শেষ বিকেল কিংবা সন্ধ্যার দিকে কখনোই ঘরের ভেতর থাকে না সে। থাকলেই, সে দেখেছে, একধরনের দমবন্ধ অনুভূতি হয় তার। আর আষাঢ়ের দীর্ঘ বিকেলের পর সন্ধ্যাগুলোকে তার কাছে লাগে একই সঙ্গে ভয়াবহ করুণ আর অসম্ভব বিপজ্জনক। করুণ মানে ঠিক গরিব ধরনের না, টাকার অভাবে কষ্টে আছে এমন কেউ না, বরং প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর কারও হঠাৎ অসহায় হয়ে যাওয়ার মতন করুণ। স্কুলের সবচেয়ে কড়া অঙ্ক স্যারের বুড়ো হয়ে নরম হয়ে যাওয়ার মতন করুণ, খুব সাজুগুজু কোনো খালা বা ফুফুর বিয়ের পর রুক্ষ চুলে আর ত্যানা শাড়িতে রান্না করা আর ম্যানিকিওর না করা হাতে ভাত বেড়ে দেওয়ার মতন করুণ। আষাঢ়ের সন্ধ্যায় পাশে কেউ থাকলেও অযথাই মন খারাপ হয়ে যেতে হয়। আর একা থাকলে এই সময়টা হয়ে ওঠে বিপজ্জনক। ভেতর থেকে ধ্বংসের ডাক আসে। তার দুইবার সুইসাইড অ্যাটেম্পট করার রেকর্ড আছে। দুইবারই চেষ্টা করেছিল বর্ষার সময়। একবার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিতে গেছিল, আরেকবার হাতের ধমনি কাটার চেষ্টা করেছিল।
তার ধারণা, তার সেই প্যারাসুইসাইডগুলো কাজ না করলেও কোনো এক বর্ষাকালেই মারা যাবে সে। তার জন্মও হয়েছিল বৃষ্টির দিনে। মেজ মামা তার নাম রেখেছিলেন শ্রাবণী। পরবর্তী সময়ে এই তৎসম নাম টেকেনি, হয়ে গেছে শাওন। তার নিজের অবশ্য শ্রাবণী নামটাই বেশি পছন্দ। শাওন একটা ইউনিসেক্স নাম, ছেলেদেরও এই নাম হামেশাই হয়। এর চেয়ে শ্রাবণী শুনতে অনেক সুন্দর। যদিও জুলাইয়ের শেষ ১৫ দিনে বাংলাদেশে জন্মানো কয়েক লাখ মেয়ের নাম শ্রাবণী আর কলেজে তাদের ক্লাসের সবচেয়ে বিরক্তিকর মেয়েটির নামও ছিল শ্রাবণী, নাম হিসেবে শ্রাবণীই তার বেশি প্রিয়। কয়েকবার ভেবেছিল কলেজে উঠে সে নিজের নাম পাল্টে ফেলবে, সবাইকে বলবে তার ডাকনাম শ্রাবণী। কিন্তু কলেজেও স্কুলের দুই এক বান্ধবী ছিল একই ক্লাসে, তাই সেই পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়েছে। আজ আষাঢ়ের কত তারিখ সে জানে না, ইংরেজি তারিখের সঙ্গে হিসাব করে বের করা যায়, সাধারণত ইংরেজি ১৩ বা ১৪ তারিখে বাংলা মাস পড়ে। যেমন ১৪ ফেব্রুয়ারি পয়লা ফাল্গুন, ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ, সেই হিসাবে ১৪ জুন পয়লা আষাঢ় হলে আজকের ইংরেজি তারিখের হিসাবে আষাঢ় কত হয় গুনে বের করা যায় হয়তো। যদিও ইংরেজি লিপ ইয়ার কিংবা ২৮ দিন ৩১ দিন আর ৩০ দিনের মাসের পার্থক্য বাংলা ক্যালেন্ডারে কীভাবে মেলানো হয়, তা তার জানা নেই।
