নিঃসহায়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মৃত্যুর পর জামিলের বাবার নাম যেমন হয়েছিল ‘লাশ’, তেমনি জামিলের মা জননীর নামও বদলে হয়ে গেল ‘বিদবা’! শুধু তা-ই নয়, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এক ব্যক্তি এসে বিধবা ভাতার কার্ড দেওয়ার জন্য যে নাম লিখে নিয়ে গেল, সেখানেও লেখা হলো ‘জমেলা বেওয়া’। আগে অবশ্য জামিলের মায়ের নাম ছিল জমেলা খাতুন।

আরও কত যে পরিবর্তন এল জমেলার জীবনে! সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের নাম বোধ হয় ‘মাথার ওপর থেকে ছায়া উঠে যাওয়া’। জামিলের বাবা, বেঁচে থাকতে একরাম হোসেন ছিল যার নাম, সে যে কেউকেটা ধরনের কেউ ছিল, এমন নয়; তবু সে-ই ছিল জমেলা খাতুনের মাথার ওপর একমাত্র নির্ভরতার ছায়া। বাজারে কুণ্ডু ব্যাপারীর ধানের আড়তে কুলিগিরি করত মানুষটা। তবু কোনো দিন সংসারে দারিদ্র্যের ছোঁয়া লাগতে দেয়নি।

গতকাল সন্ধ্যায় একরামের মৃত্যুর পর তাই ছায়াহীন জমেলা খাতুন কিংবা জমেলা বেওয়া অথবা শুধুই বিদবা জমেলা ছোট ছোট তিনটি সন্তান নিয়ে চৈত্রের এক খরতপ্ত প্রান্তরে পড়ে গেল যেন! এদের মুখে আহার তুলে দেওয়াই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন তার কাছে।

ঠিক এ রকম নিদয়া মুহূর্তে যেনবা আশীর্বাদ হয়ে এল খোনকার বাড়ির বড় বউ। ‘চাচি… ও চাচি…।’ ডাকতে ডাকতে জামিলদের বাড়িতে পা রাখে আশরাফ খোন্দকারের বউ। ‘কাল থ্যাকা বলে হামাকেরে ধান কাটা শুরু করবে। খলাডা লেপা লাগলোহিনি। তুমি লেপপিন নাকি চাচি?’

রাজি হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই জমেলা খাতুনের। সে হাসি হাসি মুখ করে বলে, ‘কখন আসমো, কন।’

‘আসরের নামাজের পরেই আসো তালে। আর শোনিন, তোমাকেরে গরুর গোবর আছে লয়, আসার সময় অ্যানা লিয়া আসো। হামাকেরে গোবরও থুছি। তারপরও শর্ট পড়ে যদি। কওয়া তো যায় না।’

জামিলের মা ডান দিকে মাথা কাত করে সম্মতি জানায়।

চাতালের লেবাররা আড়ালে বলে ‘লায়ক জসীম’! জসীম তখন বাংলা সিনেমার সুপারহিরো। শুক্রবার বিকেলে কাজ ফেলে সবাই সিনেমা দেখে। সেই সিনেমার নায়ক জসীমের সঙ্গে লিয়াকতের চেহারা-সুরতের মিল খুঁজে পায় তারা।

আমনের ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে গ্রামে গ্রামে। আশরাফ খোন্দকাররা গেরস্ত মানুষ। ম্যালা ধানি জমি তাদের। ধান কাটা শুরুর আগে তাদের বাড়ির সামনের বিশাল আঙিনা লেপেপুছে ঝকঝকা করতে হয়। সেই আঙিনাকে ওরা বলে ‘খলা’। খলাটা আগামীকাল থেকে ভরে উঠবে সোনারঙা ধানে আর খড়ে।

দুপুরের সূর্যটা বিকেলের কোলে মাথা রাখতেই খলা লেপতে শুরু করে জামিলের মা। ‘আগন মাসে দিন ছোট হয়্যা আসে। দেখপিন, টুপ কর৵া সাঁঝ লাগিছে। তাই বেল থাকতেই লেপা শুরু করনু, বউ। না হলে মগরবের আগে শেষ কর৵া পারমো না।’ নির্ধারিত সময়ের আগেই কেন কাজ শুরু করল, সেই কৈফিয়ত দেয় জমেলা খাতুন। খোনকার বাড়ির বউ সোনিয়া নিজের মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিয়ে হাসে। ‘তুমি খুবই করিতকর্মা চাচি। তোমার কাম হামার খুবই পছন্দ। হামার শাউর (শাশুড়ি) কচ্ছিল, হোসিনের বউক ডাক্যা আনবার কথা। হামি কনু, হোসিনের বউয়ের কাম হামার ভাল্লাগে না। জামির মাও কি সোন্দর কর৵া কাম করে। তারপর তোমার কাছে গেনু।’

