অহর্নিশ

দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে ঈদের খুশি। আর কদিন পরেই বাঁকা চাঁদ উঠবে আকাশে। ঈদ আয়োজনে এ সংখ্যা সাজানো হয়েছে এ সময়ের গল্পকারদের একগুচ্ছ গল্পের সমাহারে।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

আমার ধারণা ছিল নির্বাণ লাভ করে দরবেশ দশায় চলে গেছি, কিন্তু এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে। আসন্ন হার্টব্রেকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। নিজেই নিজেকে শান্টিং দিচ্ছি, ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হওয়ার জন্য রেডি হও ডিয়ার অথই! প্রথমে টেরই পাইনি, কিন্তু কীভাবে যে সে অক্সিজেনের মতো আলগোছ, অনায়াস এবং অবারিতভাবে আমার সমস্ত সত্তার ওপর রাজত্ব কায়েম করে ফেলল, তা এক রহস্য। এখন আর কিছুই করার নেই। পেটের মধ্যে একটা গিট্টুলাগা ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। টানটান হয়ে থাকতে হবে তার কণ্ঠস্বরের অপেক্ষায়, ঝনঝন করে বাজতে হবে দেখা পাওয়ার আশায়।

মেলবোর্নের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত এলাকাগুলোর একটা হলো টুরাক। এখানে একটা প্রাচীন বাড়ির দোতলায় এক বেডরুমের গরিব অ্যাপার্টমেন্টে থাকি আমি আর আমার বিড়াল মিউ। আমাদের আর কেউ নেই। বাথরুম স্যাঁতস্যাঁত করে, সিলিংয়ে মোল্ড জমেছে। রান্নাঘর চরম চিপা। প্রায়ই ভাবি অন্য কোথাও উঠে যাব। কিন্তু সামনের ছোট্ট ব্যালকনিটার কারণে পারি না। সেখানে ছায়া দিয়ে রেখেছে একটা জ্যাকারান্ডাগাছ। গরমকালে বেগুনি ফুলে ছেয়ে যাওয়া গাছটা দেখতে দেখতে মনে ভাসে আশির দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর ভিসির বাড়ির মাঝখানের আইল্যান্ডে দাঁড়ানো কৃষ্ণচূড়াগাছটা, যার লাল-হলুদ পাপড়ি ছড়িয়ে থাকত রাস্তাজুড়ে আলপনার মতো। এই অনাত্মীয় শহরে গাছটাই আত্মীয়। মায়ের চেয়ে বেশি ছায়া দিয়ে রাখে সে আমাকে।

তার গায়ের ওপর ছেড়ে দিলাম নিজেকে। যেন যা কিছু করার সে-ই করবে। বমি করার সময় পরম মমতায় সে আমার কপাল ধরে থাকল। রুমাল ভিজিয়ে মুখ মোছাল। উবারে তার গায়ের ওপর লেপটে ঘুমাতে ঘুমাতে ফিরেছিলাম।

গত কয়েক সপ্তাহ রুদ্ধশ্বাস ওড়াউড়ির মধ্যে গেল! এত উচ্ছ্বাস! ৪৮ বছর বয়সে আবার আমি টিনএজার। সপ্তাহখানেক আগে, দোলপূর্ণিমার পরের দিন, সারা রাত না ঘুমিয়েও কিছুতেই এনার্জি কমানো যাচ্ছিল না। ফোন রাখার সময় দেখলাম ছয় ঘণ্টা ধরে বকরবকর করেছি! কী কথা তার সাথে, তাহার সাথে! ইশ্! শাওয়ারে ঢুকেও তার ঘুমজড়ানো কণ্ঠস্বর আর ঘন নিশ্বাসের শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম। পানির অবিরল স্পর্শে আমার আত্মা বেঁচে উঠছিল। আমার সারা দুনিয়া অয়ন নামের একটা বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে। যেখানে যখন থাকার কথা সেখানে আর আমি নেই। সেদিনও বের হতে দেরি হলো।

