কে কথা কয়

অলংকরণ: তুলি

আমওয়ালাকে বললাম, আম কোথাকার?

রাজশাহীর।

রাজশাহীর? রাজশাহীর আম এত তাড়াতাড়ি আসবে কোথা থেকে?

নিলে নেন। না নিলে না নেন। রাজশাহীর আম কোত্থাইকা আহে, আপনে জানেন না?

খুব অপমানিত বোধ করলাম। পাশের আমওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, আম কত করে?

কত কেজি নেবেন?

দাম কম হলে পুরো ঝুড়িই নেব। আসল কথা কি জানেন, ব্যবহার। আপনি জিনিস বিক্রি করতে বসেছেন, আমি কাস্টমার, আপনি একটু হাসিমুখে সুন্দর করে কথা বলবেন, আমি জিনিস নেব। আপনার ব্যবহার খারাপ হলে আপনার জিনিস ভালো হলেও আমি নেব না।

আম বলল, ম্যাডাম। প্লিজ আমাকে পানিতে ডোবাবেন না। একটা আম কথা বলছে, এটা আপনি যদি সবাইকে দেখান, সবাই কত প্রশংসা করবে। টিভি ক্যামেরা আসবে। টিকটকওয়ালারা আসবে।

শুনে এই আমওয়ালা মিষ্টি করে হাসলেন। বুড়ো মানুষ। দুটো দাঁত মনে হচ্ছে পড়ে গেছে। তাঁর হাসি আমার প্রাণ জুড়িয়ে দিল।

এক হাজার টাকা দিয়ে আমি এক ঝুড়ি আম কিনলাম। তারপর রিকশায় তুললাম ঝুড়িটা। মুরব্বি আমওয়ালা সাহায্য করলেন ঝুড়ি তুলতে। এ জন্য তাঁকে আরও ১০০ টাকা বকশিশ দিলাম। সব করছি পাশের বেয়াদব লাল শার্ট পরা ছোকড়া আমওয়ালাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য।

আমের ঝুড়ি রিকশায় সিটে আমার পাশে রেখেছি। ১০ কেজি আম। এমন কোনো বড় ঝুড়ি নয়। পায়ের কাছে রাখতে ইচ্ছা করল না। খাবার জিনিস কীভাবে পায়ের নিচে রাখি?

রিকশা চলছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। বিদ্যুতের তারে সার সার কাক। কারওয়ান বাজার থেকে যাচ্ছি তেজতুরীপাড়া। রাস্তার অবস্থা ভয়াবহ। ট্রাকস্ট্যান্ডে বিশাল খননকার্য চলিতেছে। মেয়র আনিসুল হকের অভাব অনুভব করছি।

এই সময় সুন্দর মিষ্টি মেয়েলি গলায় কে যেন বলে উঠল, স্যার, আপনি আমাদের কিনে ভালো করেছেন। ওই আমগুলো রাজশাহীর ছিল না। ওগুলো সাতক্ষীরার।

আমি চমকে উঠলাম। মনের ভুল! নাকি পকেটে মোবাইল ফোনে কোনো ভিডিও আপনা–আপনি চালু হয়ে গেছে?

ফোন বের করলাম। না। ফোনের মুখ অন্ধকার।

আবারও কথা, স্যার, আপনার ব্যবহার ভালো। আপনার মতো কাস্টমারের পাশের সিটে বসতে পেরে আমরা গর্বিত বোধ করছি।

কথায় একটু রাজশাহীর টান আছে। আমি বললাম, কে কথা বলে?

এই তো আপনার ঝুড়িতে, আমরা আম। আম্রপালি আম। স্যার, ওরা না আমাদের নাম দিয়েছে আম রুপালি। এখন বলে রুপালি। হি হি হি!

আম কথা বলছে? এটা কি কার্টুন ছবি নাকি? আমি আবার আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশে একটা উড়োজাহাজ উড়ে যাচ্ছে।

স্যার, আপনি কি আমাদের পছন্দ করেন? আম্রপালি আম! নাকি আপনার পছন্দ ল্যাংড়া, হিমসাগর?

আমি বললাম, কে কথা বলছে?

