যে গল্পে আছে এক মানুষের দুই মৃত্যু

এই বইমেলায় প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তরুণ গল্পকার আনিসুর রহমানের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সিসিফাস শ্রম’। নিরীক্ষাধর্মী ভিন্ন স্বাদের এসব গল্প পাঠক সমাদৃত হয়েছে। সেই বই থেকে তুলে ধরা হলো একটি গল্প।

আনিসুর রহমান এবং তাঁর বই ‘সিসিফাস শ্রম’–এর প্রচ্ছদ অবলম্বনে কোলাজ

এপিটাফ
‘প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন—এখনো ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর ’পরে’
                       —জীবনানন্দ দাশ

জন্মের পঁচিশতম বছরে আমি মরে গেলাম। কিন্তু পরবর্তী দশ বছর পর্যন্ত আমার সত্কার হয়নি। আমিই শুধু জেনেছিলাম যে মরে গেছি। মৃত্যুর পরও এমন তরতাজা শরীর আমাকে হতাশ করে তুলেছিল। কারণ, বিবেকহীন পেটটা তখনো খেয়ে যাচ্ছিল, পা দুটো মাথায় নিয়ে ঘুরছিল একটা আস্ত শরীর। এটা সহজ চোখে একটা বিস্ময়, তাই আমাকে বলতে হবে অনেক কিছুই।

চিলের থাবা থেকে পলায়নরত ইঁদুরের হৃদপিণ্ড আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর পরেও...। আমি খোদাই করে চলেছি আমার সমাধিপ্রস্তর। ক্ষয়ে যাচ্ছে পাথর-শরীর গোটা গোটা বর্ণে; আমার জন্ম, মৃত্যু, জীবন, সময়—সবকিছু জমিয়ে রাখছি এই ক্ষয়িষ্ণু অক্ষয় পাথরে! ভবিষ্যতে প্রস্তরযুগের নিদর্শন হিসেবে এটা মূল্যায়িত হলেও অবাক হব না। একজন খোদাইশিল্পীর জন্য যা সব সময় একটা মর্যাদাপূর্ণ ব্যাপার। মৃত্যুর পরে যার অস্তিত্ব এই মুহূর্তে টিকে রয়েছে প্রস্তরবক্ষে।
আমার ভাগ্যে ঝুলছিল দুটো মৃত্যু। যার প্রথমটা একান্তই নিজের, আর দ্বিতীয়টা ছিল শরীরের। তাই সবকিছু শেষ হওয়ার পর এক দিনও সময় নষ্ট করিনি। কিন্তু শরীরের ওপর আমার হাত ছিল না। ওটা ছুটছিল পূর্বপুরুষদের একটা মহান দায়িত্ব উত্তরপুরুষের কাছে পৌঁছে দিতে।
বংশানুক্রমের পার্চমেন্ট অনুযায়ী, আমি মরে যাব এক কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে, কাশতে কাশতে, দম নিতে না পেরে। যেভাবে মরেছিলেন আমার দাদা আর পঞ্চান্ন বছরের আব্বা। এটা ছিল আগুনের মতো ক্ষমাহীন, বিশেষ দণ্ডের মতো অলঙ্ঘনীয়।

আমি ভেসে যাচ্ছি স্রোতে, একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে, বহুকাল ধরে। বংশের শেষ জীবন্ত ফসিল হিসেবে আমার কাজ হলো শীতভীতি, কাশি, কফ, হাঁপানি বয়ে বেড়ানো। একেবারে যেভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে সেগুলো আমার ওপর এসে পড়েছে এবং এমন একজনের ভেতরে এগুলোকে রেখে দেওয়া, যে পরম নিষ্ঠার সঙ্গে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরবে ভবিষ্যতের জন্য।

