ মোড়ে একত্র হয়। তারপর রিং রোড ধরে শ্যামলী পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়। কেউ কেউ মিরপুরগামী বাসে ওঠে, কেউ সাভারগামী বাসে। রাস্তা ক্রস করে কেউবা গুলিস্তানগামী ও মহাখালীগামী বাস ধরে। বাসের ড্রাইভার, হেল্পার এবং এসব রুটে নিয়মিত চলাচলকারী যাত্রীদের কাছেও তারা পরিচিত। বাসে ওঠার আগে তারা এক বিশেষ শব্দে তালি বাজিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়। এতে কোনো যাত্রী বিরক্ত, কেউ ভীত হয়। কোনো যাত্রী সহানুভূতিবশত তাদের পাঁচ-দশ টাকা করে দেয়। কেউ কেউ তাদের ‘ভুয়া হিজড়া’ বলে কটাক্ষ করে। তখন অর্চি ও তার সঙ্গীরা সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করে। কোনো কোনো দিন পরিধান খুলে লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশে উদ্যত হয়।

২৫ জুলাই ২০২৪। ঢাকাসহ উত্তাল সারা বাংলাদেশ। প্রতিদিনই বেগবান হচ্ছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। সড়কের মোড়ে মোড়ে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিতে শুরু করেছেন অভিভাবকেরা। তাঁদের পাশ দিয়ে হেঁটে যেত অর্চি ও তার দল। তারা শিক্ষার্থীদের স্লোগান শুনত। প্রথম দিকে তাদের মনে হয়েছিল, এ লড়াই তাদের নয়। কিন্তু একদিন, আন্দোলনের এক পর্যায়ে যখন পুলিশি নির্যাতন ভয়াবহ রূপ নিল, তখন অর্চি ও তার সঙ্গীরা আর চুপ থাকতে পারল না। শ্যামলী মোড়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে যখন পুলিশ পেটাচ্ছিল, তখন অর্চিরা ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এল। উদ্ধত ভঙ্গিতে তারা পুলিশকে ধমকাল, মারধরের শিকার শিক্ষার্থীদের আড়াল করল। তাদের এই অপ্রত্যাশিত সাহসী ভূমিকা দেখে শিক্ষার্থীরাও অবাক।

এরই মধ্যে বাংলা ব্লকেড ঘোষণা করল শিক্ষার্থীরা। বাস চলাচল বন্ধ। অর্চিদের উপার্জনও বন্ধ হয়ে গেল। এর পর থেকে, অর্চি ও তার সঙ্গীরা প্রায়ই ছাত্রদের আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করে। তারা স্লোগান দিত, আহত ব্যক্তিদের প্রাথমিক সেবা দিত, খাবার ও পানি বিলি করত। তাদের উপস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমী ও কার্যকর। যখনই কোনো ঝামেলা হতো, তারা একটা বাড়তি শক্তি জোগাত। তাদের নির্ভীকতা ও শিক্ষার্থীদের প্রতি মমতা ধীরে ধীরে স্থানীয় দোকানদার এবং রাস্তায় চলাচলকারীদের মনে একধরনের শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করল।

এরই মধ্যে বাংলা ব্লকেড ঘোষণা করল শিক্ষার্থীরা। বাস চলাচল বন্ধ। অর্চিদের উপার্জনও বন্ধ হয়ে গেল। এর পর থেকে, অর্চি ও তার সঙ্গীরা প্রায়ই ছাত্রদের আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করে। তারা স্লোগান দিত, আহত ব্যক্তিদের প্রাথমিক সেবা দিত, খাবার ও পানি বিলি করত।

অর্চি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে যেত। সে তাদের গল্প শুনত, নিজের গল্পও বলত। ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ স্লোগানটি শুনলেই অর্চির রক্ত শিরার ভেতর ফিনকি দিয়ে উঠত। আন্দোলনের দিনগুলোতে হিজড়াদের উপস্থিতি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচুর আলোচনা হলো। অনেকে তাদের সাহসের প্রশংসা করল। আবার অনেকে তাদের অপ্রত্যাশিত উপস্থিতি নিয়ে বিদ্রূপও করল। কিন্তু অর্চি ও তার সঙ্গীরা এসবের তোয়াক্কা করল না।

