ফিলিস্তিনি গল্প
রাতের শেষ ভাগ
দিয়া বারঘুতি একজন দ্বিভাষিক (আরবি, ইংরেজি) ফিলিস্তিনি নাট্যকার ও গবেষক। তিনি ২০২১ সালে লন্ডনের গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটক ও থিয়েটার আর্টসে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি প্যালেস্টাইন আমেরিকান রিসার্চ সেন্টার (পিএআরসি)-এর ফেলো। তাঁর গবেষণা তিউনিসিয়া ও ফিলিস্তিনের স্থানীয় ঐতিহ্য নিয়ে, বিশেষ করে সুফি আচার নিয়ে তিনি কাজ করেন।
• অনুবাদ: মুহসীন মোসাদ্দেক
আমি বসি। উঠি। আবার বসি। সময় হয়ে গেছে। বাইরে একজন চালক অপেক্ষা করছে। আমি নড়ি না। আমার পেটের ভেতর মোচড় দেয়। আমি উঠে দাঁড়াই। ঘরটা একটু গুছিয়ে নেব বলে ঠিক করি। চারপাশে ছড়িয়ে আছে কাগজের টুকরা, আঁকিবুঁকি, শব্দ। সময় যেন অসংখ্য টুকরা হয়ে ছড়িয়ে আছে। আমি সেগুলো ফেলে দিই, ভেবে যে হয়তো এর মাধ্যমে একটা শেষ আসবে। কিন্তু রাত থেমে থাকে না। আমি অপেক্ষা করি। চালকও অপেক্ষা করে। মনে হয় আমরা শূন্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সেই শূন্যতা, যা আসলে শুরু। আমি ভাবি, এ কি অস্তিত্বগত উদ্বেগ? নিশ্চয়ই নয়, বাইরে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আক্রমণকারী তো একই। উদ্বেগের বাইরে কিছু একটা অনুভব করি। হঠাৎ এক মাকড়সা দেখা দেয়। এ-ও তো তার ঘরেই আছে, আমিও যেমন আছি, এখনো সে-ও শিখতে পারেনি দখলের ভাষা।
মনকে অন্যদিকে ফেরাতে আমি বইয়ে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করি। কবিতা, যা বারবার নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। মানুষ সত্যিই বিস্ময়কর প্রাণী! ধ্বংস আর সৌন্দর্য এখানে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। যন্ত্রণার ভেতর সৌন্দর্যও অন্য রূপে রূপান্তরিত হয়। অন্তত এ-ই লিখে গেছেন দ্বাদশ শতকের সেই সাধক। আমি প্রাচীন বাণীতে সান্ত্বনা খুঁজি। আকাশে উড়োজাহাজের গর্জন ভাসে, তাদের শিকাররা খুব কাছাকাছি; এমন জায়গায়, যেখানে শব্দ পৌঁছায় না। এখনো আমি লক্ষ্যবস্তু নই। ফোন বাজে। ধরি। এক কণ্ঠ জানায়—শেষ এসে গেছে। তবু রাত স্থায়ী হয়, নির্দয়ভাবে।
আমি জানালায় যাই। নিশ্চিত তারা আসবে। ঘোষণা তো হয়ে গেছে। চালক হর্ন বাজায়। আমি আবার বসি। কিছু একটা অসম্পূর্ণ মনে হয়। হয়তো আমার এখানেই মারা যাওয়া উচিত। অথবা একটি কবিতার পঙ্ক্তি লিখে যাওয়া। একদিন এই রাতকে ‘ইতিহাসে’ লেখা হবে। কিন্তু আর ইতিহাস নেই, আছে শুধু সহিংসতা। পচে যাওয়া লাশ পড়ে আছে মাটির ওপরে—যে মাটিতে তারা বানাতে চায় তাদের ‘গ্রীষ্মকালীন বাড়ি’।