এই রোগগ্রস্ত স্বল্পায়ুর ক্রমবিকাশ, যেখানে পূর্বপুরুষদের একধরনের দাম্ভিকতা ছড়িয়ে রয়েছে; যদিও তাঁদের সামনে হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আধুনিক প্রতিষেধক! দম্ভের রাক্ষস আমাকেও গ্রাস করেছে, এগিয়ে যাচ্ছে একাকী, একগুঁয়ে এক দাম্ভিক ফসিল।
দাদা ছিলেন গ্রামের নামকরা কবিরাজ। আমার কাছে ছিলেন সবচেয়ে রহস্যময় ও বিভ্রান্তিকর এক বুড়ো। পাকা কলার খোসার মধ্যে তিনি পান আর সুপারি মিশিয়ে সর্বরোগের ওষুধ বানাতেন আর কলাগুলো থ্যাঁতলা করে রাখতেন তাঁর থুতুদানিতে। ফলে থ্যাঁতলানো পাকা কলার সঙ্গে পাকা কফ, যা তিনি জমিয়ে রেখেছিলেন তাঁর হাপর টানা বুকের মধ্যে বছরের পর বছর, সেগুলো যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত।

দূরদূরান্ত থেকে রোগীরা আসত তাদের রোগ নিরাময়ের আশায় হাতে কাঁদি কাঁদি পাকা কলা নিয়ে। দাদা মুখে একরাশ হাসি ধরে রেখে তুলো রাশি হাত দুটো বাড়িয়ে দিতেন কলার কাঁদিগুলোর দিকে। তারপর সেগুলোর খোসা ছাড়িয়ে থ্যাঁতলা করে রাখতেন থুতুদানিতে। আর আমি একজিব লোভ নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকতাম।

তাঁর কাপড়ের থলেটা, যেটা স্পর্শ করার সাহস ও সুযোগ আমি কখনো পাইনি, ওটা ছিল আমার একমাত্র আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু, রহস্যে ভরা আর পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থানে সুরক্ষিত। কোমরে প্যাঁচানো নাইলনের সুতোর সঙ্গে ওটা ঝুলত লুঙ্গির ভেতর, তাঁর দুই ঊরুর মধ্যবর্তী উপত্যকায়। হাঁটার সময় একটা নির্দিষ্ট বিরতি নিয়ে বিশেষ জায়গার লুঙ্গি এমনভাবে ফুলে ফুলে উঠত, যেন তাঁর বিশেষ বস্তুটি লজ্জার মাথা খেয়ে খোশমেজাজে দোল খেতে খেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমি এখন তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ‘দাদা, তোমার থলের মধ্যে কী?’ এই কটাক্ষের জবাব দিতে তিনি আমার মস্তিষ্কে নেমে আসেন বাঁশের মুড়োর লাঠিতে ভর দিয়ে, খকখক করে কাশতে কাশতে। আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুকে দুই ঊরুর ভঙ্গিল পর্বতের ভাঁজে লুকাতে লুকাতে বলেন, ‘শালো, তুমার বউয়ের ভাতারের বড়শি!’

কিন্তু আমার হৃদয় তৃপ্ত হয় না। ‘বলো দাদা, কফ মেশানো কলাগুলো কি ওটা জাগাতে পারে?’ পর্বতের ভাঁজ থেকে হঠাৎ একটা হুলো বিড়াল বেরিয়ে এসে ম্যাঁও ম্যাঁও করে, যেন জনসমক্ষে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে জাদুকরের কারসাজি।

এখন জিজ্ঞাসাবাদের চরম পর্যায়ে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে আমি পঁচিশ বছর বয়সে গ্রহণ করেছি আত্মিক মৃত্যুকে। আমার কাঁধে অর্পিত মহান দায়িত্বকে থোড়াই কেয়ার করে সম্পূর্ণ সচেতন ও সুস্থ মস্তিষ্কে অবহেলা করেছি। নিজের স্বাতন্ত্র্যের ওপর অন্যের দখলদারত্ব রুখতে স্বেচ্ছামৃত্যুর মাধ্যমে, আরও পরিষ্কারভাবে বললে, নিজ স্বার্থে কয়েক প্রজন্ম ধরে চলে আসা একটা সম্ভ্রান্ত প্রবাহকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করেছি।

