ফিনিক্স

বাবা মারা গেছেন আজ সকালে। 

ফোনে খবরটা জানালেন শওকত চাচা। পরিচয় পাওয়ার পর একটু বিব্রত হলাম। নিজের একমাত্র চাচাকে প্রথমে চিনতে পারিনি।

অফিসে এখনো আমার প্রবেশন পিরিয়ড চলছে। তার ওপর কাজের যে চাপ, তাতে আমার মরার খবর পেলেও সবাই এখন বিরক্ত হবে। আমার ইনচার্জ এমনিতে কারও দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে কথা বলেন না; কিন্তু আজ ছুটি চাওয়ার পর চশমার ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। পূর্ণ দৃষ্টিতে। সেদিকে চেয়ে আমি ছুটি চাওয়ার কারণটা ধীরেসুস্থে ব্যাখ্যা করলাম। তিনি বেশ অমায়িক ব্যবহার করলেন।

গাবতলীতে এসে দেখি সূর্যমুখী পরিবহনের একটা বাস এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে এগিয়ে এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন এখনই ছেড়ে দেবে। অর্ধেক সিট খালি। জানালার কাছে একটা সিট কনফার্ম করে খাবারের দোকানে ঢুকে পরোটা আর চা খেয়ে সিগারেট ধরালাম। তারপর বাসের সামনে এসে দাঁড়াতেই চশমা পরা অপরিচিত লোক এসে বলল, ‘ভাই, আপনি ফিশারির কাছে নামবেন?’

‘জি।’

‘কিছু মনে না করলে একটা রিকোয়েস্ট করি?’

‘করেন।’

‘এই প্যাকেটটা একজনকে পৌঁছায় দিতে পারবেন?...’

কিছু বললাম না। লোকটা বলল, ‘আমার লোক ওখানেই দাঁড়ায় থাকবে। কোনো ঝামেলা করতে হবে না। আমার এক ভাইয়ের কাছে দেওয়ার কথা ছিল। সে চলে গেছে।’

না করতে পারতাম। বলতে পারতাম, না, আজ আবার বাবা মারা গিয়েছে। কারও কাছে কিছু দেওয়ার মতো অবস্থা নেই...বাসে তো আরও লোক আছে।

এই কথা বললে লোকটা হয়তো দুঃখ প্রকাশ করবে। তারপর শুরু করবে প্রশ্ন। কোথায় বাড়ি, বাবার কী হয়েছিল, বয়স কত, বাড়িতে কে কে আছে। এত কথায় যেতে ইচ্ছে করছে না। তা ছাড়া, কাজটা সামান্যই। মফস্‌সলের অনেকেই এভাবে জিনিসপত্র পাঠায়। বাসস্ট্যান্ডে কেউ এসে দাঁড়িয়ে থাকে। তাই রাজি হলাম।

লোকটা চলে গেল। বাবার খবরটা কাকে কাকে বলা দরকার ভাবছি। এতক্ষণে মা জেনে গেছেন। জেনে গেছে এলাকার বন্ধুরাও। আর এমন কেউ নেই যাকে বলা জরুরি। নাইলাকে জানাব? সে এখনো সাবেক হয়ে ওঠেনি। এত দিনের প্রেমের পর ব্রেকআপ হয়েছে দুই মাস হয়নি। সুতরাং তাকে পুরোপুরি এক্স বলা যায় না। আমার বাবার ব্যাপারে তার করুণামিশ্রিত একটা নিখাদ কৌতূহল ছিল। তবু হুট করে এত দিন পর একটা মৃত্যুর খবর দিয়ে যোগাযোগ হওয়াটা বেমানান।

তা ছাড়া বাবার মৃত্যুতে আমি যে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছি, তা না। তিনি যে বেঁচে ছিলেন, সে কথাই ভালোমতো মনে ছিল না। সবশেষ কবে তাঁর কথা ভেবেছি? গত মাসে হতে পারে। অফিসের কোনো ফরম পূরণের সময়। তাঁর কথা ভাবার অভ্যাস বন্ধ হয়েছে অনেক দিন। ১৩ বছর আগে। তারও অনেক দিন আগে আমার মা তাঁকে ছেড়ে চলে আসেন। তখন ক্লাস টুতে পড়ি। সাদা শার্ট, কালো টাই পরে ছোট ছোট পায়ে ইংলিশ একাডেমিতে ক্লাস করতে যাই।

