একটি তুচ্ছ খুনের গল্প

গরম দুধের জামবাটি দস্তরখানে রেখে তালপাখায় বাতাস করছেন আয়েশা বেগম। বেশ দ্রুতগতিতে। গরম দুধ খেতে পারেন না তালুকদার। আগের রাতে একদফা জ্বাল দেওয়ার পর সকালে রান্না শেষে চুলার ঢিমে আঁচে অন্তত আধা ঘণ্টা না রাখলে দুধ রুচবে না তাঁর। অর্থাৎ দুধ অবশ্যই ঘন হতে হবে। প্রতিদিন সকালে ভাত খেয়েই একবাটি দুধ খাওয়া ছোটবেলার অভ্যাস তালুকদারের; আয়েশা বেগম বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এসে অবধি দেখছেন। দুধের বাটি আনার দায়িত্ব অবশ্য পেয়েছেন শাশুড়ির মৃত্যুর পর। শাশুড়ি যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন তিনিই ছেলেকে দুধটা অন্তত নিজ হাতে এনে পাশে বসে থেকে খাইয়েছেন। আয়েশা বেগম একই কাজ করে চলেছেন ত্রিশ বছর ধরে।

বাড়ির একমাত্র বউ নূরবানু আধা হাতমতো লম্বা ঘোমটায় মুখ ঢেকে এঁটো বাসন সরাচ্ছে। একে বয়স মোটে তেরো, তায় সদ্য বিবাহিতা, প্রবল প্রতাপশালী শ্বশুরের সামনে যুগপৎ ভীত ও আড়ষ্ট। ভারী কাঁসার নির্দিষ্ট থালা ছাড়া ভাত খান না তালুকদার; এঁটো থালা তুলতে গেলে খানিকটা পানি গড়াল। তালুকদার ভ্রু কোঁচকালেন। সতর্ক আয়েশা বেগম ঘটনাটা দেখছিলেন। তৎক্ষণাৎ হাতের পাখা ফেলে সামনে এগিয়ে এলেন।

‘তোমার মাও কি তোমাক কিচ্ছু শিখায় নাই, বউ? নওয়াবের বেটিক বিয়া না দিয়া কোলত থুইল না ক্যা তাইন?’ বলতে বলতে বউকে সরে যাওয়ার ইশারা করেন আয়েশা বেগম। লজ্জিত নূরবানু অধোবদনে পাকঘরের দিকে চলে যায়। তালুকদারের ভ্রু স্বাভাবিক রূপে ফিরে আসে। এবার দীর্ঘ একটা ঢেকুর তোলেন তিনি।

‘কই, জুড়াইল?’ স্ত্রীর উদ্দেশে বলেন তালুকদার সাহেব, ‘ট্রেন না ফেল করি আইজ!’

পাঞ্জাবির শেষ বোতামটা লাগিয়ে চোখে সুরমার গাঢ় প্রলেপ আঁকেন তালুকদার। ইত্যবসরে সিন্দুকের ডালা খোলেন আয়েশা বেগম। সিন্দুক থেকে টাকা বের করেন, খুঁতিতে ভরেন, টাকাভর্তি খুঁতি স্বামীর হাতে দেন। খুঁতি কোমরে বাঁধতে বাঁধতে তালুকদার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘পাঁচ হাজারই আছে তো?’ আয়েশা বেগম মাথা নাড়েন।

‘তোমার ব্যাটা বাইর হইল?’

‘ব্যাটা কি খালি মোর? শত্রু নাকি ছাওয়া! ঠেস ছাড়া কথা কন না যে!’ স্বামীর প্রশ্নের জবাবে গজগজ করেন আয়েশা বেগম। শেষ দিকে বোধ হয় গলাও বুজে আসে খানিক। ঈষৎ অস্বস্তি নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকান তালুকদার। বলেন, ‘আইনো তাইলে।’

উঠানে গরুর গাড়ি তৈরি। বলদ জোড়া তালুকদারকে দেখে গলা নাড়ে। টুংটাং শব্দ করে গলায় বাঁধা ঘণ্টি। তালুকদার গাড়িতে ওঠেন। ছইয়ের তলে পাতা বিছানায় বালিশে ঠেস দিয়ে বসেন। পাইক মনু মিয়া কাঁধের দোনলা বন্দুক সামলাতে সামলাতে হুঁকা এগিয়ে দেয়। নইবুদ্দি গাড়িয়াল ডান দিকের বলদের লেজ মোচড় দিলে হাঁটতে শুরু করে বলদরা। গাড়ির চাকা গড়ায়। তালুকদার সাহেব হুঁকা টানতে থাকেন। তামাকের ভুরভুরে মিঠে বাসনা সকালের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।

