প্রতিচ্ছায়া

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘অ্যাই, এটা শিমুল না?’ তানজি আপা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন।

আমি সদ্য সিনেমার সেটে ঢুকেছি। বেশ কদিন আসা হয় না এদিকে। আজ অনেক দিন পর বেশ আচার না হোক, কাপড় শুকানোর মতো রোদ উঠেছে। দুপুরের খাবার খেয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়তে ভালো লাগে না বলে পায়চারি করতে করতে ভাবলাম, একটু ঢুঁ মেরে আসা যাক।

আমার প্রকাশনা দপ্তর থেকে পাঁচ মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ। দুপুরের এই সময়, যান চলাচলও একদম সীমিত; পুরো পাড়ায় কেমন একটা ঘুম ঘুম ভাব নেমে আসে। তারই মধ্যে আমি, কিছুটা ঘুম তাড়ানোর তাগিদেও বটে, মাভৈঃ বলে পথে নেমে পড়ি। শীতের মিষ্টি রোদ; পাঁচ মিনিটের পথ অন্তত সাড়ে সাত মিনিট ধরে হাঁটব—এমন সংকল্প সত্ত্বেও পৌনে চার মিনিটেই দিব্যি পৌঁছে গেলাম!

সেটের মূল দরজা দিয়ে ঢুকেছি, একটা বারান্দার মতো উঁচু জায়গায় পরবর্তী শট নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। ওখানেই দাঁড়িয়ে আছেন তানজি আপা। এই সিনেমার মূল নারী চরিত্র তিনি, শহরে এখনো যার গাড়ি চলে গেলে ভক্তরা ঘণ্টাখানেক জটলা করে থাকে। বয়স চল্লিশের কোঠায় হলেও কলেজছাত্রীর চরিত্রে তাকে অনায়াস মানিয়ে যায়।

পরনে সরু পাড়ের হালকা নীল শাড়ি। বরাবরের মতোই মাঝখানে সিঁথি, ঘাড় ছোঁয়ানো হাতখোঁপা করেছেন। দুই হাতে দুই গোছা করে আটপৌরে সোনার চুড়ি, ছোট্ট কালো টিপ আর চট করে চোখে পড়ে না, এমন আকারের বসানো কানফুল। চরিত্রের স্বার্থেই বোধ হয়, তানজি আপার পা খালি। তাকে আগে কখনো পর্দার বাইরে দেখিনি আমি। খালি পা বলেই কি না কে জানে, এই কান্ত দেহসৌষ্ঠব ছাপিয়ে, আমার দৃষ্টি আটকে গেল তার পাদুকাবিহীন পায়ের দিকে।

গুরু দত্তের সাহেব-বিবি-গোলাম ছবির কথা মনে আছে আপনাদের? মীনা কুমারীকে যখন প্রথম দেখলেন গুরু দত্ত, প্রথমেই মুখের দিকে তাকাতে পারেননি; তার দর্শন শুরু হয়েছিল পা থেকে। আমারও কেমন দেবীদর্শনের অনুভূতি হলো তানজি আপার দিকে তাকিয়ে। সেটে রাখা কি–লাইটের অর্ধেকটা আপার মুখের ওপর পড়েছে, খানিকটা বোধ হয় আমার গায়েও। ব্যালকনির আদলে তৈরি উঁচু পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, আমি একটু নিচু ফাঁকা সমতলে।

কপালে হাত ঠেকিয়ে, চোখে পড়া আলো আড়াল করে তানজি আপা অদ্ভুত চোখেই তাকালেন আমার দিকে; তাকিয়েই রইলেন। তারপর, দু–এক পা এগিয়ে ভয়ানক আশ্চর্য হওয়া স্বরে বললেন, ‘এটা শিমুল না?’

তানজি আপার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন বর্ষণ। বলে উঠলেন, ‘আপা, উনি তো মলি আপা; শাল্মলী ফেরদৌস। আপনাকে বলেছিলাম না? আমাদের পাবলিসিটির আদি–অন্ত ওনারাই তো দেখছেন!’

