নাগরিক বুদ্‌বুদ

অলংকরণ: আরাফাত করিম

সুপারশপটা বন্ধ হয়ে গেলে গেটের সামনেই বসে পড়ে দিপু। বসে থাকে পাশে প্লাস্টিকের টবে প্লাস্টিকের গাছের মতো। একবার উঠে দাঁড়ায়, যাবে। কিন্তু যাবেটা কোথায়? আবার বসে।

একটার পর একটা বাড়ি জোড়া দিয়ে শহরের পর শহর ছাড়িয়ে নগরটা নদী-মাঠ ডিঙিয়ে দিপুর সেই শৈশব পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। স্মৃতিটুকুও বেহাত হয়েছে এক বহুমুখী প্রকল্পে। যাবে কোথায়? বাড়িতে? কার বাড়িতে? কোন বাড়িতে?

দিপু বসে থাকে। সকাল নয়টার মধ্যে সুপারশপটা ফের খুলবে, বন্ধ হবে রাত সাড়ে আটটায়। সরকারের নতুন নিয়মে রাত আটটার মধ্যে বন্ধ করার কথা। আগে তা–ও ভালো ছিল, বন্ধ করতে করতে এগারোটা বেজে যেত। এখন কাজ বাদে নিজের জন্য অনেক সময়। এত সময় দরকার নেই দিপুর। নিজের সবটুকু সময় বেচে দিতে পারলে নির্ভার হতে পারত। ভাবছে রাতের জন্য আরেকটা কাজ জুটিয়ে নেবে। নাইটগার্ড হতে পারে। টাকার দরকার নেই। উল্টো কিছু টাকা দিয়ে হলেও একটা কাজ সে নেবে।

আমি হোটেলে গেলাম। নাপা সাপোজিটরি আছে, জ্বর বাড়লে দিয়ো। সকালেই আবার ভর্তি করাতে হবে। টাকাপয়সা কিছু পেলে কোথাও? বলে নারীটি ঠোঁটে কড়া করে লিপস্টিক দিয়ে পরনের সালোয়ার–কামিজের ওপর একটা কালো ওড়না পেঁচিয়ে বেরিয়ে যায়।

পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে। অনেকক্ষণ ধরে বাটন চাপতে থাকে। একবার কানে নেয়। কান থেকে আর নামায় না।

মা? কালই পাঠাব। বিকাশ করব। বেশি করে ওষুধ খা। আব্বার মতো করিসনি। ওষুধের টাকা জমিয়ে কেউ বড়লোক হয় না, মরে যায়। আব্বা মরে গেছে। আব্বা বেঁচে নেই, মা। তুই বেঁচে থাক। কী? আচ্ছা, ধরে পাঠাব। মা, আমার ছাগলটা আছে? আমার বলটা কাউকে দিসনি তো? মা, আমিও আসব। একদিন ঘুম ভেঙে দেখবি তোর সিঁথির কাছে দাঁড়িয়ে। আমি আসতে চাই মা, কিন্তু বাড়ির পথটা কিছুতেই মনে করতে পারি না। কলের পাড়ে না একটা ডাবগাছ ছিল? এখন সব বাড়িতেই একটা করে ডাবগাছ পেয়ে যাই, কিন্তু কলপাড়টা যে মেলে না! মা, কলপাড়টা কি তুই লুকিয়ে রেখেছিস কোথাও? নাকি আব্বা সঙ্গে করে নিয়ে গেছে? মা…। ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসে না। দিপু মোবাইলটা কান থেকে নামায়। দুদিন হলো চার্জ দেওয়া হয়নি। আজ একবার দিয়েছিল, কিন্তু সুইচ অন করতে ভুলে গেছে। হাতে নিয়ে বাটন চাপতে থাকে। এই মুহূর্তে এটাও একটা কাজ হতে পারে বলে মনে হয় ওর কাছে। বাটন চাপতে চাপতে মনে হয় দৌড়াচ্ছে, মোবাইলের কি–প্যাডের মতো একটা বোর্ডের ওপর। জিরো থেকে নাইন, এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এর মধ্যেই জীবনটা ওর কাছে অসীম বলে মনে হয়। কিন্তু ওর দরকার সময়টাকে একটা বিন্দুর মধ্যে ধরে তার ভেতর নিজেকে বেঁধে ফেলার, যার সামনে–পেছনেও কোনো সময় থাকবে না।

