সবকিছু নিয়ে গল্প হয় না

অলংকরণ: আরাফাত করিম

তাঁর কোনো নাম ছিল না। মা তাঁকে ডাকতেন ‘রতনের মা’ বলে, আমরা ডাকতাম চাচি। গ্রামের অন্য পাশে ছিল তাঁদের বাড়ি, তবু প্রায় প্রতিদিনই তিনি আসতেন আমাদের বাড়িতে, সারা দিন কথা বলতেন মায়ের সঙ্গে, বিরামহীন কথা। মা কাজ করতে করতেই তাঁর কথা শুনতেন, তিনিও মাকে সহায়তা করতেন কাজ শেষ করার জন্য। আমাদের ভালো লাগত না। সারা দিন একজন মানুষ মাকে দখল করে রাখলে আমাদের ভালো লাগবেই–বা কেন? কিন্তু এ নিয়ে কোনো অভিযোগ-অনুযোগ করা যেত না, তাঁকে নিয়ে আমরা যেন কিছু না বলি, সে ব্যাপারে মায়ের পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞা ছিল। না, তিনি আমাদের কোনো আত্মীয় নন, গ্রামের এক দরিদ্র মানুষ, তবু মায়ের কাছে তাঁর এত গুরুত্ব ছিল কেন, বুঝে উঠতে পারতাম না।

খাওয়ার সময় হলে মা তাঁকে খেতে দিতেন। সামান্যই খেতেন তিনি, বাকিটা তুলে রাখতেন। বলতেন, ‘সিদ্দিকের জন্য নিয়া যামু।’

মা বলতেন, ‘তুমি পেট ভইরা খাও রতনের মা, আমি সিদ্দিকের জন্য তুইলা রাখছি, যাওয়ার সময় নিয়া যাইয়ো।’

কিন্তু তাও তিনি খেতেন না। এই সিদ্দিক হলো তাঁর নাতি। মানে, রতনের ছেলে। একমাত্র তারই একটা নাম ছিল। বাকিরা রতনের মা, রতনের বাপ, রতনের বউ ইত্যাদি। অবশ্য রতনের বোনেরও একটা নাম ছিল—মুক্তা। আমরা কখনো রতনকে দেখিনি, বাকি সবাইকে দেখেছি। তো, সিদ্দিক আমাদেরই বয়সী, কিন্তু আমাদের মতো স্কুলে যেত না। যেত তার দাদার সঙ্গে। বয়স হয়ে গিয়েছিল, তাও হেঁটে হেঁটে ভিক্ষা করতে হতো তাঁকে। কাজ করার মতো শক্তিসামর্থ্য ছিল না, এমনকি প্রতিদিন ভিক্ষা করার জন্য গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়াবার মতো অবস্থাও ছিল না। কিন্তু উপায়ই–বা কী? সংসার তো চালাতে হবে! আয়রোজগার করার মতো আর কেউ তো ছিল না তাঁর পরিবারে। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ মানুষই অসচ্ছল, নিজেদেরই ঠিকমতো চলে না, নিয়মিত ভিক্ষা তারা দেবে কীভাবে? ফলে তাঁকে যেতে হতো দূরের কোনো গ্রামে, যেন নিজের গ্রামে প্রতিদিন ভিক্ষা না করতে হয়। বুড়ো মানুষ, একা দূরদূরান্তে যেতে সাহস পেতেন না, তাই সিদ্দিক তাঁর সঙ্গে যেত। রতনের বউ, মানে সিদ্দিকের মা, শহরে এক বাসায় থাকতেন গৃহকর্মী হিসেবে। বছরে দু–তিনবার ছুটি পেতেন, কেবল তখনই সিদ্দিক তার মাকে কাছে পেত।

মা তাঁকে ডাকতেন ‘রতনের মা’ বলে, আমরা ডাকতাম চাচি। গ্রামের অন্য পাশে ছিল তাঁদের বাড়ি, তবু প্রায় প্রতিদিনই তিনি আসতেন আমাদের বাড়িতে, সারা দিন কথা বলতেন মায়ের সঙ্গে, বিরামহীন কথা। আমাদের ভালো লাগত না। সারা দিন একজন মানুষ মাকে দখল করে রাখলে আমাদের ভালো লাগবেই–বা কেন?

