পূর্ণাঙ্গ আঁধার

ট্রিপল নাইনে কলটা পেয়ে হানিফের মেজাজ এই শহরের মতো হয়ে গেল।

তার মনে হলো, ইমার্জেন্সি কলের কোনো সুযোগই সরকারের এখন রাখা উচিত নয়। যেখানে পুরো দেশই সাত মাস ধরে ২৪ ঘণ্টা ইমার্জেন্সিতে ভুগছে, সেখানে কেউ যদি রাত দেড়টায় ট্রিপল নাইনে ফোন করে বলে, ‘হ্যালো, ইমার্জেন্সি?’, মেজাজটা এই বিদ্যুৎহীন-অন্ধকারাচ্ছন্ন শহরের মতো না হয়ে একটা রেইন ফরেস্টের মতো হওয়ার কোনো কারণ নেই। সাত মাস ধরে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই ডিউটি দিতে দিতে দেশের, বিশেষ করে মেট্রোপলিটন সিটিগুলোর পুলিশ সদস্যদের অবস্থা রাজধানীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। হানিফের মাঝেমধ্যে অবাক লাগে, কাজ তেমন কিছু নেই, শুধু প্রস্তুত থাকা, কিন্তু দিনরাত–নির্বিশেষে কেবলই ক্লান্তি লাগে। এর চেয়েও বিপজ্জনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ অনেক অপারেশনে গিয়েও এত অবসাদ হয়নি। ওসি সাহেব কবে নাকি নিউজফিডে দেখেছেন বিদ্যুতের অভাবেই এই অবস্থা। একবিংশ শতকের শেষার্ধে গ্রামগুলো শহরতলিতে পরিণত হয়েছিল আর শহরতলিগুলোর শেষ শূন্যস্থানটিতে দরদালানে ছেয়ে গিয়েছিল। শ দুয়েক মাইল ওপর থেকে যদি তির্যক দৃষ্টিতে দেখা যায় তো থ্রি–ডি গ্রাফ পেপারে আঁকা বার-চার্টের মতো একটা এবড়োখেবড়ো কংক্রিটের দৃশ্য চোখে পড়বে। শহরের চূড়ায় চূড়ায়, মোড়ে মোড়ে, ঘরে ঘরে, হাতে হাতে বিভিন্ন রঙের আলো বহুমাত্রিক উজ্জ্বলতায় সন্ধ্যা হওয়ার আগেই জ্বলে উঠত। সবচেয়ে উঁচু আর জ্বলজ্বলে আলোগুলো জ্বলত শহরপৃষ্ঠ থেকে ১৬০০ ফিট ওপরের বাণিজ্যিক ভবন আর রুফটপ রেস্টুরেন্টগুলোয়। বাতিগুলোর ৫০ শতাংশ আকাশের দিকে মুখ করা।

দ্বাবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই সাত মাস আগে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে জাতীয় গ্রিড বিপর্যস্ত হলো। খাদ্য পাওয়া গেল, ত্রাণ পাওয়া গেল, রিলিফ মিলল, বিদ্যুৎ চালু হলো না। যারা বেঁচে গেছে, তারা বিদ্যুৎ চায় না। খাদ্য, মোমবাতি আর ছাদ পেলেই খুশি। কারণ, কীভাবে তারা বেঁচে গেছে, নিজেরাও জানে না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এলে পরে তেল-বিদ্যুৎ-গ্যাস নিয়ে ভাবা যাবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত মতামত দিয়েছে। আন্তর্জাতিক শুভাকাঙ্ক্ষীদেরও একই পরামর্শ। বহির্বিশ্ব থেকে চড়া মূল্যে তেল কিনে শুধু সরকারি কয়েকটা বিভাগ, আদালত আর থানাগুলোয় সীমিত পরিসরে জেনারেটর চালানোর ব্যবস্থা হয়েছে। বাকি সব কারখানা-গার্মেন্টস-ফ্যাক্টরি বিকেল থেকে বন্ধ ঘোষণা করা আছে। গত শীতে তবু কিছু ফ্যাক্টরি চালানো গেছে, কিন্তু সাড়ে তিন মাস ধরে প্রচণ্ড গরমে কাজকর্ম একেবারেই থ। প্রযুক্তির প্রত্যাশিত অগ্রগতির ফলে ভাগ্যিস মোবাইল চার্জ দিতে বা ইন্টারনেটে সংযুক্ত হতে এখন বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয় না, সূর্যের সামান্য আলোতেই মোবাইল চার্জ হয় আর বিভিন্ন জায়গায় বসানো ইন্টারনেট টাওয়ারেই বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এই শহরের বাতাসে পার্টিকুলেটর ম্যাটার আশাব্যঞ্জক হারে কমে গিয়ে আকাশ-বাতাস পরিষ্কার হয়েছে। ওজোনস্তর সুস্থতার দিকে ফিরে যাচ্ছে। এদিকে অন্ধকারের সুযোগে অপরাধ বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জরুরি অবস্থা চলছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় পথে পথে টহল দিতে দিতে হানিফদের অবস্থা জেরবার। শুধু গাড়ি আর টর্চের আলোয় কি ক্রিমিনাল ধরা যায়? যেটুকু অবসর পায়, অস্থিরতায় ভরা ঝিমানিতে ভুগতে হয়।

