হালকা বেগুনি রঙের টপ আর চৌকো চেকের লং স্কার্টের সঙ্গে গলায় বাঁধা সাদা স্কার্ফ বেশ মানিয়েছে ছিপছিপে গড়নের শরীরটায়। পোশাক, মেকআপ ও গেটআপে পঞ্চাশোর্ধ্ব এই রমণীকে মনে হচ্ছে কিশোরী। মাথার এক–তৃতীয়াংশ চুল সাদা হলেও সেখানে বাড়তি রঙের বাহুল্য নেই। সাদাতেই দারুণ লাগছে। চুলে বাগানের কাঁচা লাল ফুলটা ছাড়া নিরাভরণ এই ভদ্রমহিলা বারো–তেরো বছরের দুটি মেয়ের সঙ্গে বাড়ির সামনের সবজিবাগানের এক পাশে লুকোচুরি খেলছে! এই দৃশ্য বাংলাদেশের কোনো বাড়ির সামনে যদি হতো, এতক্ষণে সার্কাস দেখার মতো করে লোকজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে যেত। ম্যাপলপাতার দেশ বলে এখানে কোনো কৌতূহলী চোখের ভিড় নেই।
প্রতিদিন বিকেলে পাশের ম্যাপলগাছের নিচে ইজেলটা সেট করতে করতে এই তিন কিশোরীর খেলা উপভোগ করে কুমুদ। কিছুক্ষণ পর সে তার নিজের কাজে মন দেয়। টানটান করে সাঁটা ক্যানভাসে তুলির পরশে জীবন্ত হয়ে ওঠে একেকটা ছবি। মাঝে মাঝে ছবি আঁকায় বিরতি দিয়ে ফ্ল্যাস্ক থেকে চা ঢেলে নেয়। কাপে চুমুক দিতে দিতেও মনোযোগ দিয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব সেই কিশোরীকেই দেখে। কী স্বতঃস্ফূর্ত! বাচ্চা মেয়েগুলোর সঙ্গে বয়সের ব্যবধান তার কাছে কিছুই নয়।
কুমুদ সামনে ঝুঁকে ছবি আঁকছে। ছিমছাম পরিবেশে পাশে বসে আছে এক তরুণী। তার পরনে নীল রঙের সালোয়ার–কামিজ। সে কুমুদের ছবির মডেল। মেয়েটির চোখে বিষণ্নতা। সামান্য কিছু টাকার জন্য এক সপ্তাহ ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছে।
কুমুদ সামনে ঝুঁকে ছবি আঁকছে। বাবরি চুলে গালের দুপাশ ঢেকে আছে। লাল ম্যাপলপাতা আর তার গায়ের লাল টি–শার্ট মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। ছিমছাম পরিবেশে পাশে বসে আছে এক তরুণী। তার পরনে নীল রঙের সালোয়ার–কামিজ। সে কুমুদের ছবির মডেল। মেয়েটির চোখে বিষণ্নতা। মুখটাও মলিন দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে নীল আকাশে মেঘ জমেছে। সামান্য কিছু টাকার জন্য এক সপ্তাহ ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছে। তবু কুমুদের ছবি শেষ হয় না।
অন্টারিও প্রদেশে কানাডীয় বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশ বাস করে। প্রবাসী বাঙালিরা সেখানে একটি শক্তিশালী কমিউনিটি তৈরি করে নিজস্ব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেমন পবিত্র ঈদ উদ্যাপনের আয়োজন করে।
বাঙালি পরিবারগুলো তাদের ভাষা, ঐতিহ্য ও রীতিনীতি ধরে রাখতে সচেষ্ট থাকে, যার ফলে কানাডার মতো একটি ভিন্ন সংস্কৃতিতে নিজস্ব পরিচয় বজায় রাখা সম্ভব হয়। তেমনি অন্টারিওর বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরাও তাদের নিজস্ব সংগঠন তৈরি করে একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে। একবার ঈদ আয়োজনে শিক্ষার্থীদের সংগঠনের সদস্য হিসেবে ফারিনেরও সুযোগ হলো অনুষ্ঠানে যেতে। সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হয় কুমুদের। ফারিন অন্টারিওতে এসেছে বছরখানেক আগে। কুমুদ শখের চিত্রশিল্পী। ছোট থেকেই মা–বাবার সঙ্গে কানাডায় আছে। বছরে একবার বাংলাদেশে যায় বেড়াতে। ফারিনের সঙ্গে পরিচয়ের একপর্যায়ে যখন জানল সে পড়াশোনার খরচ চালাতে ছোটখাটো একটা চাকরিও করে, তখন কুমুদ তাকে প্রস্তাব দেয় তার ছবির মডেল হতে।