প্রতিশোধ অনিবার্য। আর প্রতিশোধের প্রতিশোধও অনিবার্য। সময়ের এই অস্পষ্ট মুহূর্তে ঝুলে থেকে ভাবি—এটাই কি সেই শেষ, যার প্রতিশ্রুতি আমাদের দেওয়া হয়েছিল? যেহেতু অনন্ত ব্যতীত কিছুই অনন্ত নয়, তাই অবশ্যই একটি শেষ আছে। আমি আবার জানালায় যাই। এক বধির নীরবতা। আতঙ্কিত হই। কাগজের একটি টুকরা তুলে লিখি—‘কবরের জীবন থেকে কোনো মুক্তি নেই, আছে শুধু সময়, অনন্ত সময়, যার ওপারে আছে কেবল বিস্তৃত শূন্যতা।’
হয়তো আমার এখানেই মারা যাওয়া উচিত। অথবা একটি কবিতার পঙ্ক্তি লিখে যাওয়া। একদিন এই রাতকে ‘ইতিহাসে’ লেখা হবে। কিন্তু আর ইতিহাস নেই, আছে শুধু সহিংসতা। পচে যাওয়া লাশ পড়ে আছে মাটির ওপরে—যে মাটিতে তারা বানাতে চায় তাদের ‘গ্রীষ্মকালীন বাড়ি’।
হেসে ফেলি। আমি মাঝেমধ্যে খুব নাটুকে হয়ে যাই। গাড়ির হর্ন বাজে, এবার ক্ষীণ শোনায়। রান্নাঘরে যাই। এত নাটক কফি ছাড়া কেমন করে চলবে? ফোন বাজে। আমি প্রথম চুমুক দিই। এক ব্যক্তি বলে, ‘খালি করো।’ আমি বসে পড়ি। সিগারেট জ্বালাই। কফিতে আবার চুমুক দিই। দূরে কোনো শব্দ, তারপর নীরবতা। রেডিও চালু করি। ‘স্থল আক্রমণ অনিবার্য।’ আরেক আক্রমণ অনিবার্য সেই আক্রমণের পরে। কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। অথবা তাদের মতে, নিয়তি। তাদের কাজ আমাদের নিশ্চিহ্ন করা, আমাদের কাজ টিকে থাকা।
আমি দরজা খুলি। একটি মৃতদেহ পড়ে আছে। তার মাথা কাটা। আর রাতের বাতাসে ভেসে আসে ল্যাভেন্ডারের ঘ্রাণ, যা মনে করিয়ে দেয়—নবীরা একসময় এ ভূমিতেই হেঁটেছিলেন। আমি দরজা বন্ধ করি। বসে পড়ি। হঠাৎ গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ নীরবতা ভেঙে দেয়। আমি কফিতে চুমুক দিই। তখন মনে পড়ে—আমি বিয়েতে দেরি করে ফেলেছি। সিগারেট নেভাই। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দ্বিধায় ভুগি—আরেকটা ধরাব কি না। আমি যদি যাই, তারা হয়তো হামলা করবে। আর হামলা হলে আমি আর ফিরতে পারব না। আলমারি খুলে আমার সেরা মখমলের পোশাকটি পরি; শেষ পর্যন্ত, এটা তো উৎসবের জন্যই তুলে রাখা। রান্নাঘরে ফিরে দরজা খুলি। মৃতদেহটা এখনো আছে, তবে মাথাটি আর কাটা নেই। আমি দরজা বন্ধ করি। আবার বসি। পরিস্থিতির বিদ্রূপ আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে। কীভাবে সম্ভব—আমরা জীবিতদের রক্ষা করার জন্য মৃতদের ওপর নির্ভর করি?