জামিলের মা কোমরে শাড়ির আঁচল পেঁচাতে পেঁচাতে হাসে। কৃতজ্ঞতার হাসি। এই কাজটুকু করার সুযোগ দেওয়ার জন্য আশরাফ খোনকারের বউয়ের প্রতি মানসিকভাবে কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ে সে। ‘বউডা কত ভালো। আল্লাহ তোমার ভালো করবে মা।’ মনে মনে বলে সে। তারপর গোবরে হাত ডুবিয়ে খলা লেপতে শুরু করে।

সন্ধ্যার পর আঁচলে দুই সের চাল বেঁধে নিয়ে বাড়ি ফেরে জমেলা খাতুন। কয়েকটা হাঁস-মুরগি আছে তার। উঠানে হুলুস্থুল কাণ্ড বাধিয়েছে তারা। মলত্যাগ করে নষ্ট করে ফেলেছে ঘরদুয়ার। জলি কেন এখনো এদের খোঁয়াড়ে তোলেনি, তা–ই নিয়ে মেয়ের ওপর গোস্যা হয় জমেলা খাতুন। ‘এত বড় ধাড়ি ছুরি হছে। তা-ও সংসারের একটা কাম পারে না! মানষের ছোলগুলা কত লক্ষ্মী!’

মায়ের চোখে ধাড়ি হলেও জলির বয়স এখনো সাড়ে ৯ পেরোয়নি। সে বারান্দায় বসে ছেঁড়া ত্যানা দিয়ে হারিকেনের চিমনি মুছছিল। মায়ের কথার কোনো জবাব দেয় না সে।

ওদিকে ‘হাম্বাআআআ’ বলে আওয়াজ ছাড়ে ধলি আর লালি। জমেলার মনে পড়ে যায়, গরু দুটোকেও খাবার দেওয়া হয়নি। গোয়ালঘরে তোলার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ‘জলি…ও জলি, গরুর চাঁড়ির মদ্যে অ্যানা ভুষি দে তো মা।’ হাঁসগুলো খোঁয়াড়ে তুলতে তুলতে হাঁক ছাড়ে জমেলা খাতুন।

হারিকেনে চিমনি লাগিয়ে ঘরে যায় জলি। প্লাস্টিকের গামলায় করে কয়েক মুঠো ভুষি নিয়ে গিয়ে গরুর চাঁড়িতে ঢেলে দেয়। জমেলা খাতুন হাঁস-মুরগিকে খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দিয়ে ফিরে আসে গরুর কাছে। খড়, ভুষি, পানি একসঙ্গে মিশিয়ে গরু দুটোকে খাওয়াতে খাওয়াতে ফের গলা ছাড়ে, ‘জমিদার দুডা একনো বাড়িৎ আসেনি লয়? জলি… ও মা জলি…। পান্টি দিয়া পিটাতে পিটাতে দুডাক ধর৵া লিয়া আয় তো মা।’

জমিদার বলতে জামিল আর হামিদকেই ইঙ্গিত করছে মা। জলি জানে, তার ছোট ভাই দুটো সেই দুপুরের পর খেলতে বেরিয়েছে। অঘ্রানের ফসলশূন্য মাঠে ধানগাছের নাড়া কেটে মাটিকে সমান করে ক্রিকেট খেলার পিচ বানিয়েছে ছেলেরা। সেখানেই খেলতে গেছে দুজন। কিন্তু সন্ধ্যা পেরিয়ে এখন চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে প্রায়। এতক্ষণ কিসের খেলা? জলি সত্যি সত্যি একটা কাঁচা কঞ্চি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। দিনের আলো নিবু নিবু এই সময়ে রিক্ত ফসলের জমির আল ধরে হেঁটে যায় এক কিশোরী, তার দুই কাঁধের ওপর দুলতে থাকে লাল ফিতায় বাঁধা চুলের বেণি। অঘ্রানের এমন সময়ে কুয়াশার পাতলা ঝালর নামে আকাশ থেকে। সেই ঝালরের ভেতর দিয়ে আবছা আবছা দেখা যায়, গোলাপি ফ্রক পরা জলি হাতে কাঁচা কঞ্চি ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে আসছে।

এমন দৃশ্য দেখার পরও কি মাঠে তেষ্টা যায়? উল্টো পথে ভোঁ-দৌড় দেয় জামি-হামি দুই ভাই। একজনের বয়স সাড়ে ছয়, আরেকজনের পাঁচ।

২.

