বিকেলের শেষ রোদটা শহরের পুরোনো অংশের দিকে এসে পড়েছে একধরনের ক্লান্তি নিয়ে; যে রোদ কয়েক দশক ধরে একই ভাঙা ফুটপাত, একই মরচেধরা খুঁটি, একই যাত্রীছাউনির ওপর বিশ্রাম নিতে নিতে বুঝে গেছে, এখানে আর কোনো ভিড় নামে না, কোনো তাড়াহুড়া শব্দ করে না, কালো ধোঁয়া মেখে ছুটে আসা বাসের চাকা গড়ায় না, কেবল ধুলো উঠে বসে থাকে আর ভিড় করে বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে মেখে ডুবসাঁতারের অপেক্ষায়। কিন্তু তাদের আশার গুঁড়ে বালি ছিটিয়ে তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বৃদ্ধ লোকটি আচমকা বসে পড়ে; প্রাণ বাঁচাতে ধুলোগুলোর মধ্যে একটা হইচই পড়ে যায়, কেউ কেউ লাফিয়ে নামে ভাঙা টাইলসে, কেউ আবার কংক্রিটের বেঞ্চের কার্নিশে ঝুলে থাকে বাদুড়ঝোলা হয়ে। বৃদ্ধ সামনে তাকায়। যাত্রীছাউনির ঠিক বিপরীত দিকে বিদ্যুতের কালো তারে বসে আছে একটা পাখি, কাকনা শালিক, দূর থেকে রং বোঝা যায় না। সে মাঝে মাঝে ডানা ঝাপটালেও কোথাও উড়ে যায় না, কেবল অবস্থান বদলায়, সামান্য পরিমাণ ডানে অথবা বামে, যেন থেমে থাকা আকাশের বুকে রেখা টেনে আবার নিজেকেই ঘিরে ফেলে, যেন সেই পাখিটিও হঠাৎ কোনো অজানা প্রতিশ্রুতির ভেতর আটকে গেছে, যেমন আটকে আছে এই ছাউনি, যেমন আটকে আছে এই বৃদ্ধ মানুষটি, বসে আছে যাত্রীছাউনির নিচে একচেটিয়া এই অপেক্ষার রাজত্বে, যেখানে কেউ আসে না, কেউ নেমে দাঁড়ায় না, কেউ প্রশ্ন করে না। তবু সে বসে আছে, যেন অনেক আগে উচ্চারিত এক অমোঘ বাক্যের প্রতি নিজের দায় শোধ করছে, ‘যদি হারিয়ে যাই, দেখা হবে এখানেই।’
যাত্রীছাউনির পাশে অবাঞ্ছিত বটগাছটির শিকড় উঠে এসেছে মাটির ওপর, ফাটল ধরা সিমেন্টের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে আঁকাবাঁকা রেখা এঁকেছে, সেই রেখা যেন বহুদিন আগে চলে যাওয়া পথের মানচিত্র, যেসব পথ ধরে একসময় মানুষ আসত, যেত, বাস ধরত, বাস থেকে নামত, দাঁড়িয়ে সিগারেট খেত, কথা বলত, প্রথম দেখায় প্রেমের প্রথম দৃষ্টি বিনিময় হতো, শত নিয়মের মধ্যে ছোট্ট অনিয়মের মতো ছিল এই থামা। আর এখন সেই সব আনাগোনার স্মৃতি জমে আছে ধুলোর মতো, যার ওপর বসে কাপড়ের ব্যাগটা পাশে রেখে, সে পায়ের পাতায় একটু একটু করে টের পায় ভাঙা ফুটপাতের দীর্ঘতা, আর বুকের গভীরে টের পায় এক পুরোনো নামের দহন, যা সে উচ্চারণ করে না, তবু সেই নাম ঘিরেই প্যাঁচ খায় তার আজকের দিনের প্রতিটি শ্বাস।
এ জায়গায় কোনো বাস আসে না বহু বছর। রুট বদলেছে, শহরের নকশা বদলেছে, মানুষের পথ অন্যদিকে মোড় নিয়েছে; গুগলের মানচিত্রে এই স্টপেজ আর কোনো নির্দিষ্ট বিন্দু নয়, কেবল এক অচেনা মোড়, অচিহ্নিত স্থান। তবু সে জানে, এখানে একদিন বাস আসত, সে জানে, একদিন এখানে একসাথে দাঁড়িয়ে তারা চা খেত সে আর তার সেই বন্ধু। কলেজ থেকে ফেরা সেই বিকেলে, অফুরন্ত সময়ের আড্ডায় তারা কখনো ভাবেনি এভাবে তারা একাকী, একজন হয়ে যাবে। সেই বিকেলে তারা খুব বেশি কিছু বলেনি, সাধারণ সব কথা, তার ভিড়েই বন্ধুটি হঠাৎ সিরিয়াস গলায় বলেছিল, ‘যদি কখনো হারিয়ে যাই, যদি কোনো দিন খুঁজে না পাই, দেখা হবে এই ছাউনির নিচে; সবকিছু খুব দূরে সরে গেলে, আর কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকলে এখানেই চলে আসবি।’ তখন এই কথা সে মৃদু হাসিতে উড়িয়ে দিয়েছিল, মনে হয়েছিল, এ তো সিনেমার সংলাপ; জীবন কি এমন প্রতিশ্রুতি মুখস্থ রাখে? তারপর বছরের পর বছর ধরে যখন জীবনের প্রতিশ্রুতিগুলো একে একে ঝরে গেল, সবার সাথে দূরত্ব এল, তখন সে বুঝল, যে কথাকে হাসির কথা ভেবেছিল, সেটাই আসলে ছিল একমাত্র সত্য।
এ জায়গায় কোনো বাস আসে না বহু বছর। রুট বদলেছে, শহরের নকশা বদলেছে, মানুষের পথ অন্যদিকে মোড় নিয়েছে; গুগলের মানচিত্রে এই স্টপেজ আর কোনো নির্দিষ্ট বিন্দু নয়, কেবল এক অচেনা মোড়, অচিহ্নিত স্থান। তবু সে জানে, এখানে একদিন বাস আসত, সে জানে, একদিন এখানে একসাথে দাঁড়িয়ে তারা চা খেত।
তার এবারকার আসা কোনো হঠাৎ আবেগের আগমন নয়; দিন কয়েক ধরে তার মধ্যে এই জায়গার স্মৃতি আবার জেগে উঠছিল, যেন কারও নিঃশব্দ টোকা, কেউ দূর থেকে বলছে, সময় হয়েছে। সে ঘরে বসে নিজের বুকের ভেতরে রাতের পর রাত ঘড়ির টিকটিক শুনেছে, মেয়ের সংক্ষিপ্ত ফোনকল শুনেছে, ছেলের কণ্ঠে দূরত্বের সুর শুনেছে—‘বাবা, ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলি’, ‘বাবা, তোমার ওষুধ ঠিকমতো খেয়ো’, ‘বাবা, নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রেখো’। সব কথা ঠিক, সব কথাই সযতনে বলা, তবু কোথাও এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে সে বলতে পারে, ‘জানো, আমি একটা জায়গায় যেতে চাই, যেখানে একদিন আমার একজন বন্ধু আবার দেখা হবে বলে কথা দিয়েছিল’—এ বাক্য শুধু পুরোনো জীবনের অভিধানেই ছিল; অভিধানের নতুন সংস্করণে তার স্থান সংকুলান হয়নি।
ছেলেমেয়েরা তাকে ভিডিও কল দেয়, সে ফ্রেমের মধ্যে মুখ এনে হাসে; পেছনের সাদা দেয়াল, পুরোনো ক্যালেন্ডার, টেবিলে ওষুধের ছেঁড়া পাতা; ওরা ভাবে, বাবা নিরাপদ আছে। সে ভাবে, তারা যেন দূর থেকে তার জীবনের পরিধি নির্ধারণ করছে; সে মন খারাপ না করলে, তারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। এই নিশ্চিন্ততার ফাঁকে ফাঁকেই ধরা পড়ে তার ভেতরের ফাঁক, জীবনের অতৃপ্ত ঢেকুর, শব্দ করে কিন্তু কারও কানে পৌঁছায় না।
আজ সকালে সে যখন আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়েছিল, একমুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আয়নায় যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে সে নিজেই যেন অপরিচিত; তবু সেই অপরিচিতের চোখের গভীরে যে একটুখানি আলো, সেই আলো তাকে টেনে এনেছে এখানে। সে কাপড় গুছিয়েছে, মুঠোফোন পকেটে নিয়েছে, কাউকে কিছু বলেনি, কেবল নিজের ভেতরে বেশ শান্তভাবে উচ্চারণ করেছে, আজ যাওয়া যায় যাত্রীছাউনির নিচে, দেখা হবে সেখানেই।