একসময় শেষ হলো আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা ফিরল ঘরে। আবার রাস্তায় ছুটল বাস। প্রায় এক সপ্তাহ অর্চি ও তার দল ছিল ট্রাফিক পুলিশের মতো স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায়। সংবাদমাধ্যমগুলোতে উঠে এল আন্দোলনের খুঁটিনাটি। কারা ছিল অগ্রভাগে, কারা আহত হলো, কারা নেতৃত্ব দিল—সবকিছুই প্রকাশ পেল। কিন্তু অর্চি আর তার হিজড়া সম্প্রদায়ের কথা কোথাও উল্লেখ করা হলো না। তাদের নাম বা তাদের ভূমিকার কথা কেউ উচ্চারণও করল না। বুকের ভেতর চাপা কষ্ট নিয়ে অর্চি ও তার দল আবার বাসে বাসে নিজেদের পেশায় ফিরে গেল।

দুই.

অর্চি নামটি মা-বাবার দেওয়া নয়। হিজড়াপল্লিতে এসে এ নাম পেয়েছে অর্পণ। অর্পণের জীবনের শুরুটা আর দশটা ছেলের মতোই ছিল। পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ পাড়ায় তার জন্ম, যেখানে এক প্রতিবেশীর বারান্দা থেকে আরেক প্রতিবেশীর রান্নাঘরের ঘ্রাণ পাওয়া যেত। ছোটবেলা থেকেই অর্পণ ছেলেদের খেলাধুলা, বাইরের জগতের প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিল না। পুতুল খেলা, মায়ের শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে নিজেকে সাজানো অথবা বারান্দার টবে নতুন চারা লাগানো—এগুলোই ছিল তার জগৎ। মা-বাবা প্রথমে ভেবেছিলেন সময়ের সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু অর্পণের বয়স যত বাড়ল, তার ভেতরের ‘ভিন্নতা’ ততই প্রকট হতে থাকল।

স্কুলে ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে সে মিশতে পারত না, মেয়েবন্ধুদের সঙ্গেও না। এ নিয়ে সহপাঠীদের টিপ্পনী তাকে আরও গুটিয়ে দিত। বাড়িতেও মা–বাবার চাপা উদ্বেগ আর বিরক্তি। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। চাকরির বাইরেও পাড়ায় তাঁর একটা সম্মান ছিল। মা সারা দিন প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প করতেন, সেখানে প্রত্যেকের ছেলেদের কৃতিত্ব নিয়ে গর্ব করার একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা চলত। অর্পণের ভিন্নতা তাঁদের এই সম্মান, এই প্রতিযোগিতার ওপর কালো ছায়া ফেলেছিল। পাড়ার লোকদের কানাঘুষা, আত্মীয়দের ফিসফাস—এগুলো যেন অদৃশ্য ছুরির ফলার মতো তাঁদের বুক চিরে দিত। এসব বুঝতে পারত অর্পণ। একদিন স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে অর্পণ আর স্কুলে গেল না। সেই থেকে আর স্কুলে যায়নি এবং তার পর থেকে আর বাড়ির বাইরে বের হতে চাইত না। এভাবেই ঘরবন্দি হয়ে কেটে যায় প্রায় সাড়ে সাত বছর।

অর্পণদের বাড়িটি ছিল রাস্তার ডান দিকে। রাস্তার বাঁ দিকে ছিল একটি ফাঁকা মাঠ। মাঠের পরেই যে বাড়িটা, সেটা বাগানবিলাসগাছের ডালপালায় ছেয়ে গিয়েছিল। বর্ষাকালে পুরো বাড়ি লাল ও সাদা রঙের বাগানবিলাস ফুলে ছেয়ে যেত, যা অর্পণদের বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখা যেত। অর্পণ মাঝেমধ্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগানবিলাস-শোভিত বাড়িটির দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকত।