রাতের খাবার খেয়ে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে জমেলা খাতুন। কিন্তু শয়ন মানেই তো নিদ্রা নয়। সে হঠাৎ টের পায় তার পিঠের নিচে যেন রাশি রাশি শর বিছানো। শরশয্যায় শুয়ে শুয়ে জমেলার মনে পড়ে ছোটবেলার এক ঘটনা। তাদের বাড়ির পাশের বড় নয়নজুলিতে পড়ে গিয়েছিল সে। সাঁতার না জানা ছোট্ট এক মেয়ে। হাবুডুবু খেতে খেতে পেট ভরে উঠছিল পানিতে। আর ক্রমেই তালিয়ে যাচ্ছিল মাটির দিকে। হাত উঁচিয়ে, পা ছোড়াছুড়ি করে কেবলই চেষ্টা করছিল একটুখানি শ্বাস নেওয়ার। চোখ মেলে শেষবারের মতো কাকে যেন দেখতে চেয়েছিল। বাবাকে? মাকে? নাকি হাঁসের ছানা দুটোকে? খইরঙা দুটো হাঁসের ছানা খুব প্রিয় ছিল তার। সেসব কিছুই দেখতে পায়নি সে। জলের অতলে পাথরের টুকরোর মতো ডুবে যেতে যেতে দেখেছিল শুধুই আলোর বুদবুদ। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ—হরেক রঙের আলো। বলা বাহুল্য, সে যাত্রায় মরেনি জমেলা। কেউ একজন চিলের মতো ছোঁ মেরে পানির ভেতর থেকে উদ্ধার করেছিল তাকে। আজ হঠাৎ নিজেকে ওই ডুবে যাওয়া শিশুর মতো মনে হচ্ছে তার। বিশাল এক নয়নজুলির মাঝখানে ডুবে যাচ্ছে সে। ডুবে যাচ্ছে।

সকালে আবার খোনকার বাড়ির দিকে পা বাড়ায় জমেলা। ধান কাটা শুরু হয়েছে যখন, সপ্তাহখানেক কাজের অভাব হবে না খোন্দকার বাড়িতে, এই আশাতেই সে আশরাফ খোন্দকারের বউয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বড় বউ খুশি হয় জমেলাকে দেখে। ‘তুমি আসিছিন, ভালোই হলো চাচি। ধান ঝাড়া লাগবে, খ্যাড় মলম (মাড়াই করা) দেওয়া লাগবে, ১৪ জন মানুষ ধান কাটিচ্ছে, তারকেরে জন্যি ভাত আন্দা লাগবে। ম্যালা কাম। ল্যাও চাচি, তাড়াতাড়ি হাত লাগাও।’

এভাবে মাসখানেক, অর্থাৎ ধান কাটার মৌসুমটা খোন্দকার বাড়িতে কাজ করে কাটিয়ে দিল জমেলা খাতুন। কিন্তু তারপর? এর-ওর বাড়িতে ধরনা দিল কাজের জন্য। কেউ মুখ তুলে চাইল না। বিমর্ষ জমেলা একদিন বারান্দায় বসে ছিল পা এলিয়ে। কী করা যায়, ভেবে কোনো কূল পায় না সে। তার বাপ-মা দুজনেই দুনিয়া ছেড়েছে। আছে দুই ভাই বটে, তারা নিজেদের সংসার নিয়েই বড় পেরেশান। তা ছাড়া দিনের পর দিন তো আর ভাইদের সংসারে গিয়ে থাকা যায় না। জমেলা ঠিক টের পায়, সে এখন আর নয়নজুলিতে পড়ে যাওয়া ছোট্ট জমেলা নয়, সে এবার পড়েছে কূল নাই কিনারা নাই এক অথই দরিয়ার মাঝে। এবং যথারীতি সাঁতার জানে না।

তার ভাবনায় ছেদ পড়ে মোজাম্মেলের মায়ের ডাকে। ‘জামিলের মাও… ও জামিলের মাও। বাইত আছু?’