জাদুকর উত্তর দেন না, হাতড়ে বেড়ান জাদুর থলেটা, আর শুধু কাশতে কাশতে সম্ভ্রম বাঁচানোর চেষ্টা করেন। একসময় অবশ্য জানতে পেরেছিলাম, কফ মেশানো ওই কলাগুলো নাকি পুরুষের যৌন দুর্বলতার অব্যর্থ ওষুধ! আমি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে জাদুকরের মাটিতে লুটিয়ে পড়া লুঙ্গি তুলে কোমরে পেঁচিয়ে দিয়ে শেষরক্ষা করি।

‘জাদুকর, তোমার হাত কি সত্যিই একা একা চলে?’ আমার মস্তিষ্কবিকৃত ফুপু আমার মাথার ঘন জঙ্গল ভেদ করে কপালের ওপর আছড়ে পড়ে, ‘আব্বা রে, সাপে কামড় দেছে গো।’ জাদুকর ঘাবড়ে যান। তিনি বাঁশের লাঠিতে ভর দিয়ে পাছাটাকে ঊর্ধ্বমুখী আর ওজনহীন করে বেরিয়ে আসেন আমার নাকের ফুটো দিয়ে। দেখতে থাকি তিনি হাঁপাচ্ছেন, তাঁর তুলো রাশি হাত সরসর করে উঠে যাচ্ছে ফুপুর শরীরে।
জাদুকর দম ধরে আছেন..., থলের ভেতর থেকে বের করে আনছেন বিচিত্র সব মাদুলি আর বহু ঠ্যাংবিশিষ্ট শিকড়-বাকড়। ফুপুর মুখ থেকে সাদা সাদা ফেনা পড়ছে আমার চোখের ওপর। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আমি, তবে বুঝতে পারছি, জাদুকর অক্সিজেনশূন্যতায় খাবি খাচ্ছেন...। কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি বাবা ও মেয়ের মৃতদেহের চারপাশে।

আমার সমাধিপ্রস্তর ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে ইতিহাসের মধ্যে। আমার আর বসার সময় নেই। সার্কাস প্যান্ডেলটা এতক্ষণে ভরে উঠেছে হাজারো দর্শকে।

অতিকায় হাতিটা একটা ছড়ির ইশারায় অসহায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। দড়ির ওপর দিয়ে বুকে ভয় আর মুখে কৌতুক ফুটিয়ে হেঁটে যাচ্ছে খর্বকায় জোকারগুলো। ঘূর্ণায়মান চাকায় হাত-পা বাঁধা তরুণীটা একাধারে ভয়ার্ত ও কামার্ত চিত্কার করছে, যার বুকের দুটো পর্বত জরি কাপড়ে ঢাকা। ধারালো ছুরিগুলো বিঁধছে তার শরীরের চারপাশে চাকার বিভিন্ন অংশে।

পাশের আসনের যুবকটা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আমার কাঁধে হাত রেখে চিত্কার জুড়ে দিয়েছে উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে, ‘বাড়ার মাথা, আরেট্টু হলি ছুরিডা ঢুকে যেতু বুকের মদ্দিরে!’ আমিও তার কাঁধে হাত রাখি, কিন্তু কোনো উত্তর দিই না। আমরা অনুভব করি নিজেদের হৃদপিণ্ডের অস্থিরতাকে। আমাদের শরীরের তাপমাত্রা বয়ে যায় একই ফারেনহাইটে। কিন্তু সময় বড় পরসুখে কাতর, যে তিন যুগের ব্যবধান গড়ে দিয়ে আমাদের পরিণত করবে পিতা ও পুত্রে। আমি বিস্ময়-চোখে তাকিয়ে থাকি শার্ট খোলা, উত্তেজিত, দৃঢ় বুকের আব্বার দিকে, যেখানে বাস্তবের দাড়ি, পাঞ্জাবি আর দূরত্ব নেই।

