সাবান

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জলপাইতলী গ্রামে ইরামণি খাতুনের কেচ্ছাকাহিনি বেড়েই চলছিল। একটা ছেলে নিয়ে সে একা থাকত। পাকা রাঁধুনি বলে দূরদূরান্তে তার নাম ছড়িয়েছে। নামের সঙ্গে দুর্নাম আর সন্দেহও কম ছিল না। জিন–পরিরা নাকি রান্নার সময় তার সঙ্গে থাকে। এই তো কদিন আগে, দরিয়ানগরের আবদুল পারোয়ার চৌধুরীর ছোট ছেলের আকিকায় একাই এত রান্না সে কীভাবে করল!

রটনা ছিল যে ইরামণির নাকি খুচরা প্রেম–পিরিত লেগেই থাকত। কেউ কেউ বলত, এই মাগি একদম পাইকারি মাল। ঠিকটাও কেউ কেউ জানত। কতগুলো নিকাহর প্রস্তাব ইরামণি ফিরিয়ে দিয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা ছিল না। কোনো পুরুষকে সে আর বিশ্বাস করত না।

একদিন বেশ রাতের দিকে ইরামণি ধড়মড় করে জেগে ওঠে। ধাক্কাধাক্কিতে দরজা তো দরজাই, গোটা বাড়িটাই যেন আরেকটু হলে ভেঙে পড়ত। লোক কটা হুড়মুড় করে ঢোকে। পুরো বাড়ি তল্লাশি করে। খাটের তলায় টর্চ মারে। প্রতিটা কোণ তন্নতন্ন করে খোঁজে। কাপড়ঝোলানো স্ট্যান্ডটাও লন্ডভন্ড করে দেয়। তারা কেন, কিসের জন্য এসেছে, বারবার জানতে চাইলেও কোনো উত্তর না দিয়ে বোবাকালা মানুষের মতো চুপচাপ এসব করছিল। শেষে একজন, নেতা–নেতা হাবভাবের লোক তাকে বলে, তার বাড়িতে একজন রোহিঙ্গা থাকে বলে তারা খবর পেয়েছে।

কাউকে না পেয়ে লোক কটা ফিরে যায়। বিছানায় ঘুমজড়ানো চোখে রাউফু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। ইরামণি এসে ছেলেকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখে। এরপর এক সন্ধ্যায় মুখ ঢাকা দিয়ে রোহিঙ্গা মার্কেটে সন্ধ্যার ভরা বাজারে হাজারো লোকের ভেতর লুকিয়ে গোপনে দেখা করতে আসা সোবহান ইরামণিকে জানায়, তার পেছনে ফেউ লেগেছে। দেশে ফেরাউনের গুষ্টি আর বিদেশে ফেউ—সে কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না! ইরামণি তাকে ভরসা দেয়। কদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে বলে। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কদিন মারামারি করবে? শক্তি–সামর্থ্যেরও তো একটা শেষ আছে।

ইরামণির বাপ সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে উধাও হয়েছিল। মায়ের কপালের শনি তারও পিছু ছাড়েনি। ইরামণির প্রথম স্বামীকেও বলে দরিয়া গিলে ফেলেছে। লোকে বলত, এটা মিছা কথা। সেটা ছিল তার দ্বিতীয় বিয়ে। ইরামণির সঙ্গে সংসার করবে না বলেই লোকটা পালিয়ে যায়। আগের বা প্রথম বিয়েটাও টেকেনি।

চেহারা–সুরতে দারুণ চটক থাকায় ইরামণির দিকে বহু লোকের লোলুপ দৃষ্টি ছিল। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং। গড়পড়তা বাঙালি মেয়েদের চেয়ে মাথায় লম্বা। পেটা শরীর। কাজ করার সময় ঘাড়ে বা বাহুতে পেশি ফুলে ওঠে। কোমরে একফোঁটা চর্বি নেই। টান টান শরীরে চোখে পড়ার মতো ভরভরন্ত কিন্তু কঠিন মজবুত নিতম্ব। ইরামণিকে সমঝে না চলে উপায় নেই। যেমন স্বাস্থ্য, তেমন তেজ। এই তেজের জন্যই নাকি কোনো পুরুষের সঙ্গে বনিবনা হয় না। আগের স্বামীর সঙ্গেও বনিবনা হয়নি। ছেলেটা এই ঘরেরই। রাউফু। ছেলেটাকেও আগের স্বামী নিতে পারেনি; আসলে নিতে চায়ওনি। শেষ দিনও মায়ের হয়ে ওইটুকু ছেলে বাপকে চ্যালাকাঠ নিয়ে তাড়া করেছিল। ফানক সাপের বাচ্চা! খন্ডারানির পোলা আর কত ভালো হবে! ইরামণি তার কাছে ছিল বিপদ, ছেলেটা আপদ। দুয়ের হাত থেকে সদর পালিয়ে বেঁচেছে।