প্রায় এক সপ্তাহ অর্চি ও তার দল ছিল ট্রাফিক পুলিশের মতো স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায়। সংবাদমাধ্যমগুলোতে উঠে এল আন্দোলনের খুঁটিনাটি। কারা ছিল অগ্রভাগে, কারা আহত হলো, কারা নেতৃত্ব দিল—সবকিছুই প্রকাশ পেল। কিন্তু অর্চি আর তার হিজড়া সম্প্রদায়ের কথা কোথাও উল্লেখ করা হলো না।

অর্পণের ছোট বোন মিম আর ভাই রাফি। মিম ছিল শান্ত স্বভাবের, রাফি বেশ চঞ্চল। পড়ালেখায় দুজনেই দুর্দান্ত। তবু মা-বাবা সারাক্ষণ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত থাকতেন। অর্পণের কারণে ওদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে না তো? পরিবারে হিজড়া সন্তান আছে জেনে স্বাভাবিক ছেলেমেয়ে দুটোর বিয়ে দিতে সমস্যা হবে না তো?—এসব প্রশ্ন তাঁদের রাতের ঘুম কেড়ে নিত।

অর্পণের বয়স তখন সতেরো। একদিন তার বাবা তাকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন। বাবার চোখে এক মিশ্র আবেগ—ভয়, হতাশা আর একরাশ অসহায়ত্ব। বাবা নিচু স্বরে বললেন, ‘অর্পণ, তুই কি বুঝতে পারছিস, তোর কারণে আমাদের কী হচ্ছে?’

অর্পণ মাথা নিচু করে ছিল। সে জানত, বাবা কী বলতে চাইছেন। তার ভেতরের সত্তা তাকে সারাক্ষণ ছটফট করাত, কিন্তু সে এটাও জানত যে এই সমাজে তার এই পরিচয়টা অস্বাভাবিক। সে অনুভব করত—সে হয়তো পুরুষ নয়, আবার পুরোপুরি নারীও নয়। সে এক ভিন্ন অস্তিত্ব, যা সমাজের চোখে হাস্যস্পদ ও অগ্রহণযোগ্য।

সেদিন রাতে, বাবার ইঙ্গিতপূর্ণ চাওয়া অর্পণকে বাড়ির চৌকাঠ পেরোতে বাধ্য করেছিল। তার চোখে জল ছিল না। পরিবারের সবার মঙ্গল আর নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে—এটিকেই সে ভবিতব্য হিসেবে মেনে নিয়েছিল। তবু অজানা আশঙ্কায় কিছুটা ভীত ছিল। বাসা থেকে বেরোনোর সময় মিম আর রাফিকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল, কিন্তু কেউ জানুক সে অজানার উদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছে—এটা সে চায়নি। তাই হৃদয়ের সব ভাবাবেগ চেপে রেখে, অর্পণ হেঁটে চলল ঢাকার অচেনা পথে। পেছনে ফেলে এল পরিজন, প্রতিবেশীদের ফিসফাস, তার প্রিয় বারান্দা আর বারান্দা থেকে দেখা লাল-সাদা ফুলে ঢাকা বাড়ি।

তিন.

অর্পণ তখনো ঠিক করেনি সে কোথায় যাবে। মধ্যরাত, চারদিকে আলো-আঁধারির খেলা। সে ক্ষুধার্ত, ভীত ও একা। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে তার একাকিত্বকে যেন উপহাস করছিল। ফুটপাতের এক কোণে বসে ছিল কয়েকজন মানুষ, তাদের পোশাক, হাবভাব অর্পণের কাছে অপরিচিত মনে হলো। তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এল। নাম রূপা। ভাসমান যৌনকর্মী।

‘কই যাইবা? এহানে বইস্যা রইছ ক্যা?’—রূপার কণ্ঠে ছিল অদ্ভুত মমতা আর চাহনিতে দৃঢ়তা। এ কণ্ঠস্বর অর্পণকে আকর্ষণ করল। অর্পণ নির্দ্বিধায় নিজের সব কথা খুলে বলল। রূপা মনোযোগ দিয়ে শুনল। রূপাই অর্পণকে পৌঁছে দিল মোহাম্মদপুর হিজড়া আস্তানার গুরুমার কাছে।