ছাউনির নিচে বসতে বসতে তার মনে হয়, আজ খুব বেশি নীরব এখানটা; বাসের কোনো হর্ন নেই; কেবল ধুলোমাখা শুকনো হাওয়া, ছিন্ন বিজ্ঞাপনের কাগজ উড়ে এসে পায়ের কাছে পড়ে, আবার সরে যায়। তার পায়ের কাছে মাটি ফুঁড়ে কোনো আগাছা উঠেছে, সেই পাতার ওপর পড়েছে আলো, সেই পাতার ওপর বালির দাগ, সময়ের স্বাক্ষরের মতো। বিদ্যুতের কালো তারে পাখিটা এখনো আছে, কখনো ডানা গুটিয়ে বসে থাকে, কখনো বাতাসে ভেসে উঠে ডানা ঝাপটায়, আবার ফিরে আসে সেই তারের ওপর। এই পুনরাবৃত্তি তার কাছে একেবারে অপরিহার্য মনে হয়; যেন তার নিজের দিনগুলোর পুনরাবৃত্তি, একই ঘর, একই বিছানা, একই একাকী রাত, আবারও একই একাকী সকাল, দুপুর, বিকেল, ভিডিও কল—‘বাবা, ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলি’, ‘বাবা, তোমার ওষুধ ঠিক মতো খেয়ো’, ‘বাবা, নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রেখো’।
আরও খানিকটা নীরবতা জমে ওঠে। সে তা গায়ে মাখে, বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। অপেক্ষা নামের এই জিনিসটি তার কাছে নতুন নয়; বরাবরই সে অপেক্ষা করেছে ফলাফলের জন্য, চাকরির জন্য, সন্তানের জন্মের খবরের জন্য, স্ত্রীর অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য, ছেলের ফ্লাইট ল্যান্ড করার মেসেজের জন্য।
একটা মোটরসাইকেল এসে থামে একটু দূরে, ব্রেকের শব্দে কেউ একজন নেমে পড়ে, তারপর একসময়, খুব ধীরে, এক তরুণ এসে ছাউনির দিকে এগোয়; সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, গলায় ঝুলছে আইডি কার্ড, কানে ইয়ারফোন, চোখ স্ক্রিনে নিবদ্ধ। সে এসে কংক্রিটের বেঞ্চে এক প্রান্তে বসে, সামান্য ঝুঁকে, যেন এই বসাটা কোনো অপেক্ষা নয়, কেবল ক্লান্তি অবসানের একপশলা উপলক্ষ।
বৃদ্ধ মানুষটি তাকে খেয়াল না করে পারে না। সামনের দিকে থাকা মুখের রেখা, কাঁধের ভঙ্গি, চোয়ালের কঠিনতা—এসবের মধ্যে সে ভুল করে আরেকজনকে দেখতে চায়; বহু বছর আগের সেই বন্ধুকে, যার কাঁধ একসময় এমনই সোজা ছিল, যেদিকে হাঁটলে মনে হতো সরে যাচ্ছে সারি সারি অনিশ্চয়তা। বৃদ্ধ কোনো কথা বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে, যেন চোখের জলীয় বিন্যাসে ধরে রাখতে চায় একটি ইলিউশন, নিজের ইচ্ছেমতো সাজানো সাদৃশ্য। তরুণটি হঠাৎ হেসে ওঠে, কারও পাঠানো মেসেজে; সেই হাসি তার বন্ধুর হাসি নয়, এই প্রজন্মের নোটিফিকেশন-নির্ভর হাসি; বৃদ্ধ বুঝে যায় ভুল হয়েছে, তবু চোখ ফিরিয়ে নিতে দেরি হয় কয়েক প্রজন্ম।
তরুণ উঠে চলে গেলে তার বসার স্থানে থাকে শুধু শূন্যতা, আর বৃদ্ধের পাশে আরও খানিকটা নীরবতা জমে ওঠে। সে তা গায়ে মাখে, বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। অপেক্ষা নামের এই জিনিসটি তার কাছে নতুন নয়; বরাবরই সে অপেক্ষা করেছে ফলাফলের জন্য, চাকরির জন্য, সন্তানের জন্মের খবরের জন্য, স্ত্রীর অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য, বিদেশে থাকা ছেলের ফ্লাইট ল্যান্ড করার মেসেজের জন্য, মেয়ের উপযুক্ত পাত্রের জন্য, ভিডিও কলে ভেসে আসা নাতি-নাতনির হাসিমুখের জন্য, কিন্তু সেই সব অপেক্ষার আড়ালে লুকিয়ে ছিল আরেকটা অপেক্ষা, যেটার কথা কখনো কাউকে বলেনি, একদিন হঠাৎ কোথাও থেকে ফিরে আসবে সেই একমাত্র মানুষটা, যে তাকে ‘তুই’ বলে ডেকেছিল সেই প্রথম দেখার প্রথম মুহূর্ত থেকে।
