ছাতিমগাছের নিচে
ঘুম থেকে উঠে পারলাম না, মামা ফরমাশ ধরিয়ে দিল। তার বন্ধু জনৈক জব্বার আঙ্কেলের কাছ থেকে ত্রিশ হাজার টাকা আনতে যেতে হবে। কিসের টাকা জিজ্ঞাসা করতেই বলল, ‘কিসের টাকা, সেটা দিয়ে তোর দরকার কী? তুই আমার নাম বলবি, তোকে টাকা দিয়ে দেবে।’
শুক্রবার একটু শুয়ে-বসে থাকার আয়োজন করেছিলাম, সেটা আর হবে না বোঝা গেল। একই সঙ্গে একটু আশাও হলো যে ত্রিশ হাজার টাকা এনে দিলে মামা হাজার দুয়েক টাকা তো বকশিশ দেবে অন্তত। কয়েক মাস ধরে টাকার টানাটানি। এমন একটা বয়সে এসে পড়েছি যে কারও কাছে টাকা চাইলে টাকা পাওয়া যায় হয়তো, কিন্তু সঙ্গে দু–একটা কটু কথাও হজম করতে হয়।
‘সংসার দুঃখতরঙ্গের খেলা, আশা তার একমাত্র ভেলা।’ সেই আশার ভেলায় চড়ে জামা গায়ে দিয়ে বাইরে বেরোলাম।
প্রচণ্ড রোদ। রিকশায় উঠে সি ব্লকে গিয়ে জব্বার আঙ্কেলকে ফোন দিলাম। তিনি ফোন ধরেন না।
তিনবার ফোন দিলাম, তাও কোনো সাড়া নেই। মেজাজটাই বিগড়ে গেল। মামাকে ফোন দিলাম। মামা বলল, ‘ফোন ধরা লাগবে না, তুই বাসায় চলে যা। গিয়ে আমার কথা বল।’
‘শুক্রবার ছুটির দিনে কারও বাসায় কি টাকা নিতে হাজির হওয়া যায়? কেমন দেখায়?’ কথাটা বলতেই খেঁকিয়ে উঠল মামা। বলল, ‘এ জন্য তোর চাকরি হয় না।’ এরপর আর কথা চলে না। ঠিকানা খুঁজে পেতেই আধা ঘণ্টার বেশি লাগল। তবে বাসাটা দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। বাসার গেটের সামনে একটা প্রকাণ্ড আমগাছ। আমগাছের ডালপালা আর পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে আসা রোদ টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়। বেশ নিরিবিলি একটা গলি। গেট খোলা। ঢুকে গেলাম। তিনতলায় বেল বাজাতেই একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলতেই তাজ্জব হয়ে গেলাম।
ড্রয়িংরুমে পাঁচ–সাতজন নানা বয়সী মানুষ। কেউ দাঁড়ানো, কেউ সোফায় বসা। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সিরিয়াস কোনো বিষয় নিয়ে আলাপে মগ্ন ছিল তারা; খুব সম্ভবত উত্তপ্ত আলাপই হচ্ছিল। আমি এসে বাগড়া বাঁধিয়েছি।
এক বয়স্ক লোক বেশ বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘কাকে চাই?’
বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘জব্বার আঙ্কেল আছেন?’
জব্বার আঙ্কেল সোফায় বসে ছিলেন। তাঁর চেহারা চিমসে আছে। মনে হচ্ছে, তাঁকে ধোলাই দেওয়া হচ্ছিল। তিনি বিরক্তি দেখালেন না। অত্যন্ত নরম সুরে বললেন, ‘বলো বাবা!’
