প্রীতিলতার প্রথম বিদেশ যাত্রা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ভোরের আলো ফুটে ওঠার একটু আগে ঘুম ভেঙেছে প্রীতিলতার। ঘণ্টাখানেক আগে পাভেলকে দুধ খাইয়ে, মুখে চুষনিটি গুঁজে দিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। তারপর নিজের ভেতর সম্পূর্ণ একা হয়ে, পাশের কামরায় গিয়ে জোর কেঁদেছে। শক্তপোক্ত স্বভাবের তরুণী প্রীতি। উনসত্তরের গণ–আন্দোলনে মিছিলের দিকে যখন লাঠিচার্জ করতে ধেয়ে এসেছিল পুলিশ, কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী প্রীতিলতা আরও চারজন সতীর্থকে নিয়ে প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। স্বদেশের—খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে ধেয়ে চলা পরিস্থিতি, যাকে লেখাপড়া জানা পাড়া-প্রতিবেশীরা আখ্যায়িত করেছেন পলিটিক্যাল ডিস্টার্বেন্স বলে, তাতেও সে ঘাবড়ে যায়নি একবিন্দু, তবে অনুভব করেছে দায়িত্ব, কিন্তু সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারেনি—ছয় মাসের তিফিল ছেলে পাভেলকে সামলিয়ে সে কী-ই বা করতে পারে?

সুরুযের আলো ফুটছে একটু একটু করে, বাসার পেছন দিককার জানালাটি খুলে দিয়ে প্রীতি এসে দাঁড়ায় বারান্দায়। মনে হয় এ ভোরবিহানেও বিরাম হয়নি সীমান্তের দিকে ছুটে চলা মানুষের পথপরিক্রমা। আজ আর বাজারের ভেতর দিয়ে বর্ডার অতিক্রম করে ওপারের দিকে যাওয়া রাজসড়কটি ধরে কেউ আর পায়ে হেঁটে, রিকশায়, বেবিট্যাক্সি বা ট্রাকটারে করে ত্রিপুরার দিকে যাচ্ছে না। সবাই গাট্টিবোঁচকা, টিনের স্যুটকেস, ঝুড়ি, ছালার টাটের বস্তা—হাতের কাছে যা পাচ্ছে তা নিয়ে প্রীতিলতার বাসার পেছন দিককার চষা খেত ধরে, বন্দকোনাকোনি দূরের সীমান্ত নিশানা করে জোর কদমে হাঁটছে। বারান্দার কুটিচৌকিতে উঠে পড়ে বাঁশের টাট্টিবেড়ার ওপর দিয়ে উঁকি দিয়ে প্রীতি কিছুক্ষণ মানুষের ছুটে চলা দেখে।

শক্তপোক্ত স্বভাবের তরুণী প্রীতি। উনসত্তরের গণ–আন্দোলনে মিছিলের দিকে যখন লাঠিচার্জ করতে ধেয়ে এসেছিল পুলিশ, কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী প্রীতিলতা আরও চারজন সতীর্থকে নিয়ে প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল।

গতকাল পাকিস্তানি আর্মি এখানেও এসে পৌঁছেছে। বেশিক্ষণ থাকেনি তারা। ক্যাপ্তেন দাউদ জিপ থেকে নামলে, হঠাৎ করে ভুঁইফোড়ে গজিয়ে ওঠা শান্তি বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে তাকে সংবর্ধনা জানিয়েছিল। বাজারের সংলগ্ন ইউনিয়ন কাউন্সিলের আঙিনায় কিছুক্ষণ চারদিকে বন্দুক তাক করে মূর্তিবৎ দাঁড়িয়েছিল কয়েকটি খান সেনা, তাদের ক্যাপ্তেন তখন চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে স্ক্যান করে নিচ্ছিল আশপাশের ধানখেত ও জনপদ। বেশ খানিকটা দূরের থানা-শহরে ফিরে যাওয়ার সময়, ট্রাকে করে আসা পাক আর্মির জওয়ানরা ফাঁকা আওয়াজ করে যেন গ্রামবাসীদের শাসিয়ে গেছে। তারপর থেকে সারা দিন, এখানে ওখানে চোরাগোপ্তাভাবে পোড়ানো হয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা। দিগন্তের কাছে থেকে থেকে উড়ছে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া, জনপদ ঘিরে গেছে ফিসফিসানো গুজবে। প্রীতিলতারও কানে এসেছে, দূরের দত্তপুর, রুকশিমইল ও রামপা গ্রামে পাকিস্তানি আর্মিরা পুড়িয়ে দিচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি।

পাঁচ দিন হতে চলল, গ্রামের বাজারের লাগোয়া ডাঙ্গার বাসাবাড়িতে মাসুম বাচ্চা পাভেলকে নিয়ে প্রীতিলতা প্রায় একাই বসবাস করছে। স্বামী ছাত্রনেতা আহাদ চৌধুরীকে হঠাৎ করে যেতে হলো মৌলভীবাজারের দিকে। কারণ, শেরপুরের ফেরির কাছে নদীর এপার থেকে ছাত্র–জনতা, রাজারবাগ থেকে জান হাতে নিয়ে বেঁচে যাওয়া কয়েকজন পুলিশ ও ইপিআরের সদস্য মিলে গড়ে তুলেছে সশস্ত্র প্রতিরোধ। এদের সরবরাহ জোগাতে, স্থানীয় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির সংগঠক হিসেবে, আহাদ মুসলিম লীগার ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের সেভেনসিটার গাড়িটি বন্দুকের মুখে জবরদখল করে, তাতে চাল-ডাল-লবণ-দিয়াশলাই প্রভৃতি চাপিয়ে রওনা হয়েছে প্রথমে মহকুমা শহর মৌলভীবাজার, তারপর শেরপুরের দিকে। আজকাল পথেঘাটে ডাকাতির সম্ভাবনা বেড়ে গেছে, তাই আহাদ হোন্ডা চালিয়ে পথ চলেছে সেভেনসিটারটির পেছন পেছন, সঙ্গে করে সে নিয়ে গেছে একটি দোনলা ও দুটি একনলা বন্দুক। দোনলাটি তার চাচা, ব্রিটিশ আমলের ডাকসাইটে সরপঞ্চ মোফাদ চৌধুরীর, তিনি বামধারার একটি ছাত্রসংগঠনের কলেজ পর্যায়ের নেতা ভাতিজাকে দোনলা হান্টিংগানটি স্বেচ্ছায় দেননি। এ নিয়ে চাচা-ভাতিজায় দ্বন্দ্ব কোন পর্যায়ে গেছে, সে সম্পর্কে প্রীতিলতা সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল না হলেও খানিকটা আন্দাজ করতে পারছে। আহাদ প্রীতিলতাকে বাসাটিতে পুরোপুরি একা রেখে যায়নি, তাদের সংসারে জীবনভর কাজকর্ম করে বৃদ্ধ হওয়া মহরমের মাকে পাভেলসহ তার দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। রোদ উঠতে এখনো ঢের বাকি, বুড়িরও ঘুম ভাঙেনি।

