ফ্ল্যাটটা কেনা হয়েছিল তিন বছর আগে। এর ভেতরে ব্যাংকের লোনও প্রায় শোধ করে এনেছিলেন তালাল হোসেন। আসল নাম মিঞা মোহাম্মদ গোলাম হোসেন। এই নামে কবিতা লেখা যাবে না সেটা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময়ই বুঝতে পেরেছিলেন। হলের বেশ কিছু ছেলে নিজেদের মতো কবিতার আড্ডা দিত, পত্রিকাও বের করত। তিনি কোনো দলে ভিড়তে পারেননি। এই যে কবিতা লেখেন, কোথাও ছাপাতে সাহস হয় না। তারপর কবে যে তিনি মিঞা মোহাম্মদ গোলাম হোসেন থেকে তালাল হোসেন হলেন,Ñতা–ও মনে নেই। ঢাকা শহরে কেউ তাকে চেনে না। এটুকু তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন, শুধু লেখালেখি দিয়ে হবে না, যেখানে ছাপা হবে, সেই পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে দেখাদেখিটা হওয়া দরকার। সেই দেখাদেখি কিছুতেই তার হয়ে ওঠে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রায়ই হাকিম চত্বরে চা খেতে যেতেন। সেখানে নব্য উঠতি কবিদের আড্ডা। ভয়ে ভয়ে কাছাকাছি যেতেন, কিন্তু দূরত্বে থাকতেন, তবে কান খাড়া করে রাখতেন। কেউ বলত, কবিতা জৈবিক ও প্রবল স্নায়বিক বিষয়। এটা পিসিতে লেখার বিষয় নয়। হাতে লিখতে হবে। আরেকজনের কথা কোনো দিন ভুলতে পারেননি। সে বলেছিল, আদর্শ রাষ্ট্রে প্লেটো কবিদের নিষিদ্ধ করেছিল, এর কারণ হলো, যৌনতাই শিল্প বা কবিতার উৎস। পরে আবার কবিতা স্বয়ং হয়ে ওঠে যৌনতার উৎস। আর যৌনতা হলো সব অনৈতিকতার আগার। বাইরে সাধু কিন্তু ভেতরে তীব্র বীভৎস ইম্মরালিটি ছাড়া কবিতা লেখা যায় না। এ নিয়ে তুমুল তর্ক। কেননা, আরেকজনের বলল, যৌনতা নয়, ক্রোধই কবিতার উৎস—অসাম্য বৈষম্য বঞ্চনার বিরুদ্ধে ক্রোধ। প্লেটো নয়, মার্ক্সই সঠিক। একদিন শুনলেন, এক নব্য বেশ জোরগলায় বলছে, কবিতা লিখতে লাগে তিনটি বিষয়: ১. পঠন, ২. রমণ, ৩. ভ্রমণ। সে সময়ে তিনটির কোনোটিতেই তিনি সক্রিয় নন। বাণিজ্যের ছাত্র। বিপুল পড়ালেখা। ঠিকমতো খেতে হবে, সময়মতো ঘুমাতে হবে, শরীর ঠিক রাখতে যোগব্যায়াম করতে হবে, আর পরীক্ষায় নম্বর কখনো কম পাওয়া যাবে না। কবিতা লেখার পাগলামির ভেতরেও এই তিন–চারটি বিষয় তিনি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। আর মেয়েদের কাছ থেকে তো সব সময়ই থাকতেন ১০০ হাত দূরে। নেশাপানি কি, হারাম কোনো কিছুতে তিনি নেই। এমনকি সিগারেটও না। তবু এত কবিতা আসে কোথা থেকে?