কিছুক্ষণ পর এক মধ্যবয়সী নারী এসে বসে তার পাশে; ক্লান্ত মুখ, হাতে বাজারের ব্যাগ, চুলে আজকের দিনের সতেজ ধুলো। তার শাড়ির রং দেখে আচমকা এক সুনির্দিষ্ট স্মৃতি জেগে ওঠে, ঠিক এমন একটা হলুদ শাড়ি তিনি একদিন তুলে দিয়েছিলেন এক নববধূর হাতে, বন্ধুর বিয়ের আগের রাতে; তখন মনে হয়েছিল, জীবনের অনেক কিছুর আগে বন্ধুত্ব, জীবনের সবকিছুর আগে বন্ধুত্ব। এখন সেই স্মৃতি এসে বসে এই বয়স্ক যাত্রীছাউনির মধ্যে, কিন্তু নারীটি এই স্মৃতির অংশ নয়, সে কেবল নিজের ব্যাগ, নিজের দুশ্চিন্তা, নিজের সামান্য বিশ্রাম নিয়ে ব্যস্ত। বৃদ্ধ মানুষ চোখের কোণ দিয়ে একবার তাকায়, তারপর আর তাকায় না। সে জানে, অচেনা মুখের ভেতরে কল্পিত পরিচয়ের সন্ধান মানে নিজেকেই ধোঁকা দেওয়া। তবু মনে হয়, কেউ যদি আপনা থেকে একবার জিজ্ঞেস করত, ‘কিসের অপেক্ষা?’, তাহলে হয়তো সে বলেও ফেলত কিছু, ‘যদি হারিয়ে যাই, দেখা হবে এখানেই’ টাইপের একটা বাক্য, কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করে না।
নারীটি আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে যায়, সাথে নিয়ে যায় তার গায়ের গন্ধ, কাপড়ের ঘ্রাণ, বাজারের ব্যাগের উটকো গন্ধ।
আলো আরও নিস্তেজ হয়ে যাত্রীছাউনির টিনের কিনারায় ঝুলে থাকা মরিচার রেখা দীর্ঘ ছায়া ফেলে বেঞ্চের ওপর। ঠিক এই সময়েই আরেকজন আসে, এক পুরুষ, বয়স পঞ্চাশের ওপরে, শার্টের কলার ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়েছে, মুখে একধরনের কঠিন নীরবতা, হাতে সিগারেট, ধুলোর রাজ্যে ধোঁয়ার অতর্কিত আক্রমণ। বৃদ্ধ দিশেহারা হয়ে ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে; ধোঁয়ার ফাঁকে একমুহূর্তের জন্য দেখা যায় এক অবয়ব, চোখের কোণে দুষ্টু হাসি, সেই পুরোনো কণ্ঠ, ‘তুই এত কিছু বুঝিস, আর আমাকে বুঝিস না!’। তারপর ধোঁয়া সরে গেলে সব স্বাভাবিক।
এই লোকের গোঁফে হাত বুলানোর ভঙ্গিটি পুরোনো বন্ধুর মতো; কিন্তু দৃষ্টিতে চেনা কোনো উচ্ছ্বাস নেই, চোখে পরিচিত কোনো আলোর ঝলক নেই। বৃদ্ধ উচ্চারণের জন্য কোনো শব্দ খুঁজে ফেরে না আর। যাত্রীছাউনির অবয়বে বহু বছর ধরে যারাই এসেছিল, তাদের মধ্যে বন্ধুর মুখ খুঁজতে চেয়েছিল সে; কিন্তু ক্লান্ত চোখে আজ আর খুঁজতে চায় না কোনো কিছু, তবু চেনা ভঙ্গি দেখে বুকের কোথাও লুকানো একটা পুরোনো তারে সুর বেজে ওঠে, তারপর আবার একটানা নীরবতা।
লোকটি সিগারেট শেষ করে চলে যায়। ধোঁয়ার গন্ধ থাকে কিছুক্ষণ, সেই গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকে এক মৃদু শোক, যেন কত অপরিচিত মানুষই এখন তার একাকিত্বের পটভূমি, কেউই তার একাকিত্বের অংশীদার নয়, এই প্রাচীন যাত্রীছাউনির নিচে, দিনের শেষ আলোকমালায়।
আকাশের রং এখন বদলে গেছে। প্রথমে ছিল বিবর্ণ সোনালি, এখন গাঢ় নীলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ধূসর; দূরের বাড়িগুলোর জানালায় আলো জ্বলছে একে একে, মানুষের ঘরে ফেরার ঘোষণা দিচ্ছে অবিরত। এখানে এই প্রাচীন যাত্রীছাউনির জীর্ণতায় কেউ ফেরে না। এখানে কেবল কেউ একজন বসে থাকে, রাস্তার ওপাশে বিদ্যুতের কালো তারে বসা পাখির চোখে চোখ রেখে।
