মিঠা সফেদা

অলংকরণ: এসএম রাকিবুর রহমান

‘সফেদা ভাঙলে ডাবের মতো গন্ধ হয়।’

পাশের রিকশা থেকে রিনরিনে একটা গলা ভেসে এল। বাংলামোটরে জ্যামে বসে আছি। ভিআইপি সিগন্যাল। কপাল ভালো থাকলে বিশ মিনিট, খারাপ থাকলে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিট। আজ সকাল থেকেই আমার কপাল খারাপ যাচ্ছে। বিশ মিনিট জ্যামে আটকে থাকব স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি শুধু মনে করার চেষ্টা করছি, কোন ফলটা সফেদা, আতার মতো দেখতে যেটা? ওটা ভাঙলে কেমন গন্ধ আসে, মনে করতে পারছি না।

একটা কড়া পুরুষকণ্ঠ শুনে তাকালাম রিকশাটার দিকে। হুড তোলা। ছেলেটার পরনে নীল স্যুট–কোট, পায়ে হাশপাপ্পিজের জুতা, হাতের ঘড়িটা রোলেক্স ঠেকছে, কিন্তু আসল মনে হচ্ছে না। যারা আসল রোলেক্স পরে, তারা রিকশায় ঘোরে না। মেয়েটার বা ছেলেটার কারও মুখ দেখতে পাচ্ছি না। মেয়েটার চুল অনেক লম্বা। সাদা কাজ করা একটা জামা পরা। হাতে কতগুলো চুড়ি। খুব সাধারণ মনে হচ্ছে। কিন্তু গলাটা এত সুন্দর! এই হুটোপাটা শীতে মেয়েটার গায়ে কোনো সোয়েটার নেই। ছেলেটা তাকে খুব বকল রাস্তায় সফেদা খুলে খাওয়ার জন্য। আমি ফলটার একটু অংশ দেখতে পেলাম, তবু মনে করতে পারলাম না। মেয়েটা গুনগুন করে কী সব যেন বলছিল। ছেলেটা খুব রেগে গিয়ে হুড ফেলে দিল। এবার দুজনকেই দেখতে পেলাম। এত কেতাদুরস্ত ছেলের এত সাদামাটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম? ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, স্পাইক করা চুল, জেল চিকচিক করছে দাড়িতেও। মেয়েটার চোখে কাজলও নেই। শুধু কপালে একটা টিপ। সব সৌন্দর্য ওর চুল কেড়ে নিয়েছে। আমি মেয়েটার চুলের দিকে তাকিয়ে আছি। বিষয়টা খুবই বাজে হচ্ছে টের পেতেই চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

চোখের সামনে দিয়ে সাতবার মেট্রোরেল চলে গেল। কিন্তু রাস্তায় একটা সিগন্যালও ছাড়ল না। আমার সিগারেটের নেশা চাগিয়ে উঠেছে। বড় খালার বাসায় যাচ্ছি। খালা অসুস্থ। মৃত্যুশয্যায়। তাকে দেখতে যেতে হবে। খালা আমার দুধমা ছিলেন—এ দোহাই দিয়ে খালাবাড়ির প্রচুর ইমোশনাল ইভেন্টে আমাকে হাজিরা দেওয়ানো হয় জোর করে। আম্মা বারবার কসম কাটিয়েছেন, আমি যেন খালার বাড়িতে যাওয়ার পথে বিড়ি না খাই। আম্মাকে বহুবার বলেছি, ওটা বিড়ি নয়, সিগারেট। তবে আম্মার দাবি, সবই এক, খাইলে ফসফস ধোঁয়াই বের হয়। তাই চাইলেও সিগারেট ধরাতে পারব না। দুধছেলে হিসেবে আমার দায়িত্ব অনেক।

মেয়েটা এবার খিলখিল করে হাসছে। আড়চোখে দেখলাম, ছেলেটা গজগজ করছে। সফেদার খোসা কোথায় ফেলবে, তা নিয়ে রেগে আছে। মেয়েটা কী সব বায়োডাইভারসেবল, মিটিগেশনের আলাপ করছে। ছেলেটা এসবে কনভিন্সড নয়।