দিপু বসে থাকে।

এবার সে উঠে দাঁড়ায়। শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে; কিন্তু পা দুটো সহসা অবশ হয়ে আসে। আজকাল দিপুর স্মৃতিশক্তিও অল্পতে জমে যায়। এক দিন আগের কোনো কিছুও মনে পড়ে না। এই শহরের মানুষগুলো যখন ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে, দিপু তখন ওর অতীত তৈরি করে চিন্তার ভ্যাকিউম থেকে। কখনো ওর বাড়ি ছিল কি না মনে পড়ে না। মা নিশ্চয় ছিল। জন্ম যেহেতু হয়েছে মা থাকারই কথা। সেই সূত্রে বাবাও থাকবে। কিন্তু স্ত্রী কিংবা ভাইবোন? থাকতেও পারে, না–ও পারে। স্ত্রীর কথা ভাবতে গেলে একটা সন্তানের ছবি ভেসে ওঠে স্মৃতির ব্ল্যাকহোল থেকে। সন্তান যখন আছে, স্ত্রী–ও থাকার কথা। নাকি ব্ল্যাকহোল থেকে অন্য কারও সন্তান কিংবা নিজেরই শিশুকালের ছবি বিচ্ছুরিত হচ্ছে থেকে থেকে! দিপুর পরিচিত মানুষেরা কি মৃত? শহরের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে একজনকেও কেন ওর চেনা মানুষ হয় না? দিপু নিজে কি বেঁচে আছে? মৃতের কি স্মৃতি থাকে কোনো? দিপু অনুমান করে, হয় সে নিজে অথবা অন্যেরা মৃত। কিন্তু অনুমানের শক্ত কোনো যুক্তি থাকে না। দিপু এবার অনেক দূরের কোনো শব্দ শোনার চেষ্টা করে। কোনো এক বালিকা বধূ কাঁদছে নিঃশব্দে। বালিশটা ভিজে গেছে। দিপুর ইন্দ্রিয় হঠাৎই এত প্রখর হয়ে ওঠে, ও সব দেখতে পায়। অশরীরী হয়ে দিপু বসে খাটের ওপর। ঘরে বেত দিয়ে বানানো ড্রেসিং টেবিলের কাচের ওপর একটা ছবি টাঙানো। অন্ধকারেও ওর চিনতে অসুবিধা হয় না। চোখ খোলে। বুঝতে পারে, এই জগতে এ রকম একটা বাড়ি কোথাও আছে, যেখানে ওর একটা ছবি টাঙানো আছে। কিন্তু বাড়িটা সে খুঁজবে কোথায়? তার চেয়ে বড় কথা, কেন খুঁজবে?

একটা কুকুর কয়েক সিঁড়ি ওপরে উঠে ওর পায়ের কাছে বসে। একটার পর একটা খালি ট্রাক গমগম আওয়াজ তুলে সামনে দিয়ে চলে যায়। সব কটি ট্রাকে নতুন ভবন তৈরির মালামাল। একটা নিশি পাখি উড়ে যায় অন্ধকার থেকে নিঃসীম অন্ধকারে। একটা স্বপ্ন কোনো ঘুমন্ত মানুষের সন্ধানে এদিক থেকে ওদিকে সরে। এই শহরের মানুষগুলো হয়তো ঘুমায় না দিপুর মতো, অথবা প্রত্যেকের একটা করে পোষা স্বপ্ন থাকে, কিছু পথস্বপ্ন দিপুর ঘুমের জন্য অপেক্ষা করে। দিপুর পাশেই একটা স্বপ্ন এসে বসে।

আমারও একটা পোষা স্বপ্ন ছিল, রোজ দেখতাম। দিপু বলে।

আমি একটা ভালো স্বপ্ন, কিন্তু আজকাল কেউ ভালো স্বপ্ন দেখতে চায় না। স্বপ্নকেও এই শহর এন্টারটেইনমেন্ট বানিয়ে ফেলেছে। স্বপ্নটা বলে।

আমার স্বপ্নটা আর মনে করতে পারি না। স্বপ্নেরও কি মৃত্যু হয় মানুষের মতো? জিজ্ঞাসা করি।

আমরা তো জীবিত আর মৃত আলাদা করতে পারি না! আমরা কেবল বুঝি ঘুম আর নির্ঘুম।

যদি কেউ অনন্ত ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ে? কিংবা জেগে থাকে অনন্ত নির্ঘুম?

আর কোনো কথা না বলে স্বপ্নটা উঠে পড়ে। ঘুমন্ত মানুষের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। এমন মানুষ খোঁজে, যার নিজস্ব কোনো স্বপ্ন নেই। এই শহরে লাখ লাখ মানুষ আছে, যারা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। তাদের হিংসা হয় দিপুর। 

রাত আর সরে না। একটু একটু করে ভবনগুলো নেতিয়ে পড়ে। দিপুর ইচ্ছা হয় পুরো শহরটা আজ হাঁটবে। হাঁটতে হাঁটতে কোনো অচেনা বাড়িতে ঢুকে পড়বে। কোনো এক নারী বলবে, হাত–মুখ ধুয়ে খেতে এসো। হাতটা ধুয়ে দিপু অতি চেনা মানুষের মতো সেই নারীর আঁচলে মুছবে। নারীটি আপন নারীর মতো কিছুতেই আর বাধা দেবে না। দিপু একবার ভাববে জড়িয়ে ধরে। কত দিন কোনো নারীকে সে জড়িয়ে ধরেনি। খুব পরিপাটি করে সাজানো টেবিলে খেতে বসে মনে হবে খুব চেনা কোনো হাতের রান্না খাচ্ছে। কার হাতের রান্না স্মরণ করতে গিয়ে একটু বেখেয়াল হবে, নারীটি তখন দিপুর কাঁধে হাত রাখবে। এমন মমতা দিয়ে কেউ কোনো দিন ওর কাঁধে হাত রেখেছে কি না, মনে করতে গিয়ে কেঁদে ফেলবে।