গতকাল পাকিস্তানি আর্মি এখানেও এসে পৌঁছেছে। বেশিক্ষণ থাকেনি তারা। ক্যাপ্তেন দাউদ জিপ থেকে নামলে, হঠাৎ করে ভুঁইফোড়ে গজিয়ে ওঠা শান্তি বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে তাকে সংবর্ধনা জানিয়েছিল।

বসায় কামরায় এসে প্রীতিলতা বইপুস্তক ও পত্রিকার স্তূপ করে রাখা বান্ডিলগুলোর দিকে তাকায়। পুস্তকাদির অধিকাংশই রাজনৈতিক ভাবাধারায় লেখা, বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস-কবিতাও আছে। আহাদ কথামতো রাতে ফিরে আসেনি। তিন দিন আগে শেরপুর-মৌলভীবাজার হয়ে এখানকার সীমান্তের দিকে যাওয়া একজনের কাছ থেকে প্রথমে শোনা গিয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে তার আহত হওয়ার খবর। মানুষটি এ তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি, যেদিকে সংঘর্ষ হচ্ছিল, ওখান থেকে বেশ দূরে, গ্রামের মেঠোপথটি ধরে তিনি আসছিলেন, কোনো হাটের টি-স্টলে কথাটি শুনেছেন তিনি। তো আহাদের রাজনৈতিক সহকর্মীরা বিষয়টি গুজব বলে উড়িয়ে দেয়। তারপর শোনা গেল, শেরপুরের দিকের প্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে, খান সেনারা অ্যাডভান্স করছে। যদিবা এসে পড়ে এরা এদিকে, আহাদের ছাত্রসংগঠনের ছেলেদের মুখ থেকে প্রীতিলতা জানতে পারে, কেউ কেউ রাজনৈতিক ভাবধারায় রচিত বইপুস্তক হয় পুড়িয়ে ফেলছে, নয় লুকিয়ে রাখছে। আহাদের খুব ঘনিষ্ঠ সংগঠন-কর্মী আফজাল তার বাসায় এসে রাজনৈতিক পুস্তকাদি ও পশ্চিম বাংলার লেখকদের লেখা উপন্যাস ও কবিতার বইপত্র বান্ডিল করে রাখতে বলে গেছে।

হঠাৎ করে প্রীতিলতার প্রবল কান্না পায়, কিন্তু শব্দে যদি পাভেল জেগে ওঠে, অনেক কষ্টে, হেঁচকি তুলে সে নিজেকে সামাল দেয়। গতকালও বারবার তার কান্না পাচ্ছিল, কিন্তু কেঁদে উঠলে পাশে শুয়ে থাকা শিশুসন্তান পাভেল যেন বুঝতে পারে মায়ের কষ্ট, স্পর্শ করতে চায় ছোট্টমোট্ট হাতটি বাড়িয়ে, প্রীতি যখন আঁচল দিয়ে মুছছিল চোখ, বাচ্চাটি তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে একটু যেন হেসেওছিল। ওই হাসিটা ডাকটিকিটের মতো সেঁটে আছে তার হৃৎপিণ্ডে। গতকাল আহাদের গ্রামের তিনজন চেনাজানা শুভাকাঙ্ক্ষী তার বাসায় এসে শুধু তার খোঁজখবর নেয়নি, তাকে সাবধান করে দিয়ে পরামর্শও দিয়েছে, সে যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যায় ওপারে। আহাদের ফিরে আসা অব্দি অপেক্ষা করা ছাড়া প্রীতিলতার গত্যন্তরই-বা কী? এ মুহূর্তে করণীয় কী, তা বুঝে উঠতে না পেরে সে ভাবে, মহরমের মাকে একবার পাঠাবে কি আহাদের বাড়ি, তার শাশুড়ি-মায়ের কাছে।

পাভেলের জন্মের সংবাদ শোনার পর নাতির জন্য জামাকাপড়, খেলনা ও ছেলের জন্য টাকাপয়সা গোপনে পাঠিয়ে সহায়তা করেছেন। আমেনা নামে অল্পবয়সী একটি কাজের মেয়েকেও পাঠিয়েছেন শিশুটির সার্বক্ষণিক দেখভালের জন্য।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে শাশুড়ি-মা তথা আহাদের পরিবার তাদের বিবাহের কারণে এত হোস্টাইল হয়ে আছেন যে তাঁরা তাকে যেমন সামাজিকভাবে গ্রহণ করে নেননি, তেমনি পুত্রবধূর মুখও দেখেননি। পাভেলের জন্ম সম্পর্কের তারা ওয়াকিবহাল, সুসংবাদটি নিয়ে আহাদ মায়ের কাছে গিয়েছিল, মা নাতির মুখ দেখতে সম্মতও হয়েছিলেন, কিন্তু বাদ সাধলেন তার চাচা মোফাদ চৌধুরী। বছর দশেক আগে বাবার মৃত্যুর পর থেকে তিনি নিজেকে আহাদের পরিবারের অভিভাবক বিবেচনা করে থাকেন।