ইরামণি খাতুন নিজের নাম লিখতে পারে। একটু পড়তেও পারে। মুখে বলে ফাইভ পাস; আসলে থ্রি। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতে করতে রান্নাবান্নার সবকিছু শেখা হয়ে গিয়েছিল। তার মা রান্না করত, আর সে ছিল জোগালের মতো। এ ছাড়া কুটাকাটার কাজটাও সে করে দিত। মা যখন মারা যায়, ইরামণির বয়স তখন মাত্র ষোলো। তার আগে সদর আলীর সঙ্গে বিয়ে হয়। সদর আলী ভ্যান চালাত। স্বভাব–চরিত্র খারাপ ছিল না। কিন্তু ইরামণির খবরদারি করার জন্য ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত। হাজারবার তালাকের কথা বললেও তালাক দিতে পারছিল না। তারপর সদর আলী তার বন্ধু কলিমুদ্দিনকে ইরামণির সঙ্গে ভাব করার জন্য ঠেলে দেয়। তারা দুজনে মিলে যুক্তি করে, একদিন কলিম ইরামণিকে প্রেমের প্রস্তাব দেবে; এর আগে ইরার সঙ্গে নরম নরম কথা বলে ভাব জমিয়ে নেবে। ইরামণি একটু দুর্বল হলে, সুযোগ বুঝে প্রেমের প্রস্তাব দেবে আর জড়িয়ে ধরবে। ঠিক তখন ঘরের জানালা খুলে যাবে। জানালায় দেখা দেবে সদরসহ আরও কয়েকজনের মাথা। তারপর হইচই হবে। ইরামণির চরিত্রে কালি ঢেলে দিলেই তালাক হয়ে যাবে। পরে এই ফন্দির কথা ফাঁস হয়ে যায়। তাতে ইরামণি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সদর আর টিকতে না পেরে কক্সবাজারে চলে আসে। বছরের পর বছর বাড়িতে না ফেরার জন্য আপনাআপনিই বলে তাদের তালাক হয়ে গেছে।

এরপর দুজনের মধ্যে হাসিঠাট্টার মুহূর্ত তৈরি হতে শুরু করে। তারপর রাউফু বাসায় না থাকার সময়টায় সোবহান ঘন ঘন আসতে থাকে। একদিন বাড়িতে ফিরে ঘরের জানালা–দরজা সব বন্ধ পায় রাউফু।

রান্নার সুনামেই দিনে দিনে ইরামণির আয়রোজগার বেড়েই চলছিল। অনেক কষ্টের পর টাকা জমিয়ে ঘুমধুমের জলপাইতলী গ্রামে একটা জমি কিনে টিনের বাড়ি তোলে। মহিলা কারিগর হিসেবে ইরামণির নাম ছড়িয়ে পড়লে কয়েকটা নামী হোটেলে কাজের প্রস্তাব ছিল। এ ছাড়া নিজের মতো বাড়ি বাড়ি বায়না নিয়ে রান্না করার কাজ তো লেগেই থাকত। ইরামণি কোথাও বান্ধা কাজ করতে রাজি নয়। তার কথা: যোগ্যতা কোনো বাধ্যবাধকতা মানে না। যার যোগ্যতা আছে, কেউ তাকে বেঁধে রাখতে পারে না। সে মুক্ত হয়েই নিজের খাওয়া–পরার সব খরচ জোগাড় করতে পারে। এর ভেতর হঠাৎ স্রোতের মতো রোহিঙ্গারা আসতে থাকে। দেখতে দেখতে ঘুমধুমের পাহাড়–বন উজাড় করে সেখানে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। যখন আর কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকতে পারবে না, ঠিক তার আগে আগে শেষ দলটার সঙ্গে আসে সোবহান। তার পুরো পরিবারের সবাই মারা পড়েছে, তা–ও সে মাটি আঁকড়ে সেখানে দিনের পর দিন পড়ে ছিল। কোথায় যাবে নিজের দেশ–ঘর ছেড়ে? গিয়ে অন্য জায়গায় কদ্দিন আর থাকবে! যদিও অনেকে বলছিল, বাংলাদেশে গেলে অন্তত থাকা ও খাওয়ার আর চিন্তা করা লাগবে না। জাতিসংঘ থেকে সব রকম সুযোগ–সুবিধা দেওয়া হচ্ছে! সেই সুবিধা–সুযোগ কি জাতিসংঘ তাদের এখানে দিতে পারত না? এর ভেতর একজন সোবহানকে এআরএসএর জন্যও রিক্রুট করতে চেয়েছিল।