একজনের কথা মনে পড়ে যায় দিপুর। পাড়ার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নামটা মনে করার চেষ্টা করে। নাম ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব অসম্পূর্ণ থাকে। নামটা মনে করতে করতে অনেকটা পথ হেঁটে ফেলে সে। এবার একটা বাড়িতে প্রবেশ করবে, ঠিক করে। রাস্তার ওপর পুরোনো একটা দোতলা বাড়ি। যেকোনো দিন ভেঙে ফেলা হবে এই অপেক্ষায় নিজে থেকে ভেঙে পড়েনি। কলিংবেলে চাপ দেওয়ার আগেই দরজাটা ভেতর থেকে কেউ একজন খুলে দেয়। দিপু এক পা ভেতরে দিয়ে দাঁড়ায়।

জুতাটা খুলে আসো। মাত্রই ঝাড়ু দিলাম। নারীটি বলে।

সম্ভবত সে-ই দরজাটা খুলেছে। দিপু জুতাজোড়া খুলে এরপর কী করবে ভাবতে ভাবতে দেয়ালের দিকে তাকায়। একটা টিকটিকি ওর দিকে তাকিয়ে আছে। টিকটিকির চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে সে। যে নারীটি মাত্রই দরজা খুলে দিল, তার চোখে চোখ রাখার সাহস হয় ওর।

কী হলো? হাত ধুয়ে খেতে আসো।

দিপু ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে বেসিনের অবস্থানটা বুঝে নেয়। হাত দুটো অনেকক্ষণ ধরে ধুয়ে নেয়। ভেজা হাত মোছার জন্য সামনে এগোয়। নারীটি শাড়ি না, সালোয়ার-কামিজ পরা। ওড়না নেই গায়ে। একটা ছোট্ট ডাইনিং টেবিলে একজন মাত্র মানুষের খাওয়ার জায়গা, বাকিটা জুড়ে এটা–সেটা জিনিস রাখা। দিপু চেয়ারটা টেনে বসে। সামনে প্লেটে ভাত আর দুটো তরকারি সাজানোই আছে। ভালো করে তাকাতেই একটা তেলাপোকা ভাতের ওপর থেকে দ্রুত দিপুর হাত বেয়ে ওর শার্টের ভেতর ঢুকে যায়। ও প্লেটের ভাতগুলো নাড়তে থাকে। আলুভর্তাটা পানি কেটে গেছে। কলার ঝোলটা শুকিয়ে এসেছে। খেতে খেতে কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করে। না, মনে পড়ছে না। কী যেন মনে করতে করতে এই বাড়িতে ঢুকেছে, সেটা আর মনে করতে পারে না। খাওয়ার পর কী করবে, এটা ভাবতে ভাবতে খাওয়াটা আর এগোই না।

খেয়ে ঘরে যাও। আমি হোটেলে গেলাম। নাপা সাপোজিটরি আছে, জ্বর বাড়লে দিয়ো। সকালেই আবার ভর্তি করাতে হবে। টাকাপয়সা কিছু পেলে কোথাও? বলে নারীটি ঠোঁটে কড়া করে লিপস্টিক দিয়ে পরনের সালোয়ার–কামিজের ওপর একটা কালো ওড়না পেঁচিয়ে বেরিয়ে যায়।

দিপু বুঝতে পারে ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে জামাটা ঝাড়া দেয়, তেলাপোকাটা নিচে পড়ে দৌড় মারে ঘরের ভেতর। দিপু খুব সাবধানে ওকে অনুসরণ করে। একটা শিশু শুয়ে আছে, সাত–আট বছর বয়স হবে। খাটটা অনেক বছরের পুরোনো। দিপু সাবধানে মেয়েটার পাশে বসে। মনে হচ্ছে জ্বরে কাঁপছে। বড় কোনো বিপদ হওয়ার আগেই ওর উচিত এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া। এই শহরে আরও অনেক বাড়ি আছে, লাখ লাখ অট্টালিকা আকাশ ঢেকে ফেলেছে। লাখ লাখ অট্টালিকা তৈরির সরঞ্জাম নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ট্রাকগুলো। কেবলই ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়ার জন্য দিপুর অনুশোচনা হয়, অসহনীয় হয়ে ওঠে নিজের বেঁচে থাকা, যদি সত্যিই সে বেঁচে থাকে…। এখনই সে বের হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে বাধা দেওয়ারও কেউ নেয়। উঠে দাঁড়ায়। পাশের দেয়ালে বেতের ড্রেসিং টেবিলের ওপর বাঁধানো ছবিটা দেখে চমকে ওঠে।