গেল ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনে চাচা মোফাদ চৌধুরী পূর্ব বাংলার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি বা পিডিপির টিকিটে প্রার্থী হয়েছিলেন। সদ্য যুবক আহাদ সম্মিলিত বিরোধী জোট কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টির প্রার্থীর সপক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় জোরেশোরে শামিল হয়েছিল, এমনকি জনসভায় ১৯৫২ সালে নুরুল আমিনের মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণের সময় যে তার চাচা মোফাদ চৌধুরী রাষ্ট্রভাষা উর্দুর সমর্থনে পত্রপত্রিকায় চিঠিচাপাটি লিখেছিলেন—এসব উল্লেখ করাতে সবেক সরপঞ্চের নির্বাচনে ভরাডুবি শুধু নিশ্চিত হয়নি, তার জন্য জনসমক্ষে আসাও দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। ঘাগু রাজনীতিবিদ মোফাদ চৌধুরী নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়ে, মুসলিম লীগের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে সম্মিলিত বিরোধী জোটের প্রগতিশীল প্রার্থীর পরাজয়কে নিশ্চিত করেছিলেন; এসব ঘটনাক্রম চাচা-ভাতিজার দ্বন্দ্বকে এমন এক ক্লাইমেক্সে নিয়ে গিয়েছিল যে আহাদ জনসভায় তাকে শুধু প্রতিক্রিয়াশীল অখ্যায়িত করেনি, সংগ্রামশীল মেহনতি জনগণের শত্রু হিসেবেও চিহ্নিত করেছিল।

উল্লিখিত মতবিরোধের জেরে চাচা-ভাতিজার পক্ষে বছর কয়েক ধরে শোভনভাবে দেখাসাক্ষাৎ দুরূহ উঠেছে, আর আহাদের মা–ও অসূয়াপরায়ণ দুঁদে ভাশুরটির সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করে পরিবারের অমতে বিবাহিত ছেলের সঙ্গে সামজিকভাবে সম্পর্ক রক্ষায় অনাগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তবে পাভেলের জন্মের সংবাদ শোনার পর থেকে মহরমের মার মারফত নাতির জন্য জামাকাপড়, খেলনা ও ছেলের জন্য টাকাপয়সা গোপনে পাঠিয়ে সহায়তা করেছেন। আমেনা নামে অল্পবয়সী একটি কাজের মেয়েকেও পাঠিয়েছেন শিশুটির সার্বক্ষণিক দেখভালের জন্য। এমনকি পঁচিশে মার্চের পর সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটিতে যখন সিদ্ধান্ত হয় হাটে-বাজারে-ইউনিয়নে সর্বত্র উড়বে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের পতাকা, আহাদ রাতের বেলা বাড়ি ফিরে এ বাসাটিতে নিয়ে এসেছিল মায়ের সিঙ্গার মেশিনটি। পাভেলকে আমেনার হেফাজতে দিয়ে প্রীতিলতা ওই মেশিনে সেলাই করে তৈরি করেছিল, অত্র এলাকায় স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রথম কয়েকটি পতাকা।

মোফাদ চৌধুরী রাষ্ট্রভাষা উর্দুর সমর্থনে পত্রপত্রিকায় চিঠিচাপাটি লিখেছিলেন। নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়ে, মুসলিম লীগের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে সম্মিলিত বিরোধী জোটের প্রগতিশীল প্রার্থীর পরাজয়কে নিশ্চিত করেছিলেন।

বেডরুমের দুয়ার ফাঁক করে প্রীতিলতা দেখে নেয়, ছোট্ট হাতের মুঠিতে ঝুমঝুমিটি ধরে নিরুপদ্রব নিদ্রায় এখানো অচেতন পাভেল, বালিশের পাশে অবহেলায় পড়ে আছে চুষনিটি। সে ড্রয়িংরুমে ফিরে এসে টেবিলে বসে ড্রয়ার থেকে টেনে বের করে ডায়েরি। ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে বিয়ের জটিল কাজটি চুকিয়ে, তাকে নিয়ে নিজের সংগঠনের এক কর্মীর বাসায় ওঠার আগে, বেবিট্যাক্সি থামিয়ে এ ডায়েরিটি তার জন্যে উপহার হিসেবে কিনেছিল আহাদ বুকস্টোর থেকে। তারপর চায়ের দোকানের কেবিনে বসে মোগলাই পরোটার অর্ডার করে লাল কালিতে লিখেছিল কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার দুটি চরণ, ‘বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে/ আমি যাই তারি দিন পঞ্জিকা লিখে—’ নোটবুকটি তার দিকে ঠেলে দিতে দিতে সে বলেছিল, ‘দেশ অতিক্রম করছে প্রবল এক ক্রান্তি, বাঙালিদের স্বাধিকারের ইস্যু নির্বাচনের মাধ্যমে হয়তো নিষ্পত্তি হবে না, প্রয়োজন হতে পারে সশস্ত্র বিপ্লবের, সময়টা হবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তো কিছু ঘটলে—এ ডায়েরিতে যদি বিবরণটা লিখে রাখতে পারো, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ অবাক হয়েছিল তাকে কেতকী রায় না লিখে গোটা গোটা হস্তাক্ষরে শুধু প্রীতিলতা সম্বোধন করায়!

