জানাজা

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

‘তোমরা কি বাহে মোর ছাওয়ার জানাজা পড়াইমেন?’

মহিলাটা আমাকে প্রশ্ন করল সেদিন সকালে, যেদিন সাংবাদিক হিসেবে আমি তৃতীয় অ্যাসাইনমেন্ট করতে বেরিয়েছি। কারওয়ান বাজারের বহুমুখী জ্যাম পেরিয়ে সবে অফিসে পৌঁছেছি, তখনই ইনচার্জের ফোন পেয়ে নেমে যেতে হলো আবার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত আর হারিয়ে যাওয়া মানুষের তালিকা প্রকাশ করতে চায় আমাদের পত্রিকা।

যেসব প্রতিষ্ঠান জুলাই আন্দোলনের বিভিন্ন ডকুমেন্টেশন করছে, তাদের অফিসের তালিকা আছে আমার হোয়াটসঅ্যাপে, সেখান থেকে দেখে দেখে একটার পর একটা জায়গায় যাচ্ছি। কোথাও তেমন কোনো তথ্য নেই, বিরক্তির চূড়ান্তে পৌঁছে যাওয়ার দশা।

আসলে অচেনা মানুষের এমন অনুরোধের সঙ্গে আমি পরিচিত নই। আবারও তিনি বললেন, ‘মোর ছাওয়ার জানাজা তোমরা পড়াইমেন?’

তেমনই এক অফিসে মাত্র উপস্থিত হয়েছি, দেখি মানুষের অনেক ভিড়। একটা বাচ্চাকে দেখলাম মায়ের কোলে। কাঁদছে। হাতে আইসক্রিমের কাঠি। এই অফিসে যে প্রতিদিনই অনেক মানুষের যাতায়াত, তা বুঝলাম চেয়ারের সংখ্যা দেখে। ভেতরে ঢোকার মূল দরজার বাইরে এবং সিঁড়ির পাশেও প্লাস্টিকের গোটা দশেক চেয়ার রাখা।

‘আমাদের কাছে কিছুই নাই’—এমন কথা শোনার জন্য যখন রিসেপশনে অপেক্ষা করছিলাম, তখন দেখলাম কাচের দরজার ওপারে সিঁড়ির দিকে এক বয়স্ক মহিলা বসে আছেন। বোরকায় আপাদমস্তক ঢাকা মহিলার চোখের রং ওঠা চশমা দেখলেই বোঝা যায় বয়স ষাটের বেশি। চোখাচোখি হতেই মাথা নামিয়ে ফেললেন। খানিক পরে বললেন, তাঁর মেয়ে জেসমিনের সঙ্গে এসেছেন তিনি, মেয়ে ভেতরে গেছে। তাঁকে বললাম, ‘সিঁড়ির এখানে বসেছেন কেন? ভেতরে আসুন। এখানে বসুন।’

আমার কথায় কি না জানি না, তিনি হয়তো ভাবলেন, আমি এখানকারই কেউ। এরপর কিছুক্ষণ তাকালেন ইতিউতি। পরে ইতস্ততভাবে এসে বসলেন আমার চেয়ারের পাশে। হাঁটার ধরন দেখেই বোঝা যায় তিনি ক্লান্ত। কথা বলার সময় যেন দীর্ঘশ্বাস বের হলো। পাশে বসার পর একমনে নখ খুঁটছিলেন তিনি। এমন সময় আঞ্চলিক ভাষায় হঠাৎ বললেন, ‘তোমরা কি বাহে মোর ছাওয়ার জানাজা পড়াইমেন?’

কথার মধ্যে প্রশ্ন আছে, আছে প্রচ্ছন্ন একধরনের দাবিও। তাঁর কথায় আমি অবাক! চারদিকে লোকজন গিজগিজ করছে, আর এক অচেনা লোককে তিনি এমন কথা বললেন! তাঁর দিকে তাকিয়েই আছি। এর মধ্যে আলতোভাবে আমার হাত ধরলেন তিনি। উল্টো এবার আমিই কিছুটা জড়সড়। আসলে অচেনা মানুষের এমন অনুরোধের সঙ্গে আমি পরিচিত নই। আবারও তিনি বললেন, ‘মোর ছাওয়ার জানাজা তোমরা পড়াইমেন?’