তারিখ যতই হোক, আকাশে আষাঢ় জাঁকিয়ে বসেছে। সন্ধ্যায় মন খারাপ লাগলেও বর্ষা তার পছন্দের ঋতু। বৃষ্টির পর গাছপালাগুলো চকচকে সবুজ হয়ে যায়, সুগন্ধি বেলিফুলের মালা নিয়ে বাচ্চারা ঘোরে ট্রাফিক সিগন্যালে। অথচ আশপাশে সে দেখে বৃষ্টি নামলেই সবাই মহাবিরক্ত, আরে বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি তো হবেই, না হলেই সেটা টেনশনের ব্যাপার। শহরের পথঘাটে পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই, ড্রেনেজ সিস্টেম খারাপ, এটা তো ওয়েদারের দোষ না। আজ দুপুরের দিকে সৌভাগ্যক্রমে জ্যাম কম থাকায় দ্রুত বাসায় চলে এসেছিল সে। ভাত খেয়ে ঘুম দেওয়ার অভ্যাস তার কোনোকালেই ছিল না। কিন্তু আজকে বিছানায় শুয়ে গান শুনতে শুনতে চোখ লেগে এসেছিল তার। দুপুরে ভাতঘুম তার একটিমাত্র কারণেই খুব অপছন্দ, ওঠার পর খুব গা ম্যাজম্যাজ করে। ফোনের আওয়াজে কাঁচা ঘুম ভেঙে তার আরও বেশি খারাপ লাগতে থাকে। ফোনে এসেছেও একটা দুঃসংবাদ। বাইরে তাকিয়ে সে দেখে অন্ধকার হয়ে এসেছে, ঘড়ি বলছে মাত্র ৫টা ২৩ কিন্তু মেঘ জমে আসাতে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে।
বিছানা ছেড়ে সে ঠিক করে বাইরে বের হবে। গুগলের ওয়েদার ফোরকাস্ট নির্ভুল হয় না অনেক সময়, তবু বর্ষাকালে বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখেই ঘর থেকে বের হয় শাওন। ফ্যান্সি ব্যালেরিনার বদলে কাদাপানি সহ্য করতে পারা বাটার চপ্পল পরে নেয়, ছাতা সঙ্গে নেয়, পাটভাঙা সুতির থ্রি পিসের বদলে জর্জেটের বা অন্য কোনো সিনথেটিক কাপড়ের সালোয়ার–কামিজ পরে নেয়, যেগুলো আয়রন করার বালাই নেই। বাংলাদেশের মানুষ আবহাওয়া অনুযায়ী কিছুই করে না। যে দেশে চার মাস ভারী বৃষ্টিপাত হয়, সেই দেশে ঘরবাড়ি বানানো হচ্ছে সানশেড ছাড়া, সামান্য বৃষ্টিতেই ঘরে বৃষ্টির ছাট এসে সব ভিজে যায়। থাই গ্লাস বলে এক উদ্ভট জিনিসের আমদানি হয়েছে, গরমকালে গ্রিনহাউসের মতো তাপ আটকে রাখে আর শীতকালে হয়ে থাকে ঠান্ডা, বর্ষাকালে আটকে না বেরোলে বাসায় ফিরে দেখতে হয় ঘর ভিজে গেছে। কোনো মানে হয়?
বের হওয়ার আগে সে রাহাতকে ফোন করে।
‘কোথায় তুই?’
‘বাসায়ই আছি, আর যাব কোথায়?’
রাহাত একটা আইএনজিওতে চাকরি করত, কিছুদিন আগে তার চাকরি চলে গেছে। থাকে তার বাসার তিনটা গলি পরে। মাসখানেক আগে বাজার করে ফেরার সময় দেখা হয়েছিল, তখনই এই সব তথ্য পেয়েছে সে।
‘দেখা করতে পারবি? একটু জরুরি।’
রাহাতের সঙ্গে তার একসময় বেশ সখ্য ছিল। প্রেম ঠিক না, তবে প্রায় প্রেমের মতনই। মানুষ হিসেবে রাহাত অত্যন্ত মানবিক, দরদি আর সংবেদনশীল। সম্পর্কটা এগোলে হয়তো ভালোই হতো। কিন্তু শাওনের মধ্যে সেই আবেগের উচ্ছ্বাস, ইংরেজিতে যাকে বলে ডিভাস্টেটিং প্যাশন, সেটা ছিল না। কিংবা সে হয়তো অপেক্ষা করছিল রাহাতই উপযাচক হয়ে তাকে বলবে, বাড়তি আগ্রহ দেখাবে আর রোমান্টিক অ্যাডভান্সমেন্টে যাবে। ওর দিক থেকে সেটা আসেনি বলেই হয়তো সে গুটিয়ে গেছে। তারপর জীবন–জীবিকা তাদের নিয়ে গেছে দুই পথে। দেখা–সাক্ষাৎ কম কম হওয়াতে যোগাযোগও ক্ষীণ হয়ে গেছে।
‘এখন? বাইরে তো মনে হয় বৃষ্টি।’
‘বৃষ্টি এখনো নামে নাই, আটটার আগে নামবেও না। একটু বের হ।’
‘ওকে, ছাতা আছে তোর সঙ্গে?’