এসব কথা নাইলাকে একটু একটু বলা হয়েছিল। বাবার ছবি দেখতে চাইত সে। যখন বলেছি তাঁর কোনো ছবি আমার কাছে নেই, সে বিস্মিত হয়েছে; কিন্তু কথাটা সত্যি ছিল।

তবে ছোটবেলায় দিলু খালার বাসায় বাবার একটা ছবি অনেকবার দেখেছি। মা আর আমার সঙ্গে অস্পষ্ট একটা ছবি। কোথাও বেড়াতে গিয়েছি সবাই। বাবার কোলে লাল সোয়েটার পরা আমি। সবুজ শাড়িতে মা। পেছনে একটা বাংলোমতো বাড়ি, লাল টালির ছাদে রাশি রাশি সাদা ফুল। আমাকে দেখে মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলব। বাবা আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। 

বাবা অবশ্য আমাকে দেখতে আসতেন। একসময় স্কুল শেষে প্রায়ই বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম ধুলোমাখা উষ্কখুষ্ক চুলে। হাতে চকলেট কিংবা বই। সেবার হাইস্কুলে উঠলাম। পূজায় এক সপ্তাহ ছুটি। সেই ছুটির আগে তিনি আমাকে মুঠোফোন কিনে দিলেন। হাতে ধরা যায় এমন নীল একটা ফোন। তাতে একটা নম্বরই সেভ করা। কী যে এক উত্তেজনা! প্রতিদিন বিকেলে খেলার মাঠে গিয়ে লুকিয়ে বাবাকে ফোন দিতাম। এক সপ্তাহের মধ্যে ধরা পড়লাম। মা আছড়ে ফোনটা ভেঙে ফেললেন।

পরের রোববার স্কুল থেকে বের হয়ে দেখি বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। ‘ফোন বন্ধ কেন, বাবাই? কী হয়েছে?’

আমি চুপ। বাবার মুখটা নিভে যায়। ছোট করে বলেন, ‘ও।’

তারপর আমার হাত ধরে দ্রুত হাঁটতে থাকেন। মনো ঘোষের দোকানে নিয়ে বসান। বিশুদাকে ডাক দিয়ে বলেন, ‘এখানে চারটা রসগোল্লা দাও।’

কালো ভেজা ভেজা টেবিল। সারাক্ষণ কয়েকটা মাছি উড়ছে। বিশুদা এসে ভেজা কাপড় দিয়ে টেবিল মুছে দিয়ে বড় বড় চারটা রসগোল্লা আনল। এতগুলো রসগোল্লা খাওয়া সম্ভব নয়। বাবাকে খুশি করার জন্য আমি পেট পুরে খেলাম। তিনি হাত দিয়ে মাছি তাড়াতে তাড়াতে তৃপ্তির সঙ্গে আমাকে দেখতে লাগলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইংলিশ পড়তেছ কার কাছে?’

মুখভরা মিষ্টি নিয়ে কোনো রকমে বললাম, ‘পরিমল স্যার।’

‘জেলা স্কুলের?’

‘হুঁ।’

‘ভালো। পরিমল স্যার খুব ভালো।’

তারপর তিনি আর কথা খুঁজে পেলেন না। এত ছাত্রছাত্রীকে ইংলিশ পড়ান, অথচ নিজের ছেলেকে পড়াতে পারছেন না। বললেন, ‘রাজভোগ খাবে?’