সফেদার খোসা কোথায় ফেলা হয়, দেখার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছি আমি। মেয়েটা ব্যাগ থেকে একটা টিস্যু বের করে খোসাগুলো তাতে মুড়ে ব্যাগে রেখে দিল। আমার আর ছেলের—দুজনের আগ্রহই পানি হয়ে গেল। মানুষের চিন্তাভাবনা এত সরল কেন! আমি ভাবছিলাম, সে পথে ফেলবে। মনে হচ্ছিল, ছেলেটা চাইছিলই যে খোসাগুলো পথে ফেলুক মেয়েটা। তাতে একটু বাড়তি গজগজ করা যাবে।

মেয়েটাকে কিছুটা আপার মতো লাগছে। এ রকম একটা সাদা জামা আপারও ছিল। বড় আপা আমাদের বাসায় একটা গল্পের নাম। অত ছোট থাকতে তো বুঝিনি, বড় হয়ে একটু একটু করে বুঝেছি। তখন বুঝলে হয়তো বড় আপা হারিয়ে যেত না।

মেয়েটার নাম কুহু। ছেলেটার ডাকে বুঝতে পারলাম। ‘মিটিগেশন’ শব্দটা মাথায় ঢুকে গেল। কিছুতেই এর অর্থ মনে পড়ছে না। মোবাইলে সার্চ দিলেই বের করে ফেলতে পারতাম। কিন্তু চার্জ আছে ছয় পার্সেন্ট। খালার বাসার নিচে গিয়ে দারোয়ান না থাকলে ফোন করে নবাবজাদাকে ডেকে আনতে হবে। কিন্তু আমার মিটিগেশনের অর্থটা খুব জানা দরকার। আর জানা দরকার সফেদা কোন ফলটা।

মেয়েটা আবার হাসছে। ছেলেটা কটমট করে তাকিয়ে আছে। আমার হুট করে বড় আপার কথা মনে পড়ে গেল। মেয়েটাকে কিছুটা আপার মতো লাগছে। এ রকম একটা সাদা জামা আপারও ছিল। বড় আপা আমাদের বাসায় একটা গল্পের নাম। অত ছোট থাকতে তো বুঝিনি, বড় হয়ে একটু একটু করে বুঝেছি। তখন বুঝলে হয়তো বড় আপা হারিয়ে যেত না। আম্মা কাঁদেন কি না জানি না, আমাকে দেখিয়ে কান্না করেন না—এটা নিশ্চিত। আর আব্বা তার আভিজাত্যের বাইরে গিয়ে কোনো ছাড় দেবেন না পণ করে এখন যে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন, তাতে কাঁদার খুব সুযোগ নেই।

বড় আপা প্রেম করেছিলেন আমাদের বুয়ার চাচাতো বোনের ছেলের সঙ্গে। আয়েশা বুয়ার তখন পড়তি অবস্থা। বাসাবাড়ির কাজ ছাড়া মানুষটা কোনো গতিক পায়নি। তখন আমি ফাইভে পড়ি, বৃত্তি পরীক্ষার জন্য তুমুল প্রস্তুতি নিচ্ছি। বড় আপা ম্যাট্রিক দিয়েছেন বলে মনে পড়ে। কারণ, আপার রেজাল্টের পর অনেক মিষ্টি আনা হয়েছিল। বুয়াকে একদিন বাসা পর্যন্ত দিতে এসেছিলেন ফারুক ভাই। মা ডেকে এনে বাসায় বসালেন, নাশতা খেতে দিলেন।

ফারুক ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তিনি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের হলেও তাদের পরিবারে কিছুটা শিক্ষাদীক্ষা ছিল। তারা বস্তিতে থাকতেন না, একটা টিনশেড বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। ফারুক ভাই ছাত্ররাজনীতি করতেন। আম্মা আমাকে পড়ানোর জন্য ফারুক ভাইকে নিযুক্ত করলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে প্রতিটি ঘটনা। প্রতিদিনই ভাবি, বড় আপা আমাদের ভুলে গেছেন, আমরাও ভুলে যাব। কিন্তু আপাকে আমি ভুলতে পারি না। সেই ইন্টারনেট–ফেসবুকহীন সময়ে হারিয়ে যাওয়া খুব সহজ ছিল।

মেয়েটা এবার বেশ জোরে কথা বলে উঠল, ‘আপনি এত জেরা করতেছেন কেন? আমি আমার পছন্দমতো কোনো কোর্স করতে পারব না?’