আমি কবিতার বই খুঁজি—দ্বাদশ শতকের সাধকের লেখা। পৃষ্ঠা ১৬৭, অস্তিত্বগত ক্ষত সম্পর্কে। আমি কি গণহত্যাকে ‘অস্তিত্বগত ক্ষত’ বলতে পারি? নাকি এ-ই তার চূড়ান্ত রূপ, যা বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে? মৃত্যু যখন একেবারে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে, তখন কি এসব প্রশ্ন করা অবান্তর নয়? নাকি আমরাই কেবল এই সত্যের বাহক? আমরাই একমাত্র, যারা এই অসীমের বৈপরীত্য বহন করার সামর্থ্য রাখি? হয়তো তাতে কিছু যায়–আসে না। হয়তো এ-ই আল্লাহর ফয়সালা, তাঁর বিশাল পৃথিবীতে আমাদের চূড়ান্ত মুহূর্ত। কিন্তু যাঁরা সাধকের রচনা পড়েছেন, তাঁরাও হয়তো বুঝবেন না। মানুষ হওয়ার সীমা অতিক্রম করার যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই কেবল এটা বোঝা যায়। কষ্ট সহ্য করা, কারাবাস, অবরোধে সৃষ্ট রোগ, অবশ করা ছাড়াই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা, মৃত্যু সহ্য করা—এ সবকিছু পেরিয়ে যেতে পারলেই মানুষ সাধুত্ব অর্জন করে। মৃতরাই জীবিতদের রক্ষা করে।
আমি ভাবি, কবে এখান থেকে বেরোনো সম্ভব হবে এবং অবশ্যই ফিরে আসাও। আমি ফিরতে পারব, তা নিশ্চিত না হলে বের হব না। কিন্তু এখানে তো কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়, ঔপনিবেশিকরা ভীষণ অনিশ্চিতভাবে আচরণ করে।
রাতের বাতাসে ভেসে আসে ল্যাভেন্ডারের ঘ্রাণ, যা মনে করিয়ে দেয়—নবীরা একসময় এ ভূমিতেই হেঁটেছিলেন। আমি দরজা বন্ধ করি। আমি কফিতে চুমুক দিই। তখন মনে পড়ে—আমি বিয়েতে দেরি করে ফেলেছি। সিগারেট নেভাই। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দ্বিধায় ভুগি—আরেকটা ধরাব কি না।
আমি দরজা খুলি। মৃতদেহ নেই। দূরে কোথাও নারীদের গান শোনা যায়—পটভূমিতে মৃত্যুর তাল। আমি দরজা বন্ধ করি। তাদের গান তবু শোনা যায়। খুব বেশি দিন হয়নি, মৃত্যু ছিল এক বিরল ঘটনা, যখন মরদেহ কাঁধে নিয়ে জানাজা ও দাফনের উদ্দেশ্যে বের হতো সবচেয়ে সুন্দর পদযাত্রা। এখন মৃত্যু অস্বাভাবিকভাবে সাধারণ হয়ে গেছে, আর অধিকাংশ গান হারিয়ে গেছে সেই সব মানুষের সঙ্গে, যারা সেগুলো গাইত।
আমি জানালার কাছে যাই। দেখি একঝলক আলো। ভাবি—এ কি আক্রমণের শুরু? কিন্তু দেখি শুধু এক ফিরোজা রঙের পাখি, অবাক করে, কারণ রাতে ওরা সাধারণত আসে না। তবে এখন আর কীই–বা ‘স্বাভাবিক’?
আমি নিশ্বাসে টানি কোমল কুয়াশা, মন শান্ত করার জন্য দোয়া পড়ি। শেষ করি এভাবে—‘এবং তা সময়ের অসংখ্য স্তরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, যেমন সূর্য প্রবাহিত হয় প্রতিটি মহাবিশ্বে।’
ফোন বেজে ওঠে, আমাকে সেই বাক্যের সৌন্দর্যে ডুবে থাকতে দেয় না।
‘তুমি দেরি করে ফেলেছ।’
আমি হঠাৎ বিয়ের কথা মনে করি। তাড়াহুড়া করে রান্নাঘরে যাই, জুতা পরে ফেলি। বসি, আর ভাবি সেই শেষ বাক্য নিয়ে—‘সময়ের অসংখ্য স্তর’। অবশ্যই ইংরেজি অনুবাদে আসল সৌন্দর্য ধরা পড়ে না। আরবি এতই কাব্যিক ভাষা যে অবাক হওয়ার কিছু নেই—অসীমের সঙ্গে সম্পর্ক আর সময়ের ভেতর তার অন্তহীন উপস্থিতি এ ভাষাই ধারণ করতে পারে।