এক ঘিঞ্জি গলির মধ্যে ছোট্ট একটা ঘর। সেখানে অর্পণের মতো পরিবার থেকে বিতাড়িত অনেকেই। অর্পণ তাদের চোখে দেখল নিজের প্রতিচ্ছবি। এখানে সে আর অস্বাভাবিক নয়, এখানে সে তাদেরই একজন।

অর্পণের বয়স তখন সতেরো। একদিন তার বাবা তাকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন। বাবার চোখে এক মিশ্র আবেগ—ভয়, হতাশা আর একরাশ অসহায়ত্ব। বাবা নিচু স্বরে বললেন, ‘অর্পণ, তুই কি বুঝতে পারছিস, তোর কারণে আমাদের কী হচ্ছে?’ অর্পণ মাথা নিচু করে ছিল। সে জানত, বাবা কী বলতে চাইছেন।

অর্পণ তার নতুন নাম পেল—অর্চি। অর্চি শিখল কীভাবে নিজের ভরণপোষণ জোগাতে হয়। নাচ, গান আর শুভ অনুষ্ঠানে আশীর্বাদ করা—এগুলোই ছিল তাদের রোজগারের প্রধান উপায়। তাদের জীবন অত্যন্ত কঠিন। বাসে উঠতে গেলে তিরস্কার, দোকানে গেলে কটুকথা, রাস্তায় হাঁটলে কুৎসিত মন্তব্য—এগুলোই নিত্যদিনের সঙ্গী। তবে তাদের আস্তানা যেন তাদের নিজস্ব পৃথিবী। যেখানে প্রতিবেশীর বিদ্রূপ, হাসাহাসি নেই। সুখ-দুঃখ ভাগ করে একে অপরের প্রতি ভরসা রাখার পরম এক শক্তি তাদের। সেই শক্তির ওপর ভর করেই পার হলো চৌদ্দ বছর।

চৌদ্দ বছরে অর্চি জেনে গেছে তাদের প্রত্যেকের পেছনে আছে একেকটি বিচ্ছেদের গল্প, একেকটি উপেক্ষিত আত্মার চিৎকার। শিখে নিয়েছে কীভাবে নিজের ভেতরের এই লিঙ্গপরিচয়কে গ্রহণ করতে হয়, কীভাবে গর্বের সঙ্গে বাঁচতে হয়। গুরুমা তাদের শিখিয়েছেন—তাদেরও বাঁচার অধিকার আছে, সম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার। সেই আত্মবিশ্বাসে অর্চি রাস্তা, শপিং মল, উৎসব থেকে রোজগার করে নির্ভাবনায় গুরুমার হাতে তুলে দেয় সব উপার্জন।

চার.

৫ আগস্ট ২০২৪–পরবর্তী সময়ে অর্চি ও তার সঙ্গীরা আবারও তাদের দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যায়। সেই শুভ অনুষ্ঠানে আশীর্বাদ করা, মানুষের কাছ থেকে টাকা চাওয়া আর কটুকথা শোনার রুটিন কাজে। তবে ইদানীং বাসে চলাচলের সময় মাঝেমধ্যেই যখন অধিকার নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মিছিল-আন্দোলন চোখে পড়ে, তখন নিজের দাবিদাওয়া নিয়েও রাস্তায় নামার ইচ্ছা জাগে অর্চির। বলতে ইচ্ছা হয়—জুলাই-আগস্টে তারাও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লড়েছে। প্রায়ই শাহবাগ মোড়ে এসে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে।

পরে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করে—তারা যে লড়েছিল, তার কি কোনো স্বীকৃতি বা প্রমাণ আছে? যেহেতু তা নেই, তাই সে নিজের সান্ত্বনা নিজেই খুঁজে নেয় এভাবে—যা কর্তব্য হিসেবে সামনে এসেছিল, তা–ই করেছি। বিনিময়ে কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল না। তা ছাড়া মা–বাবা যাদের পরিত্যাগ করেছেন, তাদের আর কার কাছ থেকে কী-ই বা প্রত্যাশা থাকতে পারে! তবু মনের অজান্তেই মনের গভীরে নানা অপ্রাপ্তি বুদ্‌বুদ করে। কোনো কোনো দিন ঘুম ভেঙে যায় সেই সব অপ্রাপ্তি ও স্বপ্নের ঘুরপাকে।