ঠিক সেই সময় আসে এক বৃদ্ধা ধীর পায়ে, শালে মোড়ানো শরীরে। যাত্রীছাউনির ঠিক শেষ মাথায় বসে পড়ে, যেন দূরত্ব রেখেও একটু আশ্রয় নেওয়া। তার নিশ্বাসের ভাঁজেও এক পরিচিত বিচ্ছিন্নতা আছে, যা এ জায়গার সাথে মানানসই। বৃদ্ধের মনে হয়, তার সমসাময়িক বয়সের এই বৃদ্ধাও হয়তো কারও জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু তার অভিব্যক্তি দেখে মনে হয়, সে অপেক্ষা করতে করতে অপেক্ষার কারণটাই ভুলে গেছে। বৃদ্ধ তার দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না; তাদের দুজনের দুই ধরনের নিঃসঙ্গতা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলে খুব বেশি সত্য হয়ে আরও প্রকট হয়ে উঠবে, আর সে এখনো পুরোপুরি সত্যের মুখোমুখি হওয়ার মতো শক্তিশালী নয়।
বৃদ্ধা কিছুক্ষণ বসে, তারপর উঠে চলে যায়। যাত্রীছাউনির নিচে আবার সে একা, বটগাছের শিকড়, মরচে ধরা টিন, আর রাস্তার ওপাশে কালো তারের ওপর থেকে তাকিয়ে থাকা সেই পাখি।
রাত নামে ধীরে, এত ধীরে যে বোঝা যায় না কখন আলোর অবশিষ্টও সরে গেছে। রাস্তার অপর প্রান্তের একটি বাতি টিমটিম করে জ্বলে, আবার নেভে, আবার জ্বলে ওঠে, যেন দ্বিধাগ্রস্ত সে দিন আর রাত্রির সঙ্গম নিয়ে। যাত্রীছাউনির ভেতরে খুব একটা আলো আসে না। অন্ধকার ও ছায়া এখানে মিশে গিয়ে নতুন একটা রং তৈরি করে, ধূসর অপেক্ষার রং।
ঠিক এই অন্ধকারের ভেতরেই আসে ছেলেটি। খুব বেশি ছোটো নয়, আবার পূর্ণ যুবকও নয়; মাঝবয়সী তারুণ্য, যেখানে কণ্ঠ এখনো নরম, চোখে একধরনের সততা থাকে, যা শহরের ধুলোতেও পুরোপুরি নষ্ট হয় না। সে এসে ধীরে বেঞ্চে বসে, বৃদ্ধের থেকে কয়েক হাত দূরে। তার হাতে একটা খাম, ছোট, সাদা, সামনের দিকে ভাঁজের দাগ, দাগের ওপাশে শুয়ে আছে গোপন সব শব্দমালা।
বৃদ্ধ তার দিকে খুব স্পষ্টভাবে না তাকিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করে। আজ এখানে চারজন মানুষ এসেছে, বসেছে, তারপর চলেও গেছে। প্রত্যেকবারই তার ভেতরে সামান্য আশার আলো জ্বলে উঠেছে, আবার নিভে গিয়েছে। এই শেষ আগমনটাকে সে আগেভাগেই অপ্রাসঙ্গিক ভেবে নেয়, ছেলেটার অস্তিত্ব অস্বীকার করে নিজেকে একটু সুরক্ষিত রাখবে আরও একটা আশার প্রতারণা থেকে।
তাদের মধ্যে কোনো কথা হয় না। দূরে একটা ট্রাক যায়, কুকুর ডাকে, কোথাও একটা অটো স্টার্ট নিতে নিতে থামে। ছেলেটি আলতো করে খামটার কিনারা ছুঁয়ে থাকে, যেন ঠিক করতে পারছে না, তুলে দেবে কি না। বৃদ্ধ মানুষ ভেতরে ভেতরে একধরনের অস্বস্তি অনুভব করে, এই বয়সে অচেনা কারও কাছ থেকে অচেনা কোনো ইঙ্গিত নেওয়ার শক্তি তার নেই। সে সামান্য নড়ে বসে, যেন নিজেকে সরিয়ে রাখে কোনো সম্ভাব্য সংযোগের পথ রুদ্ধ করে।
একসময় ছেলেটি আস্তে উঠে দাঁড়ায়, তারপর অন্ধকারে মিলিয়ে যায় দিনের শেষ আলোকবিন্দুর মতো। যাওয়ার আগে সে খামটা কংক্রিটের বেঞ্চের ওপর রেখে দেয়, কোনো শব্দ ছাড়াই, যেন কোনো ভুলে যাওয়া বস্তু রেখে যাচ্ছে, না থাকলেও যার কথা কেউ জিজ্ঞেস করবে না, থাকেলও যার দিকে কেউ ভুলেও তাকাবে না।