আহাদের সঙ্গে কেতকীর পরিচয়, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় খেলাঘরের আসরে শামিল হওয়ার পর থেকেই। বছর দুয়েকের ভেতর মফস্সল শহরের নানা অনুষ্ঠানে নজরুল ও সুকান্তর কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে কিশোরীটি যখন খানিক নাম কুড়িয়েছে, মহকুমা শহরের কলেজ থেকে আসা উঠতি ছাত্রনেতা আহাদ কখনো কখনো তাকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আধিপত্যবিরোধী আন্দোলনে আত্মাহুতি দেওয়া বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মতো চেতনাসম্পন্ন বলে প্রশংসাও করেছে। তারপর ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের আফিসে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে আহাদ উচ্চারণ করল, ‘আজ থেকে তুমি আমার কাছে প্রীতিলতা নামে পরিচিত হবে।’

মফস্সলের এক স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক বিপত্নীক মনমোহন রায়ের মেয়ে কেতকী রায় যখন বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের কলেজ লেভেলের নেতা আহাদ আহমেদ চৌধুরীর হাতটি ধরে গিয়ে দাঁড়ায় ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের দপ্তরে, বিবাহের কাজটি সহজে সম্পন্ন হয়নি। আহাদের পার্টির যে মুরব্বি গোছের উকিল তাদের সহায়তা দিচ্ছিলেন, তিনিই বিষয়টা বুঝিয়ে বললেন, হিন্দু মেয়ের সাথে মুসলমান ছেলের বিবাহে নামকাওয়াস্তে হলেও পাত্রীর ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। অবশ্য লিগ্যালি অন্য একটা উপায় আছে বটে, তার জন্য মহকুমায় নয়, যেতে হবে জেলা সদরের ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের আফিসে। ম্যাজিস্ট্রেটের দরবারে হাজির হয়ে অ্যাফিডেভিড দিয়ে বলতে হবে, তারা দুজনে এথিস্ট বা স্রষ্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী। কাজটি জটিল, দু-চার দিনে সম্পন্ন না–ও হতে পারে এবং এ প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনও হবে বেশ খানিকটা ক্যাশ টাকার। নিজেদের সামাজিকভবে এথিস্ট ঘোষণা করার মানসিক প্রস্তুতি কেতকী বা আহাদ কারোরই ছিল না, তদুপরি অন্তর থেকে দুজনের দ্রুত বিবাহিত হওয়ার তুমুল তাগিদ ছিল। তো কেতকী সালমা খাতুন নামে পরিচিত হয়ে বিবাহের বিষয়টা সমাপ্ত করতে নিমরাজি হয়। কিন্তু তার মুখ দেখে আহাদ বুঝতে পেরেছিল নামটি তার পছন্দ হয়নি। তো সে একান্তে ডেকে নিয়ে তাকে প্রীতিলতা নামকরণ করে, দপ্তরের কর্মতৎপর মানুষের উপস্থিতি উপেক্ষা করে, হাতটি মুঠো করে ধরে, চোখের দিকে নিবিড়ভাবে তাকিয়ে প্রকাশ করেছে এত দিন সামাজিকভাবে অবদমিত অনুরাগ। ঠিক সে মুহূর্তে কেতকীও অনুভব করেছে, সাপের খোলসের মতো পুরোনো দিনকালকে পেছন ফেলে সে যেন রূপান্তরিত হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন এক রূপে এবং নতুন একটি নাম, যাতে জড়িয়ে আছে অসামান্য এক বিপ্লবীর স্মৃতি, গ্রহণ করতে তার কোনো আপত্তি থাকেনি।

বেডরুম থেকে পাভেলের জেগে ওঠার আওয়াজ পাওয়া যায়। পাশের কামরায় ছুটে গিয়ে প্রীতি দেখতে পায়, চোখ বড় বড় করে তার শিশুসন্তান ছাদ থেকে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া প্লাস্টিকের রংচঙে খেলনাটি দেখছে। তাকে বুকের দুধ দিতে দিতে ক্রমাগত কাশির আওয়াজ শুনে বুঝতে পারে, জেগে উঠেছে মহরমের মা, কাজের বুয়াটিও এসে গেছে আর বুড়ির সাথে ঠাট্টা করা আমিনার চাপা খিলখিলানো আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে।

তেমন একটা বেলা হয়নি, তাই পাভেলকে আমেনার হাতে তুলে দিয়ে প্রীতি ফিরে যায় পড়ালেখার টেবিলে। ভাবে, তার জীবনে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি লিখে ফেলবে কি না। বিয়ে নিবন্ধনের ব্যাপারটা চুকে যাওয়ার পর সাময়িকভাবে তারা গিয়ে ওঠে, তাদের সংগঠনের সক্রিয় এক কর্মীর ভাড়াটে বদলি হয়ে যাওয়ার ফলে সপ্তাখানেকের জন্য খালি পড়ে থাকা বাসায়। বাসর বলে তেমন কিছু তাদের হয়নি, দুজনে তার প্রয়োজনও বোধ করেনি। তবে সন্ধ্যার দিকে রিকশা চেপে গিয়েছিল কুসুমবাগ সিনেমা হলে। জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ফিল্মটি দেখে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। তারপর টিফিন ক্যারিয়ারে করে রেস্টুরেন্ট থেকে ভাত-তরকারি-ডাল কিনে ফিরেছিল খালি বাসাটিতে।

পরের পুরো দিনই তাদের কাটে—বলা চলে নিরুদ্বিগ্ন। তবে বিকেলবেলা সংগঠনের অফিসে সম্ভাব্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া দিয়ে চেনা রেস্তোরাঁয় চা-টা খেয়ে বাসায় ফেরার পরপরই গ্রেপ্তার হয় আহাদ, রাজনৈতিক কারণে নয়, নারী অপহরণের অভিযোগে। প্রীতিলতাকেও থানা অব্দি নিয়ে যাওয়া হয়, তবে তাকে জেলহাজতে না পাঠিয়ে হিন্দু এক সম্পন্ন ব্যবসায়ীর বাসায় নিয়ে গিয়ে পুলিশ তার পরিবারের জিম্মায় রেখে আসে। পরদিন সংগঠনের কর্মীরা জেলহাজতের সামনে বিক্ষোভ করে, আদালতে ছোটাছুটি করেও বিয়েতে সহায়তা দেওয়া সহানুভূশীল উকিল জামিন পেতে ব্যর্থ হন। বিকেলে বাবা তাকে ঘরে ফিরিয়ে নিতে আসলে, সে বুঝতে পারে, মনমোহন রায় মামলা করে আহাদকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। প্রীতি বাবার মুখ না দেখার প্রতিজ্ঞা করে দুয়ারে খিল দেয়। পরদিন তাকে আদালতে হাজির হয়ে বিবাহে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে সম্মতি দিয়েছে বলে লিখিত স্টেটমেন্ট দিলে, মাজিস্ট্রেট আহাদকে তৎক্ষণাৎ বেকসুর খালাসের হুকুম দেন।