সিনেমার তরুণ পরিচালক বর্ষণের সঙ্গে পেশাগত সখ্যের বাইরে আরেকটি সম্পর্ক আমার আছে। বর্ষণের বাবা বিষ্ণু স্যার ছিলেন আমার গণিতের শিক্ষক। আমার কৈশোরে, সল্টেড বিস্কুট চিবোতে চিবোতে আর বিষ্ণু স্যারের কাছে অঙ্ক করতে করতে শিশু বর্ষণকে আমি দেখেছি মল–মূত্র আর বাটিভরা সুজি একাকার করে ফেলতে। এখন বর্ষণ যতই ‘সম্ভাবনাময় তরুণ পরিচালক’ খেতাব কুড়াক না কেন, আমার কাছে সে বিষ্ণু স্যারের বাচ্চা ছেলেটাই। কিছুটা স্নেহের বশেই বর্ষণের কাজকর্মে সব সময়ই আমার একটা প্রচ্ছন্ন ‘হ্যাঁ’ থাকে। সে জন্যই আমার সব সময় প্রয়োজন না থাকলেও বর্ষণের ছেলেমানুষি আবদারে আসতেই হয়। কী জানি, তার কেন এত পছন্দ আমাকে, আমি একদিন না গেলে নাকি তার সত্যিকারের ‘শুভ মহরত’ হচ্ছে না।

যে তানজি মাহমুদকে সব সময় পর্দা কাঁপিয়ে অভিনয় করতে দেখেছি, যার অভিনয়কে আমার বাস্তব মনে হয়, তার বাস্তব সংলাপ শুনে কিন্তু আমার এবার মনে হয়, সব্বোনাশ! কোনো অভিনয় হচ্ছে না তো?

তার সামনে দাঁড়িয়ে, বোকার মতো গায়ে চিমটি কাটাটা খুব শোভন দেখায় না বলে শুধু নিজের ভ্রু জোড়া আরেকটু ওপরে তুলে, আমি যে আদৌ ঘুমিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখছি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত থাকার চেষ্টা করি।

তানজি আপা বলেই চলেছেন, ‘সত্যিই আপনি শিমুল নন? কিন্তু কী মিল! কী চেহারা, কী তাকানো, কথা বলা! আর দেখো বর্ষণ, শিমুল ঠিক এভাবেই চূড়া করে চুল বাঁধত!’

আমি হাসি। খুব অবাক হই না। এমন তো নয় যে কেউ আমাকে দেখে কোনো দিন ‘চেনা চেনা লাগছে’ বলেনি। কিন্তু তারা কেউ তানজি আপা নয়! যা হোক, তানজি আপা বলতে থাকেন। আমি শুনছি, যেন কোনো শব্দ হচ্ছে না কোথাও। শুধু দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি।

বর্ষণের শুটিং ফ্লোরটা একটু অন্ধকার। শীতের শেষ বলেই কি না কে জানে! নাকি আসবাবের ধুলায়; চারদিকে কেমন একটা ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব। কি–লাইটটা স্পটলাইটের মতো আপার চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। যেন প্রোসেনিয়ামের মাঝখানে একলা দাঁড়িয়ে আছেন তানজি আপা। চলছে একক অভিনয়। শিমুলের কথা বলছেন তানজি আপা, যাকে আমি কোনো দিন দেখিনি। অথচ তিনি বলছেন, আমি তার মতোই দেখতে। শিমুলকে চিনি না আমি, অথচ আমি শিমুলের প্রতিচ্ছবি বলেই আমাকে চেনা চেনা লাগছে আপার! আমিই আমার প্রতিবিম্বকে চিনি না? কোনো দিন, আমাদের দেখা হয়নি, অথচ আমরা একদম এক রকম?

