বোকা মেয়ের ডায়েরি

অলংকরণ: আরাফাত করিম

তারিখ: ২২-০৬-১৯৯৭

কম্পিউটার কোর্সের ওরিয়েন্টেশন শেষে একটা কলম আর এই ডায়েরি দিল। দুই মাসের কোর্স, তাতেও কত ভুংভাং! যাক, ভালোই। আমার সুবিধাই হইলো। এখন থেকে টুকটাক লেখা যাবে। কিন্তু লেখবই বা কী? পরীক্ষার লেখাই লেখতে পারি না! তবে লেখব। কেউ তো আর পড়তে আসতেছে না। আমার যা বানান ভুল হয়...কী আর বলব...সরি লিখব! তবে শুদ্ধ করে লেখার চেষ্টা করব; আর প্রমিত উচ্চারণে লেখার প্র্যাকটিসও হবে। হা হা হা...

মনের ভেতর

মন করে

শুধু ছটফট

কারণে–অকারণে

প্রতিক্ষণ

মনের কোণে

উঁকি মারে

কে বারে বারে

পাইনি দেখা

তবু তারে

অনুক্ষণ।

তারিখ: ২৭-১০-১৯৯৭

আব্বা মারা গেছেন দুই মাস হয়ে গেল। অনেক দিন ধরেই নষ্ট কিডনি নিয়ে কষ্ট পাইতেছিলেন। এক বছর সাত মাস। শেষ দিকে ভাইবোনেরা ডায়ালাইসিসও আর করাইতে চাইতেছিল না। ওদেরই বা দোষ কী? চিকিৎসার জন্য একে একে গ্রামের সব কটা জমিই বিক্রি করে দিতে হইছে। তৃতীয় শ্রেণির সরকারি চাকুরে হিসেবে তাঁর সঞ্চয় বলে তো তেমন কিছুই ছিল না, দাদার সামান্য কিছু জমি ছাড়া। তা–ও শেষ।

তারিখ: ০২-০২-১৯৯৮

ডায়েরি খুলে দেখলাম, অনেক দিন কিছু লিখি নাই। কী আর লিখব! জীবন উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। কলোনিতে যে বাসায় আমরা থাকতাম, সেই বাসা ধরে রাখার জন্য ভাইয়া অনেক কষ্টে আব্বার চাকরিতে জয়েন করেছিল দুই বছর আগে। ভাইয়া বিয়ে করে বউ নিয়ে আসছে আজ চার মাস। এরই মধ্যে আমাদের বাসাটা ছোট মনে হইতে শুরু করছে তার কাছে। ভাবি প্রতিদিনই বলে, ‘এত লোক একটা বাসায় থাকে কী করে? চার ভাইবোন আবার মা। নড়ার জায়গা নাই।’

তারিখ: ১৫-০৭-১৯৯৮

কাল সেজপা আমাকে ওর বাসায় নিয়ে আসছে। এখন থেকে এখানেই থাকব। বাসাটা খুব সুন্দর। কয়েক মাস আগে ভাড়া নিয়েছে ওরা। এটাকে নাকি ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ বলে। মূলত দুলাভাইয়ের শুটিংয়ের কাজের জন্য নেওয়া। সেজপার বর অ্যাড বানায়। ওনার কোনো অ্যাড এখনো টিভিতে দেখায় নাই যদিও হা হা হা...

ওদের বিয়েটা আব্বা মেনে নেন নাই তখন। তিনি মরে যাওয়ায় এখন আবার সব ঠিক হয়ে গেছে। সে যাক, বাসাটা আমার খুব পছন্দ হইছে। রান্নাঘরটা একদম বিদেশের মতো। তারপর বারান্দা। ওখানে আবার একটা দোলনাও আছে। তবে সমস্যা হইলো, বেডরুম একটাই। আমার জায়গা তাই হইছে ড্রয়িংরুমে। ড্রয়িং-ডাইনিং একসাথে। মেইন দরজার পাশে একটা রাজবাড়ির মতো সিঁড়ি আছে। প্যাঁচানো। সোজা উঠে গেছে সিলিংয়ে। ফলস।

ভেঙে মোর ঘরের চাবি

নিয়ে যাবি কে আমারে...

আচ্ছা, চাবি ভাঙলে তালা খুলবে কেমনে? আমারে তো তালা ভেঙে নিতে হবে রে সই...হা হা হা...