পুরো দিনই তাদের কাটে—বলা চলে নিরুদ্বিগ্ন। তবে বিকেলবেলা সংগঠনের অফিসে সম্ভাব্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া দিয়ে চেনা রেস্তোরাঁয় চা-টা খেয়ে বাসায় ফেরার পরপরই গ্রেপ্তার হয় আহাদ, রাজনৈতিক কারণে নয়, নারী অপহরণের অভিযোগে।

ডায়েরি লিখতে গিয়ে বাবা মনমোহন রায়ের কথা খুব করে মনে ফিরে আসে। ইংরেজির শিক্ষক তার পিতা নিজেকে বামপন্থার প্রগতিশীল মানুষ বলে পরিচয় দিতেন। বালিকা বয়সে তাদের বাসায়, সে জমানায় নিষিদ্ধ হওয়া কমিউনিস্ট পার্টির কোনো কোনো নেতা-কর্মীর আনাগোনাও ছিল। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান–ভারত যুদ্ধের পর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল রবীন্দ্রসংগীত, তখন তাদের বাসায় কখনো কলের গানের রেকর্ডে কবিগুরুর গান শুনতে, কখনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠনের মহড়া দিতে প্রগতিশীল ঘরানার তরুণেরাও আসত। এ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় আহাদও আসতে শুরু করেছিল এবং বাবার সাক্ষাতেই তার হাতে তুলে দিয়েছিল ‘ছোটদের রাজনীতি’ শিরোনামের পুস্তকটি। তারপর যখন তাকে ‘ভল্গা থেকে গঙ্গা’ বইটি উপহার দিল, তত দিনে উনসত্তরের গণ–আন্দোলনে উত্তাল হতে শুরু করেছে স্বদেশ; আর তাদের মধ্যে বইপুস্তক মারফত বিনিময় হওয়া চিরকুট রূপান্তরিত হয়েছে ভালোলাগার বিবৃতিতে ভরপুর পুরোদস্তুর পত্রালাপে।

আহাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার আগে, ভালোবাসা সম্পর্কে সে যে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ছিল, তা নয়। প্রতিবেশী ঘোষ পরিবারের ছেলে, তার চেয়ে বয়সে বছর তিনেকের বড় প্রভাসের সঙ্গে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে গোপনে গড়ে উঠেছিল একধরনের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। স্কুলের পড়াশোনায় প্রভাসের মন ছিল না, তবে কণ্ঠস্বরটি ছিল চমৎকার, ভারি সুন্দর করে রবীন্দ্রসংগীত গাইত সে, তার কণ্ঠে ‘যে ছিল আমার স্বপ্নচারিণী’ কিংবা ‘আজি গোধূলিগগনে ওই’ প্রভৃতির লিরিকের শ্রুতিসুধা, শ্রবণের অনেকক্ষণ পরও মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনির রেশে মতো লেগে থাকত তার হৃদয়মনে। স্কুলে যাওয়ার পথে প্রভাস সাইকেলে অনুসরণ করত তাকে। তারপর শহরের একটি-দুটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—যেখানে কেতকী মূলত সুকান্ত কিংবা নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করত, সে সব জায়গায় দেখা হয়ে যেত তাদের। সুযোগ পেলেই মাঝেমধ্যে হাতটাতও ধরত প্রভাস। খ্যাপা প্রকৃতির ছেলেটিকে সে ভালোবাসত, তাই ওসবে প্রথম প্রথম কিছু মনে করেনি, তারপর যখন সে আরও নিবিড়ভাবে শারীরিক অন্তরঙ্গতায় লিপ্ত হতে চাইল, প্রভাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে সে মানিয়ে নিতে পারেনি, তাই ক্রমশ দূরে সরে আসতে শুরু করে কেতকী।

ব্যথিত হয় কেতকী, কিন্তু তত দিনে সে বামধারায় সংগঠিত স্টাডি সার্কেলের সদস্য হয়েছে, জানতে পারছে হরেক দেশে সফল সমাজবিপ্লবের বিষয়-বৃত্তান্ত, গ্রন্থপাঠের ভেতর দিয়ে তার সামনে খুলে যাচ্ছে ভিন্ন এক পৃথিবী।

তার ক্রমাগত অবহেলা প্রভাসকে করে তুলে আরও খ্যাপাটে। কোথাও কোনো কারণে দেখাসাক্ষাৎ হলে, তাকে কিছু না বলে সে কেতকীর ছাত্রসংগঠনের ছেলেদের সঙ্গে খামোকা ঝগড়াঝাঁটি এবং মাঝেমধ্যে মারপিটেও জড়াতে শুরু করে। কোনো কোনো দিন পাট্টা থেকে বেহেড হয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কেতকীর কবিতা আবৃত্তির সময় চেঁচামেচি করে গোলযোগও বাধায়। স্কুলে যাওয়া আগেই ছেড়েছিল, এবার প্রভাস পুরোপুরি বখে যাওয়ার পথে পা বাড়ায়।

