বাপ
ছেলেটার ভবিষ্যৎ দারিদ্র্য, মাতৃহীনতা, ছেঁড়া-ময়লা শার্ট-প্যান্ট, এক চোখের দৃষ্টিশক্তিহীনতা এবং অশেষ কালের তার এই পিতৃত্বদানের আকুলতা ছাড়া আর সব অপহরণ করেছে নয়, বলি লুট করে নিয়ে গেছে বাঞ্চোৎ গর্কি। হতচ্ছাড়া টাইফুন। ওর দেশ ছিল ভোলার দিকে। আর বাড়ি বলতে যদি বোঝায়, সহায়–সম্পদহীন অনাহার মাখানো খড়ের ঘর, ভাঙা কুলোয় ছাই মাখানো উঠান, তবে তা–ও ছিল। বাড়ি ছিল, কিন্তু বাড়ি এখন নেই। বাড়ি নেই, মা নেই, বোন নেই। কেউ নেই বলেই ওর এখন সর্বত্র যাতায়াত। গর্কির কাল থেকে কোনোমতে কোনো অলৌকিক শক্তিবলে বেঁচে গিয়েছিল ও, কেমন করে কেউ জানে না। শুধু জানে ছেলেটাকে পুরো নামে ডাকতে হয়। খুব ধীরেসুস্থে ওকে ডেকে তবে লঞ্চের ক্যানটিন থেকে চা-বিস্কুট আনাতে হয়। সারেং সাহেব যখন ওকে ডাকে, তখন নামটা বেশ কানে এসে লেগে থাকে। জনস্রোতের সঙ্গে নামের স্রোত মিশে একাকার হয়ে বিরাট নদী হয়ে যায়। লঞ্চ দুলতে থাকে পদ্মায়। আর ওর হাতে দোলে চায়ের কাপ, সিগ্রেটের দেশলাই, পান, চুন ইত্যাদি ইত্যাদি। যাত্রীদের মাথার নিচে রোদের কণার মধ্যে ওর আঙুলও দোলে। চায়ের ধোঁয়া ওড়ে। আর দূর পেছন থেকে অন্য একজন লঞ্চের সুকানি হয়তো ডেকে ওঠে খুব সাফসোফ গলায়—গোলাম আলী, সারেং ভাই ডাকছে গো তোমাকে।
গোলাম আলীকে তখন আর কেউ ডেকেও পায় না।
ওর স্বভাব ও রকম। লঞ্চের সারেং ওকে দেখেছিল লঞ্চঘাটে। বরিশালের আইডব্লিউটি টার্মিনালে। গলার নিচে কাঁধের ওপর কাটা ঘায়ের মতো কী দেখা যাচ্ছিল ওর। পাছা চুলকে চুলকে এক ভিখিরির বাসন থেকে চুরি করছিল পয়সা। সারেং চুরুট কিনতে এসেছিল টার্মিনালে। ১২/১৩ বছরের ছেলেটা, একটা চোখ কানা। বাঁ চোখটা ট্যারা। পেছন থেকে এসে বলছিল অকস্মাৎ ওকে ভয় পাইয়ে দিয়ে, কী মিয়া, খবর কী? এমন প্রশ্নে ও ভীত হয়নি। যেন ওটা ওর অধিকার। পয়সা নেই। খেতে পায় না। বিদেশের সেই হাসপাতালটা ওকে ছেড়ে চলে গেছে। রিলিফ পায় না তেমন। ও একফাঁকে চলে এসেছে বরিশালে। চোখের অন্ধত্ব নিয়ে। বাপের খোঁজে। মা নেই। বোন নেই। কেউ নেই। বাড়িঘর নেই। একা একা কী করে বেঁচে গেছে ক্ষত নিয়ে, নিঃস্বতা নিয়ে ও কিছু জানে না। ও শুধু জানে, ও ক্ষুধার্ত। অনেকজনের কাছে হাত পাততে গিয়েছিল। হাত ওঠেনি। একপুকুরে গোসল করতে গিয়েছিল, ওর গলায় ঘা, গায়ে ক্ষত দেখে পুকুরের আসল মালিক ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। শহরের সব মানুষ কি অমানুষ! দয়া নেই। মায়া নেই। ওর বাবার মতো ক্ষমা নেই কারও চোখে। ও তাই এই পথ বেছে নিয়েছে। জোর করে মাঝে মাঝে ওর চেয়ে দুর্বল ভিখিরি, পথের লোক ইত্যাদির কাছ থেকে পয়সা ছিনিয়ে নেয়। টার্মিনালে রাত কাটায়। গত দিন জ্বর এসেছিল। জ্বর এলেই মা–বাবার কথা মনে পড়ে।
তখন মুখ থেকে যত্তসব গ্রাম্য গালি বেরোতে থাকে। হারামির পুতরা সব লইয়া গেছে। বাবাগরেও। নিজের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সারেংয়ের প্রশ্নের উত্তর দেয় ও—খাই নাই। আমি চাইয়া খাইতি পারি না। তাই লইতাছি।
: তা চুরি কইরা?