একসময় ছেলেটি আস্তে উঠে দাঁড়ায়, তারপর অন্ধকারে মিলিয়ে যায় দিনের শেষ আলোকবিন্দুর মতো। যাওয়ার আগে সে খামটা কংক্রিটের বেঞ্চের ওপর রেখে দেয়, কোনো শব্দ ছাড়াই, যেন কোনো ভুলে যাওয়া বস্তু রেখে যাচ্ছে, না থাকলেও যার কথা কেউ জিজ্ঞেস করবে না, থাকেলও যার দিকে কেউ ভুলেও তাকাবে না, যার কোনো অস্তিত্ব নেই, যার কোনো তাৎপর্য নেই।
বৃদ্ধ প্রথমে স্পর্শ করে না খামটা। ভাবতে থাকে, এটা হয়তো মনের ভুলে ফেলে যাওয়া, হয়তো অন্য কারও জন্য। তবু তার মনে হয়, সারাটা দিন সে যাকে খুঁজছিল না খুঁজতে চেয়েও, তার সমস্ত অনুচ্চারিত প্রশ্নের উত্তর হয়তো এই ছোট কাগজের ভাঁজের ভেতরে লুকিয়ে আছে।
অবশেষে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব অন্ধকারে ছুড়ে ফেলে সে খামটা হাতে নেয়। কাগজের গায়ে আঙুল বোলায়, টের পায় পুরোনো কাগজের মতো গন্ধ; কাগজ নতুন, অথচ গন্ধ পুরোনো—এই দ্বৈততা তাকে ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে খাম খুলে ভাঁজ করা কাগজ বের করে সে, অন্ধকারেও চোখ মানিয়ে নেয় বহু আকাঙ্ক্ষিত অক্ষরের ছাপ।
সেই অক্ষর, সেই হাতের লেখার ঢং, কিছুটা বাঁকা, কিছুটা ঢেউ খেলানো, মেয়েলি; পুরোনো বহু খাতায়, দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারে, ক্লাসের বেঞ্চের ওপরে, কলেজের দিনগুলোর ফাঁকে যে হাতের লেখা সে দেখেছে অসংখ্যবার, আজ সেই হাতের লেখাই তার চোখে এসে পড়ে। কাগজের প্রথম লাইনে লেখা—‘বন্ধু’।
এই এক শব্দেই তার বুকের ভেতর জমে থাকা সব জীর্ণতার ওপর নেমে আসে বিদ্যুতের ঝলকানি; এত বছর পর কেউ তাকে এভাবে ডেকেছে।
পরের লাইনগুলোয় ঝাপসা হয়ে আসা বর্ণগুলো তাকে বলে দেয়, যে শরীরে তার স্পর্শ ছিল, সে শরীর এখন আর নেই; যে কণ্ঠে এই সম্বোধন ছিল, সেই কণ্ঠ থেমে গেছে গত বছর এই শহরের কোনো এক হাসপাতালের শীতল, সাদা বিছানায়। যোগাযোগের সব দরজা কখন যে বন্ধ হয়ে গেছে টের পায়নি। যে প্রতিশ্রুতির কথা একদিন বেশ আবেগ নিয়ে বলা হয়েছিল, তা শেষের দিনগুলোতে এসে সেই বন্ধু নিজেই মনে রেখেছিল, আর তাই এই চিঠি লিখে রেখে গেছে, যদি কোনো দিন কোনো এক বিকেলে কোনো এক বৃদ্ধ যাত্রীছাউনির নিচে বসে থাকে একা, তাকে যেন কেউ খুঁজে দেয় এই চিঠির রাডার দিয়ে।
বৃদ্ধ কাঁপতে থাকে, অক্ষরগুলো তার চোখে সরে যায়। সে অনুভব করে, এই কাগজ, এই শব্দের মধ্য দিয়ে যেন সময় নিজেকে উন্মুক্ত করছে, সে যে বন্ধুকে এত দিন কেবল হারিয়ে গেছে ভেবেছিল, সে তো মৃত, সে তো অস্তিত্বহীন, তবু সে-ই আবার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি উপস্থিত কোনো এক সন্তানের মাধ্যমে, কোনো এক অজ্ঞাত দূতের মাধ্যমে, কোনো এক ছেলের হাতে এই কাগজ তুলে দিয়ে।
হঠাৎ তার শ্বাস দীর্ঘ হয়ে যায়, ভারী হয়ে যায়, এতটাই ভারী যে চলতে না পেরে থমকে দাঁড়ায়। বৃদ্ধ কাগজের শেষ প্রান্তে তাকাতে চায়, যেখানে নিশ্চয়ই থাকবে সেই পরিচিত নাম। কিন্তু চোখ ঝাপসা হয়ে যায়, জলের ডাকে অক্ষরগুলো প্রথমে ভেসে ওঠে, তারপর ডুবে যায়। সে কাগজটা সামান্য দূরে সরিয়ে আবার কাছে আনে, তার দৃষ্টির বিশুদ্ধ সীমানায়, তারপর সে লক্ষ করে, যেখানে একটু আগে অক্ষর ছিল, সেখানে এখন কিছুই নেই। সাদা ফাঁকা কাগজ। কোনো ‘বন্ধু’ নেই, কোনো মৃত মানুষের স্বাক্ষর নেই, না আসার ব্যর্থতার কোনো ক্ষমা প্রার্থনা নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই।