আমি স্যার। আপনার ঝুড়ির একটা আম।

একটা আম? তোমরা কি সবাই কথা বলতে পারো, নাকি তুমি একটা আমই শুধু কথা বলতে পারো?

না স্যার। সবাই কথা বলতে পারে না। একটা ঝুড়িতে মাত্র একটা আমই থাকে, যে কথা বলতে পারে।

তাহলে কোন আমটা কথা বলছ?

আপনিই বের করুন। হি হি হি!

কারও তো ঠোঁট নেই। কোনো কিছু নড়ছে না। তাহলে কথা বের হচ্ছে কীভাবে?

স্যার, আপনার মোবাইল ফোনেরও তো ঠোঁট নাই। সে কি কথা বলে না? গান শোনায় না?

আমের ভেতর কি মোবাইল ফোন ভরা আছে?

না স্যার। আমি নিজে থেকেই কথা বলতে পারি।

শুধু কথা বলতে পারো, তা-ই নয়। বেশ যুক্তি দিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারো। তোমার কি ব্রেনও আছে নাকি?

এরই মধ্যে আমি বাসার সামনে এসে গেছি। রিকশাওয়ালার পিঠে হাত দিয়ে তাকে থামতে বললাম।

আম বলল, আমার ব্রেন নেই। আপনার মোবাইল ফোনের কি ব্রেন আছে?

আমি বললাম, তা নেই। কিন্তু এআই আছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।

রিকশাওয়ালা বলল, স্যার, আমারে কি কিছু জিগাইলেন?

না তো।

আমি ভাবছি, আপনে মোবাইল ফোনে কথা কইতাছেন। তাই জিগাই নাই। এখন ভালো কইরা তাকায়া দেখি, আপনে একলা একলা কথা কইতাছেন।

এই সময় আমের ঝুড়ি থেকে আওয়াজ এল, স্যার, মোটেও একা একা কথা বলছেন না। তিনি আমার সাথে কথা বলছেন।

রিকশাওয়ালা এদিক–ওদিক তাকালেন। কে কথা কয়? বোধ হয় নারীকণ্ঠ শুনে আরও বেশি ভড়কে গেছেন।

আম বলল, রিকশাওয়ালা আঙ্কেল, আমি কথা বলছি। এই যে আমের ঝুড়িতে। আমি একটা আম।

রিকশাওয়ালা বলল, স্যার, আপনের পকেটে কি মোবাইল ফোনের স্পিকার খোলা? আপনার মেয়ের লগে কথা কইতাছেন?

আম হেসে উঠল, হি হি হি!

রিকশাওয়ালাকেও বেশি ভাড়া দিলাম। তিনি আমার আমের ঝুড়ি বাসার দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।

গিন্নি দরজা খুললেন।

আম বলল, ম্যাডাম, গুড মর্নিং।

আমার আটাশ বছরের দাম্পত্য জীবনের সঙ্গিনী চিরনবীনা স্ত্রী ওদিক–ওদিক তাকাচ্ছেন। নিশ্চয়ই তাঁরও মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কে কথা বলে?

ম্যাডাম, আমি আম। আম্রপালি। আমি আম কথা বলছি। আপনার বাড়িতে আসতে পেরে আমরা, এই রাজশাহী থেকে আসা এক ঝুড়ি আম, নিজেদের ধন্য মনে করছি।

গিন্নি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, পকেটে মোবাইলে ভিডিও ছেড়েছ?

না।

তোমার কোনো ছাত্রীকে দিয়ে কল করাচ্ছ? স্পিকার অন করেছ?

না। এই নাও আমার ফোন।

তাহলে কে কথা বলছে?

আমিও বুঝতে পারছি না। বলছে, আম নাকি কথা বলছে।

আম কথা বলছে? গিন্নি আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকালেন।

আমের ঝুড়ি থেকে হি হি হাসির শব্দ এল। জি ম্যাডাম। আমি আম কথা বলছি।

গিন্নি বললেন, আমের ঝুড়িতে কী লুকিয়ে রেখেছ? রেকর্ড প্লেয়ার।

আমি বললাম, না গো। আমি এসব কোথায় পাব? আমি তেজগাঁ কলেজের বাংলার শিক্ষক। এত জ্ঞানবুদ্ধি কি আমার আছে?