: করুম না! খিদা লাগছে। খিদার মাইনষের মুখ দেইখ্যা তো মানুষ পয়সা দেয় না।
: চল, কাম করবি।
: কিয়ের কাম?
: লঞ্চের কাম। করবি?
সেই থেকে ও এই লঞ্চে। ক্যানটিনের বয়–বেয়ারার কাজকাম করে। এক মাসের ভেতর নদীতে থাকতে থাকতে হাওয়া–বাতাসে চেহারাটা খোলতাই হয়েছে। বোঝা যায় না, গর্কিতে ওর সব আত্মীয়স্বজন, মা-বাপ, সহায়-সম্পত্তি উধাও।
আর তা ছাড়া কোথায় কী ছিল, অতটা বুঝে নেওয়ার বয়স ওর এখনো হয়নি। একমাত্র ওর মনে আছে বাড়ির কথা। বাড়ির কাছে নতুন রাস্তা হয়েছিল। পাকা রাস্তা সরু, পাতলা কতকগুলো হিবিজিবি মানুষ—যাদের সবার নাম ওর মনে রাখাটা কোনো দিনই কুলিয়ে ওঠেনি। ও লেখাপড়া করত না। করার ইচ্ছা ছিল। পয়সার অভাবে কুলিয়ে ওঠেনি। বরং পড়াশোনার বদলে করেছে বাবার সঙ্গে বাজারে বাজারে তেল, নুন, মরিচ, আদা, কাঁচকলার ব্যবসা। একঝুড়ি কাঁচা মরিচ দূর গ্রাম থেকে কিনে এনে গঞ্জে বিক্রি করে এনেছে এক বোতল কেরোসিন তেল, চাল, ডাল, কখানা হলুদ, মাছ, মসলা ইত্যাদি। ঘরে মা, কালো রঙের নাকটা একটু চোখা, চোখ ছোট্ট—বোন, বেশ স্বাস্থ্য ভালো, শ্যামবর্ণের, তাজা মুখের বয়স্কা মেয়ে আর বাবা প্রায় বুড়ো—এই ছিল তার জগৎ–সংসার, যাকে মানুষে এখনো নামকরণ করে দিয়ে বলে ‘গাইরস্তি’।
একেক সময় যখন লঞ্চ গোঁ গোঁ করে, গোঁয়ার নদীর সাথে ঝগড়া করা ঢেউগুলোর শোঁ শোঁ শুরু হয়, তখন সেই আপন একাকী অন্ধকারের মানুষগুলো—মুখগুলো গোলাম আলীর চোখে অশ্রুবিন্দুর মতো লেগে থাকে। ছেঁড়া–ময়লা শার্ট–প্যান্ট, কোঁকড়া একস্তূপ ধূসর চুলের মতো সারা রাত সে জেগে থাকে। কথা বলে না। সুকানিরা নাক ডাকে। তার সাথের সেই আরেকজন বেয়ারা আজিজের লুঙ্গির ওপর ঘুমের বাতাস এসে হুহু করে, আর গোলাম আলী নদীর ওপর দিয়ে চোখ ফিরিয়ে আনে—যাত্রীদের মুখ; লন্ঠনের আলোর নিচে মানুষের মুখগুলো—খোঁজ করে দেখে সেই বুড়োকে দেখা যায় কি না। ‘লেডিস কম্পার্টমেন্ট’ বড় করে লেখা—ও লেখাপড়া জানে না, কিন্তু নামটা মুখস্থ, রুমটাও—হঠাৎ সেখানে গলা উঁচিয়ে খোঁজ করে বোনটাকে কি কেউ বাঁচিয়ে নিয়ে কোথাও চলে যাচ্ছে কি না।
