সূর্যগ্রহণ

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

মুখ ফসকে সব বলে ফেলি ফোনের সকাশে। জিপিএসে ঘুরি। সারা দিন কাজ শেষে আয়েশে রসেবশে সুখের জীবন আপ দিই সোশ্যাল মিডিয়ায়। অ্যামাজনে ভিটামিন কিনি। উবারে যাই ফ্রাইডে নাইট করতে। এয়ারবিএনবি বুকড।

আমার ব্যক্তিগত ডেটার কাছা খোলা। সেই ডেটা পড়ে পড়ে চিনে নিচ্ছে আমায় অ্যালগরিদমরা। তারপর সূক্ষ্ম কায়দায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছে আমার নিউরনদের। সেই ট্রেনিংয়ে ব্যাঘাত ঘটলে নেশাখোরের দ্রব্য ফুরিয়ে যাওয়ার মতো উদ্বেগ হচ্ছে। ফোন চোখের কাছে না থাকলে অস্বস্তি হচ্ছে। ইন্টারনেট চলে গেলে কলে পানি চলে যাওয়ার অনুভূতি হচ্ছে। হেরোইনের মতো আসক্ত হয়ে যাচ্ছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। অরাজনৈতিক, শান্তিময়, পরিশোধিত কনটেন্টের বন্যায় আমার স্মৃতিকোষ প্লাবিত।

ফোনের স্মৃতিকোষ ফুল। ক্লাউডে জায়গা কিনতে বলা হয়েছে, যাতে আমার ব্যক্তিগত তথ্যগুলো তাদের ইজারায় সুরক্ষিত থাকে, যা দিয়ে আমার অস্তিত্ব প্রোফাইল করা যাবে। আমার মগজে সুনির্দিষ্ট অভ্যাসের জন্ম দেওয়া যাবে। জুতসই চাহিদা উৎপাদন করা যাবে। নতুন নতুন বিশ্বাস আদর্শের চাষ করা যাবে।

ব্যক্তি আমার অস্তিত্ব অপ্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক শুধু তার ডেটা। চিন্তার স্বাধীনতা বলে কিছু হয় না। আমি এখন আমার সামাজিক প্রোফাইল। ঠিক করে দেওয়া কুয়ার ভেতর ধ্যানমগ্ন ঝকঝকে পারসোনা। চাকরির ইন্টারভিউতে দেখতে চাইলে সমস্যা হবে না।

ব্যক্তি আমি প্রাসঙ্গিক নই।

পুরোনো কাপড়ের টুকরা সেলাই করা কাঁথা গায়ে শুয়ে থাকি। ঘুমের ভেতর স্বপ্নে দেখি, পাশের বাসার যুবক–যুবতী গগলস চোখে সূর্যগ্রহণ দেখছে। বেলা দুটোর ঘাসের লনে নেমে আসা চাঁদের অদ্ভুত তামাটে ছায়ার ভেতর বরফ গলে সবুজ ঘাস বেরিয়েছে। সেই ঘাসের তলায় মাটির গায়ে হেঁটে যাচ্ছে পিঁপড়ের প্রাণ। আয়নামহল...ছায়াপথ… যেন কোনো বিস্মৃতির বন্ধন। নিরালোক মহাশূন্য...উত্তাপহীন গ্র্যাভিটির ঢাল… কোটি কোটি আলোকবর্ষ অন্ধকার।

ঘুম ভেঙে যায়। পানি খাই। ওষুধ খাই। ফোনে খুব মৃদু করে বৃষ্টির আওয়াজ বাজাই।

ব্যক্তি আমি অদরকারি। দরকারি শুধু আমার শোবার ঘরে কান পেতে থাকা অ্যালগরিদমবৃন্দ। এআইবৃন্দ। কোন খাদ্য মগজের জন্য স্বাস্থ্যকর, কোন কোন হত্যা মার্ডার, কোন কোন মার্ডার নিছক পরিচ্ছন্নতা অভিযান, কোন কোন জেনোসাইড প্রতিবাদের উপযোগী নয়, কোন কোন শিশু মানুষ, কোন কোন মানুষ শিশুরূপী জানোয়ার, কাকে বলে স্বাধীনতা, কাকে বলে প্রকৃত সাম্য—ইত্যকার নানান ট্রেনিংয়ে, পরামর্শে, মিষ্টি হুমকিতে আমার মগজের কোষগুলো ক্রমেই আধুনিকতর। স্পেস ভাড়া নিয়ে ফেলি ডিজিটাল ফিউডাল ডেটা-সরোবরে। আমার ডেটা পড়ে পড়ে আমাকে শিখে নেয় অ্যালগরিদম। তারপর আমার আত্মাকে ট্রেইন করে ওরা। দৃষ্টি সাফ করে। আমার চিন্তাজগৎ হয়ে ওঠে বুদ্ধিমান, নিয়মানুবর্তী।