তানজি আপার বর্ণনার শেষ অংশটা শুনতে পাই, ‘আপনি যেমন দাঁড়িয়েছেন, হাত দুটো সামনে এনে, বাম হাতের পাঞ্জা দিয়ে ধরে রেখেছেন ডান হাতের কবজি, ঠিক এভাবেই দাঁড়াত শিমুল। এভাবেই তাকিয়ে থাকত, যেমন আপনি তাকিয়ে আছেন, স্থির। হেঁটে আসত, কোনো শব্দ হতো না, তবু আমি কিন্তু বুঝতে পারতাম, শিমুলই আসছে!’

কথা বলতে বলতে তানজি আপা নিজেই, কেমন খাপছাড়াভাবে থেমে যান। যেন তার অভিনীত সিনেমার মতো, সুলিখিত চিত্রনাট্যের মতো ঠিক এখানেই থেমে যাওয়ার কথা ছিল তার। ঘোর কাটাতে তার মাত্র কয়েক সেকেন্ডই লাগে, গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন, ‘অ্যাই কে আছ? বেশ আদা দিয়ে এককাপ চা দাও তো। এত গলা খুসখুস করছে আজ!’

যেমন তুমুল বেগে কথা শুরু করেছিলেন, তেমন ঝড়ের বেগেই চলে গেলেন। আমি তখনো তানজি আপার শেষ কথাটার রেশের মধ্যে আছি। খেয়ালই করিনি কখন বর্ষণ এসে পাশে দাঁড়িয়েছে।

‘আপনি খেয়েছেন দুপুরে?’ বর্ষণ প্রশ্ন করে।

‘হ্যাঁ, খেয়েই বের হয়েছি।’ আস্তে করে বলি আমি।

‘আচ্ছা, এককাপ চা খাই চলেন’, ধোঁয়ার আড়ালে চা খেতে খেতে শিমুলের বাকি গল্পটা বলে বর্ষণ, ‘তানজি আপার পিঠাপিঠি ছোট বোন শিমুল। বছর পাঁচেক আগে, ২০১৮ সালের শেষ দিকে...’

আমি যোগ করি, ‘মানে, কোভিড-১৯ শুরু হয়নি?’

বর্ষণ তাকায় আমার দিকে, ‘হুম, অফিশিয়ালি শুরু হয়নি তখনো।’

বর্ষণ বলতে থাকে, ‘ডিসেম্বর মাস। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোয় বেশ ঠান্ডা। শিমুল আপা বেড়াতে গেলেন টাঙ্গাইলে। মির্জাপুরের দিকে একটা গ্রাম। নামটা ‘ভ’ দিয়ে শুরু, উমম, নামের মধ্যেই ‘গ্রাম’ শব্দটা আছে।’

চমকে উঠি আমি, ‘ভাতগ্রাম?’

বর্ষণ অবাক হয়, ‘চেনেন নাকি আপনি?’

কত কী মনে পড়ে আমার! বলি, ‘হুম, চিনি তো! যাক গে, কী যেন বলছিলে তুমি?’

বলতে থাকে বর্ষণ, ‘তো, শিমুল আপা গেলেন ভাতগ্রামে। অফিশিয়াল কোনো কাজে, সেখানে নাকি দুদিন থাকতে হবে।’

সে কথা বলছে, আমি অন্যমনস্ক। আমাকে অন্যমনস্ক দেখেই কি না জিজ্ঞেস করে বর্ষণ, ‘আপনি শুনছেন মলি আপা?’