একদম বড় আপার গলা! ওদের আলাপে যেটা বুঝলাম, ছেলেটা মেয়েটাকে রান্নার একটা কোর্স করতে বলেছিল, মেয়েটা ছবি আঁকার কোর্স করেছে। তাতেই ছেলেটার হম্বিতম্বি প্রবল। আমারই মনে হচ্ছে, নেমে ওই ফ্রেঞ্চকাটকে একটা চটকনা দিই। আমার রিকশাওয়ালা হিসু করতে গিয়েছিল। ফিরে এসে জানাল, কোনো ভিআইপি যাচ্ছেন, তাই রাস্তা বন্ধ। ফেব্রুয়ারির এক তারিখ বেলা তিনটায় বাংলামোটরের রাস্তা দিয়ে কোন ভিআইপি যায়? প্রধানমন্ত্রী? বইমেলা উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন?

এবার আমি বইমেলাটেলা কোথাও যাব না। আমি আসলে বহু বছর বইমেলায় যাই না। প্রথমবার বইমেলায় গিয়েছিলাম ফারুক ভাই আর বড় আপার হাত ধরে। এরপর নিজে বড় হয়ে একটা সময় টানা বইমেলায় গিয়েছি বড় আপাকে খুঁজতে। আমার কেন জানি মনে হতো, বড় আপা বইমেলায় আসবেন।

পাশের রিকশার আলাপ এখন ঝগড়ায় রূপ নিয়েছে। আর আমার মনে হচ্ছে, মেয়েটার ওপর ছেলেটা অহেতুক মাতব্বরি করছে। এই দুই কিসিমের দুইজন মানুষের ভেতর প্রেমের মতো একটা সম্পর্ক হলো কী করে, তা আমার বুঝে আসছে না।

সিগারেট ধরাতে গিয়ে আবার বাদ দিলাম। বড় খালার প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। পাশের রিকশার ছেলেটা ফস করে সিগারেট ধরাল। আমার মাথায় খিঁচ দিয়ে উঠল। আমাকে একটা টান হলেও দিতে হবে। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সিগারেট খাইনি। আব্বার থেরাপিস্ট এসেছিল, তাকে সাহায্য করতে হয়েছে। এই কাজ আমি নিজে থেকেই করি।

আমার আসলে আব্বার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বছর সাতেক আগে একেবারে প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার পর নিজের ভেতরের রাগ-ক্ষোভ চাপা দিয়ে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার, তাকে ভালোবাসার মিথ্যা চেষ্টা করি আমি।

আমি কোনোমতে পারিবারিক গাড়ির ব্যবসাটা দেখি, আসলে কেবল হাজিরা দিই। আমার চৌকস, সুপার, অভিজাত দুই চাচাতো ভাই চালিয়ে নিচ্ছে ব্যবসাটা। সেখান থেকে আমি একটা বেতনের মতো পাই, যার পুরোটাই তুলে দিই আম্মার হাতে। পরে আম্মার কাছ থেকে একটা মাসিক হাতখরচ নিই। সাত বছর ধরে আমি এটা করছি।

আব্বা সুস্থ থাকতে আমরা কারও মুখাপেক্ষী ছিলাম না। এই বংশে আমিই প্রথম ছেলে, যে কিনা চাকরি করতে গিয়েছিল। আব্বা স্ট্রোক করার পর আমি যখন চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় তার চেয়ারে বসলাম, মেজ চাচা এসে হাউমাউ করে বললেন, ‘কী দরকার ভাইজানের চেয়ারে বসার, তুমি তোমার কাজ করো।’ যদিও নিজের চাকরির পয়সায় আম্মা–আব্বাকে আমি চালাতে পারতাম, কিন্তু আম্মা তো সেটা নেবেন না, ব্যবসার মাসকাবারি টাকা ছাড়া তিনি কিছুই নেবেন না।

আজকে আমার অফিসের হিসাব-কিতাব নিয়ে বসার কথা ছিল। বসতে পারিনি। গাড়িটা গ্যারেজে পড়ে আছে। আনতে যাওয়া হয়নি। ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে নিজেই বিপদে আছি। গাড়ি থাকলে আম্মাকেও বড় খালার বাসায় নিয়ে যেতে পারতাম। অবশ্য উবারেও নিতে পারতাম। অফিসে গাড়ি চাইলেই পাঠিয়ে দিত, কিন্তু ওতে আম্মা ঠিক স্বস্তি পান না। আব্বার বেঁধে দেওয়া এক অমোঘ আভিজাত্যের মোড়কে নিজের জীবনটা তিনি কাটিয়ে দিলেন। অথচ আমার নানাবাড়ি ছিল এর উল্টো—সহজ-সরল মধ্যবিত্ত পরিবার। এরা জন্মদিনে কেক-বিস্কুট-চানাচুর খায়। শুধু আব্বার সঙ্গে ভালো থাকার জন্য আম্মা সেদিন বড় আপাকে আটকাননি। ২৫ বছর আগে এক মাঝরাতে আমার বড় আপা এই বাংলামোটরের বাসা থেকে একলা ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। কই গেছেন, কোথায় গেছেন, কেউই জানে না।