আমার ডেটা পড়ে পড়ে আমাকে শিখে নেয় অ্যালগরিদম। তারপর আমার আত্মাকে ট্রেইন করে ওরা। দৃষ্টি সাফ করে। আমার চিন্তাজগৎ হয়ে ওঠে বুদ্ধিমান, নিয়মানুবর্তী।

ঘুম পায়।

পুরোনো কাপড়ের টুকরা সেলাই করা কাঁথা গায়ে শুয়ে থাকি। ঘুমের ভেতর স্বপ্নে দেখি, লনের ঘাসে সূর্যের আলো এসে পড়ে...কী অদ্ভুত সবুজ পাখির ডাক! একটা শিশিরের দানায় রোদ পড়ে ঝিকমিক করছে। অবিকল হীরার টুকরার মতো। দিল-এ-নাদান তুঝে হুয়া কেয়া হ্যায়?...আখির ইস দর্দ কি দাওয়া কেয়া হ্যায়?...দুপুরবেলা ঝুপ করে ছায়া নেমে আসে রাস্তায়। পার্ক করা টয়োটার গায়ে। ‘দ্য রোজেস হ্যাড দ্য লুকস অব ফ্লাওয়ার্স দ্যাট আর লুকড অ্যাট’। ঠিক সত্য নয়, সত্যের মতো পরিবেশ। স্বপ্নে দেখি, মাকড়শার জাল কেটে আমি আর এগোতে পারছি না। শত শত মাকড়শার জাল। পেছন থেকে টেনে ধরেছে। চিৎকার করলে শব্দ বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে।

ঘুম ভেঙে যায়। ফিল্টার করা পানি খাই। বাথরুমে যাই। টেবিলে বাতি জ্বালিয়ে বসি।

খবর দেখব? আজ আমার নিউজ দেখার তারিখ নয়। থেরাপিস্ট মাসে কেবল এক দিন অনুমতি দিয়েছে খবর দেখার। নিয়ম ভাঙি।

‘দশ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হতে যাচ্ছে নতুন ক্লাউড এআই প্রযুক্তিতে। আমাদের রোবট মগজ থেকে উৎপাদিত সিনথেটিক ডেটায় তৈরি হবে সামনের দিনের শিল্প–সাহিত্য।’

‘ফেক নিউজে পাত্তা দেবেন না। শত্রুপক্ষের প্রপাগান্ডা দাবি করছে, আমাদের বীর সেনারা চলে আসার পর ওদের শহরে কাঁচা গণকবর পাওয়া যাচ্ছে। মৃতদেহগুলোর হাত-পা বাঁধা। জ্যান্ত মাটিচাপা দেওয়া বলে গুজব রটেছে। কান দেবেন না। নিশ্চিন্ত থাকুন। আমাদের নিরপেক্ষ গোয়েন্দা বিভাগ বিষয়টা তদন্ত করে দেখছে।’

‘বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে আরও ১০০ ছাত্র গ্রেপ্তার। শত্রুপক্ষের জানোয়ারগুলোর হয়ে স্লোগান দেওয়ার মতো অমানবিকতা সহ্য করা হবে না।’

‘দয়া করে তোমরা উন্নত বিশ্ব আমাদের গরিব দেশে তোমাদের প্লাস্টিকবর্জ্য পাঠানো থামাও! এখানে ব্যবসায়ীরা ওগুলো কেনাবেচা শেষে আগুনে পোড়াচ্ছে। আমাদের বাতাস ভরে গেছে মাইক্রোপ্লাস্টিকে। নদীর পানি ছেয়ে গেছে। জঙ্গলের গাছে প্লাস্টিকের কণা। জানোয়ারগুলো আক্রান্ত। হাঁস–মুরগি আক্রান্ত। আমরা ওদের ডিম খাই। আমাদের শরীরে বিষ ঢুকে যাচ্ছে। তোমাদের তো অনেক প্রযুক্তি। দয়া করে তোমাদের প্লাস্টিকবর্জ্য গরিব বিশ্বে পাঠানো থামাও!’ 