ব্যথিত হয় কেতকী, কিন্তু তত দিনে সে বামধারায় সংগঠিত স্টাডি সার্কেলের সদস্য হয়েছে, জানতে পারছে হরেক দেশে সফল সমাজবিপ্লবের বিষয়-বৃত্তান্ত, গ্রন্থপাঠের ভেতর দিয়ে তার সামনে খুলে যাচ্ছে ভিন্ন এক পৃথিবী, যেখানে তুমুল সংগ্রাম ও নিরঙ্কুশ আত্মত্যাগের মাধ্যমে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব। মাঝেমধ্যে তাদের বাসায়ও বৈঠক হচ্ছে স্টাডি সার্কেলের, মহকুমা শহরের ছাত্রনেতা কান্তিমান তরুণ আহাদও আসছে আলোচক হিসেবে। একবার সে অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দারের আত্মাহুতির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করে কেতকীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল, অগ্নিযুগের আত্মত্যাগী এ নারীর জীবনীগ্রন্থ। পুস্তকটি নিতে গিয়ে করতলের ছোঁয়াছুঁয়িতে তার মধ্যে ছড়িয়েছিল রোমাঞ্চকর বিদ্যুৎ। ধরিত্রীর আকর্ষণে কক্ষপথে আটকে পড়া চন্দ্রিমার মতো কেতকী ঘুরপাক খেতে শুরু করেছিল সমাজসচেতন রাজনৈতিক বলয়ের ঘূর্ণাবর্তে। তারপরও মাঝেমধ্যে নিশিরাতে দখিনের জানালাটা খুলে দিলে, হাওয়ায় ভেসে আসত প্রতিবেশীর আঙিনার ফুটে ওঠা কাঁঠালিচাঁপার তীব্র গন্ধ, অনামনা হতো কেতকী, আর সে যে জেগে আছে তা যেন আপনা–আপনি জেনে যেত প্রভাস, তখন আর উৎপাত কিছু করত না, তবে চাপা স্বরে গেয়ে উঠত, ‘তোমায় গান শোনাব, তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখো’—কষ্ট হতো খুব কেতকীর।

মহরমের মা নাশতা খাওয়ার জন্য তাড়া দেয়, কিন্তু খাদ্যের কণাটুকুও মুখে তুলতে পারে না সে। চোখ মোছে পাভেলকে নিয়ে এসে বারান্দায় বসে। আহাদের ওপর তার অবদমিত ক্ষোভ যেন কান্না হয়ে উথলে উঠছে। প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা ঘটল খুব দ্রুত। তখনই সচেতন হয় যে মহকুমা শহরে বাসা নিয়ে তাকে রাখার মতো টাকাপয়সা জোগাড় করতে আহাদ হিমশিম খাচ্ছে, আর পার্টি থেকে চাপ ছিল নিজ গ্রামের দিকে সংগঠনকে জোরদার করে তোলার। তো সে প্রীতিকে নিয়ে গ্রামে ফিরে, কিন্তু পরিবার তাদের বিয়েকে সামাজিকভাবে মেনে না নিলে, তাকে নিয়ে ওঠে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে। বাজারের পেছন দিকে পড়েছিল তার পরিবারের সম্পত্তি—একটি বাসা, ভাড়াটে পাওয়া যাচ্ছিল না, অতঃপর ফার্নিচারাদি জোগাড় করে ওখানেই প্রীতিকে নিয়ে সাময়িকভাবে বসবাস করতে শুরু করে আহাদ কিন্তু সংসারে আগ্রহ ছিল না তেমন, মন দেওয়ারও তার উপায় ছিল না, সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকত সাংগঠনিক কাজে, হোন্ডাটি চালিয়ে ছুটত গ্রামেগঞ্জে। রাতবিরাতে সহকর্মীদের নিয়ে ঘরে ফিরে, বসার কামরায় হয় বৈঠক করত, নয় শুনত পরপর আকাশবাণী, বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ।

বইপুস্তক ও পত্রিকার কাটিংয়ের বান্ডিলগুলো সাইকেলের ক্যারিয়ারে তুলতে তুলতে বারবার নিশ্চিত হতে চায়, পশ্চিম বাংলার হিন্দু লেখকদের লেখা কোনো বইপত্র যেন এ বাসায় কোনো কানাচে পড়ে না থাকে।

পাভেলের জন্মের সময়ও আহাদ ছিল অনুপস্থিত। ধাইয়ের কাজ করে অভ্যস্ত মহরমের মা-ই সামাল দিয়েছিল পরিস্থিতির। প্রীতি চেয়েছিল দুজনে নিরলে বসে কথাবার্তা বলে নির্বাচন করবে নবজাতকের নাম, কিন্তু সময় হলো না আহাদের। তারপর সে যখন ম্যাক্সিম গোর্কির উপন্যাস ‘মা’-এর চরিত্র পাভেল থেকে নামটি গ্রহণ করল, আহাদ তাতেও নির্লিপ্তি বজায় রেখে সম্মেলনের অজুহাতে সংসার থেকে দূরে সরে গেল সপ্তাদিনের জন্য। ফিরে এসেও আত্মজ নিয়ে দেখাল না তেমন কোনো আবেগ-নিবিড় আগ্রহ। এসব আচরণে তার সঙ্গে সংসার বাঁধা নিয়ে প্রীতির মনে দেখা দেয় একাধিক প্রশ্নের। প্রশ্নগুলো তাকে পীড়িত করতে শুরু করে অহরহ।

সমাজবিপ্লবের সংগ্রামী সহকর্মী হিসেবে আহাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে রাজনৈতিক তৎপরতায় শরিক হওয়ার যে স্বপ্ন সে দেখেছিল, তার সাথে বর্তমান জীবনের কোনো মিল ছিল না, আর গৃহবধূ হিসেবে আহাদের বন্ধুবান্ধবদের দিনের পর দিন কাঁড়ি কাঁড়ি চা জোগানোতেও সে ছিল অনাগ্রহী। সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়, রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ব্যাপারটা। প্রথম দিকে এ বাসাতে একটি তিন ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও ছিল। সংবাদটুকু অন্তত প্রীতির কানে আসত। মার্চ মাসের প্রথম থেকে যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে শুরু করল, আহাদ রেডিওটা নিয়ে গেল বাজারে, ওখানে সহকর্মী পরিবৃত হয়ে সে ইদানীং খবর শোনে। তার মুখ থেকে শুনেছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বলে একটি রেডিও স্টেশন চালু হওয়ার কথা, আম্রকাননে স্বাধীন দেশের একটি সরকারও গঠিত হয়েছে। এমনকি, কোথাও কোথাও ছাত্র–জনতা–সিপাহি মিলে সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে সংগঠিত করছে মুক্তিযুদ্ধ, প্রীতি শুধু হতাশ হয় না, বিক্ষোভে ফেটে পড়তে ইচ্ছা হয়, ঠিক বুঝতে পারে না, কোন অপরাধে সে বঞ্চিত হচ্ছে এসব কর্মকাণ্ড থেকে?