‘অবশ্যই আছে, নিয়ে নিচ্ছি।’
‘আমার বাসায় কোনো ছাতা নাই, রেইনকোটও নাই।’
অন্য সময় হলে ছাতা কেন নেই, সে নিয়ে একটা ছোটখাটো লেকচার ঝেড়ে ফেলত সে। কিন্তু দুই মাস ধরে যার চাকরি নেই, তাকে ছাতা হারিয়ে ফেলবার পর আরেকটা না কেনার জন্য তিরস্কার করা যায় না। আর রাহাতের যা স্বভাব, কাউকে ধার দেওয়া ছাতা ও ফেরত চাইবে, এমনটাও আশা করা যায় না।
‘আচ্ছা, আমার বাসায় দুইটা আছে, আমি নিয়ে নিচ্ছি, তুই বের হ।’
২
নিজের জন্য ডাঁটি ভাঙা পুরোনো ছাতা আর রাহাতের জন্য সদ্য কেনা নতুন ছাতা একটা টোট ব্যাগে ভরে পায়ে ক্রকস গলিয়ে তড়িঘড়ি বের হয় সে। এক দফা ফোন ফেলে নেমে যায়, লিফট থামতে থামতেই মনে পড়ায় আবার উঠে ফোন নেয়, সঙ্গে চার্জারও। সেগুলো একটা প্লাস্টিকের জিপলকে আটকে নিয়ে টোট ব্যাগে রাখে। বাসার চাবি আর টাকার পার্স নেওয়া হয়েছে কি না, চেক করে। রাহাত সাধারণত সময় নষ্ট করে না, কাউকে বসিয়ে রেখে গদাইলস্করি চালে হেলতে–দুলতে আসা তার ধাতে নেই। এ–ও তার আরেকটা মস্ত গুণ। অনেক গুণই আছে ছেলেটার। যেমন কী প্রয়োজন, এক্ষুনি দেখা করতে হবে কেন, ফোনে বলা যায় না কেন এসব কিচ্ছুই সে জিজ্ঞেস করেনি। উল্টো শাওনের কাছে ছাতা আছে কি না, সেটা জানতে চেয়েছে। এমন বিষণ্ণ সন্ধ্যাগুলোতে একা লাগলে সে কখনো কখনো ভেবেছে রাহাতকে ফোন করবে। এক পাড়াতেই বাস, অথচ দেখা হয় ন–মাসে ছ–মাসে। সে কয়েক দফা ফোন করতে গিয়েও করেনি খানিকটা চাপা অভিমানে আর খানিকটা অস্বস্তিতে। রাহাতের এখন কাজবাজ নাই, এ রকম অবস্থায় মানুষ অকারণ দেখাসাক্ষাতে আগ্রহী হয় না, জাস্ট আড্ডাবাজি করতে ভালোও লাগে না। সে নিজে মাঝে দুই মাস বেকার ছিল, সে জানে।
হাঁটতে হাঁটতে রাহাতের বাসার গলির মুখে পৌঁছে যায় সে। কথাটা কীভাবে তুলবে বুঝে পায় না। ওর এখন চাকরিবাকরি নেই, হাতে সময় আছে, সে জন্য ওকে রিকোয়েস্ট করছে সে, এমন যদি ভাবে রাহাত, তাহলে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে। কিন্তু তার কাছে আর উপায়ও নেই। যে ব্যক্তিকে ধরতে হবে, সেই ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছাবার আর কোনো মাধ্যম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। মনে মনে কথা গোছাতে থাকে সে। রাহাতকে দেখা যায় একটা কালো টি–শার্ট আর খাকি রঙের হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট পরে আসছে। এটা একটু অবাক হওয়ার মতন ব্যাপার। বাসা থেকে ফুলপ্যান্ট না পরে বের হওয়ার লোক সে নয়। অবশ্য মানুষ তো বেঁচে থাকলে বদলায়, দিনে রাতে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়।
‘শাওন আসিলো ফিরে, সে ফিরে এল না’—সুর করে বলে রাহাত। এত টেনশনের মধ্যেও সে হেসে ফেলে, ভালো লাগার অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করতে পারে না যদিও। ‘বরষা ফুরায়ে গেল, আশা তবু গেল না…কিরে হঠাৎ জরুরি তলব?’