হঠাৎ দরজায় জোরে ধাক্কা। চমকে উঠে চেয়ার থেকে পড়ে যাই। দরজা না খোলার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ, সন্দেহ করি, এ কোনো সৈনিক। ফিলিস্তিনিরা এমন অকারণ হিংস্রভাবে ধাক্কা দেয় না। এটা হয়তো কোনো আক্রমণ, আর আক্রমণ মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। আমি সিগারেট ধরাই, ভাবি—এটাই হয়তো শেষ। আর অপেক্ষা করি, ধাক্কাটা আবার শোনা যায় কি না। কিন্তু না, ধাক্কা থেমে যায়। থেকে যায় এক অস্বস্তিকর নীরবতা।
আমি ভাবি, আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে? আমি তো ইতিমধ্যে দেরি করে ফেলেছি। শোবার ঘরে যাই, যার জানালা দিয়ে আঙিনা দেখা যায়। দেখি তারা গেছে কি না। শুধু আমার সুন্দর বোগেনভিলিয়া চোখে পড়ে, যা শোভা হয়ে আছে ওসমানীয় স্থাপত্যের পরিপূরক হিসেবে। এই বাড়ি বহু প্রজন্ম ধরে আমাদের পরিবারের, আর আমার মতোই আগের সব প্রজন্মও বাগান সাজাতে অতুলনীয় রুচি দেখিয়েছে। আমাদের দর্শন ছিল—‘যা ইচ্ছা তাই লাগাও।’
সত্যিই, আমাদের বাগান গড়ে উঠেছে টানা প্রজন্ম ধরে, যা ইচ্ছা তাই লাগানোর মাধ্যমে। মাটির সঙ্গে, প্রাণীদের সঙ্গে আমাদের সহাবস্থানের ফলে এই ‘আকস্মিক’ কাজগুলোই গড়ে তুলেছে সবচেয়ে সুন্দর বাগান।
আমি হঠাৎ বিয়ের কথা মনে করি। তাড়াহুড়া করে রান্নাঘরে যাই, জুতা পরে ফেলি। বসি, আর ভাবি সেই শেষ বাক্য নিয়ে—‘সময়ের অসংখ্য স্তর’। অবশ্যই ইংরেজি অনুবাদে আসল সৌন্দর্য ধরা পড়ে না। আরবি এতই কাব্যিক ভাষা যে অবাক হওয়ার কিছু নেই—অসীমের সঙ্গে সম্পর্ক আর সময়ের ভেতর তার অন্তহীন উপস্থিতি এ ভাষাই ধারণ করতে পারে।
কিন্তু বিষয়টা এখানে নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে—আমি চেষ্টা করছি বোঝার, কখন বেরোনো সম্ভব, আর ফেরত আসাও। আমি ফিরতে পারব, তা নিশ্চিত না হলে যাব না। কিন্তু এখানে তো কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়, ঔপনিবেশিকরা ভীষণ অনিশ্চিতভাবে আচরণ করে। অথবা হয়তো আমাদের কাছে—আমাদের যাদের এখন ফ্যাশনেবল নামে বলা হয় ‘আদিবাসী’—তাদের আচরণ অপ্রত্যাশিত মনে হয়, কিন্তু আসলে প্রতিটি পদক্ষেপই সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পিত এক শয়তানি কৌশল।
আমাদের কাছে এই সূক্ষ্ম পরিকল্পনা—কোনো মানুষের জীবন কীভাবে যন্ত্রণাদায়ক করা যায়, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় পর্যন্ত—এসে পৌঁছায় চরম অনিশ্চয়তা হিসেবে। বিভ্রান্তিকর, তাই না? অথবা হয়তো প্রশ্নের কোনো মানেই নেই। মানুষকে বাঁচতে হয়, অন্তত চেষ্টা করতে হয়।
আমি বিয়েতে দেরি করে ফেলেছি। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে শেষবার উঁকি মারি। হলুদ গোলাপের ওপারে কিছু চোখে পড়ে না। ধরে নিই—নীরবতা মানে সৈন্যরা চলে গেছে।