এক গভীর রাতে গুরুমা অর্চিকে ঘুম থেকে জাগালেন। জানালেন—অর্চি আস্তানায় আসার দু-তিন মাস পরপর অর্চির বাবা এসে গুরুমার সঙ্গে দেখা করে যেতেন। প্রতি মাসে হিজড়া আস্তানায় যে ভালো খাবারের আয়োজন করা হয়, তাতে ডোনেট করতেন অর্চির বাবা!

গুরুমা জানালেন—অর্চির বাবা বার্ধক্যের কারণে জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে। তিনি অর্চিকে দেখতে চান। গুরুমা নিজেই অর্চিকে বোরকা পরিয়ে নিয়ে রওনা দিলেন।

অর্চিরা যখন পৌঁছায়, তখন সকাল। বাসায় ঢোকার আগেই মসজিদের মাইকে অর্চির বাবার মৃত্যুর সংবাদ শোনা গেল। কোনো অনুভূতি অর্চিকে স্পর্শ করল না। গুরুমার পেছনে পেছনে অর্চি যাচ্ছে আর তাকে আপ্লুত করছে বাড়ির পরিবর্তনগুলো!

কান্নারত মহিলাকে দেখে অর্চি নিশ্চিত হলো—সে তার বোন মিম। মিমের আঁচল ধরে শিশুকে দেখে বুঝতে পারল, মিম মা হয়েছে। উৎসুক চোখে মাকে খুঁজল অর্চি, কিন্তু চোখে পড়ল না। ভেবে নিল—হয়তো তিনিও জাগতিক মায়ার ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। আর ছোট ভাইয়ের চাহনি খুঁজে পেল টুপি পরা, দাড়িওয়ালা একজনের মুখাবয়বে।

মৃতের মুখ দেখানোর সময় অর্চি বাবাকেও খুঁজে পেল না ঠিকমতো। সোনালি রঙের মানুষটির মুখচ্ছবি সাদা দাড়িতে বিবর্ণ হয়ে গেছে। মৃতের মুখ ঢেকে যখন খাটিয়ায় তোলা হলো জানাজার উদ্দেশ্যে, তখনই কান্নায় জড়িয়ে আসে তার কণ্ঠ। জানাজায় দাঁড়াতে পারবে কি না অর্চি, সে সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারল না। চিৎকার করে কেঁদে উঠল অর্চি, আদরে বুকে জড়িয়ে ধরলেন গুরুমা।

দাফন শেষে আত্মীয়স্বজন যে যার বাড়িতে ফিরছে। আস্তানায় ফেরার আগে অর্চি বাড়ির অপরিচিত আসবাব ডিঙিয়ে সেই বারান্দায় যায়—যেখান থেকে সে আনমনে তাকিয়ে থাকত লাল-সাদা বাগানবিলাস ফুলে ঢাকা বাড়িটির দিকে। কিন্তু বারান্দা থেকে এখন সেই বাড়ি আর চোখে পড়ে না। রাস্তার ওপারে যে মাঠ ছিল, সেখানে বানানো হয়েছে সুউচ্চ বাড়ি।

আস্তানার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে সেই বাড়িটার কাছে যায় অর্চি। দেখে সুউচ্চ দেয়ালের আড়ালে লাল-সাদা ফুলে ঢাকা বাড়িটি এখনো রঙিন। আলো-বাতাস কম হওয়ায় ফুলের সতেজতা কম, পাতাগুলোও বিমর্ষ। তবু অর্চির মন আনন্দে ভরে ওঠে—কেউ দেখুক আর না দেখুক, উঁচু দেয়ালের আড়ালে ফুটে তো আছে লাল-সাদা ফুল!