ফারিনের কণ্ঠে এবার বিরক্তি ঝরে পড়ল। ‘আচ্ছা ভাইয়া, আপনার এই ছবি শেষ হতে আর কত দিন লাগবে?’ কুমুদ উত্তর দিল, ‘ভালো কিছু করতে হলে তো একটু সময় লাগবে। আর একটু অপেক্ষা করতে হবে। সব তো হয়ে গেছে। শুধু চোখ, নাক আঁকা বাকি।’ ফারিন উঠে পড়েছিল। কুমুদ তাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, ‘দেখো, ভদ্রমহিলার মাথায় কাঁচাপাকা চুল। সেখানে ফুলও গুঁজেছে। আবার বাচ্চা মেয়ে দুটির সঙ্গে নিজেও কেমন বাচ্চা হয়ে গেছে। জীবনটাকে কী সুন্দর করে উপভোগ করছে। আর তুমি কেমন মুখটা গোমড়া করে রেখেছ। বুড়ো হওয়ার আগেই বুড়ো হয়ে যাচ্ছ।’ বলে কুমুদ শব্দ করে হাসল। ফারিন বলল, ‘হ্যাঁ, উনি জীবনকে খুব উপভোগ করছেন। ওনার সুখ দেখলে হিংসা হয়।’ ফারিনের কণ্ঠটা মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে করুণভাবে ভেসে আসছে। কুমুদ বলল, ‘তোমার সঙ্গে তার আলাপ আছে?’ ‘হ্যাঁ, উনি অনেক আগে পরিবারের সঙ্গে এখানে এসেছেন। বিয়ে করেননি। এত দিন বাচ্চাদের একটা স্কুলে ড্রয়িং টিচার হিসেবে কাজ করেছেন। একজন অভিভাবকের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। স্কুলের বাচ্চারা মুনমুন ম্যাডাম বলতে অজ্ঞান। তারা অনেক করে অনুরোধ করেছিল স্কুলে থেকে যেতে। থাকেননি। বাচ্চা মেয়ে দুটি ওনার ছোট ভাইয়ের মেয়ে।’ কুমুদ বেশ অবাক হলো! ‘তুমি তো দেখছি সবকিছু জানো! উনি বিয়ে করেননি কেন?’ ফারিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উনি ফাইন আর্টসে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। সহপাঠী এক ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। তার পরিবার এত শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করাবে না বলে দিয়েছে। তাই উনিও জীবনকে উপভোগ করবেন বলে সংসারে ঢোকেননি।’ কথা বলতে বলতে ফারিনের কণ্ঠটা ধরে আসে। কারণ, সেও এমনভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কানাডায় এসেছে জীবনকে উপভোগ করতে। ব্যয়বহুল এই প্রবাসজীবন যে কী পরিমাণ উপভোগ্য, সেটা ফারিনের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। দূরে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে ফারিন তার চোখের কোণে জমা হওয়া জলটা শুকিয়ে নেয়।
ফারিনের কণ্ঠে এবার বিরক্তি ঝরে পড়ল। ‘আচ্ছা ভাইয়া, আপনার এই ছবি শেষ হতে আর কত দিন লাগবে?’ কুমুদ উত্তর দিল, ‘ভালো কিছু করতে হলে তো একটু সময় লাগবে। আর একটু অপেক্ষা করতে হবে। সব তো হয়ে গেছে। শুধু চোখ, নাক আঁকা বাকি।’
