একটা কথা ইদানীং খুব শুনেছি—এই সিনেমায় শিক্ষামূলক কিছু নেই। কথাটা মানুষ কেন বলে, এর কারণ এত দিন ধরতে পারিনি। আজ হলে ঢুকে নির্ধারিত সিট পেয়েই ধরতে পারলাম। অনেকেই সিনেমা হলে শিশুদের নিয়ে আসেন। হঠাৎ দেখে মনে হবে এটা সিনেমা হল না, কিন্ডারগার্টেন স্কুল। এই বাবা-মায়েরা নিশ্চয়ই হলটাকে স্কুল ভাবেন। নইলে এত ছোট নার্সারি কিংবা ক্লাস ওয়ানের বাচ্চাদের নিয়ে হলে প্রাপ্তবয়স্কদের সিনেমা দেখতে আসবেন কেন?
আমাদের সিট এম ওয়ান, এম টু। তিন সিট পরেই এক দম্পতি বসেছেন। সঙ্গে তাঁদের দুই সন্তান। ছেলেটার বয়স চার–পাঁচ বছর হবে। মেয়েটা আরও ছোট। কোনোভাবেই ওদের সিটে বসানো যাচ্ছে না। বসেই আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। একটু পর জাতীয় সংগীত বাজাবে তো, হয়তো আগে থেকেই প্র্যাকটিস করছে বাচ্চা দুটো। এমন ভায়োলেন্স ভরপুর একটা সিনেমা দেখতে এই দম্পতি বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন—দেখেই বিরক্তি লাগল। শুধু যে গ্রাফিক্যাল ভায়োলেন্স তা তো নয়, যত রকম ভায়োলেন্স, গালাগাল থাকা সম্ভব, সবই আছে এ সিনেমায়। সিনেমা শেষ হলে এদেরই কেউ হয়তো বলবেন—‘ছি ছি! এসব সিনেমা পরিবার নিয়ে দেখা যায় না।’ সিনেমাটা যে এমন, এটা আগে জেনে আসবেন না? বিরক্তি আটকে রাখতে পারলাম না আমি।
‘ধুর। অটোর যেমন কন্ট্রোল নাই, মানুষের নাই কমনসেন্স।’
‘কী সমস্যা?’ পাশ থেকে ফিসফিস করে বলল মাহা। ওর আগ্রহেই আমি সিনেমা দেখতে এসেছি। ছুটির দিন। কোথায় সারা দিন শুয়ে–বসে রিলস দেখে কাটাব, তা না। ওর এক কথা—‘চলো, মুভি দেখে আসি।’
‘দেখছ না, এই সিনেমা দেখতে শিশু নিয়ে এসেছে। কমনসেন্স নাই। আরে ভাই, এটা কি শিশুপার্ক?’
‘ভাষণ দিচ্ছ কেন? আস্তে কথা বলো। মানুষ শুনলে কী ভাববে? আশ্চর্য! বাচ্চাদের কোথায় রেখে আসবেন ওনারা?’
‘সেটা আমি কী জানি? আমি প্যারেন্টিংয়ের কনসালট্যান্সি ফার্ম খুলে বসেছি নাকি? যত সব ফালতু কথা।’
‘মুডটা নষ্ট কোরো না। একটা ফ্রেশ মুড নিয়ে মুভি দেখতে এসেছি। তুচ্ছ কারণে তুমি ঝগড়া করার চেষ্টা করছ। তুমি চাও আমি মুভিটা না দেখে রাগ করে চলে যাই, তাই না?’
‘আরে কী অদ্ভুত! আমি কখন বললাম এটা?’
‘তাহলে সামান্য ব্যাপার নিয়ে এ রকম বিহেভ করছ কেন? বাচ্চা মানুষ। ওরা তো তোমাকে কোনো ডিস্টার্ব করছে না।’
‘করছে না। কিন্তু করবে।’
‘এত নেগেটিভ মাইন্ড কেন তোমার! মানুষের আনন্দ দেখতে পারো না?’ মাহা ঝট করে উঠে চলে গেল।
‘আরে, কোথায় যাচ্ছ?’ আমিও ছুটলাম ওর পিছু পিছু।
‘তুমি আসছ কেন আমার পেছন পেছন? সিটে ব্যাগ রেখে এসেছি। ব্যাগ কে দেখবে?’