আমরা এদের সবার সম্বন্ধে জানতাম। গ্রামের ধরনটাই এ রকম। সবাই সবাইকে চেনে, ঘরের খবর রাখে, আত্মীয় না হয়েও একটা আত্মীয়তার বন্ধন থাকে। কিন্তু জানতাম না কেবল রতন সম্বন্ধে। অবশ্য এ–ও ঠিক যে এসব নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতাম না। গ্রামে কত মানুষ, কত প্রতিবেশী। তা ছাড়া গ্রামের সীমানা তো আর দেশের সীমান্ত নয় যে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে হলে পাসপোর্ট লাগবে! সত্যি বলতে কি, আমরা জানতামই না, কোন গ্রামের সীমানা কোন পর্যন্ত। স্বাভাবিকভাবেই, আশপাশের গ্রামের মানুষকেও একই রকম আপন মনে হতো। সংগত কারণেই একটামাত্র পরিবার নিয়ে এত চিন্তা করার কিছু ছিল না। রতনের মা প্রায় প্রতিদিন আসতেন আর মা প্রায় সারা দিন তাঁর কথা শুনতেন বলে অতটুকু মনোযোগ পেতেন। তা ছাড়া আমরা তখন ছোট, স্কুলে পড়ি; বন্ধুবান্ধব, খেলাধুলা, পড়াশোনা—এসব নিয়েও তো ব্যস্ত থাকতে হতো। রতন কে বা কোথায়, এ নিয়ে তাই খুব বেশি কৌতূহল ছিল না।

রতনের বোনটা ছিল বয়সে আমার চেয়ে বড়, সে কখনো আমাদের বাড়ি এলে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। ব্যাপারটা আমার কাছে অস্বস্তিকর ছিল। একদিন মাকে বললাম, ও আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকে কেন? ওকে এ বাড়িতে আসতে না করে দাও।

মা ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে মুক্তা, তুই খোকার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকিস কেন?’

ও বলল, ‘ভাইজানের (মানে আমার) মুখটা এক্কেরে মিয়াভাইয়ের (মানে রতনের) মতন লাগে।’

মা আর কিছু বললেন না। আমিও পাল্টা কিছু বলার মতো পেলাম না। আমার মুখে সে তার ভাইয়ের ছায়া দেখতে পায়, তাই তাকিয়ে থাকে, এই কথা শোনার পর আর কী–ই বা করার থাকে? কিন্তু ওর মিয়াভাই, মানে রতন লোকটা আসলে কোথায়? মাকে এ প্রশ্ন দু–একবার করলেও উত্তর পাইনি, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ করে থাকতে দেখেছি। ফের জিজ্ঞেস করার কথা মনেও হয়নি।

তো, ছোটবেলাটা এই রকম জানা না-জানা, বোঝা না-বোঝা নিয়ে কেটে যাচ্ছিল এবং না-জানা না-বোঝা বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে ভেবেও দেখিনি। কিন্তু ছোটবেলা চিরকাল থাকে না, বড় হয়ে যেতে হয়, না চাইলেও অনেক কিছু জানতে হয়, বুঝতে হয়, সেসব জানা-বোঝা সব সময় সুখকর হয় না। যেমন সব মানুষকেই একসময় মরে যেতে হয়, এ কথা জানলেও মৃত্যু ব্যাপারটা ঠিক কেমন, তা বাবার মৃত্যুর আগে আমার জানাই ছিল না। ঘটনাটা ঘটল আমার ষোলো বছর বয়সে। সবে স্কুল ছেড়ে কলেজে ভর্তি হয়েছি, গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছি, তখন। বাবা যেন আমার শোকেই মারা গেলেন। নইলে এমন কী আর বয়স হয়েছিল তাঁর? শহরে আসা আমার জন্য অস্বাভাবিক ছিল না। মা–বাবাও শহরেই ছিলেন, বাবা সরকারি চাকরি করতেন, অবসর গ্রহণের পর শহরে মন টিকত না বলে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকতেন। শহরে আমার অন্য ভাইবোনেরা রয়ে গিয়েছিল। আমি সবার ছোট ছিলাম বলে চলে গিয়েছিলাম মা-বাবার সঙ্গে। তো, এখন বড় হয়েছি, কলেজে পড়ব, শহরে না এলে চলবে কীভাবে? কিন্তু আমার সেই আসা আনন্দময় হলো না। বাবা না থাকা যে সাংঘাতিক একটা ব্যাপার, আর কোনো দিন বাবা বলে ডাকতে পারব না, এই সত্য যে কী অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করে, তা বলার মতো নয়। আমার তখন খুব সিদ্দিকের কথা মনে পড়ত। ও তো কখনো তার বাবাকে দেখেইনি, কেমন লাগে ওর?