সূর্যের আলোর অভাবে শরীর–মন শ্রান্ত-বিষণ্ন হয় বলে সবাই জানে। বিদ্যুতের অভাবেও হতে পারে, সেটা হানিফের জানা ছিল না। সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছে, কেউই জানে না। মানুষ কি গাছ? বিদ্যুতের আলো কি সূর্য? সালোকসংশ্লেষণ হচ্ছে না বলে মনমেজাজের এই হাল? ইমার্জেন্সি কলের কথা চেপে যাবে যাবে করেও উঠল হানিফ, জরুরি অবস্থা চলাকালে কৌশলগত ভুল করলে নিজেরই বিপদ।

ওসি সাহেব ইমার্জেন্সি কলের কথা শুনে বললেন, ‘ইউএফও? মানে এলিয়েন শিপ?’

‘তাই তো বলছে স্যার।’

‘কোথায়? লোকটার ছাদে নেমেছে?’

‘না, স্যার। বলছে, ৭৩তলায় তার ফ্ল্যাটের ছাদ থেকে আকাশে সারি সারি এলিয়েন শিপ দেখা যাচ্ছে। সেগুলো নাকি ধোঁয়ার মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ক্রমেই এই শহরের দিকে নেমে আসছে।’

তা ভালো। বহুদূর থেকে আসছে তো, দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্ত-ক্ষুধার্ত। লোকটাকে বলো ভাত খাইয়ে বিদায় করতে।’

‘জি স্যার?’

‘অন্য কিছুও হতে পারে। পুরো পৃথিবীতে শুধু এই দেশটা অন্ধকার। এলিয়েনরা হয়তো মানুষ চায় না, নির্জনতা খুঁজছে। ধরে নিয়েছে এই অংশে মানুষ নেই।’

‘স্যার!’

‘ঠাট্টা করছি। ২৪ ঘণ্টা ইউনিফর্ম পরে যে জীবন কাটাচ্ছি, মাঝেমধ্যে ঠাট্টা না করলে মারা যাব না?’

‘আমার মনে হয় স্যার প্র্যাঙ্ক কল।’

‘হতে পারে। ইউনিফর্ম ছাড়া যারা আছে, তারাও মাঝেমধ্যে ফান না করলে আত্মহত্যা করবে। যান একবার ঘুরে আসেন।’

‘গিয়ে বোকা হওয়ার মানে হয় স্যার?’

‘এলিয়েন না হোক, অন্য কিছু হতে পারে। দেখে আসা দায়িত্ব। কোথাও আগুন লাগল নাকি আবার! ধোঁয়া দেখে হয়তো এলিয়েন ভেবেছে। মাসহিস্টিরিয়া চলছে তো, বোঝেনই।’

পরবর্তী এক ঘণ্টার মধ্যে পুরো শহরের সব কটি থানায় এবং ইমার্জেন্সিতে ইউএফও দেখে আতঙ্কিত সাড়ে সাত শ মানুষের ফোনকল আসবে।

‘নক্ষত্রগুলো দেখতে পাচ্ছিস?’

‘না, দাদা।’

‘সেকি? নক্ষত্র চিনিস?’

‘ভিডিও গেমে দেখেছি। গ্যালাকটিক ওয়ার।’

‘আসলেই দেখতে পাচ্ছিস না?’

‘না থাকলে কোত্থেকে দেখব? তুমি দেখতে পাচ্ছ?’

‘ছোটকাল থেকে দেখে আসছি তো, এই কারণে মনে হয় ওপরে তাকালেই নক্ষত্র দেখি। চোখের অবস্থাও তো সুবিধার না, বয়স তো হয়েছে।’

‘মা বলেছে, ৫০ বছর আগে হলে তুমি এত দিনে মরে ভূত হয়ে যেতে। তখন নাকি গড় আয়ু মাত্র ৮৬ ছিল।’

‘এখন কত রে?’

‘৯৯। সুস্থ থাকলে তোমার আরও ১৭ বছর আয়ু আছে।’

‘তুই আকাশের দিকে তাকালে কী দেখতে পাস?’

‘লিকুইড চিজ মাখানো পিৎজা। ম্যাজেন্টা রঙের চিজ।’

‘চিজ?’

‘হ্যাঁ। ইলুমিনেটিং।’

‘ওটা আলোর প্রতিফলন।’

‘প্রতিফলন কী জিনিস?’

‘পৃথিবীর আলো গিয়ে আকাশে রিফ্লেক্ট করছে।’

‘কিন্তু দাদা, আকাশ কি আয়না? সলিড কিছু?’

‘নক্ষত্রের দিকে তাকানো মানে অতীতে তাকানো, জানিস?’

‘অতীত কী, দাদা?’

‘যা আগে হয়ে গেছে, যা এখন নেই।’

‘যা নেই, তা দেখা যায় কী করে? তুমি যখন ১৭ বছর পরে মরে যাবে, তোমাকে কি দেখা যাবে?’

একবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে শৈশবের কোনো এক রাতে দাদার সঙ্গে এই কথোপকথন যখন সুরবের মনে পড়ল, ততক্ষণে রাস্তায় তুলকালাম চলছে। সে ট্রিপল নাইনে ফোন করেছে আধা ঘণ্টার বেশি হলো। কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। আকাশে এখনো সেই জ্বলজ্বলে শিকলটা বিস্তৃত। পিঁপড়ের সারির মতো একটার পেছনে আরেকটা লেগে রয়েছে। এই শহরের দিকে নেমে আসছে কি না, এখনো বোঝা যাচ্ছে না। এই শহরে দিগন্ত দেখা গেলে ৭৩ তলা থেকে সুরব দেখতে পেত আকাশের সঙ্গে সঙ্গে ওই দীর্ঘ সারিটাও ক্রমেই ঢালু হয়ে কয়েলের মতো প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে নেমে এসেছে যেন। রাস্তায় লোকজন ছোটাছুটি শুরু করেছে। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়, আর ওরা দেখে ফেলেছে সাক্ষাৎ জলোচ্ছ্বাস। জনতার চোখ আকাশে যতটা, ডিভাইসে তার চেয়ে কম না। কয়েক ধরনের সম্ভাবনার কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। হতে পারে এটা ক্ষেপণাস্ত্র, হতে পারে এলিয়েন শিপ, অথবা রাশি রাশি উল্কাপাত কিংবা অন্য কোনো গ্রহের আগ্নেয়গিরির গলন্ত লাভা ভয়ানক গতিতে ঝরে পড়তে যাচ্ছে এই শহরে বা পুরো পৃথিবীতে। রাস্তায় একটু আগেই কারা যেন ‘কেয়ামত, কেয়ামত’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল, মোড়ের সেন্ট্রাল এসি করা মসজিদে অসময়ে আজান হচ্ছে। সুরব বহু কষ্টে রাস্তায় নেমে দিগ্​বিদিক ছোটাছুটি থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে। তার মস্তিষ্ক জানে বাইরে ছুটে বিশেষ ফায়দা নেই। আপডেট নিউজ বলছে, পেন্টাগন ও নাসা একযোগে এই রহস্য নিয়ে কাজ শুরু করেছে, যদি ইউএফও হয় নাসা মোকাবিলা করবে, ক্ষেপণাস্ত্র হলে পেন্টাগন। পাশের দেশ বিবৃতি দিয়েছে, যদি প্রয়োজন হয়, সে দেশ আবার এ দেশের পাশে দাঁড়াবে। সম্ভবত শুধু এ দেশেই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটছে; কারণ, অন্য কোনো দেশ থেকে আকাশে অদ্ভুত কিছু দেখার খবর মেলেনি। এ দেশের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকায় সেখান থেকে কিছু করা যাচ্ছে না।

৭৩ তলা থেকে নিচে তাকিয়ে সুরব পুলিশের গাড়ি আর মোটরসাইকেলের আলো দেখতে পেল, কয়েক শ। শহরের প্রতিটি গলিতে সেনাবাহিনীও মোতায়েন করা হয়েছে। দেখতে দেখতে গুলি চলল। আকাশে দেখা যাওয়া জিনিসটা কত দূরে আন্দাজ করা যাচ্ছে না বলে তারা সব ধরনের অস্ত্রই প্রয়োগ করল। কাজ হলো না কিছু, শুধু কয়েক শ পাখি আকাশে উদ্বাস্তুর মতো ঘুরতে শুরু করল আর পথকুকুরগুলো লেজ নামিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পালাতে থাকল। পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করে সবাইকে যথাসম্ভব আশ্রয়ে থাকতে বলা হলো—আস্ত ঘরবাড়ি বা ধ্বংসস্তূপ যেখানেই হোক। যাদের ঘর এখনো আস্ত আছে, তাদের অনুরোধ করা হলো আশ্রয়হীনদের আশ্রয় দিতে, অন্তত যতক্ষণ না বিপদ কেটে যায়। অবশেষে আকাশে উড়ল কয়েক ডজন যুদ্ধবিমান।

দিন দুয়েক পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মাধ্যম জানাল, রাতের আকাশে যে জিনিসটা ইদানীং এ দেশ থেকে দেখা যাচ্ছে সেটা মূলত মিল্কিওয়ে, আকাশগঙ্গা—এই পৃথিবীর ঘরবাড়ি। বিশাল এই ছায়াপথ পৃথিবী থেকে রাতের আকাশে দেখতে পাওয়ারই কথা। কিন্তু অনেক দেশের মতো এ দেশেও আলোয় আলোয় ঝাঁঝরা আকাশে সেটা দৃশ্যমানতা হারিয়েছে। সাত মাস ধরে যন্ত্রপাতি বন্ধ থাকাতে বাতাস পরিষ্কার হয়েছে, আলো নিভে গিয়ে পৃথিবীর বাসস্থান আলোকিত হয়েছে।

শহরের অস্থায়ী ঠিকানাওয়ালা মানুষগুলোকে ত্রাসিত করেছে আকাশে তাদের স্থায়ী ঘরবাড়ি।