মনু মিয়া গাড়ির পেছন পেছন হাঁটে। জোর পায়ে। তার সাথে আরেকজনও হাঁটে। কালু। তালুকদার সাহেবের ছায়াসঙ্গী। পোষা কুকুর।

এদিকে এ রকম একটা কথা চালু আছে যে তালুকদার স্বীয় ছেলের অধিক ভালোবাসেন পোষা কুকুর কালুকে। শোনা যায়, বছর তিনেক আগে এক রাতে আড়ত থেকে বাড়িতে ফেরার পথে ডাকাতের কবলে পড়েন তালুকদার। তখনো পাইক কি বন্দুক ছাড়াই চলেন তিনি। গাড়িয়াল মহুবর ডাকাতের আভাস পেয়েই গাড়ি ছেড়ে দৌড়ে পালায়। সেই যে পালায়, আজ অবধি আর ফেরেনি সে। এদিকে ক্ষিপ্ত বাঘের মতো কালু ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাকাতদের ওপর। কালুর সাহসিকতায় সে যাত্রায় বেঁচে যান তালুকদার। পরবর্তীকালে নিজের নিরাপত্তার জন্য পাইক নিযুক্ত করেন, কেনেন দোনলা বন্দুকও। লাইসেন্স পেতে ঝামেলা হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। তালুকদার এ অঞ্চলে যথেষ্টই প্রভাবশালী—কি অর্থবলে কি লোকবলে।

বাড়ি থেকে স্টেশন মাইল তিনেকের পথ। বর্ষাকালে জল–কাদায় গরুর গাড়িতে আসা–যাওয়া করা মুশকিল হলেও বর্ষান্তে ততটা মুশকিল নয়। তায় এই বলদ জোড়া তেজি যথেষ্টই। ট্রেন ফেল করা যাবে না কোনোভাবেই। নইবুদ্দি একরকম তাড়িয়েই নিয়ে যাচ্ছে বলদদের। কাঠের চাকার ঘ্যাঁচরঘোঁচর শব্দে কান রাখা দায় হয়ে পড়েছে। পথের দুই ধারে ধানখেত। খেতের পর খেতজুড়ে চোখজুড়ানো সবুজ। একটু বাতাস উঠলেই দুলে উঠছে। খেতজুড়ে ঢেউ খেলছে রীতিমতো। ওই ঢেউ খেলে যায় তালুকদারের বুকেও। জমিজমা খোদা তাআলা কম দেননি। পথিপার্শ্বে জমি যা দেখা যায়, বলতে গেলে সবই তাঁর। পৈতৃক সূত্রে জমি যা পেয়েছিলেন, তার কয়েক গুণ বাড়িয়েছেন নিজে। কেবল গেরস্তি নিয়ে পড়ে থাকেননি, ধান–পাটের ব্যবসা করেছেন। রাখি মালের ব্যবসায় কাঁচা টাকা। ইদানীং স্টেশনের কাছেই আড়ত খুলেছেন। নুন, কেরোসিন, টিন—যা কিছুর চাহিদা আছে আশপাশের জনপদে, সেই সব নিয়ে পাইকারি কারবার। রমরমিয়ে চলছে ব্যবসা। বানের জলের মতো টাকা আসছে। সামনে ইউনিয়ন বোর্ডের ইলেকশন করবেন, এ রকম পরিকল্পনা। শুধু টাকায় কি আর ইজ্জত আছে!

তালুকদার সাহেবের চিন্তা কেবল ছেলেকে নিয়ে। পরপর দুই মেয়ের পর এক ছেলে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। সংসারে এখন ছেলে শুধু। আদরেই বড় করেছেন ছেলেকে। না, ছেলে আদরে বাঁদর হয়নি। বরং বোকাসোকা হয়েছে। বার কয়েক পরীক্ষায় বসেও স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারল না। অগত্যা তালুকদার আড়তে বসিয়েছেন তাকে। দেখেশুনে বিয়েও দিয়েছেন। কোনোটাই ঠিকঠাক সামলাতে পারছে না। তালুকদার সাহেবের মতো পুরুষের ঔরসে এ রকম ম্যাদামারা ছেলে কী করে জন্মাল, সে এক ধাঁধাই বটে।