তারিখ: ০৩-০৯-১৯৯৮

কী করব বুঝতে পারতেছি না। সেজপার বাসা একটা সার্কাস। অনেক রাত পর্যন্ত অ্যাডের লোকেরা কাজ করে। আর বেলা পর্যন্ত ঘুমায়। ঘর নাই দেখে আমিও ঘুমাতে পারি না। সেজপাও চাকরি করে। তাই আমি সারা দিন একাই। কিন্তু সন্ধ্যার পর নিজেকে লুকানোর জায়গা খুঁজে পাই না। অনেক মানুষ আসে।

আগে শুটিং দেখতে ভালোই লাগত। এখন আর লাগে না। ওরা কেমন করে যেন তাকায়। তার ওপর একটু পরপর চা দাও, পানি দাও...। একটা চাকরি যদি পাইতাম, কোনো হোস্টেলে গিয়ে উঠতাম।

তারিখ: ০৮-০৯-১৯৯৮

আজ একটা কাণ্ড হইছে। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে সকালে গেছিলাম মোহাম্মদপুরে। দুপুরে বাসায় আসছি। ফ্ল্যাটের একটা চাবি আমার কাছেও আছে। দরজা খুলে দেখি, ছি! দুলাভাই, সাথে একটা মেয়ে। মেয়েটাকে আগেও দেখেছি। মডেলিং করে।

দুলাভাই উল্টা আমাকেই গালিগালাজ শুরু করলেন, যেন অসময়ে চলে এসে আমিই অপরাধ করেছি। সত্যিই খুব ভয় পাইছি তাঁর এই রূপ দেখে। সেজপাকে কী বলব?

তারিখ: ১৫-০৯-১৯৯৮

দুলাভাই সেজপাকে কী বলছে, কে জানে! সেজপা এখন আমাকে সহ্যই করতে পারতেছে না। খালি অপমান করে। কত মানুষ মরে, আমি মরি না কেন?

তারিখ: ১৬-১০-১৯৯৮

বড়পা আসছিল। বলল, আম্মার শরীরটা ভালো না।

তারিখ: ১৭-১০-১৯৯৮

আজ আম্মাকে দেখতে ভাইয়ার বাসায় গেছিলাম। ভাবি আমাকে দেখে খুশি হয়ে গেল। বলল, ‘ভালোই হইছে তুমি আসছ। দুদিন ধরে রহিমার মা আসে নাই। কাপড়গুলা ধুয়ে দিয়ে যাও।’

ভাবির কথায় এত কেন খারাপ লাগল, বুঝলাম না। সেজপার বাসায়ও তো সব কাজ আমিই করি। যখন কাপড় ধুইতেছিলাম, কলের চেয়ে মনে হয় আমার চোখ দিয়েই বেশি পানি পড়তেছিল।

তারিখ: ০২-১১-১৯৯৮

দুলাভাই বলেছে, অ্যাডে কাজ দেবেন আমাকে। সাবানের অ্যাড। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিলাম, বিশাল এক বাথটাবে সাবানের ফেনার মধ্যে আমি বসে সাবান ঘষে ঘষে গোসল করতেছি। আর সবাই ঘিরে ধরে ভিডিও করতেসে—ছি...!

দুলাভাই মনে হয় আমার চিন্তা ধরতে পেরেছিলেন। তাই বললেন, ‘না না, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। নায়িকা থাকবে, ওই গানের সাথে নেচে নেচে গোসল করবে। তুমি শুধু আর দুই–তিনটা মেয়ের সাথে পানি ছিটাবা, সখী।’

তারিখ: ০৯-১১-১৯৯৮

আজ কাপড় ধুয়ে এত কাহিল হয়ে গেছিলাম যে আপার ঘরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙতেই দেখি দুলাভাই আমার ওপর ঝুঁকে আছেন। চিৎকার দিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসতেই আপা রান্নাঘর থেকে চেঁচাল, ‘কী রে, কী হয়েছে? ঘুম ভাঙল?’

‘রুমা মনে হয় দুঃস্বপ্ন দেখতেছিল’, চট করে উঠে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন দুলাভাই।

তারিখ: ১০-১১-১৯৯৮

বড়পার বাসায় গেছিলাম আজ। সব বললাম। আপা কিছুই বলল না। শুধু মাথা নিচু করে বসে থাকল। এমন সময় আপার শাশুড়ি এসে বললেন, ‘কেমন আছ, মা?’

 ‘আসসালামু আলাইকুম। ভালো, খালাম্মা; আপনি কেমন আছেন?’

 ‘এই তো মা, চলছে কোনোমতে। হাঁটুর ব্যথাটা বাড়ছে। তুমি কিন্তু দুপুরে খায়া যাবা।’ আমার সাথে থাকা ব্যাগটা দেখেই মনে হয় কথাটা বললেন।

 ‘খালাম্মা, আমি কটা দিন থাকতে আসছি।’

 ‘না না, বাসায় দুই–দুইটা অবিবাহিত ছেলে আছে আমার। তোমার তো থাকা চলবে না। তুমি বরং চলে যাও।’ আপা তেমনি মাথা নিচু করে বসে থাকল।

আজব! ওনার ছেলে অবিবাহিত তো আমার কী? আল্লাহ নেয় না কেন আমারে?