কুমুদ তার ২৭ বছরের জীবনে এই প্রথম এমন ট্র্যাজেডির এক নায়িকাকে চর্মচক্ষে দেখছে, যে কিনা হাসি দিয়ে দুঃখ আড়াল করে রেখেছে। অনেক দিন ধরে এই মুনমুন ম্যাডামকে সে দেখে আসছে। একমুহূর্তের জন্য কখনো মনে হয়নি ওনার মধ্যে কোনো অপ্রাপ্তি আছে। কুমুদের হঠাৎ মনে পড়ল চিত্রশিল্পী মোরশেদ মিশুর কথা। তার আঁকা ‘গ্লোবাল হ্যাপিনেস চ্যালেঞ্জ’ সিরিজের ছবিগুলো তার শিল্পীসত্তাকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে। রংতুলি দিয়ে কী সুন্দর করে বেদনার ছবিগুলো সুখী জীবনের ছবিতে রূপান্তর করে নিল! বোমা বিস্ফোরণে বাবা আর শিশুকন্যা ছাড়া পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। হতবিহ্বল বাবা কন্যাকে নিয়ে ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কোনো এক ফটোসাংবাদিকের তোলা এই ছবিকে মিশু পরিবর্তন করে আঁকল বাবা আর শিশুকন্যার খেলা করার সুন্দর একটা দৃশ্য। আরেকটা ফটোতে দেখা যাচ্ছে ধ্বংসাবশেষের ভেতর থেকে বাবা বের করে এনেছে তার ছোট্ট শিশুটির নিথর দেহ। সেটাকে মিশু রূপান্তর করে দেয় বাবা–ছেলের মধুর খুনসুটিতে। বোমার আঘাতে মা–বাবার শরীর ছিন্নভিন্ন। বোন ছোট্ট ভাইকে কোলে নিয়ে ছুটতে ছুটতে আসে একটা ওষুধের দোকানে। অসুস্থ ভাইকে শ্বাসকষ্টের জন্য নেবুলাইজার দিতে হচ্ছে। মিশুর তুলির ছোঁয়ায় মাউথপিসটি হয়ে উঠেছে দুধের ফিডার। কুমুদও ঠিক এ রকম একটি ছবি আঁকবে বলে মনস্থির করেছে।
ফারিন আজ একটু আগে আগে এসেছে। বাসার গ্রোসারি আইটেম শেষ হয়ে গেছে। হাতের টাকাও ফুরিয়ে এসেছে। কুমুদের কাছে চাইতে হবে। না জেনে এমন একটা জায়গায় এনগেজড হয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি। কোনোভাবে টাকাটা হাতে পেলে আর এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবে না। এ কয় দিনে অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু কুমুদের তো এখনো কোনো পাত্তা নেই। উষ্কখুষ্ক চুল আর ইজেল নিয়ে অবশেষে এল কুমুদ। ফারিনকে অনেক সময় বসিয়ে রেখেছে বলে ক্ষমা চেয়ে নিল। তারপর চুক্তির পুরো টাকা ফারিনের হাতে তুলে দিল। ‘ভাইয়া, ছবি তো এখনো শেষ হয়নি। সব টাকা দিয়ে দিলেন যে?’ কুমুদ বলল, ‘ছবি তো শেষ হয়ে গেছে। শুধু মুখের কিছু অংশ বাকি ছিল। সেটাও হয়ে যাবে। তোমার ছুটি। এত দিন সময় দেওয়ার জন্য তোমাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।’ ‘ভাইয়া, যদিও আমার তাড়া আছে, তবু ছবির ফিনিশিংটা দেখে যেতে চাই। আমি অপেক্ষা করছি। আপনি শেষ করুন।’ ফারিনের কথায় কুমুদ অস্বস্তিতে পড়ল। তারপর ছবিতে মন দিল।
আধা ঘণ্টার মধ্যে কুমুদ তার ছবি আঁকা শেষ করে ইজেলটা ফারিনের দিকে ফিরিয়ে দিল। ফারিন ছবির দিকে তাকিয়ে হাঁ করে আছে! ‘ভাইয়া! এত দিন ধরে আমাকে মডেল বানিয়ে ছবি আঁকলেন! এখন দেখছি এটা অন্য ছবি! এখানে দেখা যাচ্ছে, নীল আকাশের নিচে মধ্যবয়সী দুই নারী–পুরুষ মুখোমুখি বসে গল্প করছে। নারীটি বাচ্চাদের স্কুলের ড্রয়িং টিচার মুনমুন ম্যাডাম আর লাল টি–শার্ট পরা লম্বা চুলের পুরুষটির চেহারা বোঝা যাচ্ছে না।
ফারিন অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘ভাইয়া, মুনমুন ম্যাডামের সঙ্গে গল্প করছেন যে, এই ভদ্রলোক কে?’