গ্রামের জীবন ছিল নিস্তরঙ্গ, সেখানে আলোড়ন তোলা ঘটনা কমই ঘটত। শহরে উল্টো। পরিবারে, সমাজে, এমনকি জাতীয় জীবনে ঘটনা ঘটতেই থাকে। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের পরিবারে আরেক ঘটনা ঘটল। আমার ছোট চাচা অনেকগুলো বছর জেল খেটে বেরিয়ে এলেন। আমি খুব ছোটবেলায় দেখেছি তাঁকে, তেমন কোনো স্মৃতি নেই। তবু জেলফেরত চাচাকে বড় আপন মনে হলো, তাঁর কাছে গেলে যেন বাবার গন্ধ পেতাম। চাচার এই জেলবন্দী হওয়ার ব্যাপারটা নিয়েও আমাদের পরিবারের কেউ কথা বলত না। কিন্তু তিনি ফিরে আসার পর আমি তাঁকে আঁকড়ে ধরলাম, বাবার অনুপস্থিতিতে চাচাই হয়ে উঠলেন আমার আশ্রয়। বাবার সঙ্গে খুব একটা গল্প হতো না; বরং ভয়ই পেতাম, চাচার সঙ্গে আমার গল্প আর ফুরাতই না। তাঁর কাছেই জানতে পারলাম, তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীতে। ছুটিতে এসেছিলেন বাড়িতে। তখনই দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। তিনি আর ফিরে না গিয়ে নিজের এলাকার তরুণদের সংগঠিত করতে থাকেন এবং একসময় ট্রেনিং দিয়ে গড়ে তোলেন এক ছোটখাটো বাহিনী। পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাঁর বাহিনীসহ যোগ দেন দুই নম্বর সেক্টরে। পরিণত হন দুর্ধর্ষ এক যোদ্ধায়। সেই সব গল্প শুনতে শুনতে আমার দিনরাত একাকার হয়ে যেত।

রতনের বোনটা ছিল বয়সে আমার চেয়ে বড়, সে কখনো আমাদের বাড়ি এলে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। একদিন মাকে বললাম, ও আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকে কেন? ওকে এ বাড়িতে আসতে না করে দাও। মা ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে মুক্তা, তুই খোকার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকিস কেন?’

যুদ্ধ একসময় শেষ হয়, দেশ স্বাধীন হয়, কিন্তু চাচার ভেতরে একটা পরিবর্তন আসে। সেনাবাহিনীতে ফিরে না গিয়ে, এমনকি অস্ত্র জমা না দিয়ে, তিনি যোগ দেন আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিতে। তারই পরিণতি এই দীর্ঘ কারাবাস। সে এক দীর্ঘ গল্প।

মুক্তিযুদ্ধে চাচার কয়েকজন সহযোদ্ধা শহীদ হন, তাঁদের নাম বলতে গিয়েই তিনি একদিন রতনের নাম বলেন। আমি চমকে উঠি, রতন? মানে সিদ্দিকের বাবা?

হ্যাঁ।

তাহলে যে শুনতাম, রতন হারিয়ে গেছে!

হারিয়েই তো গেছে। চিরতরে হারিয়ে গেছে।

কিন্তু চাচি, মানে রতনের মা তো অপেক্ষা করে আছেন। উনি তো বলেন, রতন একদিন ফিরবেই।

কারণ, ওনাকে ওভাবেই বলা হয়েছে।

কেন? তা বলা হয়েছে কেন?

