অর্ধেক বাঁদর

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

কুয়াশা কেটে যেতে শুরু করেছে। ঝাপসা আলো-আঁধারিও। কেটে যেতে শুরু করেছে চাঁদের আলো। স্পষ্ট হচ্ছে দৃশ্যগুলো। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে চরাচরের এতক্ষণের পরিপার্শ্ব।

একটু পর শোনা গেল রিকশার টুংটাং। তারপর বেড়ে চলল আরও বিবিধ শব্দ। শোনা গেল হাজারো মানুষের কোলাহল। দোকানপাট। বিকিকিনি। হকার। গাড়িঘোড়া। প্রেমিক–প্রেমিকা। ব্যবসায়ী। চাকরিজীবী। সরকারি কর্মচারী। ব্যাংকার। পরিচ্ছন্নতাকর্মী। ছদ্মবেশী পতিতা। হিজড়া। ভিআইপি। ট্রাফিক। মেট্রোরেল। মাইক। মাইকের শব্দ। ভদ্রলোক। পকেটমার। পথশিশু। কোটিপতি।

একটু আগের দূর্বাঘাসগুলো এখন কংক্রিটের রাস্তা। গাছগুলো এখন ল্যাম্পপোস্ট। কুয়াশার ঢেউগুলো এখন বড় বড় ভবন। এককথায় এক চিরচেনা নাগরিক শহর। ব্যস্ত শহরের বৈশিষ্ট্য নিয়ে চলমান প্রহর। প্রহর আসলে দ্বিপ্রহর। আলোকিত। উদ্ভাসিত। ঝকঝকে।

এতসব দৃশ্যের ভেতর দেখা গেল বিশ-বাইশ বছরের এক তরুণের রুদ্ধশ্বাস দৌড়। তার পেছনে দশ–বারোজন উচ্চকণ্ঠ কিশোর-যুবক। কারও হাতে উদ্ধত ছুরি, কারও হাতে চাপাতি। কারও হাতে কোনো না কোনো আঘাতসক্ষম অস্ত্র।

দৌড়মগ্ন তরুণ যুবকদের সামনে যে দৌড়াচ্ছে আতঙ্কিত হৃদয় নিয়ে, সে কিছু দূর গিয়ে পড়ে গেল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে তাৎক্ষণিক উঠে আবার দৌড় শুরু করল। যুবক দৌড়াতে দৌড়াতে একটি ভবনের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। দৃশ্যটি দেখতে থাকা জনতার ভেতর থেকে একজন বলে উঠল, এই বিল্ডিংয়ে ছেলেটা কাজ করে।

দৌড়মগ্ন যুবক দোতলায় উঠে একটা ঘরের মধ্যে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দরজায় ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। তখন পেছন থেকে কেউ একজন তার পেছনে চাপাতির একটা কোপ বসিয়ে দিল। রক্তমাখা পিঠ নিয়ে উঠে দাঁড়াল যুবক তবু। দৌড়ানো শুরু করল আবারও। সে হয়তো ভেবেছিল, এই ঘর তাকে নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু দরজা আটকে দিল তাকে। বাধ্য হয়ে এই সব আঘাতসক্ষম অস্ত্রের হাত থেকে নিজেকে আরেকটু বাঁচাতে সে পথ পরিবর্তন করল। কিন্তু গায়ে আগের মতো শক্তি নেই। পায়ে নেই আগের মতো গতি। পিঠ বেয়ে রক্তের স্রোত জীর্ণ পোশাকটাকেও ভারী করে তুলেছে। আর পারছে না সে।

গতি শ্লথ হয়ে যাওয়ায় দৌড়মগ্ন যুবকের পিঠে আরও একটি চাপাতির কোপ পড়ল। এই কোপ খেয়ে পড়ে যেতে যেতে পেছনে ফিরে তাকাল সে। কী যেন বলতে চেয়েছিল। তার আগেই মুখ বরাবর আরেকটি কোপ পড়ল। বিস্মিত-বিহ্বল-করুণ-আতঙ্কিত চোখ নিয়ে তবু সে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। আরেকটি আঘাত এসে তার বুকে লাগল। তবু মাথা তুলে তার হন্তারকদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তারপর আরও কিছুক্ষণ আঘাতসক্ষম অস্ত্রগুলো তাদের ক্ষমতা দেখাল।