তাদের কারও কারও ফর্মুলা তিনি মানার চেষ্টা করেছিলেন। যেমন একজন বলেছিল, জীবনানন্দকে ফলো করা যাবে না, বিনয়-উৎপল আর ভাস্কর চক্রবর্তী ককটেল করে কিছু একটা তৈরি করতে হবে। সঙ্গে শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদের জল মেশাতে হবে। ব্যস। তবে সবার আগে নিজের একটা কবি কবি নাম চাই।
কবি কবি নামটা কী হতে পারে এ নিয়ে দিনের পর দিন তিনি ভেবেছিলেন। যখন পেলেন, মানে মিঞা মোহাম্মদ গোলাম হোসেন থেকে তালাল হোসেন হলেন, তার কবিতা লেখার ঝোঁক কয়েক গুণ বেড়ে গেল। ভার্সিটির লেখাপড়া শেষ করেই মোটামুটি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকে চাকরি। বছর কয়েকের ভেতর বিয়েথা করে বাচ্চাকাচ্চার বাপ। দিনে অফিস। রাতে হিংস্র উদগ্র দীর্ঘস্থায়ী রতিতে স্ত্রীকে বিধ্বস্ত করে, রতিকুহর ভাসিয়ে দিয়ে বিপুল পরিমাণ রেত নয়, যেন ঘুম-সমুদ্র ঢেলে দেন। লাশের মতো পড়ে থাকা স্ত্রীর ওপর থেকে নেমে গিয়ে অতি সন্তর্পণে কবিতা লিখতে বসেন। প্রায় দিনই কোনো কবিতা শেষ অব্দি লিখে উঠতে পারেন না। কাটাকুটি হিজিবিজিই সার হয়। রাত বারোটার আগে ঘুমাতে যেতেই হবে। সকালে অফিসে এক মুহূর্ত দেরি করা যাবে না। ফলে সেদিনের মতো ক্ষান্ত হন। যেদিন লিখতে পারেন, স্বর্গীয় সুখ পান। মনে হয়, এ সুখের কাছে জগতের আর সব কিছু তুচ্ছ। তাতে মাসে তিন-চারটার বেশি হয় না। আর একটা মুশকিল হলো, যেদিন কবিতা লেখা হয়ে ওঠে, এত উত্তেজিত থাকেন যে এরপর পাণ্ডুলিপিটা কোথায় কোনো দিকে গুঁজে দেন, খেয়ালই থাকে না।
একুশের বইমেলায় একগাদা ছোটকাগজ কিনে সেগুলোর একটির ঠিকানায় কবিতা পাঠিয়েছিলেন একগুচ্ছ। দিনের পরদিন কোনো সাড়া আসেনি। তারা কিছু বলেওনি—কবিতা ছাপা হবে কি হবে না। হঠাৎ একদিন আজিজ মার্কেটে গিয়ে ওই পত্রিকার নতুন একটি সংখ্যা দেখে বিস্ময়ে হতবাক! তার প্রতিটি কবিতা ছাপা হয়েছে। দু–এক জায়গায় বানান ভুল ছিল, কিন্তু তাতে যে শব্দটা দেওয়া হয়েছে, কবিতাটি আরও জোরদার হয়েছে। সম্পাদক মনে হয় ইচ্ছা করে বসিয়েছে, নাকি ছাপার ভুলের কারণে এটা হলো, সেসব বিচার করার মতো অবস্থা তার ছিল না। তার জীবনে এমন সুখের দিন এর আগে আর আসেনি। সারা রাত সেদিন চোখের পাতায় নেমেছিল স্বপ্নের স্রোত। এর পরই তার মনে হয়েছে বই একটা করা দরকার। ৮০ পৃষ্ঠার একটি বইও বের করেন। দাম ২০০ টাকা। কেউ তার এই বইয়ের খোঁজ জানে না। তারপরও পরিচিত কেউ কেউ কিনেছিল কি না, তা–ও জানেন না। নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে বের করা বইটির বেশির ভাগ পড়ে থাকে ছাপাখানার গুদামে, আর কিছু নিজের ফ্ল্যাটে। এই একটি বই বের করেই তিনি একটু ক্লান্তি বোধ করেন। তার বইটা নিয়ে কেউ কিছু বলল না, কোনো আলোচনা হলো না, কবি হিসেবে তাকে কেউ চিনল না—এসব মনে হতে থাকে। তার পরও দমে যান না তিনি। দেখতে দেখতে আরেকটা পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে যায় তার।