ওই তো বসে আছে ছেলে। বাইশের নওজোয়ান। অথচ বসার ভঙ্গি দেখো—জড়োসড়ো, মাথা নিচু, ঝিমোচ্ছে। এখনো ঘুম সরেনি চোখ থেকে। বসেছেও নইবুদ্দির পিঠ ঘেঁষে। বাপের থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে। বাপকে বোধ হয় বাঘই ঠাওরায় সে। তালুকদার সাহেবের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

‘হামজা!’ মৃদুস্বরে ছেলেকে ডাকেন তালুকদার। সদ্যোত্থিত শিশুর মতো চোখ মেলে তাকায় হামজা। কয়েক মুহূর্ত বাদে সোজা হয়ে বসে। বলে, ‘জি, আব্বা।’

‘আমি তো সদর থাকি ফিরি আসতে আসতে রাইত হয়া যাইবে। কোর্টকাছারি সারি অ্যাকনা মহাজনের ঘরত যামো। টেকাপাইসা দিয়া আসমো কিছু তামার ঘরোক। আড়তত বসি ফির নিন যাইস না। বেচাবিক্রির দরকার নাই, পাইকার কয়েকজন আইসার কতা, টেকা দিলে নিবু, খাতাত তুলবু। কী, পারবু না?’

হামজা হাই তুলতে গিয়ে তোলে না, হাই চেপে নিচু স্বরে বলে, ‘জি, আব্বা।’

এই হলো ছেলে। এত বিষয়-আশয়, ব্যবসা ছেলে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। আবারও একদফা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তালুকদার।

আড়তের সামনে গাড়ি থামাল নইবুদ্দি। হামজা নেমে পড়ে। গাড়ি এগোয়। পেছনে মনু মিয়া। মাইল তিনেক পথ হেঁটে পরিশ্রান্ত। দরদর করে ঘামছে। কালুকে অবশ্য মোটেই ক্লান্ত দেখাচ্ছে না।

প্ল্যাটফর্মে পা রেখেই একনজর ডানে-বামে তাকালেন তালুকদার। যথারীতি যাত্রীদের ভিড়। দিনে–রাতে গোটা দুই ট্রেন যায়-আসে। দুইখানা ট্রেন মোট চারবার দাঁড়ায় এই স্টেশনে। কাজেকামে সদরে যেতে হলে লোকের একমাত্র ভরসা ট্রেনই। ফলে ভিড় লেগেই থাকে। ঘণ্টা পড়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেন ঢুকবে। তালুকদারকে দেখে বড়বাবু এগিয়ে এলেন, ‘স্লামালিকুম, তালুকদার সাব। তারিখ পড়ছে নাকি আইজ?’ হেসে জিজ্ঞেস করেন। তারিখ মানে মামলার তারিখ। মাসে কয়েকবার সদরের কোর্টে যেতে হয় তালুকদারকে, সবাই জানে। জমিজমা নিয়েই যত মামলা–মোকদ্দমা। জমি বাড়াতে গিয়ে কিছু বাঁকা পথও অবলম্বন করেছেন তালুকদার। আশপাশের গ্রামে কোথাও জমিজমাসংক্রান্ত বিবাদ কোর্টে গড়ালেই বাদী কিংবা বিবাদী কোনো এক পক্ষের কাছ থেকে মামলা কিনে নেন তিনি। মামলায় হার–জিতের ঝুঁকি নেন; যেহেতু বাজারের চেয়ে ঢের কম দামেই জমি পেয়ে যান। এভাবেই ইউনিয়নের কমবেশি সব মৌজাতেই জমির মালিক বনেছেন তালুকদার। সংসারে সোজা পথে সব হয় না তো।

ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালে ভিড়টা ট্রেনের দরজাগুলোর দিকে ভাগ হয়ে যায়। মনু মিয়া আগেই উঠে পড়ল। আশপাশের ভিড়টাকে সরায় সে। দরজার হাতল ধরে উঠতে গিয়ে তালুকদার টের পেলেন, লুঙ্গিতে টান পড়েছে। ঝুলন্ত অবস্থায়ই পেছনে ফিরে তাকালেন। কালু কামড়ে ধরেছে লুঙ্গির নিচের দিকটা। একটু ঝুঁকে কালুকে তাড়ালেন তালুকদার, ‘যা, যা। বাড়িত যা অ্যালা!’ কালু দুই-একবার লাফিয়ে বগিতে ওঠার চেষ্টা করে, উঠতে পারে না। যাত্রীদের মধ্যে একজন সাহস করে তাড়ায় কালুকে। তালুকদার বগিতে উঠে গেলে একে একে উঠে পড়ে বাকি যাত্রীরাও। করিতকর্মা মনু ভিড়ের ভেতরও মনিবের জন্য সিটের ব্যবস্থা করে ফেলেছে দেখে স্বস্তি পান তালুকদার। এই বয়সে ঘণ্টা কেন, কয়েক মিনিটও দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে। সিটে বসার পর অভ্যাসবশত কোমরে হাত দেন। খুঁতি গায়েব! সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মনুকে বলেন, ‘সব্বোনাশ হইছে রে, মনু। নামেক জলদি!’