শক্তপোক্ত ছিপছিপে লম্বা গড়নের সোবহান খেতখামারে কাজ করার বাইরে কোনো দিন কিছু করেনি। কোনো বাজে স্বভাব ছিল না। দোষের ভেতর মসজিদে কম যেত, আল্লাহবিল্লাহ কম করত। সেও আর টিকতে না পেরে কোনোমতে পালিয়ে রোহিঙ্গাদের শেষ দলের সঙ্গে বাংলাদেশে চলে এল।

এমনিতে বাঙালিদের সঙ্গে সহজেই মিশে যাওয়ার মতোই সোবহানের চেহারা। লম্বা না হলে আরও সহজে মিশে যেত পারত। মায়াময় একটা শান্ত চেহারার সোবহানকে দেখে ইরামণির প্রথমেই মনে ধরে। অ-নেএএএএএএ-ক দিন পর কোনো পুরুষকে তার মনে ধরল। এতে নিজেকে নিয়ে সে নিজেই অবাক হয়েছিল! রোহিঙ্গা মার্কেটেই আলাপ হয়েছিল। ইরামণি সেদিন একটু মুরগি, পোলাওর চাল আরও কী কী কিনতে গিয়েছিল। ছেলেটা অনেক দিন পর পোলাওর সঙ্গে ফিরনি খেতে চেয়েছে। সোবহান ঘরে থাকার লোক ছিল না বলে কায়দা করে একে–তাকে ধরে রিকশা চালানোর একটা কাজ জোগাড় করে। ইরামণি খুব কম রিকশায় ওঠে। কিন্তু রিকশায় উঠলেই সে রিকশাওয়ালার সঙ্গে এ কথা-সে কথা বলতে শুরু করে। ভাঙা ভাঙা চাটগাঁইয়া কথায় সোবহান যে রোহিঙ্গা, সেটা বুঝতে দেরি হয়নি। লোকটাকে বড়ই সহজ–সরল মনে হয়।

ইরামণির জলপাইতলীর ছোট্ট দোচালা টিনের বাড়িটায় দুটো ঘর, একটা রান্নাঘর। আর বাইরে পাটকাঠির বেড়া দিয়ে কলতলা, আর এককোণে বাঁশের বেড়া দিয়ে পায়খানা। প্রথম দিন বাড়ি চিনে যাওয়ার পর আরও কয়েক দিন বাজারে দেখা হয়। আগে রিকশাভাড়া নিলেও, পরে আর নিতে চাইত না। কিন্তু ইরামণি এমনি যা ভাড়া, তার চেয়ে সোবহানের হাতে বেশি টাকা গুঁজে দিতে শুরু করে। কোনো কোনো সন্ধ্যাবেলায় সোবহানকে নিয়ে বাড়িতে ফেরে। এর ভেতর দু–এক দিন পানি খাওয়ায়। এরপর শুরু হয় চা–বিস্কুটের পালা। একদিন এক দুপুরে মাছ-ভাত।

মাঝেমধ্যে দেখছে, দিন পনেরোর জন্য সোবহান উধাও। এলে বলে, একটা দলের সঙ্গে লুকিয়ে মংডুতে গিয়েছিল। প্রথম প্রথম বিশ্বাস করলেও ইরামণির সন্দেহ বাড়ে। তখন আবার উধাও হওয়া দিনের সংখ্যা কমতে থাকে।