‘তলব কোথায় করলাম, দেখা করতে চাইলাম শুধু।’
‘চাইলি যে সেটাই আমার সৌভাগ্য। কোন দিকে যাবি?’
‘আশপাশেই কোথাও বসি’—রাহাতের ফ্লার্টমিশ্রিত কথার কোনো জবাব সে দেয় না। সব সময়ই তাদের সম্পর্কটা এমন ছিল, হালকা, সহজ। অনেকেই তাদের একসঙ্গে দেখে জুটি বলে ভাবত। এমনকি মৌটুসী আপুও ভেবেছিল। একবার বলেছিল, ‘প্রেম করতেছ নাকি রাহাতের সঙ্গে?’ সে মানা করাতে বলেছিল, ‘করলে ভালোই ছিল, তোমাদের দুজনকে মানায়।’ সে কোনো জবাব দেয়নি। এই মানানো না মানানোর ব্যাপারটা সে কখনো বুঝতেই পারে না। যেকোনো দুজন রিলেশনশিপে আছে ঘোষণা দিলেই আশপাশ থেকে সবাই বলে, ‘বেশ মানিয়েছে।’ দুজন মানুষ যখন প্রেমে থাকে, তাদের মনের আনন্দ মুখের অভিব্যক্তিতে বের হয়ে আসে, সেই সুখী সুখী চেহারা দেখতে ভালো লাগে আর ভদ্রতা করেও লোকে বলে ‘বড্ড মানিয়েছে’। আসলে কি আর মানায়? তাহলে তো মানানো দুজনের সম্পর্ক আর কখনোই ভাঙত না।
৩
রাহাতের বাসার গলি থেকে সামান্য ডানে যেতেই একটা লোকাল ক্যাফে আছে। বৃষ্টির দিন, হয়তো খালিই পাওয়া যাবে, এই ভেবে সেদিকে যেতে ধরে শাওন, রাহাত তাকে অনুসরণ করে। তার অনুমান সঠিক, ক্যাফের ভেতরটা সম্পূর্ণই খালি। কাউন্টারের ছেলেটা একা বসে ফোনে কী যেন করছিল, তাদের দেখেই উৎসাহী হয়ে টুল ছেড়ে দাঁড়ায়। দুইটা কফি অর্ডার করে কাউন্টার থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী টেবিলটাতে বসে তারা। আগের কাস্টমারের রেখে যাওয়া পেপার কাপের পাশে ছোট্ট একটা কাঠের অ্যাশট্রে, দেখে খুশি হয়ে যায় রাহাত ‘আরে এখানে বিড়ি খাওয়া যায়’ বলেই সে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে। ক্যামেল। বর্তমানে আর্থিক সংকট চলছে বলেই হয়তো ব্র্যান্ড পাল্টেছে। তার বাড়ির কাছে হলেও এখানে সে আগে কখনো আসেনি বোঝা গেল। শাওন নিজেও আসেনি কখনো। বাইরে থেকে দেখেছে দু–একবার। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা সম্ভবত বসে আড্ডা দেয় এখানে। হয়তো দোকানের মালিক নিজেও এলাকার ছেলেছোকরাদের কেউ হবে।
‘মৌটুসী আপুর কোনো খবর জানিস?’
ভণিতা না করে সরাসরি প্রসঙ্গে চলে যায় সে। রাহাত মাত্র প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরানোর চেষ্টা করছে, তার লাইটার কোনো কারণে কাজ করছে না, ভিজে গেছে হয়তো। কয়েকবারের চেষ্টায় সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে সে বলে, ‘জানি, খুব অসুস্থ।’
‘কোথায় আছে জানিস?’