আব্বা ছিলেন একেবারে নীরস। সামাজিক ‘আব্বা’ বাস্তবতার আদর্শ উদাহরণকে তিনি ধারণ করেছিলেন। চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে তাঁকে আব্বা বলে ডাকত। তিনি বিয়ে করেছিলেন আমার মাকে একটা দুধওয়ালা গাই ও দুই বিঘা জমিসহ।

আব্বা দাদার মতো বয়ে বেড়াতেন হাঁপানি আর শীতভীতি। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ছিল অনেকটা সমান্তরাল রেখার মতো। ফলে খুব পাশাপাশি থাকা সত্ত্বেও কোনো পক্ষই সেই দূরত্ব কখনোই অতিক্রম করতে পারেনি।

গোঁফ-দাড়ি গজাতে শুরু করার পর, আমার সঙ্গে আব্বার দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল আরও বেশি। প্রথমবার দাড়ি কামিয়ে, তেলাপিয়া মাছের মতো মুখ নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়ানোর পর বুঝেছিলাম, এখন তিনি গরুকে আদর করেন, গাছ লাগান আর মাছ পোষেন।
আমার সার্কাসভক্ত আব্বা ছেলেমেয়ের গা থেকে বাচ্চা শব্দটা উঠে যাওয়ার পর গভীর শূন্যতায় পতিত হয়েছিলেন। আর সেই শূন্যতার ক্যাথারসিস তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল গরু, গাছ আর মাছের কাছে।
তিনি খৈল, কুঁড়া, বিচালি মাখিয়ে গরুটাকে খাওয়াচ্ছেন, গোসল করাচ্ছেন, গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, মাছি তাড়াচ্ছেন...। আর সামনে যোজন দূরত্ব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার ফুটফুটে বাচ্চারা বীভত্স লম্বা লম্বা ‘ব্যাটা’ হয়ে!

আব্বা মরার আগের দিন থেকে পুকুরের মাছগুলো মরে ভেসে উঠতে শুরু করেছিল। সেবারের শীতের কথা মনে আছে। জানুয়ারির মাঝামাঝি ১০-১২ দিন টানা সূর্যের দেখা ছিল না। কুয়াশা আর শীতের প্রকোপে লেপ-কাঁথাকেও মনে হতো যেন আস্ত বরফের চাকতি। বেঁচে থাকার সহজাত লড়াইয়ে শরীর ঠকঠক করে কাঁপত, কিন্তু ভেতরটা গরম হতো না।

শীতের দিনে প্রায়ই আব্বা শরীর গরম রাখার জন্য সালসা জাতীয় একধরনের সিরাপ খেতেন। ঢাউস সিরাপের বোতলের গায়ে, সাদা স্লিপে বড় ফন্টে গাঢ় কালো কালিতে লেখা থাকত, ‘বিদ্যুৎ সালসা: ইহা তাপ, শক্তি ও বীর্যবর্ধক!’

তাই এমন কনকনে শীতে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন পানিতে ঝিম মেরে থাকা মাছগুলোর জন্য। বাজার তন্ন তন্ন করে এনেছিলেন পানির তাপবর্ধক ওষুধ! মাছগুলো মরে ভেসে উঠছিল একটার পর একটা, যেন গরম বালির ভেতর থেকে হঠাৎ খই ফুটতে শুরু করেছে। আব্বাকে এমন শোকাচ্ছন্ন দেখিনি কখনো। তিনি গভীর রাত পর্যন্ত নিজেকে চাদরে মুড়ে পায়চারি করে গেলেন ধনুক-বাঁকা শরীর নিয়ে।
মৃত্যুর সময় ছেলেমেয়েরা তাঁর পাশেই ছিল দাঁড়িয়ে। তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না। প্রচণ্ড গরম লাগছে তাঁর। ঘামে ভিজে গেছে সমস্ত শরীর। মুখটা ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে। তিনি কী যেন বলার চেষ্টা করছেন। চুন...পানি...মাছ...। তাঁর শেষ অস্পষ্ট শব্দগুলো থেকে ছেলেমেয়েরা মনোযোগ দিয়ে শিখছে পানি বিশুদ্ধকরণ প্রণালি!