আমি দরজা খুলি। গুলি লাগে। মাটিতে পড়ে যাই। আমার শরীরজুড়ে রক্ত, রক্তে ভিজে যাচ্ছে মায়ের পরা মখমলের পোশাকটি, যা তাঁর মা-ও পরতেন। মৃত্যুর মুখে আমার প্রথম চিন্তা হয়—কীভাবে এই মখমলের পোশাকটি বাঁচানো যায়। এ তো পারিবারিক উত্তরাধিকার। তারপর বুঝতে পারি, রক্তক্ষরণ ভীষণ বেশি। ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে ফোনের দিকে যাই, ক্ষত চেপে ধরে।
ফোন বেজে ওঠে। আমি ধরি।
‘তুমি মারা যাচ্ছ।’
নীরবতা।
আমি ফোন নামিয়ে রাখি, আতঙ্ক এড়াতে চেষ্টা করি। সবাই জানে—এটা ভয় দেখানোর ইসরায়েলি কৌশল। আমি অ্যাম্বুলেন্স ডাকি। অপারেটরের কণ্ঠ আমার চেয়ে বেশি ভীত শোনায়। বুঝি, বাইরে অনেক কিছুই ঘটছে। সে বলে শান্ত থাকতে, ক্ষত চেপে ধরে রাখতে। অ্যাম্বুলেন্স পাঠাচ্ছে।
আমি অপেক্ষা করি। সময় যায়। শরীরের প্রায় প্রতিটি অংশ এখন রক্তে ভিজে গেছে। আবার ফোন করি। যেমন ভেবেছিলাম, অপারেটর জানায় ইসরায়েলি সেনারা অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে দিচ্ছে না।
‘কিন্তু চিন্তা করবেন না,’ সে বলে, ‘আমরা পৌঁছে যাব।’
আমি এক হাতে ক্ষত চেপে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে রেডিওর কাছে যাই। শরীর যত বেশি সময় এই আঘাত উপলব্ধি করতে পারে, ব্যথা ততই তীব্র হতে থাকে। রক্তের গন্ধে বমি বমি লাগে, জ্ঞান হারাতে বসি। রেডিও চালু করি।
‘উত্তরে যে স্থল-আক্রমণের চেষ্টা হয়েছিল, তা পূর্ণ আক্রমণে রূপ নিয়েছে।’
রেডিও বন্ধ করি।
ফোন বেজে ওঠে। ধরি।
‘অ্যাম্বুলেন্সচালক মারা গেছে।’
নীরবতা।
সে কি সত্যিই মারা গেছে? নাকি এ-ও ভয় দেখানোর আরেকটা ইসরায়েলি কৌশল?
আমি বারান্দায় যাই। যদি মরতে হয়, অন্তত বাগান দেখে মরব। আমি তো আপনাকে আমার বোগেনভিলিয়ার কথা বলেছি, কিন্তু জানেন না—আমার বাগানেই আছে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু। স্বাভাবিকভাবেই, এটি কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই করা হয়েছে। পরিকল্পনার মতো এত খুঁটিনাটি আয়োজন করা একেবারেই ইউরোপীয় স্বভাব। তারা বোঝে না—শুধু ‘বৈজ্ঞানিক’ পদ্ধতি দিয়ে প্রাচুর্য আসে না, আসে এ উপলব্ধি থেকে যে পৃথিবী নিজেই অসীমের প্রকাশ, তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রাচুর্যময়—যদি তুমি এর ছন্দে চাষ করো, তাহলে।
এ ছন্দ নতুন এক সুর তৈরি করে, যা মানুষের শ্রবণাতীত, অথচ এ-ই অস্তিত্বের মূল সুর। চরম যন্ত্রণার মাঝেও এ চিন্তা আমাকে হাসায়। আমি বরাবরই পছন্দ করেছি যাকে বলে ‘মেটাফিজিক্স’—সুফিরা যাকে বলেন ‘অসীম শূন্যতা থেকে আলোর উদ্ভাসনের বিজ্ঞান।’
আমি বাগান আর তার ওপারের বিশাল প্রান্তরের দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। ফিলিস্তিনি হলে খুন হওয়া খুব সহজ ব্যাপার।
আমি নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করি—আল্লাহর বিশাল পৃথিবীতে সুর তোলার জন্য পঞ্চাশ হাজার আত্মার মধ্যে আমিও একজন হয়ে গেলাম। তাই তো আমাদের কাছে দাফনের বিষয়টা এত গুরুত্বপূর্ণ—যদি ফিলিস্তিনিরা লাশ উদ্ধার করতে পারে।