ধুপুরধাপুর লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। অন্যান্য দিন আমি চলি কুচিমুচি হয়ে, মাটিতে চোখ নামিয়ে। সেদিন ফাটা পোস্টার নিকলা হিরো স্টাইলে বিড়ালের চামড়ার জিপার খুলে সিংহ বের হয়ে গটগটায়ে হাঁটছিল যেন বাপের রাস্তা! ততক্ষণে রোদ উঠে গেছে। গাছের কচি পাতার ভেতর থেকে আলো ঠিকরাচ্ছে। পাখিগুলো মহা অস্থির আলাপ শুরু করেছে। ইশ্ অয়ন! কী যে করলেন আপনি আমারে! নিজের মনেই কথা বলছিলাম তার সঙ্গে। হার্টবিটের সঙ্গে তাল রাখার জন্য ঝেড়ে দৌড় দিতে ইচ্ছা করছিল অথবা একপাক নেচে নিতে। হিন্দি সিনেমায় প্রেমে পড়লে কেন আকাশ-বাতাস থেকে গান ভেসে আসে আর নায়ক-নায়িকা কেন এত দৌড়ায় এখন বোঝা যাচ্ছে।

নাহ্‌, সাবধান হও অথই! আনন্দ সিনেমায় রাজেশ খান্না কী বলেছিল, মনে নেই? ‘বাবুমশাই, এত ভালোবাসা ভালো নয়!’ সে তোমার চেয়ে ১৮ বছরের ছোট। যখন সে সদ্যোজাত, তুমি তখন সাবালক। সে জিয়াউর রহমানের শাসনকাল জানে না, বিটিভির প্রতিটি খবরের আগে রাষ্ট্রপতি লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ব মোরা’ দেখেনি, গ্রীষ্মের ঝাঁ ঝাঁ রোদে বারান্দায় বসে ডাকপিয়নের জন্য অপেক্ষা কেমন, সে জানে না। এক অধিকল্প বিছিয়ে আছে আমাদের মধ্যে। 

এত সব গরমিলে পার হয়েও তার কণ্ঠস্বর নিরালা-নির্জন দুপুরে দূর থেকে ভেসে আসা নিরবচ্ছিন্ন ঘুঘুর ডাকের মতো একটা বিষণ্ন আপনবোধে আচ্ছন্ন করে আমাকে। প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে ঠান্ডা জলপট্টির মতো প্রশান্তিময় তার স্পর্শ আমি মনে করতে পারি।

চার সপ্তাহ আগের শনিবারে ব্যালকনিতে ঠিক আমার সামনের চেয়ারটায় সে বসেছিল, যেখানে মিউ এখন গোল্লা পাকিয়ে কান খাড়া করে শুয়ে আছে। হাতে চায়ের মগ, চোখ মেলে দেওয়া রেলিংয়ের ওই পাশে দোদুল্যমান জ্যাকারান্ডাগাছের শাখায়। কী দেখছিল সে? সকালের স্নিগ্ধ মায়াময় বাতাস আলগোছে পরিপাটি বিলি কাটছিল চিরল পাতায়। বেগুনি ফুলগুলোর ছায়া দুলছিল বারান্দাজুড়ে। আমি দেখছিলাম তাকে ঘিরে আলোছায়ার খেলা। চারকোনা কালো ফ্রেমের চশমার ভেতরে গহিন উজ্জ্বল চোখ। বিষণ্ন? অস্থির? একদম কাছ ঘেঁষে তার দিকে মুখ করে বসেছিলাম আমি, তার গায়ের তাপ অনুভব করছিলাম। তার নিশ্বাসের আঁচ এসে লাগছিল কোলের ওপর ফেলে রাখা আমার হাতের ওপরে। বাঁ গালের ওপরে চশমার ফ্রেমটা যেখানে শেষ হয়েছে, তার নিচে, খাড়া ঋজু নাকের ঠিক পাশে, গালের প্রান্ত ছুঁয়ে কালো তিলটা চুম্বকের মতো টানছিল আমাকে।