প্রত্যেক শীতের রাতে একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ঘুমোতে যেতাম। যেন এ জন্যই আমি জন্মেছিলাম। জন্মের আগেই আমাকে বাছাই করা হয়েছিল। বিগত পুরুষেরা তাকিয়ে ছিল আমার সফলতার দিকে। তাই রাতগুলোতে প্রস্তুতি থাকত নিরেট। চমত্কার একটা নৈশভোজ সারতাম বিবেকহীন পেটকে ফাঁকি দিতে। অন্ধকার আর ঠান্ডাকে জেঁকে বসতে দিতাম বুকের ওপর। জীবনের সবকিছু ফালি ফালি করে কাটতাম যতক্ষণ না সেটা শূন্যে পৌঁছায়। নিজেকে মনে হতো একটুকরো মেঘ, যে ঘনত্বের অভাবে ফাঁপা, অথচ দারুণ সাদা হয়ে দিগ্বিদিক ছুটছে কিংবা সুন্দরভাবে বলতে গেলে ভেসে বেড়াচ্ছে।
তারপর আমার মস্তিষ্কে পাকা কফ ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলত। অক্ষম হাপরটা ব্যর্থ হতো লাঙল পোড়ানোর মতো বাতাস টানতে। কাঁদি কাঁদি কলা ঝুলত চোখের পাতায়। স্পর্শকাতর দাঁতগুলো খুলে পড়ত ঝরঝর করে। আর মাছগুলো ঠোকর দিয়ে ছিঁড়ত আমার সমস্ত শরীর।

দেখতে পেতাম বিছানা থেকে একটা হলুদ রঙের পথ বয়ে চলে গেছে ডাকুয়ার বিল পেরিয়ে কিংবা সেটা আদৌ হয়তো কোনো বিল ছিল না। দেখতাম, একটা বয়স্ক জীর্ণ হাত ইশারায় আমাকে ডাকছে। এগিয়ে যেতাম ওই হাতকে অনুসরণ করে, কিন্তু যখন পথের সামনের সেই পিতরাজ গাছটা আমার পথ আটকাত, যার তলায় হাঁটতে শিখেছিলাম ওর তেতো, কিন্তু ভীষণ লাল ফল খেতে খেতে, তখন বুঝতাম, পরের সকালটা আমাকে নৃশংসভাবে হতাশ করবে।

আমার মা ছিল একটা দুধপাগল মেয়ে। তার বিয়ে হয়েছিল এমন এক পরিবারে, যেখানে জীবন ছিল অনেকটা যাযাবরের মতো। যেন জীবন আর সময় আলাদা দিকে ছুটত সেখানে। পৃথিবীর এক অন্ধকার কোণে বসে পরিবারটা তত দিনে দুটো পাগল আর একটা ভবঘুরে জন্ম দিয়েছে।

প্রথম যেদিন মা এ পরিবারে এসেছিল, তখন একপাশে ছিল তার অপরিচিত স্বামী এবং আরেক পাশে চিরপরিচিত দুধেল গাইটা। আমার দাদি নতুন পুত্রবধূর ঘোমটা দেওয়া মুখ দেখার আগেই ছুটে গিয়েছিল গাইটার কাছে। তারপর গাইয়ের মুখের মধ্যে আঙুল পুরে দিয়ে দাঁত গুনতে গুনতে একটা হইচই বাধিয়ে দিয়েছিল। ‘এ তো দেখচি আশি বচরের বুড়ি!’
কথাটা এমনভাবে প্রচার হলো যে গ্রামের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ল গাইটার ওপর। ‘একটা বুড়ি মাগি কীভাবে পাঁচ কেজি করে দুধ দেয়!’