বৃদ্ধ বিশ্বাস করতে পারে না। সে কাগজ উল্টে দেখে, দুই পাশই ফাঁকা। সে ভাবতে চেষ্টা করে, অন্ধকার কি তাকে ভুল দেখাল? স্মৃতি কি আগেভাগে নিজেই নিজের লেখা বানিয়ে নিল? নাকি সত্যিই কেউ লিখেছিল, আর এখন সময় মুছে ফেলেছে? প্রশ্নগুলোর ভার সে সইতে পারে না; তার ভেতরে এক অদ্ভুত আতঙ্ক জেগে ওঠে।
সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে, যেন কোনো প্রমাণ খুঁজবে, তার বন্ধুর একটা কল, একটা মেসেজ, ‘দেখা হবে বন্ধু। চলে এসো!’ বন্ধ ফোনটা চালু করতেই স্ক্রিন জ্বলে ওঠে, ‘নো সিমকার্ড ইনসার্ট’, যেন প্রযুক্তি নিজেই ঘোষণা করছে, এ মুহূর্তে তার কোনো সংযোগ নেই, কোনো কল যাবে না, কোনো কল আসবে না, পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এই ছোট পর্দা কেবল তার নিজেরই মুখ দেখাতে পারে তাকে, আর কিছু নয়।
এই দৃশ্য, এই ফাঁকা কাগজ, এই সিমহীন ফোন, এই বাসহীন যাত্রীছাউনি—সবকিছু একসঙ্গে এসে তার মাথার ভেতরে এমন এক শূন্য আলো জ্বালায়, যার মধ্যে দাঁড়িয়ে সে বুঝতে পারে, যাকে সে আজ পর্যন্ত মনে করত—‘শেষ প্রান্তে আমার কেউ আছে’, সেই সম্ভাবনাটুকু পর্যন্ত নেই আর। যে বন্ধুটিকে সে একদিন কল্পনা করেছিল ফিরে আসবে, অথবা না ফিরেও কোথাও থাকবে আপন হয়ে, সেই বিশ্বাস পুরোপুরি দুমড়েমুচড়ে গেলে তার আর দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা কোথায়!
যাত্রীছাউনির নিচে রয়ে যায় একটা ফাঁকা বেঞ্চ, একটা ভাঙা ফুটপাত, একটা মরচে ধরা খুঁটি, একটা শিকড়ে আটকে থাকা সাদা কাগজ, যার কোনো বুকে কোনো স্মৃতি নেই, তবু সে অস্পষ্টভাবে কিছু ধারণ করে কোনো দিন লেখা হয়েছিল বলেই; বটগাছের পাতায় অন্ধকার জমে থাকে; দূরের আলো নিভে যায়।
বৃদ্ধ কাগজটা হাত থেকে ফেলে দেয়। সেটা গড়িয়ে পড়ে বটগাছের শিকড়ের কাছে, আটকে যায়। সে লাফিয়ে গিয়ে তুলতে চায়, আবার ভয় পায়। কংক্রিটের বেঞ্চের সামনে এদিক–ওদিক হাঁটে কয়েক পা, মাথায় হাত দেয়, কিছু অসংলগ্ন ক্ষীণ শব্দ বের হয়। যাত্রীছাউনির মধ্যে তার এই অস্থিরতার কোনো সাক্ষী নেই; শুধু টিনের মরিচা, বটের শিকড়, দূরের বাতির কম্পমান আলো, আর কালো তারে কালো এক পাখির কালো অবয়ব।
কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধ নিজেই কাগজটা কুড়িয়ে নেয়। আবার দেখার চেষ্টা করে। কিছুই নেই। ফাঁকা কাগজ। সে একা। একেবারে একা।
বৃদ্ধের এই একাকিত্ব নতুন নয়, কিন্তু আজ তা সম্পূর্ণ; আজ সব বিকল্প দরজা বন্ধ হয়েছে। প্রজন্মের দূরত্ব, পরিবারের ব্যস্ততা, নগরের যান্ত্রিক শৃঙ্খল, প্রযুক্তির অদৃশ্য দেয়াল—সব মিলে তাকে এত দিন ধীরে ধীরে আলাদা করছিল; আজ এই ফাঁকা চিঠি আর সিমহীন ফোন সেই বিচ্ছিন্নতাকে স্পষ্ট, নগ্ন, অনস্বীকার্য করে দিল তার পৃথিবীর সামনে।