‘না।’

আমি সেদিন জানতাম না, বাবা আর আমাকে দেখতে আসবেন না। এরপর মনো ঘোষের দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমার খুব লজ্জা লাগত। মনে হতো, বিমল কিংবা বিশুদা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

এখন আমার মিষ্টি খেতে ভালো লাগে না। নাইলা বলে, ‘তুমি একটা বেরসিক মানুষ।’ হয়তো তা–ই। নাইলা শব্দটার মানে বিজয়ী। স্বভাবেও সে তা–ই ছিল। তার মতো হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল মানুষের তুলনায় পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই বেরসিক।

ও চলে যাওয়ার জন্য ওর মোটেই দোষ নেই। আমিই ওকে বাধ্য করেছি। আমাকে ওর মতো কে আর এমন ভালোবাসবে! সে ভাবত, বেশির ভাগ মানুষ আমাকে বোঝে না। ভাবত, ও আমাকে খুব ভালো বুঝতে পারে, সারা পৃথিবী থেকে আমাকে আগলে রাখবে। সবশেষে টেক্সট করেছিল, ‘ভুল করছ। আমি জানি খুব দ্রুতই সেটা বুঝতে পারবে।’

প্রেমে পড়লে মানুষ ভাবে এসব। একসময় যেমন আমার মা আবার বাবাকে নিয়ে ভাবতেন। সেই ভাবনা একসময় সম্পূর্ণ উল্টো হয়ে যায়। নাইলারও তা-ই ঘটত। তখন ভাবত, সে নিজেই ভুল করেছে। এত কিছু অনুভব করার পরও সব মানুষেরই কিছু কথা থাকে পৃথিবীতে কেবল একজনকে বলার জন্য। নাইলার জন্যও আমার তেমন কিছু কথা জমা ছিল।

আজকের আকাশটা দেখে ওর একটা পছন্দের গানের কথা মনে পড়ছে। কোল্ড প্লের। ‘লুক অ্যাট দ্য স্টারস/ লুক হাউ দে শাইন ফর ইউ/ অ্যান্ড এভরিথিং ইউ ডু’। আগুনলাগা বিকেলে নাইলা এই গান শুনতে পছন্দ করত। হয়তো এখনো করে। কিন্তু এসব বিকেলে আমার বুকের মধ্যে একটা জায়গা মোচড় দিয়ে ওঠে।

একটা বিকেলকে আমি অনেক বছর ধরে গোপন রেখেছি। মনে হতো, সেই বিকেলের কথা কেবল ওকে একদিন বলব।

সেটা বাবাকে নিয়ে। তখন তিনি আর আমাকে দেখতে আসেন না। বিভিন্ন জায়গা থেকে আমি তাঁর টুকরা টুকরা খবর পাই। নতুন সংসারে তাঁর দুটি ছেলে হয়েছে। তিনি ভালো আছেন। তাঁকে দেখতে কিশোর বয়সে একদিন আমি কাউকে না জানিয়ে বাসে চেপে বসেছিলাম।  

সেদিন বিকেলে আকাশটা ছিল অপূর্ব। হলুদ, কমলা, লালচে মেঘ। কিন্তু আমার মন খুব অস্থির। বাস থেকে আদুলপাড়া বাজারে নেমে চেয়ারম্যানবাড়ির দিকে যেন একটা ঘোরের মধ্যে হেঁটে গিয়েছিলাম। বেশ খানিকটা গিয়ে হাতের বাঁয়ে বাড়িটা। সেখানে গিয়ে বোকার মতো আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।

যেন আমাকে ছায়া দিতেই মাথার ওপর ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল একটা আমগাছ। রাস্তায় ওই পারে সুন্দর, ছিমছাম দরজার ওপরে লেখা নামফলকে জ্বলছিল একটা টিমটিমে বাতি। সেই ফলকে লেখা ‘হামিম-তামিম ভিলা’।

ঘরের ভেতরের আলোতে পরিষ্কার সব দেখা যাচ্ছিল। খোলা দরজা–জানালায় ছিল না কোনো পর্দা। দুটি ছেলে পাটিতে বসে পড়ছিল দুলে দুলে। হলুদ শাড়ি পরা এক মহিলা ঘরের মধ্যে এসে খুব তাড়াহুড়ার ভঙ্গিতে বলছিলেন, ‘তামিম, তামিম, বাবা, ওঠো, উঁহু, উঁহু...ঘুমায় না। ঘুমায় না, বাবা।’

একটু পর পরিচিত সাইকেল আর ঘামের কড়া গন্ধ নিয়ে কেউ একজন আমার ঠিক পাশ দিয়ে চলে গেলেন। ওই সাইকেলটা আমার চেনা। ফিনিক্স সাইকেলটা চালাচ্ছিলেন বাবা। তিনি আমাকে লক্ষ করলেন না।