দাদি যখন গাইয়ের পেটের তলায় বসে শর্ষের তেল দিয়ে ওলানটা প্রস্তুত করত, তখন ভিড় জমে যেত চারপাশে। দাদির অত্যাচারী আঙুলের চাপে শর্ষের তেলে চোবানো ওলান থেকে ধবধবে সাদা দুধ ঝরে পড়ত আর ভরিয়ে তুলত বালতিটাকে।
মাকে জীবনটা কাটিয়ে দিতে হয়েছিল একজন সার্কাসভক্ত ও সালসাসক্ত পুরুষের সঙ্গে। তাদের দাম্পত্য সুখ-দুঃখ নির্ভর করত এক বোতল সালসার কর্মশক্তির ওপর। কিন্তু আমি তো এখানে এ বিষয়ে সব কথা খোলাসা করে বলে দেব না।

জন্মের বছর সাতেকের মধ্যে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল আমার ওপর। আমি বেড়ে উঠছিলাম বাতাসের মধ্যে। বাতাসের ঘোলে পড়ে যেন উড়ে যাচ্ছিলাম ব্যস্ত শৈশবে। ওই সময় থেকে আমার বয়সের চেয়ে জীবন বাড়তে শুরু করেছিল। নিছক সাদামাটা দিনগুলোতে অনেক কিছুই ঘটে যেত তখন।
আমার পা দুটো তখন ছিল শিকলমুক্ত পাখি। আমার রুচি তখন পাকা গাব, খেজুরের রস আর শাপলার ঢ্যাপে। আমার স্বপ্ন তখন খোলা মাঠ, দমকা বাতাস আর উড়ন্ত ঘুড়ির অস্থিরতাকে ঘিরে। আমার ভালোবাসা তখন চুঁইশালিকের বাচ্চার চিকন, নরম, হলুদ, ক্ষুধার্ত ঠোঁটে। আমার বেদনা তখন পায়ের নিচের পচা শামুক আর বাবলা কাঁটায়।

বাড়ির সামনে একটা চমত্কার বিস্তীর্ণ মাঠ ছিল। বলতে গেলে শুধু আমার কাছেই চমত্কার লাগত। কেননা, মাঠটাকে সারা বছর গালিগালাজ শুনতে হতো। মাঠের চারপাশে বাড়িগুলো এমনভাবে বেড়ে চলেছিল, যেন সেটা এক গভীর ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়েছে। তাই সারা বছর মাঠটাও তাণ্ডব চালাত গ্রামের ওপর। পাটের মৌসুমে শুঁয়োপোকায় ছেয়ে যেত সমস্ত গ্রাম। লক্ষ লক্ষ শুঁয়োপোকার পেলব তরঙ্গে তখন গ্রামটা যেন ভাসত। আবার ফসল কাটার পর ধুলোয় অন্ধকার হয়ে যেত সবকিছু। তখন যেন কাউকেই আলাদা করে চেনা যেত না। আর গরমের রাতগুলোতে, যখন সবাই ক্লান্তি আর বিরক্তি নিয়ে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ত, তখন কেন্নোর দল তাদের কানের শীতল গোলকধাঁধায় হাই তুলত শুয়ে শুয়ে।

আমার বয়স এখন পঁয়ত্রিশ এবং খুব শিগগির দশম মৃত্যুবার্ষিক পালন করব। তাই দ্রুতই শেষ করতে হবে এই প্রস্তরলিখন। আমার ফুসফুস সংগ্রাম করছে বাতাসের সঙ্গে। গলা দিয়ে বের হতে শুরু করেছে হলুদ রক্তিম দুর্গন্ধযুক্ত কফ আর পূর্বাভাস পাচ্ছি শতাব্দীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রার। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, আমি হয়ে পড়েছি সন্দেহমুক্ত।

তাই এখন প্রথম মৃত্যুর বিষয়টা ভেঙে বলার সময় এসেছে, যেখানে আমার ভূমিকা ছিল একজন ডাক্তারের। যে সব পরীক্ষা শেষে স্বাক্ষর করেছিল মৃত্যুসনদে। সেখানে তার পর্যবেক্ষণ ছিল, ‘অ্যাবসেন্স অব হোপ, মিসিং অব ড্রিম, মিনিংলেসনেস অব লাইফ অ্যান্ড হেরিডিটি সেনট্রিক প্রেসার।’ এবং পরের কয়েকটি শব্দ, যেগুলো আগে থেকেই সব মৃত্যুসনদে প্রিন্টেড ভার্সনে থাকে, ‘সকল পরীক্ষা সম্পন্ন করিয়া ব্যক্তিকে (২৫) মৃত বলিয়া ঘোষণা করিতেছি।’

