মা সকাল থেকেই অনেক খুশি। গুনগুন করছে, তবে কী গান গাইছে, জানি না। তার পছন্দের পদ রান্না করেছে। কাঁচকলা ঘন্টতে চালকুমড়ার বড়ি দিয়ে এই খাবার রান্না করলে বাবা খায় না, আমার তো গন্ধ শুকলেই মাথা ঝিমঝিম করে। মা আজ সেসব কিছু মাথায় নেবে না। বলছে, ‘তোর যা পছন্দ, রান্না করে খা। আর না হয় অনলাইনে অর্ডার করে নে।’ মাকে এর আগে এমন হাসিখুশি দেখিনি। পুরোনো একটা শাড়ির ভাঁজ খুলে কয়েকটা ন্যাপথলিন বের করল। তারপর আবার শাড়িটা উল্টো করে ভাঁজ করল। আমি বললাম, ‘সেই কবে থেকেই বাবার স্যুটকেসটার কভারটা পাল্টাও না। কেন?’ সে কথা কানেও তুলল না। আসমা আপা কাজে আসেনি। তার সেজ মেয়েটা এসেছে। মা বলল, ‘আজ রান্নাঘরে কাউকে ঢুকতে দেব না।’ মাজেদাকে আমি আমার ঘরে ডেকে নিলাম। ‘এই, তুই স্কুলে যাস না?’
‘যাই, মাঝেমধ্যে। আমার ভাইটা মাদ্রাসায়। হ্যার জ্বর উঠছে। মায় হ্যার কাছে গ্যাছে।’
মাজেদা নাকি রফিককেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। এই যে স্কুলে ওর তিনজন বান্ধবী হয়েছে—শেফালি, আরবিনা, আলতা—ওরা সবাই ওদের মাকে বেশি ভালোবাসে। ওদের কাছ থেকে সে গল্প জেনেও মাজেদা বলেছে, ‘আমি আমার ভাইকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।’ মাজেদা মনে করে, ওর প্রথম বোনের জন্মের পরই যদি রফিকের জন্ম হতো, তাহলে কলির জন্ম হতো না। আর মাজেদার জন্ম নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। মা–বাবার মুখে সে এ কথা বহুবার শুনেছে। মাজেদা মনে করে, রফিকটা একটু দেরি জন্ম নিয়ে ভালোই করছে। না হলে তার জন্ম নেওয়া হতো না। এই যে সে একটু একটু করে দরজির কাজটা শিখে ফেলেছে। এই কাজ করে সে যে আনন্দ পায়, এই আনন্দের ঘুড়িটা তার উড়তে দেখা হতো না। রফিক ওকে বুবু বলে ডাকে। একসঙ্গেই বড় হয়েছে। রফিককে যেদিন মাদ্রাসায় দিয়ে এল ওর মা, সেদিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল মাজেদা। রফিক বলেছিল, ‘বুবু, কাঁদিস নারে। শোন, আমি হাফেজ হলে বেহেশতে যাব। আরও অনেককে আমার সঙ্গে বেহেশতে নিতে পারব। তোকে আমার সঙ্গে অবশ্যই নেব। সেখানে দুই ভাই–বোন আঙুরের রস খাব। বুঝলি!’
রফিকের জ্বর হয়েছে শুনে মাজেদা ওর মায়ের সঙ্গে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আসমা তিন বাসায় কাজ করে। সেই কাজ করার দায়িত্ব পড়েছে মাজেদার ওপর। বড় বোনটার বিয়ে হয়ে গেছে। মেজ বোন কলি হাইস্কুলে যায়। তার পরীক্ষা।
মাজেদা দরজির কাজ শিখেছে যার কাছ থেকে, গোপনে তাকে মা ডাকে। ওদের পাশের বাসায় থাকে মন্দিরা। মন্দিরার ছেলেমেয়ে নাই। স্বামী রংমিস্ত্রি। তিন মাসের মতো হলো, শহরে এসেছে। নতুন নতুন ডিজাইন করে সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় বানায় মন্দিরা। বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের জন্য। আশপাশের সবাই মন্দিরার কাছ থেকে জামাকাপড় বানানো শুরু করেছে। মাজেদা মন্দিরার কাছে যায়, বসে গল্প করে। মন্দিরার মাথায় তেল দিয়ে দেয়। মন্দিরার কাজ করা দেখে। একদিন বলেই বসে, ‘কাকি, আমারে এটটু শিখাইবা?’ জবাবে, ‘শিখাব, কিন্তু আমারে মা কইতে হইব’ বললে শুনে মাজেদার ভয় হয়, ওর মা জানলে যদি কিছু বলে! মন্দিরা অভয় দেয়, কেউ কোনো দিন জানতে পারবে না। এই অভয় পেয়ে মন্দিরার কাছে যায় মাজেদা। তারপর কাজ শেখে। আসমা জানতে চায়, ‘সে তোরে আমনাআমনি কাজ শিখাইতেছে?’