কিন্তু কত রাত কত দিন শুধু সেই একই জল, একই নদী, একই গোঁয়ারমুখী ঢেউ—গোঁ গোঁ করে লঞ্চ—সুকানিরা হাসি–মশকরা করে—সারেং মিয়া ডাকে, গোলাম আলী—স্পষ্ট—মিত ঘটনাস্রোত—নদী-স্রোতের মতো উজানে যায়—ভাটায় আসে—বাবা খোঁজার তবু তার শেষ হয় না। মানুষের উজান–ভাটা—যাতায়াত—লন্ঠনের আলোর নিচে সম্পন্ন হয়—বাবাকে খোঁজা শেষ হয় না—
তখন কী রকম লাগে তার! ভালো ছিল সে—টার্মিনালে। ধ্যাত্তেরি। পাছার চুলকানিতে হাত ঘষে সেই ভিখারির কুঁজো পিঠ গলগণ্ডটা চিন্তা করতে চেষ্টা করে। এত লোক ভিক্ষা করে। ভদ্দরলোক চলে–ফেরে। টার্মিনালে একটি মাফলার জড়ানো কুলি তার বোনের মতো এক যুবতী ভিখিরিকে চোখ মেরে দিয়ে বলেছিল—কী রে মাগি অইবো?
‘মাগি’ শব্দটা হঠাৎ তার মনে হতে ভয়ে চমকে ওঠে গোলাম আলীর গলা। বোনটা-বাবাটা-মা–টা—সবাই একেকজন এ রকম হয়ে গেল নাকি; কেউ মাগি—কেউ ভিখিরি...?
গ্রামের যারা মানুষ, দয়ার মানুষগুলো তাদের মতন কাউকে সে লঞ্চের ভেতর খুঁজে খুঁজে বেড়ায়। সেই সব লোকের একজনও কি শহরে আসে না? ঢাকায় যায় না? তাদের সেই গ্রামের পলাশগাছ, শিমুল তুলো, কই–চিতল–শিং মাছের জলাভূমিবেষ্টিত অঞ্চলের মাটির রঙের মতো মাটি—সে তো কত ইস্টিশনে নামল। মাটির রং কত রকম। গোলাম আলী দীর্ঘশ্বাস তুলে স্মৃতিতে আবার হারিয়ে যায়। শেষ কালে কিনা গর্কি, শালা বাঞ্চোৎ গর্কি—তাদের গ্রামের ইজ্জত আলীর চেয়ে, আইয়ুব খানের চেয়ে হারামি—বাজারের যারা তাকে বাস্টার্ড বেজন্মা বলত, তাদের চেয়ে খারাপ এই বেজন্মা গর্কি এসে কিনা বোনটাকে কোথায় ভাসাইয়া লইয়া গেল। হা, মা-ডা কোন জায়গায় মইরা রইছে কে কইতে পারে।
আমি কি আর বাঁচতাম। ভোরবেলা উইঠা দেহি একজাগায় পইড়া আছি। অনেকগুলোন মরা মানুষ। একটা গাই গরু মইরা আছে—জিহ্বাডা হাতখানেক অইয়া গেইছে… একটা মাইয়া মানষির অর্ধেক কিসের মতন বোঝা যায় না। আমার চোখডায় দেখতি পারি না। এক চক্ষু দিয়া কী দেখলাম। কী রকম জায়গা রে বাবা কোনো জনমেও দেহি নাই।
গা জাড় করছিল। রেডিও নাই। বাজার নাই। আমাগো সেই শ্যামলা বোনডা নাই। চায়ের দোকানডা নাই। একটা উটকোমুখো ওপরে ওড়া জাহাজ। নামল কয়ডা সাব আর মেমসাব। একটা তাঁবু। আমার চোখটা কেমন ঝাপসা অইয়া গেইসোলোরে বাবা, ইশ!