আমার জীবন থেমে গেল পঁচিশ বছরে। গ্রাস করল অর্থহীনতা, জীবনের প্রতি অনাগ্রহ আমাকে করল মন্থর। শৈশব-কৈশোরের কুমির টেনে নিয়ে যেতে লাগল গভীর জলে। সময় প্রতিদিন এগিয়ে নিয়ে চলল গতকাল, গত পরশু, গত মাস, গত বছরের পথে।
মায়ের মুখের আঁচিলটা দেখতে দেখতে দৃশ্যমান হলো আমার মুখে। আব্বার ক্যাঙারুর মতো লাফিয়ে হাঁটার ছন্দটা অজান্তেই অনুসরণ করতে শুরু করল পা দুটো। পশ্চাদ্দেশে অনুভব করতে লাগলাম একটা শক্ত গোল মাংসপিণ্ড। দাদা যেটাকে বলতেন ‘বান্দরের লেজ’। ওটার পীড়ায় তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়খানায় ব্যয় করত।

এ রকম একটা পরিস্থিতিতে, যখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার সবকিছু থেমে গেছে, আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি নিজের ওপর। আমাকে চালিত করছে বিগত ধুলোকণা। শরীরের বিভিন্ন অংশ যাচ্ছে প্রতিস্থাপিত হয়ে। আর আমি ক্রমশ যাচ্ছি পিছিয়ে...। তাই সবকিছু শেষ হওয়ার পরে আমি ঘোষণা করেছি আমার আত্মিক মৃত্যুকে।

শতাব্দীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পূর্বাভাসে, অতীতের ষড়যন্ত্রের গিনিপিগ হিসেবে আমি কামড়ে ধরেছি এই প্রস্তরখণ্ড। চাটছি এর লোনা স্বাদ, মুখের লালায় ভিজিয়ে ভিজিয়ে গড়ে তুলছি একান্ত সখ্য। কিন্তু আমাকে এখন কিছু স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। কারণ, অভিযোগের তীক্ষ� তির ধেয়ে আসছে আমার দিকে। আব্বা তিরের আগা শান দিচ্ছেন, দাদা ধনুকের ছিলাটা বেঁধে নিচ্ছেন, দাদার আব্বা মনোযোগ দিয়ে মেপে নিচ্ছেন লক্ষ্যবস্তু ও তার মধ্যকার দূরত্ব। কারণ, বিশ্বস্ত বাহক হয়ে গেছে গুপ্তঘাতক! মহান দায়িত্বের একজন নির্বাচিত দূত হিসেবে আমার অবশ্যপালনীয় হলো ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সবকিছু বয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সংবিধানের অলিখিত, অথচ অলঙ্ঘনীয় অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পরবর্তী প্রজন্মের একজন যোগ্য বাহকের হাতে এগুলো তুলে দেওয়া।

এখন জিজ্ঞাসাবাদের চরম পর্যায়ে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে আমি পঁচিশ বছর বয়সে গ্রহণ করেছি আত্মিক মৃত্যুকে। আমার কাঁধে অর্পিত মহান দায়িত্বকে থোড়াই কেয়ার করে সম্পূর্ণ সচেতন ও সুস্থ মস্তিষ্কে অবহেলা করেছি। নিজের স্বাতন্ত্র্যের ওপর অন্যের দখলদারত্ব রুখতে স্বেচ্ছামৃত্যুর মাধ্যমে, আরও পরিষ্কারভাবে বললে, নিজ স্বার্থে কয়েক প্রজন্ম ধরে চলে আসা একটা সম্ভ্রান্ত প্রবাহকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করেছি। যার রয়েছে একটা বর্ণাঢ্য ঐতিহাসিক ও সামাজিক তাত্পর্য। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংবিধানের অলঙ্ঘনীয় অনুচ্ছেদ করেছি লঙ্ঘন। আমি সৃষ্টি করিনি ভবিষ্যতের কোনো বাহক। আমি প্রতারণা করেছি আমার প্রপিতামহের সঙ্গে। আমি অসম্মান করেছি দাদাকে। আমি ধ্বংস করেছি আব্বার স্বপ্নকে। আমি অসুখী করেছি আমার মাকে।