‘হুম, তার শ্বশুরবাড়িতে।’
মৌটুসী আপুর শ্বশুরবাড়ি কোথায়, তা সঠিক জানে না সে। আগের হাজব্যান্ডের বাড়ি ছিল গাজীপুর, এইটুকু জানে। সেই স্বামীর সঙ্গে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর একা থাকার সময়ই সে শাওনের সঙ্গে বাসা নিয়েছিল। সাবেক স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে কোনো মন্দকথা সে কখনোই বলেনি। মানুষ হিসেবে মৌটুসী আপু খুবই সাদামাটা, সরল, খানিকটা মনে হয় বোকাও। অসম্ভব সুন্দরী সে, কিন্তু নিজের রূপ সম্পর্কে তার এতটুকুও সচেতনতা নেই। সাধারণ কোনো জোক শুনেও ঘর ফাটিয়ে হাসত। কিন্তু বাসার বাইরে অপরিচিত মানুষের সামনে চুপচাপ হয়ে যেত। দেখে অনেকেই তাকে অহংকারী বলে মনে করত। একবার তার এক বান্ধবী বলেছিল, ‘শাওন তোর ফ্ল্যাটমেট কি খুব দেমাগি নাকি? কথাই বলে না।’ সে বলেছিল, ‘আরে না, আপু একটু ইন্ট্রোভার্ট টাইপের।’ মৌটুসী পরপর কয়েকটা চাকরি পাল্টে বেশ সোশ্যাল হয়ে গেছিল, তার পরিচিতের পরিধিও বেড়েছিল অনেকটা। কিন্তু এখনকার অবস্থা প্রায় কেউই জানে না বলে মনে হলো। রাহাতের তথ্য সঠিক হলে সে এখন কোনো এক মফস্সল শহরে আছে। তার দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর বেশ কিছু ছবিটবি ফেসবুকে দেখা গিয়েছিল। খুব সম্ভবত ময়মনসিংহ শহরে সেই বাড়ি, কিংবা মুক্তাগাছাও হতে পারে। পুরোনো আমলের ভিন্টেজ লুকের একটা বাড়িতে শাড়ি পরে ছবি তুলেছিল। বারান্দায় অপরাজিতার ঝাড় থাকাতে ছবিতে বেশ একটা আলোআঁধারি খেলা করছিল। সেই বারান্দাতেই কি এখন শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে মৌটুসীকে?
‘আপুকে নাকি শিকল দিয়া বাইন্ধা রাখতে হয়?’
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে রাহাত বলে, ‘অত ডিটেলস জানি না, তবে অবস্থা বেশ খারাপ শুনছি।’
শাওন আহত হয়, ব্যথিত হয়। চাকরিবাকরি না থাকলে একজন মানুষের আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই বলে কাউকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার মতন অবিশ্বাস্য নির্মম ব্যাপারে কোনো হেলদোল থাকবে না?
‘কেন? উনি কি ভায়োলেন্ট হয়ে যান? লোকজনকে আক্রমণ করেন?’
‘না, মনে হয়। বাসা থাইকা বাইর হইয়া যান রাতবিরাতে। অপ্রকৃতস্থ তো, বিশ্বাস নাই কোনো।’
‘সে জন্য শিকল? বাড়াবাড়ি হইয়া গেল না ব্যাপারটা?’
‘সেটা তো আমি বা তুই ডিসাইড করার কেউ না। যে ওনারে টেইককেয়ার করতেছে, সে-ই ভালো বুঝবে।’
শাওন এমনিতে শান্ত স্বভাবের মানুষ, খামোখা উত্তেজিত হয় না। কিন্তু রাহাতের এহেন নিরাসক্তি দেখে, সে টের পায়, তার ভেতরে ক্রোধের সঞ্চার হচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এত এত কথাবার্তা হয় আজকাল। একজন মানুষ মেন্টালি আনস্টেবল হলেই তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা কোন পদের মধ্যযুগীয় আচরণ। একে টেইককেয়ার করা বলে?
‘যিনি টেইককেয়ার করতেছেন তিনি কি জানেন যে মানুষকে শিকল দিয়া বাইন্ধা রাখা মানবাধিকারের লঙ্ঘন?’