একসময় দেখি, সাদা কাপড় কোটের মতো পরনে একজন তার বোনের মতো মেয়ে। তার চোখে কী মাখিয়ে দিল।
এক চোখে সে আর দেখতে পারে না। সেই চোখটা ব্যান্ডেজ করা। পরে জেনেছে হাসপাতালে ছিল সে। ভ্রাম্যমাণ বিদেশি হাসপাতাল। যে মেয়েটা তার চোখের ব্যান্ডেজ খুলে দিয়েছিল, তার সেই মুখ, তার নরম হাত এখনো তার চোখেমুখে, সারা গায়ে গতরে হাত দিয়ে স্পর্শ করলে গোলাম আলী যেন টের পায়।
কী একটা সাদা নরম হাত রে বাবা। কেমন সাদা। কী সুগন্ধি তার আঙুলগুলায়।
গোলাম আলী এখন সেই সব কথা যখন মেজাজ ভালো থাকে তখনই বলে ওঠে। তার মতে লঞ্চের সারেং ভাই, সেই মেয়েটা আর তার বাবা—এই তিনজনই হলো পৃথিবীতে তার আপনজন। লঞ্চের সারেং যে তাকে লঞ্চের চাকরিটা জুটিয়ে দিয়েছে, এ জন্য ও সব দুঃখের মধ্যেও কম সন্তুষ্ট নয়। ভালো লাগে। মাঝে মাঝে কেউ যদি বলে, এই ছোকরা...ও তাড়াতাড়ি থামিয়ে দেয়; বলে, স্যার, আমার নাম গোলাম আলী। অ্যাই তোর চোখের ভেতর কী হয়েছিল? তখনো পূর্বোক্ত সব ঘটনা বলে যায়। বলতে বলতে আর বলে না—মা নাই, বাবা নাই, বোন নাই। হঠাৎ সে চলে যায়…কেবিনে গিয়ে একটানা ঢেউয়ের আলুথালু ভাঙা শব্দ শোনে তো শোনে…ধারাবাহিক…যেন কোথাও শান্তি নেই—স্বস্তি নেই।
যেন বাবা মরে যায়নি। গোলাম আলী খোঁজে। বাবা খোঁজে। বাবা পায় না। শান্তি পায় না। কী রকম যে একেকটা দিন। লঞ্চ গোঁ গোঁ করে এগোয়। নদীর গর্জন, জলস্রোতা আকাশে উপুড় করা মেঘের ভেতর সমস্ত ধ্বংস দেখে ও আঁতকে ওঠে—১২-১৩ বছরের ছেলেটা একটুকরা হাত দিয়ে ওর বাবাকে খোঁজ করে করে ঘুমের ভেতর ফিরে যায়। গোলাম আলী ঘুমায়। সকালে উঠে আবার ভাবে। সব কথা ভাবে। কেউ জানে না। আজিজের কাছে বলে ওঠে, তুই জানিস?
: কী?
সহকর্মীর মুখ বসন্তের দাগে চিহ্নিত। গোলাম আলী আজিজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে…আমার বাবাকে খুঁজে পাচ্ছি না রে। দেখিস তো, তুইও একটু খুঁজিস।
সে তার বাবার সবিস্তার বর্ণনা দেয়। কেমন বাঁ হাতটা ভেঙে কোন দিকে বাঁকা হয়ে গেছে। কপালের নিচে রামদার কাটা দাগ। অনেকটা ৭–এর মতো দেখতে কাটা দাগটা। ডান চোখটা ছোট। চুল নেই। সম্পূর্ণ টাক। মানুষ ডাকার সময় নামটা জেনে নিয়ে ডাকে...ইত্যাদি ইত্যাদি।
হঠাৎ সে মনে মনে বলে ওঠে, বাবা কি ছেলের নাম ভোলে? ছেলে কি বাবাকে?