আমি বারান্দায় যাই। যদি মরতে হয়, অন্তত বাগান দেখে মরব। আমি তো আপনাকে আমার বোগেনভিলিয়ার কথা বলেছি, কিন্তু জানেন না—আমার বাগানেই আছে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু। স্বাভাবিকভাবেই, এটি কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই করা হয়েছে। পরিকল্পনার মতো এত খুঁটিনাটি আয়োজন করা একেবারেই ইউরোপীয় স্বভাব।
আমি পৃথিবীকে আমার ভেতর প্রবেশ করতে দিই এবং আমি নিজেই হয়ে যাই পৃথিবী। মৃত্যুর অনুভূতি বর্ণনা করা কঠিন। কিন্তু বলা যায়—মনে হয় যেন দেহ আর পৃথিবীর মধ্যে কোনো সীমানা রইল না। আপনার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ছাড়াও, আপনি চেতনার একটি পরিবর্তিত অবস্থা অনুভব করেন, যা বর্ণনা করা অত্যন্ত জটিল। এসব জানার কোনো প্রয়োজন নেই, অন্তত এই মুহূর্তে তো নয়ই, আমাকে গল্পটি শেষ করতে দিন।
দুই ইসরায়েলি সেনা আমার ঘরে ঢোকে। তারা আমার মৃতদেহের দিকে তাকায়। একজন আমার ডান হাতের আঙুল থেকে আংটি খুলে নেয়। অন্যজন বারান্দায় যায়, দেখে আর কোনো ফিলিস্তিনি আছে কি না, যাকে গুলি করা যায়। আমি আমার প্রতিবেশীর চিৎকার শুনতে পাই।
দেহ ছাড়াই কীভাবে হস্তক্ষেপ করব বুঝতে পারছিলাম না, তবু আমি হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিই। সাধারণত মৃতরা জীবিতদের কাজে হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু অন্যায়টা ছিল ভীষণ গুরুতর। যদিও সবাই জানত—অথবা সঠিকভাবে বললে, যাদের থামানোর ক্ষমতা ছিল, তারাও জানত—তারা হস্তক্ষেপ করেনি। মৃতরাই জীবিতদের রক্ষা করে।
আমি বাড়ির ভেতরে শব্দ করি, যাতে তারা আমার প্রতিবেশীর দিক থেকে মনোযোগ সরায়। সে তখন তার কুকুর সিমসিমকে নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছিল। প্রথম সৈন্য—তাকে ‘সৈন্য-১’ বলি—ভয়ে অস্থির হয়ে গুলি চালাতে থাকে, ঘরের সব প্রায় কোণে। আমার সুন্দরভাবে সাজানো আসবাবপত্র তছনছ হয়ে যায়, আর ভুলবশত সে গুলি করে ফেলে ‘সৈন্য-২’-কে।
নিজের নির্বুদ্ধিতায় রাগে ফেটে পড়ে সে রান্নাঘরের দরজা খোলে—সম্ভবত আমার প্রতিবেশীকে খুন করার জন্য। আর তখনই ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা—মূলত এটা আমি করলাম শরীর ছাড়াই। আমি তার পায়ের সামনে পা বাড়িয়ে দিই। সে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়, তারপর নিজের গুলিতেই সে মারা যায়।
আমার প্রতিবেশী অন্তত এখনকার জন্য নিরাপদ আছে জেনে আমি বারান্দায় ফিরে যাই প্রার্থনা করার জন্য। নিজের মৃতদেহের ওপর প্রার্থনা করা অদ্ভুত বিষয়। হয়তো একে ‘লাশ’ বলা উচিত, কিন্তু যেহেতু অন্য কেউ পৌঁছাতে পারল না, আর কোনো উপায়ও ছিল না। এটা আমাকে মনে করিয়ে দেয় সেই গল্প—কীভাবে মুসা নবী নিজের কবরের পাশে প্রার্থনা করেছিলেন, সেই লাল বালিয়াড়িতে, যেখানে প্রতি বসন্তে হাজিরা যায়।
তাই আমি সেই একই প্রার্থনা পাঠ করি, শেষ করি এই আয়াত দিয়ে—‘এবং তা সময়ের অসংখ্য স্তরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, যেমন সূর্য প্রবাহিত হয় প্রতিটি মহাবিশ্বে।’