চাচা এবার বিস্তারিতভাবে রতনের গল্প বলেন। সেটি এ রকম:

শুরুতে মুক্তিযুদ্ধের কোনো কেন্দ্রীয় কমান্ড ছিল না, যুদ্ধকালীন সরকার ছিল না, সেনাপতি ছিল না, সেক্টর ছিল না, কিন্তু প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল। ইপিআর, পুলিশ আর সেনাবাহিনীর বাঙালি সেনারা যেমন বিদ্রোহ করেছিলেন, তেমনি বেসামরিক লোকজনও সাধ্যমতো প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারাও সেই বিদ্রোহে শামিল হয়েছিলেন। যেমন ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি আর্মিরা ভয়ংকর গণহত্যা শুরু করার পর, খবর পেয়েই ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী মানিকগঞ্জ থানায় আক্রমণ করে সমস্ত অস্ত্র দখল করে নেন। তারপর মানিকগঞ্জের নানা অঞ্চল ঘুরে ঘুরে তরুণদের সংগঠিত করেন, যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। পরে তিনি দুই নম্বর সেক্টরে ১৬টা থানার কমান্ডারের দায়িত্ব পান। ক্যাপ্টেন সাহেব আমাদের এলাকায়ও এসেছিলেন, আমাদের বাড়িতেই ক্যাম্প করেছিলেন। তাঁর কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্য যুবকদের মতো রতনও যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠল। অন্যদের সঙ্গে রতনও ট্রেনিং পেল। যুদ্ধের ট্রেনিং তো কঠিন, ও সব পরীক্ষায় উতরে গেল, অস্ত্রও চালানো শিখল, যেকোনো টার্গেটে নিখুঁতভাবে লক্ষ্যভেদ করতে শিখল। কিন্তু সেই টার্গেট হতে হবে জড়বস্তু। ও ছিল খুব নরম মনের ছেলে। একটা পাখিও মারতে পারত না, মায়া লাগত বলে। কৃষিশ্রমিক ছিল সে, কৃষকেরা ফাঁদ পেতে ইঁদুর ধরত, আর ও গিয়ে গোপনে ছেড়ে দিত বলে জমির মালিকের বকাবাজি কম শুনত না। অথচ যুদ্ধ মানেই হলো শত্রুকে ঘায়েল করা, মায়াদয়ার কোনো ব্যাপার নেই। একবার এক অপারেশনে পাকিস্তানিদের রেঞ্জের ভেতরে পেয়েও সে গুলি করল না। কেন? ওর উত্তর: মানুষ তো! ওকে যতই শেখানো হোক যে শত্রুপক্ষকে মানুষ বলে ভাবা যাবে না, ভাবলে যুদ্ধ করতে পারবে না। কিন্তু ওর ওই একটাই কথা, শত্রু হলেও মানুষ তো! মহা মুশকিল। এভাবে তো যুদ্ধ হয় না। কী করা যায় ওকে নিয়ে? যুদ্ধ সে করবেই, কিন্তু কাউকে মারতে পারবে না! অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, ওকে নৌকা চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হবে। তখন তো বর্ষাকাল, নদীনালা-খালবিল-মাঠঘাট সবই পানিতে ডুবে আছে, সেবারের বর্ষাটাও দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। নতুন দায়িত্ব পেয়ে রতন খুশি। মারামারির ঝামেলা নেই, আবার কাজও করতে পারছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এখান থেকে ওখানে যাচ্ছে নৌকা বেয়ে। সাহসী ছিল ও। পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ের ভেতরেও ও অনায়াসে নৌকা চালাতে পারত। তো, সে রকমই একবার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এক নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেল, দূর থেকে ধেয়ে আসছে স্পিডবোট। মুক্তিযোদ্ধাদের স্পিডবোট ছিল না, নৌকাই ছিল তাঁদের সম্বল, পাকিস্তানিরাই আসছে বুঝতে দেরি হলো না কারও। বিপদ দেখে মুক্তিযোদ্ধারা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, কিন্তু রতন তো মাঝি, সে ঝাঁপ দিলে নদীর তীব্র স্রোতে নৌকা কোথায় ভেসে যাবে তার কি কোনো ঠিক আছে? আর নৌকা হারালে মুক্তিযোদ্ধারা চলাচল করবেন কীভাবে? যা হওয়ার তা–ই হলো, পাকিস্তানিরা ওকে ধরে নিয়ে গেল।

তার পরের ঘটনা আসলে কেউই ঠিকমতো জানে না। পাকিস্তানিরা কাউকে ধরে নিয়ে গেলে তার পক্ষে ফিরে আসা ছিল অসম্ভব, ওদের ক্যাম্প থেকে কাউকে উদ্ধার করাও সম্ভব ছিল না, কিন্তু রতন ফিরে এসেছিল।

কোনো স্থল ক্যাম্পে নয়, রতনকে আটকে রাখা হয়েছিল একটা লঞ্চে। পাকিস্তানিরা ওটাই ব্যবহার করত চলাচলের জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম-ঠিকানা-পরিচয় জানার জন্য অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়েছিল ওর ওপর। তবু সে মুখ খোলেনি। ‘শত্রু হলেও ওরা মানুষ তো’—এই কথা বিশ্বাস করত রতন, ওদের হাতে ধরা পড়ার পর ওর এই বিশ্বাস ভেঙে যায়। কোনো মানুষ তো আরেক মানুষকে এত নির্যাতন করতে পারে না!