‘ও। আমি ভাবলাম চলে যাচ্ছ রাগ করে…’
‘হ্যাঁ, তুমি তো সেটাই চাও…বাসায় গিয়ে শুয়ে রিলস দেখা তোমার কাছে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট, তাই না? যাও, বসো চুপচাপ। আমি পপকর্ন কিনতে যাচ্ছি।’
আবার সিটে এসে বসলাম। বাচ্চা দুটো তখনো ছোটাছুটি করছে। তাদের মা–বাবা মাঝেমধ্যে ‘অ্যাই, দুষ্টুমি করে না। বসো এখানে’ টাইপ আদেশ দিচ্ছেন। কিন্তু মিড ওভারে বাংলাদেশের বোলিং যেমন বিপক্ষ দলের ব্যাটারদের ভয় ধরাতে পারে না, ওনাদের এই আদেশও সে রকম। বাচ্চা দুটো পাত্তাই দিচ্ছে না। ছেলেটা তো এক পর্যায়ে আমার কোলের কাছে এসে মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করল। আরে, এই ছেলে হাসে কেন? আমার চেহারা কি কার্টুনের মতো? ‘অ্যাই ছেলে, সর এখান থেকে।’ মনে মনে বললাম। এমন সময় দেখি মাহা উঠে আসছে। আমি বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললাম, ‘কী নাম তোমার?’
‘তুমি…তুমি এত মোটা কেন?’ বাচ্চাটা বলল। আশপাশের সবাই হাসতে শুরু করল। বাচ্চার বাবা বললেন, ‘ছি ছি রায়ান। এটা কেমন কথা? আঙ্কেলকে সরি বলো।’
‘বলব না।’ রায়ান ঘুরে মায়ের কাছে চলে গেল। ভদ্রলোক অস্বস্তি নিয়ে বললেন, ‘সরি ভাই। এক্সট্রিমলি সরি। ছেলেটা এত দুষ্টু। কিছু মনে করবেন না।’
‘না না, ঠিক আছে।’ হাসার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ চেষ্টা। সিনেমা শুরু হওয়ার এত আগে হলে ঢোকাই ভুল হয়েছে আমার।
‘রায়ান, হোয়াট ইজ দিস?’ বাংলায় কাজ হয়নি দেখে ইংরেজিতে রায়ানকে শাসানোর চেষ্টা করছেন তার মা। ‘আমি কিন্তু এক্ষণ চলে যাব। সিট ডাউন।’
‘কী হয়েছে?’ মাহা এসে বসল।
‘এই পিচ্চি আমাকে বলে, তুমি এত মোটা কেন?’ ফিসফিস করে বললাম আমি। মাহা শব্দ করে হাসতে গিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। ফিসফিস করে বলল, ‘কতবার বলেছি, জিম করো। ওজন কমাও। তোমার যে অবস্থা, একটা বাচ্চাও বোঝে যে তুমি মোটা। নাও, ধরো ট্রেটা।’
ঠিক তখনই নিভল হলের বাতি। জাতীয় সংগীত শুরু হলো। রায়ান বলে উঠল, ‘মা, কারেন্ট চলে গেছে! কারেন্ট চলে গেছে।’ ট্রে হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বাচ্চা দুটো এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, যেই সবাই দাঁড়িয়েছে, ওরা সিটে বসে পড়ল। পোলাপান! দেশের প্রতি ভালোবাসা নেই। অন্ধকারেই ওদের দিকে একটা কড়া লুক দিলাম।
সিনেমা শুরু হলো। ট্রে হাতে নিয়ে বসে আছি। মাহা পপকর্ণ আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাচ্ছে ট্রে থেকে। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী হলো, খাচ্ছ না কেন?’