তারা চলে গেল। পড়ে থাকল সবার আগে আগে দৌড়ানো যুবক। স্থির চোখ নিয়ে। তার আশপাশে তারই রক্তে অঙ্কিত রক্ত-চিত্রের মধ্যে।

এই দৃশ্যের আগে-পরে অনেক লোকজন দেখা গেল। কেউ নাকে–মুখে হাত চেপে সরে গেল। কেউ এগিয়ে গেল। কেউ ছবি তুলল। কেউ কেউ তো খুব কাছে গিয়ে ক্লোজ ছবি তুলল। খুব তাড়াতাড়ি সেখানে দেখা গেল টিভি চ্যানেলের লোগোসংবলিত মাইক্রোফোন। পেছনে তাদের ক্যামেরা। শুরু হয়ে গেল লাইভ।

এদিকে রক্ত-চিত্রের মধ্যে পড়ে থাকা যুবকের চোখ ভাবলেশহীন হতে থাকল। পান্ডুর হতে থাকল। হালকা পলক পড়তে পড়তে পলকহীন হয়ে গেল। রক্ত-চিত্র বিলুপ্ত হয়ে গেল রক্তধারার স্রোতে। তারপর আবার চিত্রিত হতে থাকল রক্ত। এই চক্র চলতেই থাকল। যতক্ষণ শরীরে রক্ত ছিল।

আমি তার কাছে গেলাম। চোখের দিকে চোখ রাখার চেষ্টা করলাম। মনে হলো, তার চোখের ভেতর কার যেন ছবি ভেসে উঠছে। বিবর্ণ আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দিতে দিতে এক মহিলা বলছেন, ‘এত ঘেমে গেছিস কেন বাপ? কতক্ষণ ধরে তোর জন্য বসে আছি। কেন এত দেরি করিস?’

আমি আরও একটু এগিয়ে গেলাম। দেখলাম দুফোঁটা অশ্রু চোখের কোণ দিয়ে নামতে নামতে শুকিয়ে গেছে। আমি শুধু তার ওই চোখের দিকে এগিয়ে যেতে চাইলাম। রক্তে আমার বড় ভয়। দেখতে চাইলাম এই ভরদুপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে জীবন বাঁচাতে দৌড়াতে দৌড়াতে সে আসলে কী ভাবছিল? আমার ভাবতে ইচ্ছা করছিল, তার চোখের দিকে তাকালে তা বোঝা যাবে। বোঝা যাবে কোন আশ্রয়ের কাছে, কোন প্রশ্রয়ের কাছে যেতে অমন উদ্যত হয়েছিল সে। মনে পড়ছিল আমার, যখন আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হচ্ছিল, যখন সে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে যাচ্ছিল, তখন কার মুখটি তার মনের আয়নায় ভেসে উঠেছিল!

আমার মুহূর্তটি অত্যন্ত নীরব হয়ে গিয়েছিল। আমি প্রায় তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ কে যেন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল আমাকে। আমার মতো আরও অনেককে। দেখলাম তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজন, যাদের আমরা হিজড়া বলি, তারা, প্রায় নিস্তেজ হয়ে যাওয়া যুবকটিকে ধরে নিয়ে গেল। বলল, ‘সেন্ট্রাল হসপিটাল কাছেই। চল লইয়া যাই।’