‘এই কুত্তাই সব্বোনাশটা করিল। গাড়িত উঠব্যার সময় লুঙ্গি ধরি টানাটানি করতে পকেটমারা খুঁতি সরাইছে। উয়্যাক আইজ শেষ করমো আমি!’ বলতে বলতে মনুর কাঁধের দোনলা হাতে নেন তালুকদার।

কালুকে পাওয়া গেল স্টেশনমাস্টারের ঘরের সামনে। কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে দিব্যি। বাড়িমুখী হয়নি। রাত অবধি এখানেই থাকবে। বরাবর তা–ই থাকে। তালুকদারকে আসতে দেখে কালু উঠে দাঁড়ায়। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে গোটা কয়েক গুলি এসে বুকে বিঁধলে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, প্ল্যাটফর্মে পড়ে যায়। ক্রোধোন্মত্ত তালুকদার রক্তাক্ত কালুকে কষে লাথি ঝাড়েন। কিছুটা দূরে সরে যায় কালুর নিথর শরীর। দেখা গেল, কালুর রক্তে তালুকদারের টাকাভর্তি খুঁতি ভিজে গেছে। এতক্ষণ তাহলে খুঁতির ওপর শুয়ে ছিল কালু! বড়বাবুর সাথে কথা বলার সময় লুঙ্গির আলগা গিঁট ফের বেঁধেছিলেন মনে পড়ে তালুকদারের। খুঁতি ওই সময়ই পড়ে গিয়েছিল।

চৌধুরাণী নেহায়েত এক পাড়াগাঁর স্টেশন। আন্তনগর ট্রেন এখানে দাঁড়ায় না; উচ্চগ্রামে হুইসেল বাজিয়ে, প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে, ধুলা উড়িয়ে চলে যায়। বহুদিন এখানে রেলের কোনো স্টাফ নেই। স্টেশনের ছোট্ট লাল বিল্ডিংটা আর দোতলাসমান সিগন্যাল রুমটাই যা টিকে আছে। যদিও বড়বাবুর অফিসের দরজায় ভিমরুলের হাঁড়ি, টিকিট বেচার জানালায় চড়ুইয়ের বাসা। এখনো দিনে–রাতে দুইটি লোকাল ট্রেন আসা-যাওয়ার পথে চারবার দাঁড়ায় এখানে। সাবেদালি পয়েন্টসম্যান আর ঘণ্টি পেটায় না। তবু যাত্রীরা ওঠে-নামে। ওই সময়ই যা কিছু লোকের আনাগোনা থাকে। বাকি সময় স্টেশন সুমসাম পড়ে থাকে। দিন গেছে ঠিকই, এই স্টেশনের কোনো উন্নতি হয়নি। বরং দুই নম্বর লাইনে জং ধরে গেছে, তিন নম্বর লাইন চলে গেছে মাটির গভীরে। স্টাফ কোয়ার্টার্স, মালের গোডাউন ভাঙা পড়েছে অনেক আগেই। এই রুটে আর কোনো ধীরগতির দীর্ঘ মালবাহী গাড়ি চলে না। রেলের সেসব সুদিন গত হয়েছে। এখানকার ছোট ছোট চায়ের দোকানে আশপাশের বেকার লোকেদের আড্ডাই কেবল কিছুটা জ্যান্ত রেখেছে স্টেশনটিকে। কোনো চ্যাংড়া দোকানি দোকানে অনাহূত কুকুরের গায়ে গরম পানি ঢালতে গেলে আড্ডার বুড়োদের কেউ না কেউ তালুকদারের পোষা কুকুর কালুর গল্প করে। যদিও ওই ঘটনার পর কয়েক যুগ কেটে গেছে। কে না জানে, কেবল বুড়োরাই এসব ঘটনা মনে রাখে!