 ‘ফাইটার জেটে বিনিয়োগ করুন! শেয়ারবাজার পুনরায় চাঙা। গার্ডিয়ান–এর তথ্যমতে, ইউক্রেন যুদ্ধে এখন পর্যন্ত তেল কোম্পানিগুলোর মুনাফা ২৮১ বিলিয়ন। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় প্রকাশ, “ওয়ার অন টেরর” যুদ্ধে ডিফেন্স কন্ট্রাক্টররা মুনাফা করেছিল সাত ট্রিলিয়ন! ফাইটার জেটে বিনিয়োগের এখনই সময়।’

খবর বন্ধ করি। শীতকাল। রাত একটা। হালকা বরফ পড়ছে। চারদিকে আবছা আলো। সব দেখা যাচ্ছে। এই আলো চাঁদ বা তারার আলো নয়। যেহেতু আকাশ ঘন মেঘের ঢাকনা দিয়ে বন্ধ। তাহলে এই আলোর উৎস কী? সিরি, মানে আমার এআই ইন্টারফেসকে প্রশ্ন করি। সিরির কণ্ঠ জানায়, ‘এ আলো হচ্ছে রাস্তার বাতিটাতি ইত্যাদি থেকে আসা আলোর যোগফলের অংশ মাটিতে জমে থাকা সাদা বরফে প্রতিফলিত হয়ে রাতের আকাশে মিলিয়ে যাওয়ার পথে, ওপর থেকে পড়তে থাকা বোন্দা বোন্দা বরফ আর মেঘের গায়ে দ্বিতীয়বার প্রতিফলিত হয়ে, উল্টো আবার বায়ুমণ্ডলে, মানে পৃথিবীতে ফেরত চলে আসছে।’

দুটো মুখোমুখি আয়নার মধ্যবর্তী শূন্যে আটকা পড়া ডাবের ননীর মতো আলোয়, বরফপাতের রাত একটা।

আমার অস্থির লাগতে শুরু করে। অস্থিরতাকে পাত্তা দেওয়া যাবে না। ব্যক্তি আমি অদরকারি। দরকারি শুধু আমার রক্তচাপ ঠিক রাখা। কোলেস্টেরল কমানো। সিরি জানায়।

আবার ঘুম পায়। পুরোনো কাপড়ের টুকরা সেলাই করা কাঁথা গায়ে শুয়ে থাকি।

ঘুমের ভেতর স্বপ্নে দেখি, পঁচিশ বছর আগেকার আমি ও পারুল। নিবিড় কাঁঠালগাছের ছায়া। মুহুর্মুহু বাতাস দিচ্ছে। একটা পরিত্যক্ত চিপসের প্যাকেট গড়াগড়ি খাচ্ছে রাস্তার ওপর। পারুল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এমন করছ কেন?’ আমি বললাম, ‘এটা স্বপ্ন! আমি স্বপ্ন দেখছি!’ পারুল বলল, ‘চলো বেবিট্যাক্সি নেই।’ ‘কেন?’ ‘এমনি।’

বেবিওয়ালাকে আমরা বললাম উদ্যানে যেতে।

বেলা তিনটা। ঘন কালো মেঘলা আকাশ। উদ্যানে কুয়াশার মতো হালকা বৃষ্টি পড়ছে। বটগাছের ইটবাঁধানো গুঁড়িতে আমি আর পারুল বসে আছি। কোথায় যেন গন্ধরাজ ফুটেছে। পারুলের গাঢ় লাল কামিজের গন্ধ সেই গন্ধরাজের সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে।

আমার দিকে ঝুঁকে এল পারুল। ঘাসের ওপর মেঘের ছায়া গড়িয়ে পড়ল। কোথাও কেউ নেই। এই নির্জন বেলা তিনটায় পারুল ও আমি ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব নেই উদ্যানে। বটপাতার গা থেকে অল্প অল্প চুইয়ে নামছে বৃষ্টির পানি। থপথপ শব্দ হচ্ছে। পারুল আমার মুখের ভেতর চুমু খেতে খেতে বলছে, ‘কামড়াচ্ছ কেন?’

ঘুম ভেঙে যায়। পানি খাই। বাথরুমে যাই। টেবিলে বাতি জ্বালিয়ে বসি।