‘হ মা, সে অনেক ভালা।’
মাজেদা আমাকে এই গল্প বলে আবার অনুরোধ করে, আমি ওর মাকে না বলি। একটা ছোট্ট মেয়ে, তার জীবনের একটি গোপন গল্পের নাটাই আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ফুড়ুত করে কখন যেন মায়ের কাছে গেল। তারপর চলেও গেল।
প্রিন্টের আড়াই গজ নতুন কাপড় কিনে রেখেছিলাম। বালিশের ওপরই ছিল। ব্যাগে। ব্যাগ না খুললেই তো বোঝার কথা না, ভেতরে কী আছে। দরজির কাছে নিয়ে যাব যাব করে যাওয়া হয়নি। মাজেদার কথা শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, কাপড়টুকু ওকেই দিয়ে দেব।
মাজেদা চলে যাওয়ার পর মা আমার ঘরে এসে বলল, ‘দ্যাখ, সব ঠিকঠাক আছে কি না।’ রাগ হলো আমার। দেখার কী আছে। মা বলল, ‘তুই ওদের এখনো চিনতে পারিসনি। ওরা সুযোগ পাইলেই এটা-সেটা সরিয়ে ফেলতে পারে।’
বালিশের ওপর কাপড়টুকু না দেখে মায়ের কথাই সত্য বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু মাকে আর বললাম না। কলিং বেল বেজে উঠল। এমন দীর্ঘ সময় কলিং বেল চেপে রাখে বাবা। কিন্তু তার তো আজ কানাডা থেকে ফেরার কথা নয়। যেখানেই যাক, যে দেশেই যাক, সেখান থেকে ফেরার আগে বাবা ফোনে জানায়। দরজা খুলে দেখি, মাজেদা। ‘ব্যাগটা ভুলে নিয়ে গিছিলাম।’ ওর চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক। মা ভেতর থেকে বলে উঠল, ‘কে রে?’, আমি মাজেদাকে চলে যেতে বললাম। ব্যাগটা নিতে বললাম, ও রাজি হলো না। তারপর বললাম, ‘তোমাকে গোপনে এই গজ কাপড়টুকু দিলাম, আমার মা যেন জানতে না পারে।’ ফিসফিস করে বললাম বলে ও হাসল। তারপর দিল দৌড়। আমার মনে হলো, মানুষ গোপন বয়ে বেড়ায়, আবার গোপনীয়তা মানুষকে তাড়িয়ে–নাড়িয়ে বেড়ায়। ঘরের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে আমার বাবার স্যুটকেসটা চোখে পড়ল।
বাবার কাছে অনেক দিন জানতে চেয়েছি, ঘরে বড় বড় আলমারি, ওয়ার্ডরোব থাকতে পুরোনো স্যুটকেস কেন ঘরে রাখতে হবে। বাবা বলেছে, এটা ফেলা যাবে না। কী আছে এর মধ্যে, তা কোনো দিন বলেনি। চুপিচুপি স্যুটকেসটা খুললাম। স্যুটকেসটা জং ধরা সুইচগুলোর নম্বর টেনে মেলালাম। জিরো, জিরো, জিরো। এরপর খুললাম। পুরোনো কাগজের গন্ধ নাকে মুখে লাগল। চিঠি আর চিঠি। দৈনিক পত্রিকার পাতা কেটে রাখা। কিছু কবিতার আর একটা বিজ্ঞাপনের। ‘পত্র মিতালী’ বিভাগে বন্ধু হওয়ার আহ্বান জানিয়ে একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। বাবার নাম, আর আমাদের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা।