বড় আপার অপরাধ ছিল, ফারুক ভাইকে তিনি ভালোবেসেছিলেন। ভালোবাসাটা বেশি হয়ে গিয়েছিল বলে তার পেটে বাচ্চাও এসে গিয়েছিল। ফারুক ভাইও আপাকে ভালোবাসতেন।

একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডোবায় ফারুক ভাইয়ের লাশ পাওয়া গেল। সবাই বলল, প্রতিপক্ষ মেরেছে। আপার সেই চিৎকার করে কান্না আমি ভুলতে পারি না। আব্বা আর আম্মা আপাকে ঘরে বন্দী করলেন। আমাদের ডুপ্লেক্স বাড়ির দোতলার জানালা থেকে আপার কান্না নিচ পর্যন্ত আসেনি। তবে এক রাতে কীভাবে কীভাবে যেন আপা বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। পরের দিন সকালে নয়াটোলায় ফারুক ভাইদের টিনশেড বাসায় গিয়ে আমি দেখলাম, বাড়িটা তালা দেওয়া। আয়েশা বুয়াও আমাদের বাসায় আসা বন্ধ করল।

আমাকে কেউ আপাকে খুঁজতে যেতে বলেনি, নিজেই গিয়েছিলাম, খুব গোপনে। আপার পেটে বাচ্চা আসার বিষয়টা অনেক পরে আমি জানতে পারি। আমাদের ড্রাইভার একদিন মালির সঙ্গে আলাপ করছিল, সেখান থেকে জেনেছি।

বড় হতে হতে আমার শুধু মনে হয়েছে, ফারুক ভাইকে আব্বা খুন করিয়েছেন। আমার মেজ চাচা ঢাকার একটি আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। প্রতিমন্ত্রীও হয়েছিলেন। তার জন্য এটা ছিল ওয়ান–টুর ব্যাপার। আমার একমাত্র বোনের নিখোঁজ সংবাদ নিয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করল না। নানাবাড়িতে অনেক কথা হবে, তাই আম্মার তার মায়ের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। আপা চলে যাওয়ার পরদিন আম্মা ইলিশ মাছের ডিম রান্না করেছিলেন। ইলিশের ডিম আপার খুব খুব প্রিয় ছিল। আম্মার প্রথম সন্তান ও মেয়ে বাড়ি থেকে কোথায় গেছে, কীভাবে হারিয়ে গেছে, তার কোনো খোঁজ নেই, অথচ আম্মা ইলিশের ডিম প্লেটে তুলে দিচ্ছেন আব্বাকে।

মেয়েটা কাঁদছে। কুড়ি–পঁচিশ বছরের একটা মেয়ে। এত অদ্ভুত করে খোলা রিকশায় মুখ ঘুরিয়ে কাঁদছে মেয়েটা! ছেলেটা খুব বিরক্ত মুখে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে ফোনে। জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। ওদের রিকশা আমাকে ছেড়ে এগিয়ে যেতেই মনে হলো, এই মেয়ে আমার খুব চেনা, এটা বড় আপার মেয়ে, ওর সবকিছুই অবিকল বড় আপার মতো!

আমার রিকশার চেইন পড়ে গেছে, রিকশাওয়ালা চেইন লাগানোর জন্য একপাশে দাঁড় করাল। আমি মুহূর্তে হারিয়ে ফেললাম ওদের। উন্মাদের মতো আমি খুঁজছি ওদের রিকশাটা। চারটে সিগন্যাল একসঙ্গে ছেড়েছে। আমার ফোন বাজছে। ধরলাম ফোনটা। আম্মা বললেন, বড় খালা মারা গেছেন। আমি যেন ফিরে গিয়ে তাকে নিয়ে যাই। ‘আচ্ছা’ বলে ফোন কেটে দিয়ে বাসার দিকে হাঁটা দিলাম আমি। পেছন থেকে একটা হকার বলে চলছে, ‘পাকা সফেদা ১০০ টাকা, চিনির মতো মিঠা সফেদা...।’