জহির রায়হানের অগ্রন্থিত গল্প
অজগর
১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকার মিরপুরে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কথাশিল্পী জহির রায়হান। গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল তাঁর মৃত্যুদিন। এ লেখককে স্মরণ করে প্রকাশিত হলো তাঁর অগ্রন্থিত একটি গল্প
খরচার আর অন্ত নেই।
টাকা আসছে।
টাকা যাচ্ছে।
একটা পয়সা যে জমিয়ে রাখব, সে উপায় নেই।
তিন মেয়ে, দুই ছেলে।
বড় মেয়ের বিয়েতে এক কুড়ি হাজার টাকা যে কেমন করে বেরিয়ে গেল, টেরই পেলাম না।
দুই ছেলে পড়ছে।
একজন বিদেশে। জার্মানিতে।
আরেকজন চাটগাঁয়ে। ক্যাডেট কলেজে।
খরচা অনেক।
দুই মেয়ে।
একজন বিলেতে আছে।
আরেকজন হলি ক্রসে পড়ে।
আজ এটা। কাল সেটা।
খরচার অন্ত নেই।
স্ত্রী আমার দুই বেলা মে-ফেয়ারে যান চুল বাঁধতে।
বাঁধেন।
খেলেন।
আবার বাঁধেন।
পয়সা আমাকে জোগাতে হয়।
শহরে দুটো বাড়ি আছে আমার।
অতি কষ্টে বানিয়েছি।
গাড়িও কিনেছি একটা।
কী করব, স্ত্রী আর কন্যার বিশেষ প্রয়োজন।
গাড়ি ছাড়া রাস্তাঘাটে বেরোনো যায় না।
আয়া। চাকর। বাবুর্চি। ড্রাইভারের মাইনে জোগাতে গিয়ে আমাকে রীতিমতো হিমশিম খেয়ে যেতে হয়।
তা ছাড়া।
প্রতি রোববারে সিনেমা দেখা।
প্রতি সপ্তাহে দুই দিন করে চাইনিজ খাওয়া।
মাসে একটা করে পার্টি।
স্ত্রীর শাড়ি।
কন্যার বেলবটম।
ছেলের পিকনিকের চাঁদা।
বাড়ির ট্যাক্স।
জমির ট্যাক্স।
পানির ট্যাক্স।
এত খরচা কেমন করে জোগাই আমি!
এই শহরতলির ছোট্ট এক স্টেশনের সামান্য স্টেশনমাস্টার আমি।
বেতন মাসে আড়াই শ টাকা।
কাজী জাহিদুল হক
কিংবদন্তিতুল্য চলচ্চিত্র নির্মাতা হলেও প্রথম জীবনে লেখালেখির মধ্য দিয়েই সংস্কৃতির বৃহত্তর অঙ্গনে পা রাখেন জহির রায়হান (১৯৩৫-১৯৭২)। মাত্র ৩৭ বছরের জীবনে চলচ্চিত্রের পাশাপাশি তিনি এমন কিছু গল্প-উপন্যাস রচনা করেছেন, বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে যা তাঁকে স্থায়ী আসন দিয়েছে। জহির রায়হানের জীবদ্দশায় প্রকাশিত একমাত্র ছোটগল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ। তাঁর ছোটগল্পের বড় অংশ গ্রন্থভুক্ত হয় তাঁর মৃত্যুর পর। সূর্যগ্রহণ–এ গ্রন্থিত গল্পগুলোসহ মোট ১৯টি গল্প নিয়ে ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় জহির রায়হানের গল্পসমগ্র। তারপরও এ কথাশিল্পীর অনেক গল্প অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। অগ্রন্থিত ৭টি গল্পের সমন্বয়ে আমার সম্পাদনায় প্রথমা প্রকাশন থেকে জহির রায়হানের অগ্রন্থিত গল্প সংকলন যখন যন্ত্রণা প্রকাশিত হয় জানুয়ারি, ২০২৩ সালে। অক্টোবর, ২০২৩-এ প্রকাশিত গ্রন্থটির প্রথম বর্ধিত সংস্করণে আরও তিনটি গল্প যুক্ত হয়। এখনো নানা অনুসন্ধানে তাঁর অগ্রন্থিত ছোটগল্পের খোঁজ মিলছে। এখানে পত্রস্থ হওয়া ‘অজগর’ গল্পটি তেমনই একটা অনুসন্ধানের ফল। গল্পটি প্রথম ছাপা হয়েছিল ১৯৭০ সালে গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ সম্পাদিত সচিত্র সন্ধানীর ১৪ বর্ষ: ৪র্থ সংখ্যায় (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৭০/ ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৭৭)। পরে গল্পটি আর কোনো গল্পগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ গল্পে লেখক গত শতকের সত্তরের দশকের একজন স্বল্প বেতনের চাকরিজীবীর পরিবারের সদস্যদের বিলাসিতার যে চিত্র এঁকেছেন, ৬৫ বছর পরে এসেও অনেক ক্ষেত্রেই তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বিলাসিতার অর্থ তিনি অবৈধ পন্থায় উপার্জন করেন। বর্তমান সমাজে এমন অজগরের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদের নিয়ন্ত্রণের যেন কেউ নেই। গল্পটির বিন্যাসে লেখক অনেকটা কবিতার মতো নীরিক্ষা করেছেন। এখানে মুদ্রণের সময় সমকালীন বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।