আমার দৃষ্টি দিয়ে তাকে স্পর্শ করা সে-ও টের পেয়েছিল। আমার দিকে ফিরে দৃষ্টি ছুঁয়ে থাকল চোখে চোখ ফেলে। যেন আমার মনের বিস্মৃত আর ধুলায় ধূসর তালাগুলো খুলে যাচ্ছে, যা কিছু আমি নিজেও জানি না অথবা ভুলে গেছি, দিনের আলোর মতো সহজে ধরা দিচ্ছে তার কাছে। পেটের ভেতর কয়েক লাখ প্রজাপতি ডানা ঝাপটাচ্ছিল, বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে বেরিয়ে আসছিল কাঁপা কাঁপা নিশ্বাস। ধীর সহজ প্রশ্রয়ের হাসি তার সারা মুখে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। সস্নেহ, কোমল, গভীর স্বরে মুখটা সামনে এগিয়ে নিয়ে এসে, ভ্রু সামান্য ওপরে তুলে সে টেনে টেনে উচ্চারণ করেছিল ‘কীইইই!’ চমকে উঠে তার চোখ থেকে সরিয়ে নিয়ে ঝাপসা দৃষ্টি সামনের রাস্তায় পাঁচ বাচ্চাসহ হাঁসের হেলেদুলে হাঁটার দিকে ফোকাস করতে করতে উত্তর দিলাম, ‘কিছু না।’ সে শব্দ করে হেসে উঠে হাতের চায়ের মগ মাটিতে নামিয়ে রেখে চেয়ারে আধশোয়া ভঙ্গিতে বসে জিনস পরা খালি পা মেলে দিল সামনে। আমার লম্বা স্কার্টের ঝুল মিশে যাচ্ছিল তার পায়ের পাতায়। আমরা ভান করলাম খেয়াল করিনি।

তার চুলে, ঘাড়ে এসে পড়েছিল সূর্যের নরম আলো। কমলা রঙের টি-শার্ট টানটান হয়ে আছে কাঁধ আর বাহুর সীমানায়। টি-শার্টের বুকের কাছে এক জোড়া ঝুলন্ত জুতার ছবি। তার এক পাটিতে লাল-কালো-সবুজে লেখা, ‘ফ্রিডম ইজ আ হিউম্যান রাইট’, আরেক পাটিতে, ‘অল লাইভস আর ইকুয়াল’। জানতে চাইলাম, এই টি-শার্ট ফিলিস্তিনের সমর্থনে কি না।

প্রশ্ন শুনে একঝটকায় টানটান উঠে বসল সে। একমুহূর্ত আগের শৈথিল্য ঝরে গিয়ে অস্থিরতা দখল নিল তার। ক্রিকেটার উসমান খাজার কথা জানাল আমাকে। পাকিস্তানের সঙ্গে টেস্ট ম্যাচ খেলার সময় বাহুতে তিনি কালো কাপড় বেঁধেছিলেন ফিলিস্তিনের সমর্থনে, প্র্যাকটিসের সময়ে তাঁর জুতায় লেখা থাকত টি-শার্টের এই স্লোগানগুলো। তা নিয়ে আইসিসির নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে টি-শার্ট ডিজাইন করেছেন খাজা। বিক্রির সব অর্থ দিয়ে গাজায় ত্রাণ পাঠানো হবে। 

আমি মুগ্ধ দেখছিলাম তার চোখে-মুখে চাপা রাগ আর অসহায়তা। হাত নাড়ার ভঙ্গি। অস্থির পায়চারি। শক্ত করে চেপে ধরা বারান্দার রেলিংয়ে কাঁপতে থাকা হাতের পাতা। সে যখন বাবার কোলে মৃত শিশুকন্যার কথা বলছিল, তার কপালের পাশের রগ দপদপ করছিল। আমরা রিফাত আলারিরের কবিতা উচ্চারণ করলাম নিশ্বাসদূরত্বে দাঁড়িয়ে। গণমাধ্যমে কেট মিডলটনের অন্তর্ধান নিয়ে তোলপাড়ের সমান্তরালে গাজায় হাজার হাজার শিশুহত্যার বিষয়ে নীরবতার রাজনীতি নিয়ে কথা বললাম। একসঙ্গে রান্না করার সময় ছোটবেলায় ফিরতে ফিরতে দেখলাম আমার আশির দশকের ঢাকা আর তার শূন্য দশকের মফস্‌সল পাশাপাশি স্বাচ্ছন্দ্য।