তারা, কয়েকজন হিজড়া ছেলেটাকে ধরাধরি করে একটি রিকশা অথবা সিএনজিতে তুলল।

আমরা, উৎসুক জনতা, বিহ্বল জনতা, উৎসবকামী জনতা, ফেসবুক জনতা, লাইভ জনতার চোখের সামনে দিয়ে কয়েকজন হিজড়া আহত বা প্রায় নিহত যুবকটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেল আমাদের চোখের সামনে দিয়ে। তখনো কোনো সরকারি-অসরকারি রক্ষাকর্তা আসেননি।

হঠাৎ চিৎকারের শব্দ। আঘাতসক্ষম অস্ত্রধারীরা আবার ফিরে এসেছে। সংখ্যায় এবার আরও বেশি। এবার এলোপাতাড়ি জনগণের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। আমাকে কেউ একজন ধাক্কা মেরে বলল, ‘আরে ভাই, খাড়াইয়া দেকছেন কী। দৌড় লাগান।’

আমি দৌড় শুরু করেছি। কারণ আমার মনে হলো, এই অস্ত্রোন্মুখ প্রাণীদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। আমি দৌড়াচ্ছি। আমার সঙ্গে আরও অনেক লোকজন। সবাই দৌড়াচ্ছে। আমাদের পেছনে অস্ত্রধারীদের রক্তপিপাসু অস্ত্র। আমাদের পেছনে জানোয়ারের হুংকার, শতসহস্র জিজ্ঞাসু চোখ, পেশাদার ক্যামেরা, নিউজ ভ্যালু, পেশাদারত্ব, মৃত্যুর থাবা, মৃত্যুদূত, স্থির হয়ে যাওয়া চোখের সহযাত্রী।

আমরা দৃশ্যধারণে ব্যস্ত ছিলাম। দৃশ্য বদলানোর জন্য উদ্যোগী ছিলাম না। এখন দৃশ্যের ভেতরে আমরা। অন্যরা দৃশ্যধারণে ব্যস্ত। কেউ দৃশ্য বদলানোর উদ্যাগী নয়।

আমরা অনেক দ্রুত দৌড়াচ্ছি। আমাদের পেছনে যা যা ছিল, সবই আছে। কোনো কিছুরই পরিবর্তন হয়নি। হুংকার, অস্ত্রের ঝনঝনানি, কারও কারও ত্রাহি চিৎকার। যখন ওদের নাগালে পড়ে যাচ্ছে দৌড়মগ্ন আমাদের কেউ কেউ, তখনই অস্ত্রগুলো তাদের পিপাসা মেটাচ্ছে। তখনই রক্ত-চিত্র এঁকে নিথর হয়ে যাচ্ছে আমাদের দৌড়-সহযাত্রী।

এভাবে কতক্ষণ দৌড়েছি, জানি না।

দুই

চোখ মেলে দেখি সম্পূর্ণ অচেনা এক জায়গায় আমি। আমার আশপাশে অনেক বাঁদর। সব কটা বাঁদর গা চুলকাচ্ছে। আর বাঁদরসুলভ আচরণে মাতিয়ে রেখেছে চারপাশ।

আমি স্বগতোক্তির মতো করে বললাম, ‘এত বাঁদর এল কোত্থেকে?’

আমার পাশের এক বাঁদর বলল, ‘আঁপনিঁও তোঁ বাঁদঁর হঁয়ে গেঁছেন। মোঁবাঁইল বেঁর কঁরে চেঁহাঁরা দেঁখেঁন।’

পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে নিজের চেহারা দেখি। সত্যি আমি বাঁদর হয়ে গেছি। আমার মুখটা বাঁদরের মুখ। আমার শরীরে বাঁদরের মতো লোম। আঙুলগুলোও বাঁদরের মতো।

আমাকে বিস্মিত হতে দেখে আমার সঙ্গী বাঁদর বলল, ‘আঁমরাঁ যাঁরা এঁকসাঁথে দৌঁড় দিঁয়ে পাঁলিঁয়েঁছিলাঁম, সঁবাঁই বাঁদঁর হঁয়ে গেঁছি। তঁবে পুঁরো বাঁদর নাঁ। হাঁফ বাঁদর!’