আমি কি একটু চমকে যাই। ‘হ্যাঁ, শুনছি তো! বলো না…’

বর্ষণ একটু তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার বলে, ‘শিমুল আপা প্রথম দিন ঠিকঠাকই ছিলেন। কিছু তথ্য সংগ্রহের কাজ করেছেন, বাকি সময়টা আশপাশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ফেসবুকে ছবিও দিয়েছিলেন।’

একটু থেমে এবার ধরে আসে বর্ষণের গলা, ‘ওগুলোই শিমুল আপার আপলোড করা শেষ ছবি।’

‘শেষ ছবি কেন?’ আমি প্রশ্ন করি।

বর্ষণ বলে, ‘কারণ, পরদিন সকাল থেকে শিমুল আপাকে পাওয়া যায়নি আর। রাতে নাকি ঠিকঠাক খেয়েদেয়েই ঘুমিয়েছিলেন। সকালে অন্য সবাই ঘুম থেকে উঠেছে। নিজেদের মতো তৈরি হয়েছে। সবাই ভেবেছে, শিমুল আপা হয়তো কাছেই কোথাও আছেন, হয়তো গ্রামের ভোর দেখছেন। কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও যখন কোথাও তাকে দেখা গেল না, তখন সহকর্মীরা ফোন করে দেখে, ফোন বন্ধ। আস্তে আস্তে খোঁজা শুরু হলো, বেলা গড়াল। দুপুরের পর তানজি আপাও গিয়ে পৌঁছালেন সেখানে। পুলিশ গেল। পুকুরে খোঁজা হলো। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হলো, শিমুল আপাকে সকালবেলায় দেখেছে, এমন একজন মানুষও কোথাও পাওয়া গেল না! সেই থেকে তানজি আপা কেমন বদলে গেছেন।’

‘কত তারিখ ছিল, মনে আছে তোমার?’

‘না, আপা। এত বিস্তারিত তো মনে নেই। তবে হ্যাঁ, পত্রিকায় এসেছিল খবরটা।’

ফোন হাতে নেয় বর্ষণ। গুগল ঘেঁটে বের করে সংবাদটা; মির্জাপুরের ভাতগ্রামে, বেসরকারি সংস্থার কর্মী নিখোঁজ।

খবরে চোখ বোলায় বর্ষণ, ‘এটা ১০ ডিসেম্বরের ঘটনা। পত্রিকায় খবরটা এসেছিল ১১ ডিসেম্বর।’

আমিই ইতি টানি গল্পের, ‘আমাকে এখন যেতে হবে। মেলা কাজ ফেলে এসেছি!’

একটু তাড়াহুড়া করেই কি চলে আসি আমি? কিন্তু আমি অফিসের দিকে যাই না, সরাসরি বাসায় চলে আসি। সারা দিনের কাজকর্ম খুব অল্প করে হলেও প্রতিদিন লিখে রাখা আমার বহু বছরের অভ্যাস। আমি ড্রয়ার থেকে ২০১৮ সালের ডায়েরি বের করি—

১০ ডিসেম্বর, ভাতগ্রাম, মির্জাপুর

একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল আজ সকালে। স্বপ্নটা এমন—আমি হাঁটছি গ্রামের পথ ধরে। আর পাঁচটা গ্রাম যেমন হয়, তেমনই। ঘন সবুজ, ধানখেত, কাঁচা বা আধা পাকা বাড়িঘর। মাটির রাস্তা ধরে হাঁটছি। হঠাৎ মনে হলো, আমি হারিয়ে গেছি। কোনো দিকে, কোনো কিছুই চিনতে পারছি না, ফেরার কোনো রাস্তা জানা নেই আমার! আতঙ্কে অস্থির হয়ে দেখছি চারদিকে, চিৎকার করে কাউকে ডাকার চেষ্টা করছি, কিন্তু কোনো শব্দ বের হচ্ছে না গলা দিয়ে। আমার ঘুম ভেঙে যায়। বুঝতে পারি, এই ভীষণ শীতের মধ্যেও ঘেমে গেছি আমি।

মনটা এমন অস্থির হয়ে ছিল আজ, তাই ঘর থেকে বের হইনি সারা দিন। হালকা বইপত্র পড়ে সময় কাটানোর চেষ্টা করলাম।

এখন ব্যাগ গোছাব। কাল যতটা সকালে সম্ভব রওনা হব ঢাকার দিকে।