‘কী হইছে আপনার ছেলের?’

‘কোনো কিছুই হয় নাই।’

মহিলার দিকে আরেকটু গভীরভাবে তাকালাম। আমাদের মা-খালাদের মতোই। আলাদাভাবে কিছু চোখে পড়ল না। বোরকায় ঢাকা মানুষটির হাতেও কালো রঙের মোজা। আর ওই হাতেই ধরা আছে একটা বড় শপিং ব্যাগ। সেখানে লেখা ‘রংপুর টেইলার্স’। মানে তাঁর বাড়ি কি রংপুর? আমার সাংবাদিক মন ততক্ষণে সক্রিয় হতে শুরু করেছে। ভাবছি, কী হয়েছে এই মহিলার? অচেনা-অজানা আমাকে তিনি ছেলের জানাজা পড়াতে বলবেন কেন!

পাশ দিয়ে চলে গেল একজন। দেখলাম কি দেখলাম না। এর মধ্যে আমার ভাবনায় ছেদ ঘটল ডান হাতে চাপ খেয়ে। মানুষটা এবার হাত খুব জোরে চেপে ধরেছেন। চোখের চশমা খুলে তিনি যখন বলতে শুরু করলেন, দেখলাম ঘোলাটে দৃষ্টি। চোখের সে দৃষ্টি উদ্‌ভ্রান্ত, সেখানে কোনো গন্তব্যই নেই। গন্তব্যহীন দৃষ্টির মানুষের সামনে বসলে কি অস্বস্তি হয়? ঠিক জানি না। আমার ভেতরে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল।  

আমাকে তিনি বলে চললেন, ‘বাবা, হামার বেটি জেসমিন একটা কথা কবার চায়, টাকা-পাইসার কথা নোমাই। কিন্তু কাক কইবে, বুঝবার পাচ্ছে না। তোমাকে কই, তোমরা কয়া দেন।’

সাংবাদিক হিসেবে মানুষের এ ধরনের কথার সঙ্গেও আমি পরিচিত। এই জুলাইয়ের পরে অনেকেই হয়তো ভাবেন, তাঁদের সব সমস্যা আমরা সমাধান করতে পারব। ধরা যাক, কোনো লোকের বাসার ভাড়া দেয় না ভাড়াটে। এই কথাও তাঁরা উপদেষ্টাদের কাছে পৌঁছাতে চান। তাঁকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘আমাকে বলুন, সমস্যা নেই।’

তিনি আমাকে জানালেন যে জেসমিনের ছেলে, অর্থাৎ তাঁর নাতি রাসেল ইদানীং পাড়ার বিভিন্ন ছেলের সঙ্গে ঝামেলা করছে। পাড়ার ছেলেরা প্রতিদিনই তাঁর কাছে এসে নালিশ করে রাসেলের নামে। আমি যেন রাসেলকে বকা দেওয়ার জন্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে বলি। তাঁর কথাগুলো শুনলাম। কিছু বললাম না। ততক্ষণে আমি এই বয়স্ক নারীর কাছ থেকে নিস্তার পাওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু তিনি আমাকে ছাড়লে তো! রাসেলের গল্প থেকে তিনি চলে গেলেন তাঁদের গ্রামের পুব পাড়ার চাষের জমিসংক্রান্ত ঝামেলার দিকে। সে গল্পেও রাসেলের এক শিক্ষক ঢাকায় এসে একটা মাদ্রাসায় পড়ান। সেই মাদ্রাসায় তাঁর চাকরি পার্মানেন্ট হচ্ছে না। আমি যেন এই ব্যাপারটাও দেখি।