ঘটনাচক্রে অফিসের একটা ট্রেনিংয়ের জন্য বিদেশে যেতে হয়। ফিরে এসে বাসাবদল। একদিন রাতে তার কবিতার পাণ্ডুলিপিটা খুঁজে পান না। না পেয়ে তিনি একটু হন্যেও হয়ে ওঠেন। কাউকে তিনি তার পাণ্ডুলিপি দেননি, ফটোকপি করে রাখেননি। তাহলে পাণ্ডুলিপিটা গেল কোথায়? বিলকুল গায়েব হয়ে গেল? বাজে কাগজ মনে করে স্ত্রী সেগুলো সেটি বেচে দিল কি না, তা–ও জিজ্ঞাসা করতে সাহস হয় না। একটু হতাশ হলেও তিনি হাল ছাড়েননি। আবার লিখতে শুরু করলেন। স্মৃতি থেকে একের পর এক কবিতা। সাদা কাগজের ওপর স্রোতের মতো ভেসে আসতে থাকে কালো কালো কবিতা। মাঝেমধ্যে বিরতিতে পড়ে দেখেন, মনে হয় এটা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।
ঠোঁটের কোণে একটা রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে তার। তাহলে তিনি পারছেন, লিখতে পারছেন, নিজেকে ফিরে পাচ্ছেন কবিতায়! তিনি বিখ্যাত হবেন কি হবেন না, কেউ তার কবিতা পড়বে কি পড়বে না, সেটাও না, তিনি স্রেফ লিখতে পারছেন কবিতা—সেটাই অনেক বড় ব্যাপার। কবিতা আর ভালোবাসাটা এদিক থেকে একই বিষয়। তিনি ভালোবাসতে পারলেন কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ; কেউ বাসল কি বাসল না, তা আর বিবেচনায় পড়ে না। আবার একদিন রাতের বেলায় নতুন এই পাণ্ডুলিপিটাও আর খুঁজে পান না। এবার একটু দমে যান।
সবচেয়ে রহস্যময় ও মারাত্মক ঘটনাটা এরপর ঘটল। কদিনের জন্য স্ত্রী বাপের বাড়িতে বেড়াতে গেছে পুত্রকন্যাসহ। বাসায় তিনি একা। ছুটির দিন। দুপুরে ঘুমিয়ে ছিলেন। মাথার কাছে একটা টুলে মোবাইলটা রাখা। দুপুরের ঘুমে তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন—ফাঁকা মাঠে বিশাল একটা খোলা বইয়ের ওপর উলঙ্গ হয়ে তিনি বসে আছেন। হাতে পানপাত্র। কিছুক্ষণ পরপর ওই মাঠে, ওই বিশাল বইয়ের পাশ ঘেঁষে, একটার পর একটা ঘোড়া দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে। ঘোড়ার ওপর একজনের কোলে পিঠ পেতে ধবধবে ফরসা দুজন নারী। দুজনই পুরো উদোম। প্রতিটি ঘোড়ায় এমন দুজন করে নারী। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তাদের সবার চেহারা হুবহু এক। তারা পাথরে বাঁধা ফুলের পর ফুল তার দিকে ছুড়ে ছুড়ে মারছে। এভাবে হতে হতে তিনি একদম ফুলে ও পাথরের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে গেছেন। শুরুতে তো একজনের নিখুঁত নিশানায়, পাথরের এক ঘাতে তার আলট্রাথিন কাচের তৈরি পানপাত্র ভেঙে চুরমার। তখন কেবল মাথাটা ঢেকে যেতে বাকি, ঢং ঢং করে প্রচণ্ড জোরে ঘণ্টা বেজে ওঠে। তিনি ধড়মড় করে জেগে ওঠেন। দেখেন, মোবাইলটা বাজছে। অচেনা নম্বর, ‘হ্যালো’, ঘুম থেকে ওঠা জড়ানো গলায় তিনি বললেন। ও–প্রান্ত থেকে সুরেলা সুকণ্ঠী এক নারী জানতে চায়,
‘তুমি কি মদ খাচ্ছ? গলা এমন!’
গোলাম হোসেন, মানে তালাল হোসেন, বললেন, ‘আপনি!’
উত্তর এল, ‘আমি কবিতা।’
‘কোন কবিতা?’
‘তুমি যাকে চাও। মানে? বাসায় তো তুমি এখন একা, তাই না?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু...।’
‘আমি আসতেছি। মানে আসছি।’
‘মানে?’
‘আমাকে একটু চেখে দেখবে। বুঝবে, তোমার বউয়ের চেয়ে আমি কয়েক শ গুণ সরেস।’
বলেই ফোনটা কেটে দেয়। তালাল হোসেনের সারা শরীর থরথর কাঁপতে থাকে। কতক্ষণ কত ঘণ্টা কত দিন কত মাস বছর কেটে গেছে তিনি জানেন না, হুঁশ ফিরলে দেখেন, তার স্ত্রী পুত্র কন্যা ব্যাকুল চাহনি নিয়ে তার দিকে ঝুঁকে আছে।
এরপর থেকে তার মাথায় আর কখনো কোনো কবিতা জেগে ওঠেনি। হারানো পাণ্ডুলিপিটার কথাও চিরতরে তার মন থেকে মুছে গেছে।