বৃদ্ধ কংক্রিটের বেঞ্চে বসে পড়ে, মাথা নিচু করে, হাত দুটো ঝুলে থাকে দুই পাশে। তার মাথার ওপরে মরিচা পড়া টিনের ছাউনি, ছাউনির ওপরে রাত, রাতের ওপরে দূরের তারা, যেন বিশাল কোনো অন্ধকার তাঁবু, যার নিচে এই একমাত্র মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে, যার জন্য কোনো পথ খোলা নেই।
বিদ্যুতের কালো তারের ওপর বসা পাখিটা একবার নড়ে ওঠে, সে নড়াচড়া খুব ছোট, কিন্তু সেই ছোট নড়াচড়া যেন অন্ধকারের মধ্যে এক ফোঁটা শব্দ; সে মাথা তুলে তাকায়। পাখির চোখ দেখা যায় না, শুধু একখণ্ড অবয়ব, তার একাকিত্বের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শহরের আলোর সামনে।
হঠাৎ দমকা বাতাস বইতে শুরু করে। টিনের মরিচারা শব্দ করে, শুকনো পাতারা নড়ে ওঠে, কাগজটা আবার উড়তে চায়, এবার ওড়ে না, শিকড়ের ভাঁজে আটকে থাকে। সেই পাখি ডানা ঝাপটায় আবার, উড়ে একটু এগিয়ে আসে তার দিকে, আবার ফিরে গিয়ে বসে, যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সে।
বৃদ্ধের মনে হয়, এই পাখিই হয়তো সে, যার আশায় তার সারাটা বিকেল কেটেছে; এই পাখিই হয়তো তার পুরোনো কোনো ডাকে সাড়া দিতে চেয়েছে; এই পাখিই সেই বন্ধুর অদৃশ্য ছদ্মবেশ। কারণ, মানুষেরাও তো আর সরাসরি আসে না; আসে চিঠি হয়ে, আসে স্মৃতি হয়ে, আসে স্বপ্ন হয়ে, আসে বাতাস হয়ে, পাখির ডানায় ভর দিয়ে।
তার বুকের গভীর থেকে একটি সুদীর্ঘ, ভারী, শব্দহীন নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। পা দুটি বেশ ভারী, তবু ওঠে, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে বটগাছের কাণ্ড ছুঁয়ে দেয়, সেই স্পর্শে অদ্ভুত এক নিশ্চয়তা, অস্পষ্ট অন্ধকারে কেউ যেন স্পষ্ট করে বলে, ‘তুমি বসেছিলে, এটুকুই যথেষ্ট।’
বৃদ্ধ কিছু বলে না, মুখ খোলে না। তার আর কিছু বলার নেই এই পৃথিবীর প্রতি। সে ধীরে ধীরে যাত্রীছাউনির বাইরে পা রাখে। রাস্তার ধুলো তার পায়ের সঙ্গে মিশে যায়, তার অস্পষ্ট ছায়া লম্বা হয়ে পেছনে পড়ে থাকে, যাত্রীছাউনির সীমানা পর্যন্ত গড়িয়ে যায়, তারপর মিশে যায় অন্ধকারে।
পাখিটা ডানা মেলে আকাশের দিকে উড়ে যায়। কোনো শব্দ করে না, কোনো ইশারা করে না; তবু তার উড়ে যাওয়া যেন এক শেষ দাগ টেনে দেয় বৃদ্ধের স্মৃতির ওপরে।
যাত্রীছাউনির নিচে রয়ে যায় একটা ফাঁকা বেঞ্চ, একটা ভাঙা ফুটপাত, একটা মরচে ধরা খুঁটি, একটা শিকড়ে আটকে থাকা সাদা কাগজ, যার কোনো বুকে কোনো স্মৃতি নেই, তবু সে অস্পষ্টভাবে কিছু ধারণ করে কোনো দিন লেখা হয়েছিল বলেই; বটগাছের পাতায় অন্ধকার জমে থাকে; দূরের আলো নিভে যায় আবার জ্বলে উঠবে বলে, কিন্তু জ্বলে না।
এই শহরের মানচিত্রে জায়গাটা অনর্থক, তবু এখানে আজ সত্যিই কিছু ঘটে গেছে, একজন মানুষের শেষ ভরসাটুকুও নিঃশব্দে সরে গেছে তার হাত থেকে, সাদা কাগজ হয়ে। বৃদ্ধ আর ফিরে তাকায় না। এখন থেকে সে বাঁচবে কেবল নিজের নিঃসঙ্গতার সাথি হয়ে আর কারও অপেক্ষা ছাড়া, তবু তার ভেতরে পুনরাবৃত্ত স্মৃতির মতো যাত্রীছাউনির নিচে এই শেষ বিকেলের দৃশ্য ফিরে আসবে, ফিরে আসতেই থাকবে, যত দিন সে মনে রাখতে পারবে যে কোনো একদিন কেউ বলেছিল, ‘যদি হারিয়ে যাই, দেখা হবে এখানেই।’