মায়ের সঙ্গে সোবহানের এই সব শুরুতে ভালোমতো না নিলেও, পরে আর কিছু বলত না রাউফু, ‘লোকটা কে, কেন আসে, কী চায়?’ এসব প্রশ্নের উত্তর সুন্দরমতো দিয়েছিল ইরামণি। ‘লোকটা মানুষ। অভাবী মানুষ। রিকশা চালায়। সারা দিন খায়নি, তাই একটু পানি দিলাম।’ এভাবে শুরু হয়েছিল। এরপর দুজনের মধ্যে হাসিঠাট্টার মুহূর্ত তৈরি হতে শুরু করে। তারপর রাউফু বাসায় না থাকার সময়টায় সোবহান ঘন ঘন আসতে থাকে। একদিন বাড়িতে ফিরে ঘরের জানালা–দরজা সব বন্ধ পায় রাউফু। কড়া নাড়লে ইরামণি দরজা খোলে। শাড়ি আলুথালু। খেয়াল করলে দেখত, পরনে ব্লাউজও নেই। শাড়িটায় কোনোমতে পিঠ, কাঁধ, পেট ঢেকে নিয়েছে। ঘামের রেখা কপাল বেয়ে গালের পাশ দিয়ে থুতনিতে জমা হচ্ছে। ছেলে তার ঘরে যেতেই ইরামণি মুখে পানি দিতে গোসলখানায়  ঢোকে। ঠিক তখন পায়খানার দরজা খুলে সোবহান বের হয়। বেরিয়ে সে রাউফুর ঘরে ঢোকে।

‘ও পুৎ, আঁই তোর লাই কী আইন্নি চাছ না!’

সোবহান রাউফুর জন্য এটা–সেটা খাবার আর খেলনা মাঝেমধ্যে  নিয়ে আসে। কেনার টাকাটা ইরামণিই দেয়।

বিছানার চাদর কোনোমতে টেনেটুনে দিলেও তাণ্ডবের পুরোটা মুছে দেওয়া যায়নি। বালেগ হওয়ায় মায়ের শোয়ার ঘরের পাশের ঘরটায় এখন রাউফু থাকে। একটা চেয়ার–টেবিল আর চৌকিমতো আছে। একপাশে বেতের মতো বুনন দেখতে তিন–চারটা খয়েরি রঙের প্লাস্টিকের টুল একটার ওপর আরেকটা বাসিয়ে রাখা। তার একটা নামিয়েই সোবহান বসে। আজ রাউফু কেমন কী করল, হ্যানোতেনো জানতে চায়। রাউফু ব্যাগ থেকে খাতা–বই বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে কথা বলে। এ সময় ইরামণি এসে চোখে ইঙ্গিত করে সোবহানকে পাশের ঘরে যেতে বলে। রাউফুকে বলে, হাত–মুখ ধুয়ে এসে একটু নাশতা করতে। মায়ের কথামতো রাউফু গোসলখানার দিকে গেলে ইরামণি পাশের ঘরে গিয়ে আবার সোবহানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সোবহান তাকে পাগলের মতো চুমু খেতে থাকে।

‘ও মা উনো।’ চেঁচানো শুনে দুজনের ভেতর কয়েক ফুট চাওড়া একটা হাওয়াই কোপ পড়ে। লাফিয়ে আলাদা হয় দুজন।

‘ও পুৎ হসোনা।’ ঘর থেকে পাল্টা চেঁচিয়ে ওঠে ইরামণি।

‘সাবানান্ কঁডে গিইয়ে মা? (সাবানটা কোথায় গেল মা?)’

ইরামণির তাড়াহুড়ায় সাবানটা তখন মাটিতে পড়ে যায়। অন্ধকারে খুঁজে পায়নি, ফলে জায়গামতো তুলে রাখা সম্ভব হয়নি।

এর কদিন পরই সাদাপোশাকে লোকগুলো আসে। তার বাসায় কোনো রোহিঙ্গা লুকিয়ে আছে কি না, তারা ধমক দিয়ে জানতে চায়: ‘তোঁয়ার গরৎত হনো রোইঙ্গা আছে নি, হ!’

এরপর দিনের আলোয় আর দুজনের দেখা হয়নি। রাতের বেলা, তা–ও অনেক রাতে আসত সোবহান। রাউফু ঘুমিয়ে কাদা হওয়ার সুযোগটা পুরো কাজে লাগত। ফেব্রুয়ারিতে গোলাগুলি বাড়তে থাকায় রাউফুকে কদিনের জন্য শরিফার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। শরিফা ইরামণির সঙ্গে একই রেস্টুরেন্টে কাজ করে। দুটো ছেলেমেয়ে। তাকেও স্বামী ছেড়ে চলে গেছে।

শেষ রাতের দিকে খাওয়াদাওয়া সেরে সোবহান বিদায় নিত। এরই একটা রাতে মর্টার শেল এসে রান্নাঘরে থাকা ইরামণি আর সোবহানের ওপর পড়ে। ইরামণি মেঝেতে পড়ে ছিল আর সোবহান বেড়ায় ঠেস দিয়ে।

দিনের বেলা লাশ দুটো বাইরে নিয়ে আসা হয়। দুজনকে চিনতে কারোরই তেমন কষ্ট হয়নি।