এভাবে গল্প তিনি চালিয়েই যাচ্ছিলেন। আমি কেবল হাঁ-হুঁ করছিলাম। আমার ভাবখানা হলো, অনেক হয়েছে বাপু, এখন ক্ষান্ত দাও। তবে এক গল্প থেকে এত দ্রুতই তিনি আরেক গল্পে ছুটছিলেন যে ওঠার ফুরসত পাচ্ছিলাম না। আর আমার হাতটাও যে তিনি ছাড়ছেন না।

 মাঝেমধ্যে কাচের দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন স্যুটেড-বুটেড কোনো কোনো কর্মকর্তা। তাঁদের দেখে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। তবে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই উধাও হয়ে যান তাঁরা। অগত্যা আবার ধপ করে বসে পড়তে হয় আমাকে। বুড়ো মহিলা ফিসফিস করতে শুরু করেন, তাঁদের পুকুর থেকে রাতের অন্ধকারে কারা মাছ মেরে নিয়ে গেছে। তাঁর ছেলে রুই মাছ খেতে পছন্দ করত। এসব বলতে বলতেই মহিলা আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আইচ্ছা, মোর ছাওয়া যে রুই মাছ খাইল না...অ্যালা বেলা কয়টা?’

তিনি আমাকে প্রশ্ন করছেন ঠিকই, তবে উত্তর শোনার ধৈর্য নেই। এ সময় আমারও মনে হলো, এখানে থেকে আর কাজ হবে না। এখন বের হতে হবে। অন্য জায়গায় যেতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থানের আহতদের নিয়ে একটা স্টোরি করতে হবে আমাকে, অ্যাসাইনমেন্ট। অযথা বকর-বকর ছাড়া এখানে যেহেতু কিছু পেলাম না, অন্যখানে তো যেতেই হবে। যখন বের হব, তখনই কম বয়সী এক মহিলা ছুটতে ছুটতে এল আমাদের কাছে। তাকে দেখে বয়সী মহিলাটা কেমন যেন মিইয়ে গেলেন।

‘আপনি আবার শুরু করছেন!’ বয়স্কর উদ্দেশে বেশ জোর গলায়ই বলল কম বয়সী। বোরকা পরা মহিলা বোরকার ভেতর ঢুকেই ছিলেন, এবার যেন আরও একটু ঢুকে গেলেন। অনেকক্ষণ পর এখন এখানে নিস্তব্ধতা।

হঠাৎই কম বয়সী মহিলা আমাকে বললেন, ‘মা কি আপনাকে কিছু বলেছে? অনেক জ্বালিয়েছে, না?’

তার দিকে তাকিয়ে দেখি গোলগাল মুখ। বুঝলাম, এই হলো জেসমিন। আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটা বলল, ‘উনি নিশ্চয়ই রাসেল আর গ্রামের মাস্টারকে নিয়ে কথা বলেছেন?’

সরাসরি হ্যাঁ-না কিছু বললাম না। শুধু বললাম, ‘সমস্যা নেই। বয়স্ক মানুষ। বলতেই পারেন।’

তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে জেসমিন বললেন, ‘রাসেল আমার ছেলে। জুলাই মাসে ছেলেটা রায়েরবাগে পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ার পর মা পাগল হয়ে গেছেন। সবাইকে এসব বলেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, যাদের নামে মা এগুলো বলেন, তারা কেউই বেঁচে নেই। কোনো এক বিচিত্র কারণে মৃত মানুষদের সমস্যা নিয়েই সবাইকে বলেন। এ জন্যই তাঁকে এখানে বসিয়ে রেখে ভেতরে গিয়েছিলাম, মাফ করবেন।’

জেসমিনের কথাগুলো মুহূর্তেই অন্য দুনিয়ায় নিয়ে গেল আমাকে। শীতের দুপুরও তখন তেতে উঠেছে। আর আমি ভাবছি, কীভাবে জুলাই অভ্যুত্থানের পর শহীদ পরিবারগুলো বেঁচে আছে, যেভাবে একটা দমকা হাওয়া চড়ুই পাখিকে ঘরহীন করে দেয় অনন্তকালের জন্য!