সারা দুপুর তাকে পড়ে শোনালাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে নাজিম হিকমতের কবিতা আর রিলকের লেটারস টু আ ইয়াং পোয়েট, ‘একজন মানুষের পক্ষে আরেকজনকে ভালোবাসাই হয়তো জগতের সবচেয়ে কঠিন কাজ…’,  সে সোফায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে শুনল আমাকে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম তার কাঁপতে থাকা চোখের পাতা, চেহারায় খেলে যাওয়া অনন্ত অভিব্যক্তি। সে জানাল, আমার উচ্ছ্বসিত আর আদুরে কণ্ঠস্বর কানের জন্য আরামদায়ক, আমি জানালাম, তার অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী চোখের জন্য স্বস্তিকর। তাকে বললাম, মোনাশ ইউনিভার্সিটির একাডেমিকদের ভেতরকার রাজনীতির কথা, সে বলল, মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে তার স্কলারশিপের কথা। বিকেল গড়াল সন্ধ্যায়, সন্ধ্যা ঢলে পড়ল রাতে। বিদায় নেওয়ার সময় সে আমাকে উপদেশ দিল রাত না জেগে ঠিকঠাক লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘুমাতে, আমি তাকে বললাম সাবধানে রাস্তা পার হতে। সেটা ছিল তার সঙ্গে আমার দ্বিতীয় এবং শেষ দেখা।

প্রথম দেখা ঠিক তার আগের রাতে। সহকর্মীদের সঙ্গে অফিস শেষে একটা পাবে ঢুকেছিলাম। সেদিন খুব কিছু খাওয়া হয়নি সারা দিন, তার ওপর পেটে তরলের মাত্রা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। রাত প্রায় একটা বাজে তখন। সঙ্গের লোকজন যে যার মতো বাড়ি ফিরেছে। আমি টলতে টলতে এসে দাঁড়ালাম ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে। খুব অসুস্থ লাগছিল, বমি পাচ্ছিল। চাঁদটা ক্ষয়ে যাচ্ছিল আকাশে। বাতাসে ধুলা, কুয়াশা আর মেলা ভেঙে যাওয়া ক্লান্ত বিষণ্ন গন্ধ। সারা গা গুলাচ্ছিল আর আমি টালমাটাল হয়ে বমি করার জন্য ময়লার ঝুড়ি খুঁজতে খুঁজতে চিৎকার করে জাতীয় সংগীত গাইছিলাম বাংলায়। তখনই সে এসে ধরে ফেলেছিল আমাকে। বারবার জানতে চাইছিল, ঠিক আছি কি না।

তার গায়ের ওপর ছেড়ে দিলাম নিজেকে। যেন যা কিছু করার সে-ই করবে। বমি করার সময় পরম মমতায় সে আমার কপাল ধরে থাকল। রুমাল ভিজিয়ে মুখ মোছাল। উবারে তার গায়ের ওপর লেপটে ঘুমাতে ঘুমাতে ফিরেছিলাম। আর সে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছিল আমাকে। এখনো ঘুমের ঘোরে আমি তার গায়ের আনকোরা সুতি শার্টের গন্ধ পাই, তার হার্টবিটের শব্দ এসে কানে বাজে, আর চুলে পাই তার হাতের স্পর্শ, তার গায়ের পরিচ্ছন্ন ঘ্রাণে নিজেকে পবিত্র লাগে।

আমার মাতাল কণ্ঠে বেসুরো বাংলা গান শুনেই বুঝেছিল আমি বাংলাদেশের। পরের দিন এসেছিল তার কাছে থেকে যাওয়া আমার পার্সটা ফেরত দিতে; এবং তার পরের দিন, অর্থাৎ রোববার দুপুরে ঘুম ভেঙে আমি তার ফোনে মেসেজ পাঠাতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম। বারবার ফোন করে ফোন বন্ধ পেলাম। এরপরের তিনটা দিন শ্বাসরুদ্ধ গেল। নিজেকে প্রশ্ন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। খুব কি অশালীন কিছু করেছি আমি? শুক্রবার রাতে যদি করেও থাকি কিছু, তখন তো আমি নিজের নিয়ন্ত্রণে ছিলাম না। শনিবার সারা দিন একসঙ্গে ছিলাম, তাকে তো বিরক্ত মনে হয়নি। তাহলে কেন হঠাৎ একদম চুপ?