আজিজ মাঝরাতে জেগে দেখে, গোলাম আলী নেই। ছাদে আসে। দেখে ছাদের ওপরে বসে আছে গোলাম আলী। ছেলেটা মুখ গুঁজে বসে আছে। আকাশ, পৃথিবী, নদী—ডেকের বক বক ধোঁয়ার কুণ্ডলী—প্রস্তাবিত সকল সন্ধান খালি খালি লাগছে তার। নিচে পদ্মা। জলস্রোত। ধ্যাত্তেরি। ভাল্লাগে না। গোলাম আলীর কানে কথা আসে, তাকিয়ে দেখে আজিজ।
লঞ্চ ভেড়ে বহু রাতে এক গাঁও–গেরামের ইস্টেশনে। তাদের গ্রামের মতো। যেন পৃথিবীর সব মানুষের মুখ ভেসে ওঠে নদীর ওপর পড়ে থাকা চাঁদের নিচে। সে কেবিনে এসে জানালায় হাত বাড়িয়ে জলের শরীর স্পর্শ করে। কোনো ক্রোধ নেই। শাসানি নেই। ঘটনাস্রোতের মতো বহু রাতে এই অন্ধকারে গোলাম আলী কোনো ক্রোধ করে না। কথা বলে না। ইস্টিশনের দূরশ্রুত শব্দের ভেতর তার কান ছুটে যায়। বাবার কণ্ঠস্বর মনে আছে। কাত করা করাতের মুখ পুরোনো শিরীষ কাঠে চালিয়ে দিলে যেমন কড়কড়ে তীক্ষ্ণ শব্দ ওঠে, সে রকম গলা। কিন্তু সে গলার ডাক পৌঁছায় না। অর্থাৎ তার বাবা মানুষটা নেই.... নেই...।
চোখ ফের তেজি বর্শার মতো ধারালো হয়ে ওঠে। বাবাকে খোঁজে। ঘুমে খোঁজা মানুষের ভেতর। বাবা নেই। পরদিন কী রকম সাফসোফ সূর্য ওঠে। রোদটোদের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকলে তার মনে পড়ে যায়, তাদের গ্রামটা তাইলে একেবারে উইঠা গেল?
আজিজের কাঁধে হাত রাখে...বলে, থাইকগা, শালা, বাবাটাবা খুঁইজা লাভ নাই। কী লাভ? বুড়োডার কি আর আমারে মনে আছে? হালার মাইনষের জাতই আলাদা।
পাগলের মতো প্রলাপ—কী যে বলে গোলাম আলী। আজিজ থামিয়ে দেয়। চুপ করবা?
ইতিমধ্যে লঞ্চ ঢাকায় আসে। আইডব্লিউটিতে ভিড়। সকালটা কেমন ঘষামাজা তাজা তাজা লাগে। একটা খেলায় খোলার মতো জলে ভাসমান কার্গো। নৌকার সারিগুলো দেখলে বাড়ির কথা খালি মনে আসে। ক্যানটিনের ওপর চা জ্বাল দিতে দিতে গোলাম আলী বলে, আইজ রাত্রে লঞ্চ ছাইড়ব আট্টায়। কোনো দিন ঢাকা শহরডা ঘুইরা দেখা অইল না। এট্টু দেখাইয়া আনবা আজিজ?
আজিজ হঠাৎ বলে ওঠে—ঘুইরা আসি, তোমার বাবারেও খুঁইজা আসি। তোমার বাবারে হয়তো পাইয়া যাইতে পার।
: কহনে?
: রেললাইনে, গুলিস্তানে, মতিঝিলে, বাইতুল মোকাররমে, সদরঘাটে।
গোলাম আলী কোনো দিন এতগুলো নাম একসঙ্গে মুখস্থ করতে পারেনি। সে বিস্ময়াভিভূত হয়। প্রশ্ন করে, তুমি লেখাপড়া করছ, না?