সে ভেবেছিল রাহাত খেপে যাবে। কিন্তু সেটা ঘটে না। রাহাত কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে, ‘দেখ শাওন, আমি মৌদিকে বহু বছর ধরে চিনি। তার প্রতি সিমপ্যাথি আমার কিছু কম নাই।’
‘হ্যাঁ, তা তো বটেই। তোদের তো জাবি কোরাম।’
শাওন কোনো ইউনিভার্সিটিতে পড়েনি। ইডেন থেকে পাস করে এমবিএ করতে চেয়েছিল, পরে আর সেটা হয়নি। স্কুলে পড়ানোর চাকরিটা নিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছে। রাহাতের মতন অনেক বন্ধুবান্ধব তার আছে, যারা জাহাঙ্গীরনগর কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছে। ভার্সিটির অ্যালামনাই হিসেবে একটা কমিউনিটির তারা অংশ। এদের মধ্যে জাবির লোকজনের মধ্যে আবার প্রেম–পিরিতি একটু বেশি। দেখা হলেই তারা একে অন্যের গলা জড়িয়ে ধরে। তো এখন সেই জাবির বড় বোনের এহেন মানবেতর দশা দেখেও এমন নির্লিপ্ত সে থাকছে কীভাবে, ভেবে শাওনের রাগ লাগে।
‘আমি ক্যাম্পাসের অনেকের কাছ থেকেই খোঁজখবর পাই। মৌদির অবস্থা এতই খারাপ যে কেউই তাকে দেখেশুনে রাখতে পারবে না। শফিক ভাই যেভাবে পারতেছেন সেভাবে রাখতেছেন।’
একটা মানুষ নিজের স্ত্রীকে আধুনিক চিকিৎসা না দিয়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগের নিয়মে বেঁধে রাখছেন আর রাহাতের মতন ছেলে সেটাকে জাস্টিফাই করছে—পুরো ব্যাপারটা সুররিয়াল মনে হয় শাওনের কাছে। অবশ্য মানুষ তো মরে গেলে পচে যায় আর বেঁচে থাকলে বদলায়। জগতের নিয়মই এই। সে আর কথা খুঁজে পায় না।
‘মৌদির কোনো ভাইবোন নেই, মা–বাবাও বেঁচে নেই। তার দায়িত্ব আর কে নেবে? তুই আমি কি নেব? অযথা এসব নিয়া উত্তেজিত হইয়া লাভ কী বল?’
‘তোদের জাবি কোরামের লোকজন সব কই? তোদের না কত্ত বড় কমিউনিটি? কেউ একজন কোনো বিপদে পড়লে একশজন ঝাঁপায়া পড়ে?’ কিছুটা শ্লেষের সঙ্গেই বলে শাওন। রাহাত হাসে।
‘কারও পারিবারিক সিদ্ধান্তে তো হস্তক্ষেপ করা যায় না। আর শফিক ভাই জাবির লোকও না।’
‘আমি তো শুনছি উনি কোনো ইউনিভার্সিটিতেই পড়েন নাই।’
‘ইউনিভার্সিটিতে পড়া দিয়া কি লোকের ভালোমন্দ বিচার করা যায়?’
শাওন মানে যে তা যায় না। সে নিজেও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনি। বহু পিএইচডি ডিগ্রিধারী লোকজন নানা ধরনের খারাপ কাজ করে। মানবিকতার সঙ্গে ডিগ্রির সম্পর্ক যে নেই, তা সে জানে। কিন্তু প্রসঙ্গটা মৌটুসী আপুর ব্যাপারে বলেই কথাটা মাথায় এসেছিল। ‘দুজনকে মানায়’…কাউকে কারও সঙ্গে মানায় কেন বা কিসের ভিত্তিতে? অমন একটা হাসিখুশি নরম স্বভাবের মেয়ে যে ভালো একটা ইউনিভার্সিটি থেকে লেখাপড়া শেষ করেছে, গান গাইতে জানে, জগতের খবরাখবর রাখে, ভালো ভালো অর্গানাইজেশনে চাকরি করেছে, সে কী দেখে একজন অল্পশিক্ষিত মানুষকে বিয়ে করে তার সংসার টানতে টানতে নিজেই মানসিক বৈকল্যে পড়ে মাঝপথে জীবন থামিয়ে দেবে? প্রেম? এটা কী ধরনের প্রেম? প্রেম এত বিধ্বংসী হবে কেন? এটা কি তাকে মানাল?
‘ওনাদের একটা বাচ্চাও আছে। মা অসুস্থ থাকলে বাচ্চার দেখভাল কে করবে? শফিক ভাইকে তো চাকরিটাও করতে হয়, হয় না?’