বুধবার ভোররাত তিনটার দিকে আমার হোয়াটসঅ্যাপে একটা ফুলের ছবি এল তার নম্বর থেকে। নিচে লেখা—ফুলের নাম কানাই বাঁশি। আমি ধড়মড় করে উঠে বসে লিখলাম, ‘কই আপনি?’ জানলাম রোববার ভোরের ফ্লাইটেই সে দেশে গেছে, আমাকে নাকি বলতে ভুলে গেছিল। তিন মাস দেশে থাকবে রিসার্চের কাজে। এরপর কয়েকটা সপ্তাহ স্বপ্নের মতো। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা। সারা রাত জেগে, দিনের বেলা ডিপার্টমেন্টে ঝিমানো। কখনো চুপচাপ ফোন ধরে একজন আরেকজনের নিশ্বাস শুনতাম আর তার সেই গভীর কণ্ঠের, ‘কীইইই!’ একদিন বললাম, ‘অয়ন! আমাকে একটু জড়ায়ে ধরেন তো!’ সে জবাব দিল, ‘সম্মানিতা রাজকন্যা অথই অবন্তিকা, এক সমুদ্র দূর থেকে কীভাবে আপনারে জড়ায়ে ধরব?’ আমি রাগের চোটে তাকে কাঠের টুকরো বলে গালি দিলাম। সে বলল, এই নাম তার ভালো লেগেছে। কারণ, কাঠের টুকরা চিরভাসমান, তার কোনো আশ্রয় নেই।

তিন দিন আগে ফোন রাখার পর একটা কবিতা পাঠিয়েছিলাম তাকে—    

তোমাকে আমি তো আপনি করেই বলি

ঘুমের ভেতরে তুমি হয়ে যাও তুমি

আজ বলছিলে জীবন কেমন

জোনাকির মতো উড়ে উড়ে গিয়ে

নিরেট অন্ধকারের গায়ে

মিটমিট করে জ্বলে...

বলতে বলতে হাসছিলে খুব

কান্নার মতো করে

কত কথা শুধু মুছে মুছে যায়

হাসি দিয়ে ঢেকে রাখি

আমি তো তোমাকে আপনি বলেই ডাকি…

লেখাটা সে দেখেছে, কিন্তু জবাব নেই। প্রথমে খুব অস্থির ছিলাম। আর আজ, তার চুপ হয়ে যাওয়ার তৃতীয় দিনে অবসাদ ঘিরে রেখেছে আমাকে। আবার শনিবার। দিন ফুরাচ্ছে। পাড়া বেড়িয়ে মিউ ফিরল, আমার পায়ের কাছে বসা। তাকে বললাম, ‘আর কোনো দিন দেখব না, নারে?’ মিউ ঘররর শব্দ করে আমার পায়ের আঙুল নিয়ে খেলে।

কলিং বেল বাজল, আর বিদ্যুৎ-তরঙ্গ খেলে গেল আমার শরীরে। দরজায় পৌঁছানোর আগেই বুঝলাম, সে এসেছে। এখানে আর কেউ আসে না! দেখি সিঁড়ির রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে সে দাঁড়ানো। আমি কিছুতেই ঠিকঠাক শ্বাস নিতে পারছি না! চোখ উপচে পানি আসছে। এই রকম পানির ফোয়ারা সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি? সে আস্তে হেঁটে ঠিক আমার সামনে এল। ‘কী খবর সম্মানিতা রাজকন্যা অথই অবন্তিকা?’

‘কেন আমার মেসেজের জবাব দেন নাই!’ এবার ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করেছি।

‘আহহা! দেখো তো কী করে!’ এক হাতে আমার চিবুক তুলে ধরে চোখ মুছে দিল আরেক হাতে। কাঁধ জড়িয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘আর কতকাল আপনি করে বলবা? চলো ঘরে যাই, আর ভেসে থাকতে ভাল্লাগে না!’