সাইকেল চালিয়ে আসে সংগঠনের ছেলে আফজাল। তাকে দারুণভাবে শঙ্কিত দেখায়। বইপুস্তক ও পত্রিকার কাটিংয়ের বান্ডিলগুলো সাইকেলের ক্যারিয়ারে তুলতে তুলতে বারবার নিশ্চিত হতে চায়, পশ্চিম বাংলার হিন্দু লেখকদের লেখা কোনো বইপত্র যেন এ বাসায় কোনো কানাচে পড়ে না থাকে। প্রীতি জানতে চায় আহাদের কথা, সাইকেলে উঠতে উঠতে সে স্বীকার করে যে তার কাছে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই আর আহাদ যদি আহত না–ও হয়ে থাকে, তাহলেও সে এদিকে ফিরে আসতে পারবে না। কারণ, সে যে মুসলিম লীগার ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের সেভেনসিটার গাড়িটি ঝাড়ি দিয়ে নিয়ে গেছে রণাঙ্গনে, সেই লোকই তার চাচা মোফাদ চৌধুরীর যোগসাজশে সংগঠিত করেছে শান্তি বাহিনী, ফিরলে বিপদ অবধারিত। বিস্ফোরণের আওয়াজের সাথে বাঁশবনের ওপর দিয়ে দেখা যায় ঝলসে ওঠা আগুনের শিখা। ওদিকে তাকিয়ে প্যাডেল মারতে মারতে আফজাল ঘাড় ফিরিয়ে বলে, ‘খান সেনারা মনে হয় হিন্দুপাড়ায় আগুন দিল।’

উঠান থেকে ঘরে উঠে গেল রাতে গুছিয়ে রাখা ছোট্ট একটি স্যুটকেস ও শোল্ডার ব্যাগ প্রভৃতি ফের সে চেক করে, যদিবা বাড়ি ছেড়ে যেতে হয় সীমান্তের দিকে। কিন্তু পাভেলকে নিয়ে একা যাবেই–বা কীভাবে, হাতে টাকাপয়সা বলতে আছে আসে মাত্র ছয় টাকা কয়েক আনার মতো। মাইকের আওয়াজ ভেসে আসে, শান্তি কমিটির তরফ থেকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, ‘নারায়ে তকবির—পাকিস্তানে জানি দুশমনরা—হুঁশিয়ার সাবধান। হিন্দু্স্তানের রেডিও হুনিলে, নিষিদ্ধ বইপত্র পড়িলে, ফুস্কৃতিকারিদের মদদ দিলে, উল্টাপাল্টা ঝান্ডা উড়াইলে, দুশমনরা হুঁশিয়ার, মেরুদণ্ড দেওয়া অইবে—থুক্কু—মীড়তুদণ্ড দেওয়া অইবে, কেহই বাঁচিবেন না, মীড়তুদণ্ড দেওয়া অইবে, হিন্দুস্থানে চর ফুস্কৃতিকারিদের থাকি সক্কলে সাবধান থাকিবে, জানে বাঁচিবে না, মীড়তুদণ্ড দেওয়া অইবে। হিন্দুস্থানের দিকে ভাগিবে না, কেহই ভাগিবে না, অদ্য শান্তি পতিষ্টিত অইয়াছে। পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ।’

মহরমের মা এসে তাকে স্নেহের স্বরে বলে, ‘হুনছো বৌবেটি, মাইকোর কথা হুনছো, বড় বিপদ, এখনো সময় আছে, আমি পথ দেখাই দেই তুমি বাসা ছাড়ো, ইন্ডিয়ার দিকে যাও। পাভেলকে আমার জিম্মায় রাইখা যাও,’ তারপর কানের কাছে মুখে এনে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘তুমি বুঝতে পারছো না, মাইয়ামাইনষর ওপরে বড় গজব নাজিল অইছে, ঘর থাইকা জলদি বারোও।’ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না প্রীতিলতা, পাভেলকে বুকে জড়িয়ে তব্দিল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে।

সাইকেলের ক্রিংক্রিং করে চেনা শব্দে তার পাঁজরের ভেতর কী যেন চমক দিয়ে ওঠে! ঝোড়োকাকের মতো চেহারাসুরত নিয়ে এলোমেলো পদক্ষেপে ঘরে উঠে আসে প্রভাস। দ্রুত কথা বলে সে, ‘ঘর থাইকা বাইর হো কেতকী, দাঁড়াইয়া থাইকলে আর জানে বাঁচবি না, ঘরে ঘরে আগুন লাগাইতাছে মিলিটারি, মেয়েদের ধর্ষণ করতাছে, দুধের বাচ্চাদেরও বেয়নেট দিয়া খুঁচইয়া খুঁচাইয়া মারতাছে।’ শুনে সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে প্রীতি। প্রভাস অনুনয় করে বলে, ‘জীবনে একবার অন্তত তোর প্রবাসদারে বিশ্বাস কর, আর পারলে আমারে জলদি কিছু খাইবার দে। বত্রিশ মাইলের পথ সাইকেল চালাইয়া আইছি, এখনই বারোন লাগবো যে।’

তুই না বলতি, বড় হইয়া বৈদেশের নানা জায়গায় বেড়াইতে যাইবি। তোর বৈদেশ যাওনের পয়লা শহর অইবো কইলকাত্তা, বিদ্রোহী কবির বাসাত গিয়া নিজের আতে তাঁরে ফুল দিবি, শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলা দেইখতে যাইবি।