তখন গোলাম আলীর সেই বাজারের লোকটার কথা মনে পড়ে যায়। লোকটা তাকে গালি দেওয়ার মতো চিত্কার করে একদিন বাস্টার্ড বলেছিল। স্পষ্ট মনে আছে শব্দটা—বাস্টার্ড। গোলাম আলী বাস্টার্ডের অর্থ জানে না। আজিজকে বলে ওঠে—
: বাস্টার্ডের মানে জানো?
: বাস্টার্ড?...‘ব্’ কথাটা উহ্য থেকে যায় আজিরের জিহ্বায়।
: আজিজ বিড়বিড় করে। বাস্টাড-ফাস্টাড কইরা কাম নাই। চলো বাবা খুঁজি। বাবা পাইয়া যাবা। এত বড় শহরডার এত মানুষের ভেতর কত বাস্টাডের বাবা পালাইয়া রইছে চলো।
ভূমিকা
রাশেদুর রহমান
বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে অকালপ্রয়াত কবি আবুল হাসানের (৪ আগস্ট ১৯৪৭—২৬ নভেম্বর ১৯৭৫) আবির্ভাব ষাটের দশকে। ষাট ও সত্তর দশকের জনপ্রিয় কবিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। মূলত কবি হলেও কিছু ছোটগল্পও লিখেছেন তিনি। ‘বাপ’ শিরোনামে তাঁর এই গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের ৩১ জানুয়ারি (১৭ মাঘ, ১৩৭৭), ইত্তেফাক পত্রিকার সাহিত্যপাতা ‘রবিবাসরীয় ইত্তেফাক’–এ।
১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর ভোলাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যায় প্রলয়ংকারী এক ঘূর্ণিঝড়, যার নাম ছিল ‘গোর্কি’। এই ঝড়ে প্রায় দশ লাখ মানুষ মারা যায় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ‘বাপ’ গল্পের প্রেক্ষাপটে রয়েছে সেই ‘গোর্কি’। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র গোলাম আলী গোর্কির ছোবলে হারিয়ে ফেলে তার মা–বাবা আর বোনকে। ঝড় কেবল তার পরিবারকেই ছিন্নভিন্ন করেনি, শিকড় উপড়ে ফেলেছে তারও। তাই বাবাকে খোঁজার মধ্য দিয়ে আসলে নিজের শেকড়ে ফিরতে চায় গোলাম আলী। তবে গল্পের চরিত্রটির মধ্য দিয়ে এক পরাধীন দেশের বাসিন্দা আবুল হাসানও কি ফিরতে চাননি আপন শেকড়ের কাছে?
উত্তরটি আর পাওয়া যাবে না। কারণ, ১৯৭৫ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে মারা গেছেন বাংলাদেশের কবিতায় স্থায়ী আসন পাওয়া এই কবি।
আবুল হাসান কবি বলেই তাঁর গল্পের বর্ণনার মধ্যেও পাওয়া যায় কবিত্বের স্পর্শ। এই গল্পের ছত্রে ছত্রে তার নমুনা ছড়িয়ে আছে।
‘বাপ’ গল্পটি একাত্তরের প্রথম মাসে প্রকাশিত হলেও আবুল হাসানের মৃত্যুর পর তারিক সুজাতের সম্পাদনায় তাঁর যে গল্পসংগ্রহ (১৯৯০) বের হয়েছে, সেখানে গল্পটি গ্রন্থিত হয়নি। এই গল্প নেই আবুল হাসান রচনাসমগ্রতেও (১৯৯৪)। তাই গল্পটিকে এখনো অগ্রন্থিতই বলা চলে।
প্রথম প্রকাশের ৫২ বছর পর আবুল হাসানের অগ্রন্থিত এই গল্প নতুন করে আবার প্রকাশিত হলো। পুনর্মুদ্রণের সময় সমকালীন বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।