শাওন বুঝতে পারে এখানে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। মৌটুসীর যে দূরসম্পর্কের কাজিন তাকে ফোন করেছিল, শাওনের এক্স কলিগ, তার বয়ানের সঙ্গে রাহাতের বয়ান মোটেও মিলছে না। বরং ৩৬০ ডিগ্রি বিপরীত বলে মনে হচ্ছে।
‘উনি ঢাকাতে থাইকা চাকরি কইরা উইকেন্ডে বাড়ি গিয়া এই পাগল সামলায়া কেমনে চলতেছেন, সেটা উনিই বুঝতেছেন।’
শাওনের কানে খট করে লাগে শব্দটা, ‘পাগল’ মানে কী? মানসিকভাবে আনস্টেবল থাকলেই একজন মানুষকে ‘পাগল’ বলে দেওয়া যায়? শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা যায়? রাহাতের কাছ থেকে এমন অসংবেদনশীল মন্তব্য সে মোটেও আশা করেনি।
‘তোর শফিক ভাই বেশ সৌভাগ্যবান বলতে হবে। লোকে প্রায়ই বলে অমুক তমুকের জন্য পাগল হয়ে গেছে। মৌটুসী আপু আসলেই হয়ে দেখাইল।’
শাওনের কণ্ঠের শ্লেষ টের পেয়েই কিনা, রাহাত সামান্য অধৈর্য হয়, ‘শাওন, আমি মৌদিকে চিনি আজকে পনেরো বছর হয়। সে সব সময় একটু ডেলুলু ছিল। যার সঙ্গে প্রেম করে তার জন্য অন্ধ হয়ে যায়, এটা তার ক্যারেক্টারিস্টিক ফিচার। আগে বিয়ে করেছিল যাকে, সেই ভাইও আমাদের ক্যাম্পাসের। বাপ–মায়ের সম্পত্তি যেটুকু পাইছিল সব সেই আগের স্বামীর নামে লিখে দিছিল সে। এখন তার নিজের বলতে কিছুই নেই। শফিক ভাইয়ের দয়াতেই তাকে বেঁচে থাকতে হবে।’
আরেকবার তথ্যবিভ্রাট। শাওনের কলিগ মৌটুসীর কাজিন জানিয়েছে বাবার বাড়ির সম্পত্তি, মায়ের গয়না আর নিজের গ্র্যাচুইটি প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা শফিককেই দিয়েছে মৌটুসী। শফিক নিজেই অফিসে এসে জমা টাকা তুলে নিয়ে গেছে মৌটুসীর অসুস্থতার কথা বলে। নমিনি সে-ই ছিল।
শাওনকে চুপ করে থাকতে দেখে আরও ব্যাখ্যা করতে উদ্যত হয় রাহাত, ‘শফিক ভাই যা করতেছেন, তা এই জমানার কোনো পোলা করবে না কারও জন্য, বউ সামান্য অসুস্থ হইলেই ছাইড়া দেয় লোকজন।’
‘হুম, আর মৌটুসী আপু তো নিম্ফোম্যানিয়াক, কন্সট্রাকশন লেবারারদের সঙ্গেও নাকি ফস্টিনস্টি করে।’
‘এগুলা তোরে কে বলছে? আমি তো এসব শুনি নাই’—রাহাত এবার বিরক্ত হয়।
‘শফিক ভাই নিশ্চয়ই সুপারম্যান,’ এবার ‘তোর’ শব্দটা বাদ দেয় সে ইচ্ছা করেই, ‘পাগল বউ সামলে চাকরিই করতে পারার কথা না, আবার ময়মনসিংহের বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়িও বানাইতেছেন।’
‘আরে ওইটা ওনার ফ্যামিলি প্রপার্টি, সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিছে ডিভেলপ করার। এক্সট্রা প্যারা ওনার জন্য।’
শাওন অতিরিক্ত চিনি দেওয়া মেশিনের কফিতে একটা চুমুক দিয়েই রেখে দিয়েছিল, এবার প্রায় ঠান্ডা হয়ে যাওয়া অবশিষ্ট কফি এক চুমুকে শেষ করে বলে, ‘উঠি তাহলে, জোরে বৃষ্টি নামবে মনে হয়।’
‘চল উঠি। আচ্ছা, পরশু দিন তুই ফ্রি আছিস?’