শব্দ পেয়ে ছোট ছেলেটা ‘বাবা আসছে, বাবা আসছে’ বলে দৌড়ে এল। তিনি সাইকেলটায় তালা দিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ছেলেটাকে দ্রুত কোলে তুলে নিলেন। সে ‘পাপ্পা, বাবা, পাপ্পা’ বলায় বাবা তাকে অনেকগুলো পাপ্পা দিলেন। তারপর পকেট থেকে দুটো চকচকে প্যাকেট বের করে ওদের হাতে দিলেন। ছোট ছেলেটা তখন কোল থেকে নেমে খুশিতে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল। মহিলাটি কয়েকটা কাপড় ভাঁজ করতে করতে কী একটা কথা বলছিলেন। তাঁর হাসি একসময় ছড়িয়ে পড়ল বাবা এবং ছেলে দুটির মধ্যেও। 

ঠিক সে সময় আমার পাশ দিয়ে একটা খালি রিকশা যেতে যেতে ট্রিন ট্রিন করে বেল বাজিয়ে ওঠায় আমি চমকে উঠলাম। মনে হলো কয়েক লক্ষ বছর কোনো ভুল জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। তখনই ফেরার পথ ধরলাম। আর অকারণেই মনে হলো, মা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে অস্থির হয়ে গেছে। 

কিছু রহস্য বন্ধ একটা দরজার মতো সারা জীবন সঙ্গে থাকে, কিন্তু কখনো দরজার ওপাশে কী আছে জানা যায় না। মা কেন বাবাকে ছেড়ে চলে এসেছিলেন, সেই কারণ কখনো জানতে পারিনি। আমার মনে হয়, বাবা কারণটা জানতেন বলেই কখনো জোর গলায় মাকে জিজ্ঞেস করতেন না। সবাই বলত, মনসুর খুব ভালো মানুষ। তাঁকে ছেড়ে এসে আমার মা সবার চোখে ছিলেন অপরাধী। নানা–মামারা মাকে নতুন সংসার করানোর অনেক চেষ্টা করেছেন। একবার আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ছোট খালার বাড়িতে। বিয়ে প্রায় হয়েই যায়। কিন্তু মা দরজা আটকে বসে থাকেন। বলেন, গলায় ফাঁস নেবেন।

বাবার ওই সাইকেলের সঙ্গে খুব ছোটবেলার কিছু স্মৃতি আছে। তিনি যখন স্কুল থেকে ফিরতেন, আমিও সাইকেলের শব্দে দৌড়ে যেতাম। বাবা বলতেন, ‘বুঝলে খোকন, ফিনিক্স একটা আশ্চর্য পাখি। কয়েক শ বছর বাঁচে। তারপর একদিন পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেই ছাই থেকে আবার জন্ম নেয় এই পাখি। মানুষকে ফিনিক্স পাখির মতো হতে হয়। কখনো আশা হারাবে না। জ্বলেপুড়ে শেষ

হলেও আবার শুরু করতে হবে।’

আমার বাস ফেরিতে ওঠার লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সন্ধ্যার আকাশও আগুনলাগা। সোনালি, লাল মেঘের মধ্যে কুসুমের মতো লাল সূর্য। একতারা বাজিয়ে এক বৃদ্ধ বয়াতি গান ধরেছে। সে গানের কথা কিছুই বুঝতে পারছি না শুধু ‘আমার পাখি রে’ ছাড়া।

১৩ বছর আগের সেই সন্ধ্যায় ফিনিক্স পাখি আমার কাছে মিথ্যে হয়ে গিয়েছিল। তারপর একটা জলোচ্ছ্বাসের মতো মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর ধীরে ধীরে জীবনের প্রতি আগ্রহ খুঁজে পাই। তখন মনে হয়, ফিনিক্স হতে পারে এমন কেউ, যার জন্য আবার স্বপ্ন দেখা যায়। এ কথাগুলোই নাইলাকে বলতে চেয়েও কখনো বলা হয়নি। ‘আমার পাখি রে’ গানটা শুনতে শুনতে মনে হলো, নাইলাকে একটা ফোন দেওয়া খুব জরুরি।