মহরমের মা প্রভাসকে এনে দেয় নাশতার বাসি দুখানা রুটি ও সবজি। খেতে খেতে কথা বলছে প্রভাস, তার মুখ থেকে চারদিকে ছিটকে পড়ছে খাদ্যের টুকরা-টাকরা। শেষরাতের অন্ধকারে, টর্চের আলোয় গ্রামের ভেতর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে এসেছে সে। দিনের বেলা তা–ও বিপজ্জনক হয়ে উঠলে, রেললাইন ধরে পরপর কয়েকটি পুল পাড়ি দিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে। গেল দেড় দিনে তার মুখে দানাপানি কিছু জোটেনি। আহাদের পাকা খবর এনেছে প্রভাস। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সংবাদটি সত্য, রক্তক্ষরণে কাহিল হয়ে পড়া আহাদের ক্ষতে সংক্রমণ দেখা দিলে, তার পার্টির ছেলেরা তাকে চাষবাসের পাওয়ার টিলারে শুইয়ে নিয়ে গেছে সীমান্তের দিকে। মনে হয় তাকে কৈলাশহরের কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাবে।

প্রীতিকে আশ্বস্ত করে সে বলে, ‘টাকাপয়সা নিয়া কোনো চিন্তা করিস না কেতকী। আমাগো দোকানঘরে আগুন দেওয়ার আগের রাইতে বাবা আমারে সিন্দুকের চবি দিয়া পাঠাইছিল। জমানো তহবিলের কিচ্ছু পুড়ে নাই। ওই টাকাটুকা লাইয়া মা-বাবা-দিদি-দাদা সব্বাই জিপ ভাড়া কইরা বর্ডার পাড়ি দিছে চাইর দিন আগে। আমারে ঘরদুয়ারের পাহারায় রাইখা সবাই ইন্ডিয়ায় গেছে। পাহারা কি দিমু? জ্বালাইপুড়াই বেবাক ছারখার কইরা দিছে।—তরে ওই পারে পার কইরা দিয়া আমার কাম শেষ আইবো। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিমু রে। সব জায়গায় যুদ্ধ অইতেছে, তেলিয়াপাড়ার দিকে মারত্মক লাড়াই লাগছে।’ বলে ফিচেল হেসে কোমরের পেটি থেকে খুলে প্রীতিকে দেখায় টাকার বান্ডিল, ‘বাবারে সবটা দেই নাই রে কেতকী, বুদ্ধি কইরা নিজর লাগিও থোড়া কিছু রাখছি, জলদি কর, বাইর অ, রাস্তায় রিকসা বেবিট্যাক্সি কিচ্ছু পাইলে ভাড়া করুম। তোরে কাইলাশরের আসপাতালে আহাদের পাশে রাইক্কা আমি মুক্তিফৌজে ঢুকুম।’

বাজার-সংলগ্ন এ বাসাটি থেকে সীমান্ত কাঁটায় কাঁটায় পাঁচ মাইল দূরে, এ দুর্যোগে রিক্সা-ফিক্সা পাওয়ার কোনো কুদরত নেই। তাই মহরমের মার দেখিয়ে দেওয়া বন্দকোনাকোনি পথে তারা পা বাড়ায়। কয়েক পা সামনে গিয়ে প্রীতি জানতে চায়, প্রভাস তার বাবার কোনো খবর জানে কি না? বুঝতে পারে, যে বাসাটিতে বেড়ে উঠেছে কেতকী, তা পুড়ে সম্পূর্ণ ছাই হয়ে গেছে। তবে মনমোহন বাবু অগ্নিকাণ্ডের তিন দিন আগে আকবরপুরের ট্যুরিস্ট লজে, যেখানে তার ছোট ভাই দেবানন্দ কর্মরত, সরে গিয়েছিলেন। প্রভাস শুনেছে যে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান থেকে ওই ট্যুরিস্ট লজ নিশানা করে ছোড়া হয়েছে রকেট, সব নাকি পুড়েটুড়ে গেছে। মনমোহন ও দেবানন্দবাবু প্রাণে বেঁচে ওপারে পাড়ি দিতে পেরেছেন কি না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কোনো তথ্য সে দিতে পারে না।

গ্রামের জংলার জায়গা নির্বিঘ্নে পাড়ি দিয়ে তারা এসে পড়ে আদিগন্ত ধানি জমিনের কাছে। পাওয়া যায় একটি রাজআইল, তার ওপর দিয়ে সাবধানে প্রভাস সাইকেল ঠেলে, হ্যান্ডেল ও ক্যারিয়ারে দড়ি দিয়ে বাঁধা কেতকীর শোল্ডার ব্যাগ ও স্যুটকেস। পেছন পেছন পাভেলকে পাঁজরে জড়িয়ে ধরে হাঁটে প্রীতিলতা। তার কাঁধঝোলাতে দুধদনি, অস্টারমিল্ক বলে গুঁড়া-দুধের টিন, কিছু খেলনা ও চামচ। চলাচলের তোড়ে ঝুমঝুমি থেকে আপনা–আপনি বেরোয় ঝুম-ঝুম ধ্বনি। হাঁটতে গিয়ে দূরে কোথাও গাড়ি চলাচলের আওয়াজে চমকে ওঠে প্রীতি, মনে হয়, হোন্ডাটি হাঁকিয়ে আহাদ ছুটে আসছে এদিকে। দাঁড়িয়ে পড়ে ফিরে তাকায় সে পেছন দিকে।

বিরক্ত হয় প্রভাস, ‘পেছনে তাকাস কেন কেতকী? পা চালা।’ ফের হাঁটতে গিয়ে কান্নার তোড়ে হেঁচকি তুলে সে, থেমে পড়ে প্রভাস নিবিড় করে তার দিকে তাকায়, ‘বলে, তুই না বলতি, বড় হইয়া বৈদেশের নানা জায়গায় বেড়াইতে যাইবি। তোর বৈদেশ যাওনের পয়লা শহর অইবো কইলকাত্তা, বিদ্রোহী কবির বাসাত গিয়া নিজের আতে তাঁরে ফুল দিবি, শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলা দেইখতে যাইবি। এখন তো অই দিকে যাইতাছিল, আবার কান্দোস কেন?’ চোখ মোছে কেতকী ওরফে প্রীতিলতা, পা চালায় সে ফের আন্তর্জাতিক সীমান্তের দিকে।