‘নাহ, আমার ওজন বেশি। মানুষ মোটা বলে। খাওয়া কমাতে হবে।’
‘ঢং কোরো না। খাও।’
খাবার সামনে থাকলে অন্য কিছু আর মাথায় থাকে না আমার। খেতে শুরু করলাম। স্ক্রিনে ততক্ষণে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। এতগুলো গুলিতে নায়কের কিছু না হলেও রায়ানের বোন বিকট শব্দে কান্না শুরু করল। যেন কিছুই হয়নি, এমন একটা ভাব করে আশপাশের লোকজন তাকিয়ে রইল স্ক্রিনের দিকে। কিন্তু আমি বারবার ওই দম্পতির দিকে তাকাচ্ছি। আমার আশা, ওনারা বুঝবেন যে মানুষ বিরক্ত হচ্ছে। হয় বাচ্চাকে থামাবেন, না হয় বেরিয়ে যাবেন। কান্না থামিয়ে আবার আসবেন। কিন্তু তাঁদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বাচ্চা কাঁদছে, তাঁরা ‘কাঁদে না কাঁদে না’ বলছেন ঠিকই, কিন্তু এর বেশি কিছু করছেন না। মেয়েটার কান্না থামতেই রায়ান শুরু করল প্রশ্ন। ‘বাবা, ওকে মারছে কেন? ওরা পিস্তল পেল কোথায়? পুলিশ কিছু বলছে না? এটা কী গাড়ি? এই গাড়িটা আমাকে কিনে দেবে…’
আশপাশের মানুষ এবার একটু উসখুস করছে। অনেকেই তাকাচ্ছে রায়ানের মা–বাবার দিকে। কিন্তু তাঁরা হয়তো ভাবছেন, এটা তাঁদের ড্রয়িংরুম। বাচ্চারা এমন করবে, এটাই স্বাভাবিক।
বিরতির সময় আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ভাই, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে আপনার ছেলেমেয়েরা দারুণ পারফর্ম করল।’
‘মানে?’
‘যেসব জায়গায় কান্নার ঘাটতি ছিল, আপনার মেয়ে কাঁদল। ছেলে ডায়ালগ দিল।’
‘এসব কী বলছেন?’ মাহা ততক্ষণে আমার হাত ধরে টানতে শুরু করেছে।
‘বলব না? এটা কি বাচ্চাদের মুভি? জানা কথা এখানে ভায়োলেন্স থাকবে। আপনারা বাচ্চা নিয়ে এসেছেন, পুরো সময় এরা সবাইকে বিরক্ত করছে, আপনাদের কিছু মনে হচ্ছে না?’
‘আর কারও তো সমস্যা হচ্ছে না। আপনি কথা বলছেন কেন?’ পাশ থেকে বললেন রায়ানের মা।
‘সবার সমস্যা হচ্ছে। কেউ বলছে না ভদ্রতা করে।’
‘আরে থামেন তো ভাই। বাদ দেন। বাচ্চা মানুষ।’ রায়ানের সামনে বসা পাঞ্জাবি পরা লোকটা বললেন। ‘মুভি শুরু হয়ে গেছে। এসব নিয়ে আর ঝামেলা কইরেন না।’
এই লোক বলে কী! আমি ঝামেলা করছি? কী হাস্যকর। মাহা রাগ করে বলল, ‘আমি আর কোনো দিন তোমার সঙ্গে মুভি দেখতে আসব না।’
একি জ্বালা! সব দোষ আমার ওপরে এসে পড়ল? আশ্চর্য ব্যাপার তো।
সিনেমা শুরু হতেই রায়ানের বোন আবার কান্না শুরু করল। মাহাকে বললাম, ‘এই মেয়ের মনে হয় সিনেমাভীতি আছে। সিনেমা যখন হয়, তখন কাঁদে।’
মাহা সাপের মতো ফোঁস করে উঠল। কথা বলল না। সিনেমা থেকে ততক্ষণে আমার মন উঠে গেছে। আমি বাচ্চাদের মা–বাবাকে দেখছি। দেখতে চাই এঁরা কী করেন। রায়ানের মা তাঁর ফোন চালু করে দিলেন মেয়েকে। মেয়ে কান্না থামাল। রায়ান তখন সিটে শুয়ে পড়ছে। আবার উঠে বসছে। কয়েকবার আমাদের এদিকে হেঁটেও গেল। শেষবার আমাদের সামনে থেকে হেঁটে বাবার কাছে ফেরার সময় পা হড়কে পড়ে গেল মাটিতে। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ‘হোয়াট আ সিন!’ বলে আমি হাততালি দিয়ে উঠলাম। অনেকেই তাকাল আমার দিকে। রায়ানও কাঁদতে শুরু করেছে। ওর হাতে কোক ধরিয়ে দিলেন বাবা। মাহা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘কী অসভ্য আচরণ করছ তুমি! একটা বাচ্চা ছেলে, পড়ে গেছে, তুমি হাততালি দিচ্ছ!’