আর এখন আমার পূর্ববর্তী পারিবারিক সদস্যদের নিয়ে গঠিত চার সদস্যের বিচারিক বেঞ্চে রায় ঘোষণার সময় এসেছে।
পিতার রায়: দোষী। মন্তব্য: ‘এমন সন্তানের পিতা হওয়া আমার জন্য অত্যন্ত কলঙ্কজনক। বংশের পূর্বপুরুষগণের সামনে সে আমার সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। আমার আর মুখ দেখানোর উপায় নেই। একজন আশাহত পিতা হিসেবে আমি আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করছি।’
পিতামহের রায়: দোষী। মন্তব্য: ‘আসামি একটা সম্ভ্রান্ত বংশের বিধান লঙ্ঘন করেছে। আমার মূল্যবান থলে নিয়ে করেছে জঘন্য উপহাস। বিশেষ ক্ষমতাকে করেছে সন্দেহ। সবচেয়ে বড় কথা, আসামির পশ্চাদ্দেশে আমার দেওয়া উপহার ‘বান্দরের লেজ’ সে ডাক্তারের কাছে গিয়ে কেটে ফেলেছে। বংশের গৌরবসূচক চিহ্নকে করেছে অপমানিত। তাই কঠোর শাস্তি ভিন্ন কোনো পথ নেই।’
মাতার রায় (ঘোমটা একহাত টেনে ওজনদার বিচারকদের কঠোর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে): দোষী। মন্তব্য: ‘বয়স অল্প। এখনো ছেলেমানুষি ছাড়তে পারেনি। না বুঝে একটা বড় ভুল করে ফেলেছে। আপনারা বুজুর্গ মানুষ, চাইলেই একটা মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিতে পারেন।’

প্রপিতামহের রায়: দোষী। মন্তব্য: ‘সকল বিচারকের পর্যবেক্ষণে আসামি দোষী প্রমাণিত হইয়াছে। প্রধান বিচারক হিসাবে আমার পর্যবেক্ষণও তাহাই। বিচারের আনুষ্ঠানিকতা অনুযায়ী এই রায়ের বিষয়ে আসামির কিছু বলার আছে কি না জানা দরকার।’
আসামি মুখে একরাশ হাসি ছড়িয়ে বলল: ‘দোষী!’
আমি আমার সমাধিপ্রস্তর লিখনের একেবারে শেষ অংশে রয়েছি। খোদাই কর্ম প্রায় শেষ। এখন এটার সৌন্দর্যবর্ধনের শেষ আঁচড় হিসেবে চূড়ান্ত রায়টা খোদাই করে যাব।
‘সকল সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আসামি দোষী সাব্যস্ত হইয়াছে। তাহার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ আসামি স্বয়ং নিজের মুখে স্বীকার করিয়াছে। তাই কাজী বংশের ধারা অনুযায়ী, আসন্ন শীতের কোনো এক কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে আসামির মৃত্যুদণ্ড ধার্য করা হইল!’

প্রথমা প্রকাশন প্রকাশিত ‘সিসিফাস শ্রম’–এর প্রচ্ছদ

সিসিফাস শ্রম
আনিসুর রহমান
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০২৪
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
দাম: ২৫০ টাকা।

বইমেলায় বইটি পাওয়া যাচ্ছে প্রথমার ৫ নং প্যাভিলিয়নে।
ঘরে বসে বইটি পেতে অর্ডার করুন: prothoma.com