আম বলল, ম্যাডাম। আমি আম। এই ঝুড়ির ৫০টা আমের মধ্যে আমি একটা আম।

গিন্নি আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে বললেন, এত আম কেন কিনেছ?

মেয়ের বাড়িতে পাঠাব। একটাই মাত্র মেয়ে। সিজনে মেয়েজামাইকে ফল পাঠাতে হয়।

মেয়ের কথায় তিনি বোধ হয় আশ্বস্ত হলেন। আম বলল, খুব ভালো হবে। আপনাদের মেয়ের সঙ্গেও আমাদের দেখা হবে।

গিন্নি বললেন, আমার মেয়ের বাড়ি গিয়েও কি তুমি কথা বলবে?

তা তো বলবই। আমি কথা একটু বেশিই বলি।

তাহলে তো এই আম শ্রেয়ার বাসায় পাঠানো যাবে না। এ তো ভুতুড়ে ব্যাপার।

ভুতুড়ে না। আষাঢ়ে ব্যাপার। আম বলল।

মানে?

আষাঢ় মাসে অনেক আজগুবি ঘটনা ঘটে। যেমন আম কথা বলে।

দাঁড়াও কথা বলাচ্ছি।

গিন্নি এক বালতি পানিতে একটা একটা করে আম রাখতে লাগলেন।

একটা আম তখন চিৎকার করে উঠল, আমাকে পানিতে ডোবাবেন না। তাহলে আমি আর কথা বলতে পারব না।

বাকি আমগুলোর একটাও কিন্তু প্রতিবাদ করেনি।

গিন্নি বললেন, কালপ্রিটটাকে পেয়েছি।

কালপ্রিট বলছেন কেন। আমি কথা বলতে পারি, এটা কি আমার অপরাধ? আম বলল।

হ্যাঁ। অপরাধ। গিন্নি বললেন।

আম বলল, ম্যাডাম। প্লিজ আমাকে পানিতে ডোবাবেন না। একটা আম কথা বলছে, এটা আপনি যদি সবাইকে দেখান, সবাই কত প্রশংসা করবে। টিভি ক্যামেরা আসবে। টিকটকওয়ালারা আসবে। আপনাদের বাড়ির সামনে ভিড় লেগে যাবে। দেখুন, আপনারা বড়লোক হয়ে যাবেন।

গিন্নি বললেন, আমি বড়লোক হতে চাই না। আমি শান্তি চাই। আমি তোমাকে পানিতে ডোবাবই।

প্লিজ ম্যাডাম। প্লিজ...

গিন্নি বালতিতে হাতের আমটা ডোবালেন। একটা আর্তনাদ পানির নিচে হারিয়ে গেল।

আমি হতভম্ব। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। তবু ঘামছি।

গিন্নি বললেন, এই আম শ্রেয়াকে পাঠানোর দরকার নেই। এই আম ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে এসো।

১০ কেজি আম ফেলে দেব?

দেবে না? পরে এই আম খাওয়ার পর দেখা গেল পেট থেকে কথা আসতে শুরু করেছে। গুড মর্নিং ম্যাডাম, আপনার পেটে আসায় আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি। ন্যাকা। সহ্য হয় না। তুমি একটা কাজ করো। আমগুলো ডাস্টবিনেও ফেলো না। নিচে বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতর যে একটুখানি বাগান আছে, সেখানে গর্ত করে পুঁতে দিয়ে আসো।

যেন আমি লাশ গোপন করছি, এমনি করে বাসার সামনে গর্ত করে আমগুলো পুঁতে দিলাম।

এক মাস পরের কথা। অনেকগুলো আমের চারা গজিয়েছে বাগানের সেই জায়গায়। একদিন গেট খুলে বের হচ্ছি, অমনি চিকন গলায়, একেবারে শিশুর কণ্ঠে, কে যেন বলে উঠল, স্যার কি কলেজে যান?

সর্বনাশ। এবার আমের চারা কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে।

আমি বললাম, কে কথা বলে?

বলব না। বললে আবার আমাকে পানিতে ডোবাবেন। গর্তে পুঁতবেন। কথা বলাই বিপজ্জনক। আমি আর কথাই বলব না। কোন জগতে এসে পড়লাম, মনের কথা মুখে আনা যায় না!