‘আরে না, সিনটা দারুণ! দেখলে না, টপ নচ!’
স্ক্রিনে তখন নায়ক–নায়িকার রোমান্টিক মুহূর্ত। দুজন দুজনার কাছে আসি আসি করছে। সবাই চুপ। নায়িকার উদ্দেশে নায়ক আবেগপ্রবণ কিছু একটা বলবে যখন, তখনই আমার পাশ থেকে বেজে উঠল বেবি শার্ক ডু ডু ডু, বেবি শার্ক ডু ডু ডু, বেবি শার্ক…। রায়ানের বোন মোবাইলে বেবি শার্ক বাজাচ্ছে। বাহ। কী দারুণ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। আবার হাততালি দিলাম আমি। আসল মুভি তো এটাই। আশপাশের দর্শক চরম বিরক্তি প্রকাশ করল এবার। কিন্তু রায়ানের মা–বাবা কর্তৃপক্ষের মতো নীরব। তাঁরা পুরো সিনেমা না দেখে যাবেন না। আমিও যাব না। দেখি শেষে কী হয়।
তবে শেষে যে এ রকম টুইস্ট থাকবে, তা আমিও ভাবিনি। সিনেমায় যখন চরম ক্রাইসিস, ঘটনা কোন দিকে যাচ্ছে কেউ যখন বুঝতে পারছে না, তখনই ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিল রায়ান। কোকের গ্লাস নিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে পুরো গ্লাস ফেলে দিল সামনে বসা লোকটার ঘাড়ে।
‘আরে, একি!’ বলে লাফিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। কেউ কেউ ফোনের আলো জ্বালল। লোকটার ঈদের পাঞ্জাবি ভিজে চুপচুপে।
‘এটা কী হলো?’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। ‘কী হলো এটা?’
‘সরি ভাই। এক্সট্রিমলি সরি। রায়ান, আঙ্কেলকে সরি বলো।’ রায়ানের বাবা বলে উঠলেন।
‘রায়ান, হোয়াট ইজ দিস?’ বললেন রায়ানের মা। ‘আমি কিন্তু এক্ষণ চলে যাব। সিট ডাউন!’
‘আরে ভাই, পুরা দুই ঘণ্টা এভাবে ডিস্টার্ব করলেন, আর আছে ২০ মিনিট! একবারে শেষ করেই যান।’ টিস্যু দিয়ে পাঞ্জাবি মুছতে মুছতে বললেন ভদ্রলোক।
এ সময় আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। হেসে বললাম, ‘বাদ দেন ভাই। বাচ্চা মানুষ।’ ঠিক এ কথাই একটু আগে লোকটা আমাকে বলেছিলেন। তাঁর কথা তাঁকে ফিরিয়ে দিতে পেরে একটা পৈশাচিক আনন্দ হলো আমার। সিনেমা দেখে আনন্দ পাইনি (সিনেমা তো দেখতেই পারিনি ঠিকমতো)। কিন্তু স্ক্রিনের বাইরের এই এন্ডিংটা খুব ভালো লেগেছে।