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি আর্মিরা ভয়ংকর গণহত্যা শুরু করার পর, খবর পেয়েই ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী মানিকগঞ্জ থানায় আক্রমণ করে সমস্ত অস্ত্র দখল করে নেন। মানিকগঞ্জের নানা অঞ্চল ঘুরে ঘুরে তরুণদের সংগঠিত করেন, যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। পরে তিনি দুই নম্বর সেক্টরে ১৬টা থানার কমান্ডারের দায়িত্ব পান।

যাহোক, দিন কয়েক পর ওদের কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে রতন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার চিরচেনা পদ্মা নদীতে। জায়গাটা কোথায় সে জানত না, তবু পাকিস্তানিদের লঞ্চের চেয়ে উত্তাল পদ্মাকেই সে আপন ভেবেছিল, নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিল ভাটির টানে। তারপর কীভাবে কেউ জানে না, সে সাঁতরাতে সাঁতরাতে এসে উঠেছিল তার নিজের বাড়িতে। তত দিনে ওর জীবনীশক্তি শেষ, সারা শরীরে অকথ্য নির্যাতনের চিহ্ন, পরনের কাপড়টিতে শুকনো রক্তের দাগ, হয়তো খেতেও পায়নি কত দিন, সেই অবস্থায় সে এসে ওঠে বাড়ির সীমানায়।

মায়ের কাছে গিয়ে বলে, মা, ‘তোমার কোলে ঘুমাইতে দাও। আমি মাইলের পর মাইল সাঁতার দিয়া আসছি তোমার কোলে শুইয়া ঘুমামু বইলা’।

মায়ের কোলে শুয়ে সে যে কথাগুলো বলতে পেরেছিল, সেখান থেকেই জানা গেছে তার ফিরে আসার এই গল্প। মায়ের কোলে মাথা রেখেই সে মারা যায়। মা সংজ্ঞা হারান, বউ আর বোন বিলাপ করে, বাপ পাথরের মতো শক্ত থেকে প্রতিবেশীদের খবর দিতে যায়। কবর তো দিতে হবে!

আমি জিজ্ঞেস করলাম: কিন্তু চাচা, রতন তো ফিরে এসেছিল, তাহলে ওর মাকে কেন বলা হলো, ও হারিয়ে গেছে?

উনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। জ্ঞান ফেরার পর আর মনেই করতে পারেননি যে রতন তাঁর কোলে শুয়ে মারা গেছে। শুধু ওকে খুঁজতেন। আমরাই গিয়ে ওনাকে বলেছিলাম...

কবর কোথায় হলো?

গ্রামের গোরস্তানেই।

কই, ওখানে তো কোনো স্মৃতিফলক দেখিনি!

স্মৃতিফলক?

হ্যাঁ! একজন বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধিতে স্মৃতিফলক থাকবে না!

গরিবদের ওসব থাকে নারে পাগল!

গরিব! মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও ধনী-গরিব ভাগ আছে?

আছে না?

তা থাকবে কেন?

রতনের মাকে কখনো শহীদজননী নামে ডাকা হয়েছে?

না।

ওর বাবাকে কখনো শহীদের পিতা বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে?

না।

ওর বউকে কখনো শহীদজায়া পরিচয়ে সম্মান করা হয়েছে?

না।

ওর ছেলে কখনো শহীদসন্তান হিসেবে কারও কাছ থেকে বাড়তি মনোযোগ পেয়েছে?

না।

অথচ এসব শব্দ তো কারও না কারও জন্য ব্যবহার করা হয়, তাই না?

হ্যাঁ, হয়।

এবার বুঝতে পারছিস যে গরিব হলে শহীদ হয়েও লাভ নেই। কোনো সম্মান জুটবে না। এমনকি স্বীকৃতিও না।

স্বীকৃতিও না?