চিঠিগুলো পড়ার আগে নাম দেখছিলাম। প্রতিটা চিঠি একজনেরই লেখা। নাম গুলশান আরা জেরিন। কী স্পষ্ট হাতের লেখা! প্রতিটি চিঠি শুরু হয়েছে দুই লাইন কবিতা দিয়ে। এরপর আর কোথাও কোনো কবিতার আলাপ নেই। কোনো চিঠিতে এসেছে জীবনানন্দের জীবন নিয়ে কথা। আমার শুধু জানতে ইচ্ছা করছিল, প্রত্যুত্তরে বাবা কি লিখেছিল। দ্রুত শেষ করছি চিঠি পড়া। একটি ছোট কাঠের বাক্সে আরও কিছু চিঠি, এই চিঠিগুলোর ওপর শুকনো ফুলের পাপড়ি।
এবার আমি অবাক হলাম। সেই একই মানুষ। গুলশান আরা জেরিন। চিঠিতে কবিতার লাইন নেই। শুরুতেই লেখা। ‘চিঠির মাধ্যমে তোমার সঙ্গে অনেক দিন কথা হলো। দেখা হলো না। তবু মন পড়ে যেন তোমার ঠিকানাই। বিয়ের পর মনে হলো, আমি নয় আমার চেতনা, আমার জ্ঞান, আমার ধ্যান আর অপেক্ষারা তোমাকে ভালোবেসেছে। অথচ তোমাকে বলা হয়নি।’
আরও আরও চিঠি খুলে পড়লাম। আমি যেন আমার বাবার হারানো সময়ের ভেতর সাঁতার কাঁটছি। যে বাবাকে প্রতিদিন সকালে অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে দেখি, যে বাবা আমার প্রয়োজন মেটাতে মেটাতে অস্থির হয়ে পড়ে—সেই বাবার স্মৃতির ভেতর কী ধীরে বয়ে যাওয়া এক নদী। অথচ জানতেই পারিনি, জানতে চাইওনি। আচ্ছা, মা কি জানে! হয়তো না।
মা হঠাৎ এল। এই পুরোনো স্যুটকেস খুলে বসেছি বলে ছ্যা ছ্যা করে চলে গেল। মায়ের ইচ্ছা ছিল, বাবার সঙ্গে কানাডায় যাবে। বাবা তার আগে মাকে ভেনেজুয়েলা থেকে ঘুরিয়ে এনেছে। মা বলে, ‘বাংলাদেশ দেখা আর ভেনেজুয়েলা দেখা একই কথা। ওই দেশেও এই দেশের মতো গরম।’
তার আগেও মা কানাডায় যেতে চেয়েছিল, বদলে বাবা মাকে তুরস্কে নিয়ে গিয়েছিল। আঙ্কারায় ঘুরিয়ে এনেছে। মা বলে, ‘তুরস্ক একই সঙ্গে আধুনিক ও আদি সংস্কৃতি বয়ে চলেছে।’
মা শেষে বলল, ‘কানাডায় আর যেতে চাই না। এরপর কানাডাতে যেতে চাইলে নিশ্চয় আমাকে তুমি নরওয়েতে নিযে যাবে। তার চেয়ে বরং তুমিই যাও।’
বাবা গেল এবং একা। গুলশান আরা জেরিনের যে চিঠিটা হাতে ধরে আছি। এতে লেখা, ‘আমার বিয়ের পর তোমাদের বাড়িতে টেলিফোন এল, আমাদের বাড়িতেও। তবু চিঠি লিখছি। এটা যত্ন করে রেখো। তোমার সঙ্গে দেখাও হলো। কিন্তু অনেক দেরিতে। প্রথমবার দেখা করতে এসে তুমি দুইটি ম্যাগনেটিক টেপ হাতে ধরিয়ে দিলে। বললে, আমার পছন্দমতো গান যেন দুইটা ম্যাগনেটিক টেপেই রেকর্ড করি। ডিস্কো রেকডিংয়ে গিয়ে আমার পছন্দের গান রেকর্ড করে পাঠালাম। আশা করছি তুমি শুনবে আর আমার কথা মনে করবে। আর আমিও শুনব। ভাবব, একই সুর আমাদের অন্য ভুবনের আলো এনে দিয়েছে। কয়েক দিন পর কানাডা চলে যাব। ওখানে থাকতে হবে সারাটা জীবন। যদি পারো, কোনো দিন এসো। আমার ছোট্ট বাসায় তোমাকে একবারের জন্য হলেও স্বাগত জানানোর স্বপ্ন নিয়ে অপেক্ষা করব।’