তারিখ: ১৫-১১-১৯৯৮

কালকে আপা আমাকে ডায়েরি লিখতে দেখে ফেলছে। কানটা এত জোরে মোচড় দিছে যে চোখে পানি চলে আসছিল। রান্না চুলায় দিয়ে বাজে কাজে সময় নষ্ট করতেছি—এই হইলো অপরাধ। হায় রে! তিনজন মানুষ আমরা অথচ শত মানুষের রান্না করতে হয়। আপার হাতে ডায়েরি পড়ার আগে তাড়াতাড়ি বাথরুমের পানির ড্রামের পেছনে লুকায়ে ফেলছি। এখন থেকে বাথরুমে বসেই লিখতে হবে।

তারিখ: ০৫-১২-১৯৯৮

আমার একটা চাকরি হইছে। কম্পিউটার অপারেটর। ডাটা এন্ট্রির কাজ। ছোটখাটো চাকরি। দশটা–পাঁচটা অফিস। দুই হাজার টাকা বেতন। ডিগ্রি পাস মেয়ের জন্য এ–ই অনেক।

আপাকে বলতেই হাসল, অপমান করল, ‘ছি! এটা কোনো চাকরি হলো!’

দুলাভাই তো সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘তোমার চাকরি–ফাকরি করার দরকার নেই। তোমার কাজের ব্যবস্থা আমি করব।’

তারিখ: ১১-১২-১৯৯৮

ঠিক করছি, চাকরিটা আমি করব। গোপনে। তা ছাড়া বেঁচে থাকার আমার আর কোনো পথ খোলা নাই। যা দুইটা টাকাই পাই না কেন, তা দিয়েই নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। এখান থেকে পালাতে হবে। শঙ্খনীল কারাগার।

কাল চাঁদনি চক যাব। কাপড় কিনতে। দু–তিনটা জামা বানাতে হবে অফিসে যাওয়ার জন্য। আমার ভালো কোনো জামা নাই। যা আছে তা পরে অফিস যাওয়া চলবে না। জমানো ৫০০ টাকা আছে। আপার থেকেও কিছু টাকা পাওয়া যায় নাকি দেখি। ছুরি কিনতে হবে একটা। আপার ছুরিগুলোর একটাতেও ধার নাই। কাটাকাটি করতে খুব অসুবিধা হয়। কালকে আম কাটতে গিয়ে হাত কেটে গেছে অনেকখানি।

তারিখ: ১২-১১-১৯৯৮

আজ চাঁদনি চক থেকে ফিরে দেখি, দুলাভাই বাসায়। সাথে আরেকটা লোক। আমি ভেতরে চলে যাচ্ছিলাম, দুলাভাই বললেন, ‘রুমা, সাব্বিরকে চিনতে পারোনি। এদিক আসো।’

গেলাম। কাপড়ের ঝোলাটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখারও সময় পেলাম না। চিনতে পারলাম। কোন নাকি এমপির ছেলে। কালো কুচকুচে মুখের মধ্যে লাল টুকটুকে চোখ।

 ‘আসসালামু আলাইকুম’, বললাম ক্লান্ত আমি।

 ‘আমাদের জন্য চা করো তো! আমি একটু আসছি।’ বলেই দুলাইভাই জোর কদমে বেরিয়ে গেলেন। আমার মাথা ফাঁকা লাগতেছে। বুঝতে পারলাম, বাসায় শুধু আমি আর কুচকুচে কালো সাব্বির। ব্যাগটা তখনো আমার কাঁধে। চট করে আমিও তিনলাফে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। কেন এমন করলাম, তা জানি না। কিন্তু খুব ভয় করতেছে। হাত–পা ঠক ঠক করে কাঁপতেছে। যদি বাথরুমে ডায়েরি না রেখে ফোনটোন লুকিয়ে রাখতাম, তাহলে এখন কাজে দিত। বসে বসে ডায়েরি না লিখে পুলিশকে ফোন করতে পারতাম। ইশ্‌! বাথরুমের দরজা মনে হচ্ছে ভেঙে ফেলবে। এমন করে বাড়ি মারতেছে।

আল্লাহ আমারে রক্ষা করো, নয়তো মেরে ফেলো, এখনই। কাপড়ের ভেতর ছুরিটা তো আছে, না? মেয়েরা বোধ হয় বুঝতে পারে...

বিশেষ দ্রষ্টব্য

বরাবর,

সম্পাদক,

আমি সুমন। ম্যাট্রিক পাশ খবরের কাগজ বিক্রি করি। পড়ার অভ্যাস আছে। এই ডায়েরিখানা পড়েছি। শেষের আরও কয়েকখানা পাতা ইঁদুরে খেয়ে ফেলেছে, একটু পানির দাগও আছে, পড়ার উপায় নাই। তারিখ দেখে মনে হয়, এটা মেলা দিন আগের। তারপর কী হলো মেয়েটার? মনে হলো তার সাহায্যের প্রয়োজন। আহা রে! মেয়েটা নিজেই মরে গেল নাকি মেরে ফেলেছে ওই এমপির পুতেরে? এটা জানার জন্য এই ডায়েরি আপনাদের কাগজের অফিসে পাঠাইয়া দিলাম। আপনারা শিক্ষিত মানুষ। যদি মেয়েটার জন্য কিছু করতে পারেন তো করেন।