না। রতনকে কখনোই শহীদ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়নি। অনেক চেষ্টা করেও করা যায়নি।

কেন? এটা কী ধরনের কথা?

মুক্তিযুদ্ধের মালিকানা তো সিক্সটিন ডিভিশনের হাতে চলে গেছে। সেখানে রতনের নাম থাকবে কী করে?

কোনো স্থল ক্যাম্পে নয়, রতনকে আটকে রাখা হয়েছিল একটা লঞ্চে। পাকিস্তানিরা ওটাই ব্যবহার করত চলাচলের জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম-ঠিকানা-পরিচয় জানার জন্য অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়েছিল ওর ওপর। তবু সে মুখ খোলেনি। ‘শত্রু হলেও ওরা মানুষ তো’—ওদের হাতে ধরা পড়ার পর ওর এই বিশ্বাস ভেঙে যায়।

এতক্ষণ ধরে যেসব ঘটনা বললাম, সেসব আসলে অনেক আগের কাহিনি। সেই যে বাবার মৃত্যুর পর কলেজে পড়তে শহরে এসেছিলাম, মাকেও নিয়ে এসেছিলাম, ভাইবোনেরা আগে থেকেই শহরে ছিল, ছোট চাচাও এসে যুক্ত হলেন, আমি কলেজ পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, আরও অজস্র ঘটনা-উপঘটনা পেরিয়ে বছর পাঁচেকের পর আমাদের পরিবারে একটা বড় বিপর্যয় ঘটল। আমাদের গ্রামের বাড়িটি বিলীন হয়ে গেল পদ্মার গ্রাসে। শুধু বাড়ি নয়, জমিজমা-সহায়সম্পদ এবং গ্রামও। আমরা সব হারালাম। এরপর বহু বছর আর ওই এলাকায় যাওয়া হয়নি। এক অদ্ভুত অভিমান আমাদেরকে গ্রাস করে ফেলেছিল। মনে হচ্ছিল, আমাদের বলপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং উচ্ছেদকর্তা স্বয়ং প্রকৃতি, যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উপায় আমাদের জানা নেই।

ওই এলাকার সঙ্গে একেবারেই বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল আমার। কিন্তু প্রায় পঁচিশ বছর পর, স্কুলের কয়েকজন অনুজ আমাকে খুঁজে বের করল। দাবি জানাল, স্কুলের শতবর্ষ উদ্‌যাপনের অনুষ্ঠানে যেতে হবে। মনটা কেঁদে উঠল! আবার যাব ওখানে! সহ্য করতে পারব তো! কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা, যেতেই হবে।

চিরচেনা পথ, গেলাম একাই। যেতে যেতে দেখলাম, পঁচিশ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। অনেক বাড়িঘর, অফিস–আদালত, রাস্তাঘাট। সব নতুন মুখ, কেউ আমাকে চেনে না, আমিও কাউকে চিনি না। পঁচিশ বছরের বিচ্ছেদ কম নয়!

উপজেলা সদরের কাছে নেমে রাস্তার পাশের একটা দোকান থেকে চা নিলাম, দাঁড়িয়ে চুমুক দিতে না দিতেই একটা ফোন এল; আয়োজকদের একজন: ভাই, আপনি কোথায়?

চা খাচ্ছি। তোমরা কোথায়?

আমরা তো অনুষ্ঠানে। কখন আসবেন?

এই আসছি।

ঠিক এই সময় শুনলাম, পেছন থেকে এক নারীকণ্ঠের ডাক: ভাইজান না?

ঘুরে তাকিয়ে তাকে দেখলাম, কিন্তু চিনলাম না।

আমি মুক্তা ভাইজান, চিনেন নাই?

চেনার কথা না। ওকে আমি শেষ দেখেছি অন্তত তিরিশ বছর আগে। দুজনের চেহারাতেই বয়সের ছাপ পড়েছে, ওর একটু বেশিই। বললাম, আমি তো চিনি নাই। তুমি চিনলা কেমনে? ছিলা তো পিছনে, সামনে থেইকা তো দেখোও নাই।

আপনের গলা শুইনা চিনছি ভাইজান।

গলা শুইনা?

হ। গলা শুইনাই মনে অইলো, এইরম গলা খালি ওই বাড়ির মানুষেরই আছে।

অবাক হলাম। তিরিশ বছর আগে আমি ছিলাম