পরশু দিন পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে না সে এখন, আজকের দিনের চরম পরাজয় নিয়েই বিমর্ষ সে।
‘ক্যান? পরশু দিন কী বার পড়ে?’
‘শুক্রবার, তোর ছুটি থাকার কথা।’
‘শুক্র শনি হইলে ফ্রি আছি, কী বিষয়?’
‘তোর জন্মদিন না? লাঞ্চ করা আমাকে।’
রাহাতের মনে আছে তার জন্মদিন, সেলিব্রেট করতেও ইচ্ছুক বোঝা গেল। অন্য সময় হলে সে খুশি হয়ে যেত। মনে মনে কী রঙের শাড়ি পরবে, ঠিক করতে থাকত আর মুখে বলে ফেলত, ‘কী গিফট দিবি?’ কিন্তু আজকে নিজের জন্মদিন নিয়ে কোনো আগ্রহ বা উত্তেজনা অনুভব করতে পারছে না সে।
‘আচ্ছা, দেখা যাক। পরশু দিনের দেরি আছে।’
এই উদাসীনতাকে নেতিবাচক ধরে নিয়ে রাহাত পিছিয়ে যেতে পারে, তবু কোনো উচ্ছ্বাস দেখাতে পারল না শাওন। তার মনে হচ্ছে ঠিক এই সময়ে মৌটুসী আপু কী করছে? ময়মনসিংহেও কি এমন আকাশ কালো করে মেঘ জমে এসেছে? সে কি বন্ধ ঘরের জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখে ছাদে উঠে ভিজতে না পারার অক্ষমতায় চিৎকার করছে আর পাড়া–প্রতিবেশী মহিলারা বলাবলি করছে শফিকের পাগলি বউ চিল্লায়? ছয় মাস এক বাসায় ছিল তারা। মৌটুসী প্রায়ই বলত, ‘বৃষ্টি হইতো আমাদের ক্যাম্পাসে, বুঝলা। সারা দিন বৃষ্টি কিন্তু কোথাও পানি জমত না, কাদা হইত না। আমরা সেন্ট্রাল মাঠে শুইয়া শুইয়া বৃষ্টিতে ভিজতাম, মুক্তমঞ্চে গিয়া নাচতাম। আর ঢাকা শহরের বৃষ্টি তো শহীদ কাদরীর সহসা সন্ত্রাস ছোঁয়া, শুরু হইলেই মনে হয় কী জানি একটা সর্বনাশ হইয়া গেছে, লোকজন মাথা খারাপ কইরা দৌড়াইতে থাকে।’
ক্যাম্পাস নিয়ে মৌটুসীর উচ্ছ্বাসের শেষ ছিল না। সেই কবে পাস করে বের হয়ে গেছে, তবু ক্যাম্পাসের ব্যাপারে অবসেসড। একদিন তাকে বলল, ‘শাওন এই গানটা শুইনা দেখো, আমাদের ক্যাম্পাসের এক ছেলের করা। কী যে সুন্দর। এই সায়েম জয় পোলাটা জিনিয়াস। আমি অবশ্য পারসোনালি চিনি না। কিন্তু জাবি বাডি বইলা কথা। আই’ম সো প্রাউড অব হিম।’
৪
বাসায় ফিরে ইউটিউব খুঁজে সে গান বের করে, ‘কী বিষণ্ণ, কী বিষণ্ণ, কী বিষণ্ণ লাগে, আষাঢ় সন্ধ্যাবেলায়/ বয়ে যাওয়া ক্ষয়ে যাওয়া একা একা একা মেঘ, আষাঢ় সন্ধ্যাবেলায়।’
আহা মৌটুসী, ডেলুলু একটা। ক্যাম্পাস ক্যাম্পাস বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে সারা জীবন, এখন তার ক্যাম্পাসের ভাই–বেরাদাররাই কেউ তার খোঁজ রাখে না, খবর পেলেও পাত্তা দেয় না। কোনো এক মফস্সল শহরের পুরাতন বাড়িতে সে ঘরবন্দী হয়ে বসে আছে। ম্যাড উইমেন ইন দ্য অ্যাটিক, জেন এয়ারের বার্থা হয়ে হয়তো জানলার শিক ধরে বাইরে চেয়ে আছে।
শেষ হওয়ার আগেই অফ করে দেয় সে গানটা। একটা রবীন্দ্রসংগীত শোনা যাক বরং...