আমি থেমে যাই। হোয়াটসঅ্যাপে বাবার কল। ভিডিও কল। আমি কাঁদছি। বাবা আঁতকে ওঠেন, ‘কি রে, তোর মায়ের কিছু হয়েছে?’ আমি কান্না চেপে বলি, ‘না, বাবা।’ বাবা কান্নার কারণ জানতে চায়। আমি বলি, ‘তোমার কাছে কি ম্যাগনেটিক টেপ আছে?’ বাবা বলল, ছিল, কিন্তু বাসা পাল্টানোর সময় হারিয়ে গেছে। বাবা আরও অনায়াসে বলে, ‘শোন, এখানে তোর একটা আন্টির সঙ্গে দেখা হয়েছে, তোর কথা ওকে বলেছি। ও তোকে দেখতে চায়।’
যে মানুষটি বাবার হাত থেকে ফোন নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছে, আমি তাকে প্রথমেই বললাম, ‘তুমি, গুলশান আরা জেরিন আন্টি?’ ‘হ্যাঁ, তুমি আমার কথা জানো। বাব্বাহ। তোমার বাবা তো ভীষণ চাপা স্বভাবের। কিন্তু আমার কথা তোমাকে বলেছে? কী সাংঘাতিক ব্যাপার। শোনো, তোমার আঙ্কেলও আছেন এখানে, তার সঙ্গেও কথা বলো।’ কাঁচা-পাকা দাঁড়িওয়ালা এক লোক আমাকে বলল, ‘হাই, কাবেরী। ইতিমধ্যে তোমার বাবার মুখে তোমার অনেক গল্প শুনে ফেলেছি। তুমি নাকি বিদেশে বেড়াতে পছন্দ করো না?’ আমি বললাম, ‘সত্যিই শুনেছেন।’ আমার আর কথা বলার ইচ্ছা নেই। কিন্তু হঠাৎ লাইনটা কেটে দেওয়াও ঠিক মনে হলো না। গুলশান আরা জেরিন বাবার ফোনটা নিজে নিলেন। তারপর কথা বলতে বলতে চলে গেলেন দূরে। ‘শোনো মেয়ে...’ আমি কলটা কেটে দিলাম।
বাবা বেশ কিছু সময় পর কল দিলেন, ‘তোর চোখে অনেক প্রশ্ন, আমি এসে তোকে সব বলব।’
‘প্রশ্ন না বাবা, তোমাকে ভালোবাসি।’
‘জীবন সত্য আর মিথ্যা, শব্দ আর নৈঃশব্দ বহন করে চলে। আমরা এই বয়ে চলাকে কেউ বলি প্রেম, কেউ বলি অপ্রেম। সব দৃশ্যের গভীরতায় যেতে চাইলে মানুষ তলিয়ে যায়। তোর মা কেমন আছে, তাকে ফোনে পাইনি। গুলশান আরা ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল।’
এবার আমার আরও চমকে যাওয়ার পালা। ‘তার মানে মা জানে, তুমি আন্টির বাসায় গিয়েছ?’
‘বলিনি, কিন্তু জানে। আজই এখান থেকে অন্য শহরে চলে যাচ্ছি। এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।’
বাবা কথা দেয়, তাড়াতাড়ি ফিরবে। আমি মাকে দেখি। মা যেন আরও হাসিখুশি, আরও অন্য রকম। মা একটি পুরোনো নকশিকাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। মাথায় হাত দিয়ে দেখি জ্বর। মা বলে, ‘তোর বাবাকে বলার দরকার নেই যে আমার জ্বর।’ মাকে বলি, ‘চলো, রিকশায় দুজন ঘুরি।’ মা প্রথমে ‘না’ বলে। তারপর উঠে বসে। পুরোনো কাচের চুড়ি হাতে দেয়। আমি আর মা রিকশায় ঘুরি। মা বলে, চটপটি খেতে যাবে। অথচ মাকে কোনো দিন চটপটি খাওয়াতে রাজি করতে পারিনি আগে। মায়ের চোখ যেন বিষাদের গ্লাসে জমা জল দিয়ে ধুয়ে এসেছে। একেবারে শুষ্ক। মা তবু হাসছে। বাবার কথা উঠতেই মা বলল, ‘তোর বাবা আমাকে কোনো দিন ইচ্ছা করে দুঃখ দেয়নি। কখনো কখনো দুঃখও ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকে। ইচ্ছায়–অনিচ্ছায় তাকে পাওয়া যায়।’