আমি জানালাম যে মোজাম্মেল আঙ্কেল আমাকে পাঠিয়েছেন।
আর কিছু বলতে হলো না, তিনি বেশ উৎসাহ নিয়েই বললেন, ‘ও, মোজাম্মেল পাঠিয়েছে? আসো আসো, বসো বসো।’
বেশ কাঁচুমাচু হয়েই সোফায় বসলাম। তখনো সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থা। জব্বার আঙ্কেল বললেন, ‘তুমি তো ঘেমে একাকার, একটু রেস্ট নাও। এই, ওকে শরবত–টরবত দাও।’
তবে আমাকে শরবত খাওয়ানো নিয়ে কেউ খুব একটা উৎসাহ দেখাল না। কিছুক্ষণ বসে থেকে কাজের মেয়েটা নেহাতই না পেরে বিরক্ত মুখে অনিচ্ছায় ঢুলতে ঢুলতে ভেতরে গেল।
শরবত আসার আগেই তারা ধীরে ধীরে ফিরে গেল আগের আলাপে। আমি যে এখানে আছি, সে কথা তারা বেমালুম ভুলেই গেল। ঘটনা খুবই গুরুতর। প্রথমে যেটা ভেবেছিলাম সেটাই, জব্বার আঙ্কেলকেই ধোলাই দেওয়া হচ্ছে। জব্বার আঙ্কেল আজ সকালে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে একটা কবর বুকিং দিয়ে এসেছেন। স্থায়ী কবর। ডেভেলপার কোম্পানি একটা আবাসন প্রকল্প খুলেছে। সেখানে মনোমুগ্ধকর একটা কবরস্থানের ব্যবস্থাও আছে। স্থায়ী কবর সাত লাখ। আড়াই লাখ হচ্ছে বুকিং মানি। প্রতিটি কবরকে ছায়া দেবে ছাতিমগাছ। ছাতিমগাছের নিচে কবরের মালিক শুয়ে থাকবে। শুধু তা–ই নয়, কবরের পাশে বসে স্বজনদের সময় কাটানোর জন্য থাকবে একটা সিমেন্টের বেদি। তবে জব্বার আঙ্কেল এক লাখ টাকা ডিসকাউন্ট পেয়েছেন।
আঙ্কেলের ছোট ভাইকে ডাকা হয়েছে। তাঁর শালাও এসেছেন। বিল্ডিংয়ের দু–তিনজন গণ্যমান্য ব্যক্তিও এসেছেন সস্ত্রীক। বলা বাহুল্য, তাঁরা এসেছেন মজা দেখতে। জব্বার আঙ্কেল যতই আত্মপক্ষ সমর্থন করার চেষ্টা করেন, ততই খেপে যান তাঁর স্ত্রী, ‘এই লোকের সাথে সংসার করতে করতে আমার জীবন ঝালাপালা। এত বোকা মানুষ হয়?’ সবাই তাঁর সঙ্গে একমত।
এখন বিষয় হচ্ছে, টাকাটা আদায় করতে হবে। কিন্তু কীভাবে?
পুরোটা বুঝতে পেরে প্রথমে আমার মনে যে প্রশ্ন এল, সেটা হলো, এরা আড়াই লাখ টাকা ধরা খেয়েছে। এখন যদি আমি ত্রিশ হাজার টাকা চাই, কেমন দেখাবে? কী বিপদে পড়লাম!
নিজের বিপদ নিয়ে বেশিক্ষণ চিন্তা করতে পারলাম না। কাজের মেয়ে ঢুলতে ঢুলতে এক গ্লাস শরবত নিয়ে ঢুকল। আর তার পেছন পেছন একটা মেয়ে। চোখেমুখে বিরক্তি ও রাগ। এসেই বলল, ‘আম্মু, একটা বাইরের লোকের সামনে তোমরা এগুলো কী শুরু করেছ?’ বলেই খুব বিব্রত চোখ মেলে আমার দিকে তাকাল। আমি তার দিকে নজর না দিয়ে শরবত খাওয়ায় মন দিলাম।
মেয়েটার কথায় সবার কণ্ঠ একটু নিচু হলো বটে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হলো না। যেহেতু আজ টাকা দিয়েছে, সেহেতু আজই যদি গিয়ে বলা যায়, তাহলে হয়তো ফেরত পাওয়া যেতে পারে। অন্ততপক্ষে চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু কে যাবে?
জব্বার আঙ্কেলের ছোট ভাই আগেই বলল, ‘আমি এসবের মধ্যে নাই, আমি যেতে পারব না। ভাইজান নিজে যাক।’
কিন্তু জব্বার আঙ্কেল কিছুতেই যাবেন না। তাঁর কথা, এটা প্রেস্টিজ ইস্যু। তবে কেউ যদি গিয়ে নিয়ে আসতে পারে, তাহলে তাঁর আপত্তি নেই।
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর আবার সবার চোখ পড়ল আমার দিকে। আঙ্কেলের স্ত্রী খুব নরম স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি মোজাম্মেল ভাইয়ের ভাইগনা? ঢাকা ভার্সিটিতে পড়তা?’
অসহায়ের মতো বললাম, ‘জি।’
তিনি বললেন, ‘তুমি একটু হেল্প করো। আমি মোজাম্মেল ভাইকে ফোন করে বলব, বুঝতেই তো পারছ, তোমার আঙ্কেল খুব বিপদে ফেলেছেন আমাদের।’
এভাবে কট খেয়ে যাব বুঝিনি। হুট করে মাথায় এল। বললাম, ‘কিন্তু আমাকে তো টাকা দেবে না। আমি তো আঙ্কেলের কেউ নই। আমাকে কেন টাকা দেবে?’
কথা যুক্তিসংগত। তখনই আঙ্কেলের শালার চোখ গেল বিরক্তি নিয়ে পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে থাকা মেয়েটার দিকে। বলল, ‘এই ঋতু, তুই যা এই ছেলের সঙ্গে। ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং দিয়ে বসে আছিস, মেক ইউরসেলফ ইউজফুল।’
মেয়েটা আকাশ থেকে পড়ল, ‘আমি যাব টাকা আনতে! ইম্পসিবল।’
ওর মা খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘সারা দিন মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকা ছাড়া সংসারে আর কী সে কন্ট্রিবিউট করে? এখনকার মেয়েরা সারা দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর সে নিজের বাপের টাকা উদ্ধারে যেতে লজ্জা পায়? তার একটা ভাই থাকলে সে কি আজ যেত না?’
সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল, ঠিক ঠিক। তা ছাড়া তার তো কিছু করতে হবে না, যা করার এই ছেলে করবে। সে শুধু মেয়ে হিসেবে যাবে। গিয়ে বলবে, আমার বাবার মাথায় একটু সমস্যা আছে, টাকাটা তার হাতে দিতে। তারপর লাগলে বাবার ফোনে কথা বলিয়ে দিলেই হবে।
এ কথা শোনার পর আমি জব্বার আঙ্কেলের দিকে তাকালাম। তিনি হতাশ। কোনো কিছুতেই তাঁর আর কিছু যায় আসে না।
যুক্তিতে পরাস্ত হয়ে ঋতু নামের মেয়েটা জামাকাপড় বদলে আমার সঙ্গে বেরোল। বেরিয়েই বলল, ‘কিছু মনে করবেন না, আমাদের ফ্যামিলিতে সবাই একটু ক্র্যাক।’
আমি কোনো জবাব দিলাম না। যেতে হবে বনানীতে। এমনিতেই শুক্রবার সব অফিস বন্ধ, কেবল কবরস্থানের বুকিং খোলা, জুমার নামাজের আগে–পরে মানুষের আনাগোনা হয়, সম্ভবত সে কারণে।
বনানীতে যেতে যেতে টুকটাক কথা হলো। ঋতুর লেখাপড়া শেষের দিকে। যত দ্রুত সে এই বাসা থেকে বেরোতে পারে, তত ভালো। আমি ভাবলাম, হয়তো বিয়ের কথা ভাবছে। কিন্তু সেটা না, সে মাস্টার্স করতে বাইরে যাবে। এই দেশ তার ভালো লাগে না।
আমি নিজের কথা আর তেমন কিছুই বললাম না। বেকার, বলার মতো কিছুই নেই।
বনানীতে নেমে ফুটপাত ধরে হাঁটছি। কিছুদূর গিয়ে মেয়েটা বলল, ‘আচ্ছা একটা কাজ করি?’
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী?’
বলল, ‘আমরা না যাই। ঘুরেটুরে বাসায় গিয়ে বলব, টাকা চেয়েছি, দেয়নি।’ তারপর বিরক্তি নিয়েই বলল, ‘আপনি বলেন, এভাবে কি টাকা আনা যায়? এটা কোনো প্রসেস? এমব্যারাসিং।’
দোনোমোনো করতে করতেও আমরা গিয়ে হাজির হলাম। জুমার সময় হয়ে এসেছে। অফিসে কেতাদুরস্ত এক লোক বসা। আমরা তাকে আমাদের আরজি জানাতেই সে বলল, বুকিং মানি ফেরত দেওয়া হয় না।
তার কঠিন জবাবে ঋতু একটু খেপে গেল। বলল, ‘এটা কী ধরনের কথা? একটা সহজ–সরল লোক ভুল করে টাকা দিয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা হলো। সেটা আপনারা ফেরত দেবেন না?’
লোকটা বলল, ‘এটা আমাদের কোম্পানি পলিসি।’
মেয়েটার রাগ আরও বাড়ল বলেই মনে হলো। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কিছু বলেন।’
জীবনে কোনো মেয়ে আমাকে বাহাদুরি দেখাতে বলেনি। এই মেয়ে প্রথম বলল। এখন আমি কী করি? বললাম, ‘আপনার কোম্পানি পলিসির আমি খ্যাতা পুড়ি।’
শুনে সে লোক আর ঋতু দুজনই আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর লোকটা ঋতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি জব্বার স্যারের মেয়ে বলে কিছু বলছি না। কিন্তু এই লোক আরেকবার কিছু বললে আমরা সিকিউরিটি ডাকব।’
অপমানিত হয়ে অগত্যা দুজনই বেরিয়ে এলাম। ঋতু বেশ খেপেছে বলে মনে হলো। বলল, ‘দেখলেন কত বড় ফ্রড?’
আমি মাথা নাড়লাম। তখন সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনিও একটু উইয়ার্ড আছেন।’
আমি কোনো জবাব দিলাম না। কী বলব?
এবার সে-ই বলল, ‘যা হয়েছে হয়েছে, বনানীতে যেহেতু এসেছি, চলেন কোল্ড কফি খাই।’
কোল্ড কফি খেতে খেতে ঋতু একটু উদাস হয়ে গেল। স্ট্রয়ে চুমুক দিয়ে বলতে লাগল, ‘বিদেশে চলে যেতে চাই। কিন্তু বাবার কথা মনে হলে মন কিছুতেই সায় দেয় না। বাবা এত সহজ–সরল! রিটায়ার করার পর থেকে বলছিল, “গ্রামে কিছু নেই। এই শহরে আমি মরে গেলে আমার মেয়েটা আমাকে দেখতেও আসতে পারবে না, এটা কেমন হয়?”’
বলতে বলতে তার গলা ধরে এল। সম্ভবত চোখও ভিজে উঠল। সেটা লুকাতেই কি না কে জানে, ক্যাফের জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তায় তাকিয়ে রইল সে।