জমেলা খাতুন চমকে উঠে সদর দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে উত্তর পাড়ার মোজাম্মেলের মা ঢুকছে বাড়িতে। মোজাম্মেলের মায়ের আর কোনো নাম আছে কি না, কেউ জানে না। গ্রামসুদ্ধ লোক, ছেলে-বুড়ো সবাই তাকে ডাকে মোজাম্মেলের মা বলে। মোজাম্মেলকেও দেখেনি অনেকেই। জন্মের চার দিনের মাথায় নাকি মরে যায় সে। সেই মোজাম্মেলের মা জমেলার কাছে বসতে বসতে বলে, ‘তালুকদারের চাতালৎ কাম করবু? খুব একটা খাটনির কাম লয়। খালি বস্তাকে বস্তা চাউল ঝাড়া লাগবে। দিনে ৫০ ট্যাকা কর‌্যা পাবু। কম কী? ছোলপল লিয়্যা তাও খায়্যা বাঁচপা পারবু।’ তারপর জমেলার কানের কাছে মুখ এনে কণ্ঠস্বর নিচু করে বলে, ‘চাউলও চুরি করবার পারবু!’

চাউল চুরি করতে পারবে সেই লোভে নয়, বরং বেঁচে থাকার দায় মেটাতেই তালুকদারের চাতালে কাজ করতে রাজি হয়ে যায় জমেলা। জলি, জামিল, হামিদ—তিনটি সোনামুখ ভেসে ওঠে তার চোখের সামনে।

চাতালটা গ্রাম থেকে একটু দূরে, আধমাইলটাক হবে। এই পথটুকু হেঁটে যেতে যেতে, কীভাবে কাজ করতে হবে, সে বিষয়ে জমেলাকে নানা পরামর্শ দেয় মোজাম্মেলের মা। শেষে বলে, ‘খালি অ্যানা ম্যানেজারের সাথে তাল দিয়া চলবু। তালে দেখপু আর কোনো সুমিস্যাই হচ্চে না।’

মোজাম্মেলের মায়ের পরামর্শমতো নতুন কর্মজীবন শুরু করে জমেলা। একটু একটু ভাব জমে ওঠে চাতাল ম্যানেজার লিয়াকতের সঙ্গে। লিয়াকত চল্লিশোর্ধ্ব। নাকের তলায় পুরু গোঁফ। সুন্দর করে ছাঁটা। গালে দাড়ি নেই। সুন্দর করে কামানো। শ্যামবর্ণ গাট্টাগোট্টা লিয়াকতকে চাতালের লেবাররা আড়ালে বলে ‘লায়ক জসীম’! জসীম তখন বাংলা সিনেমার সুপারহিরো। শুক্রবার বিকেলে কাজ ফেলে সবাই সিনেমা দেখে। সেই সিনেমার নায়ক জসীমের সঙ্গে লিয়াকতের চেহারা-সুরতের মিল খুঁজে পায় তারা।

জমেলা এসব মিলটিল খুঁজে পায় না অবশ্য। তার কাছে মহিমাগঞ্জ থেকে কাজ করতে আসা লেবার মিরাজকেই বেশি ভালো লাগে। ‘কী সোন্দর ধলা! উঁচা, লম্বা!’ তবে জমেলা সেয়ানা আছে। সে ম্যানেজারকেই তোয়াজ করে চলে। তাতে তার কাজের চাপ কমে। ফাঁকফোকর পেলে ধানের গুঁড়া চুরি করে বিক্রি করতে পারে। ম্যানেজার টের পেলেও কিছু বলে না।

কিন্তু এভাবে চুরি-চামারি করে আর ৫০ টাকার উপার্জন দিয়ে কত দিন? জলির বয়স দশে পড়েছে। মেয়ে তো কলাগাছের মতো ধাঙড় হয়ে উঠছে। জামি-হামিও বড় হচ্ছে। খোরাকি বাড়ছে। ইশকুলে যাচ্ছে তিনজনই। ইশকুলে যদিও বেতন-টেতন লাগে না, কিন্তু খাতা-কলম কেনার খরচ তো আছে! আবার নয়নজুলি দশা অনুভব করে জমেলা। চারপাশে থইথই পানি, সে ডুবে যাচ্ছে। কেবলই ডুবে যাচ্ছে।

এ রকম এক ডুবন্ত দিনে জমেলাকে পুরোপুরি তলিয়ে দিতে এক ভোর আসে সাক্ষাৎ গজব হয়ে। সেদিন সোমবার। ঘড়িতে ফজরের ওয়াক্ত। খানিক আগে আজান হেঁকেছে চান্দের বাপ। হেমন্তের হিম হিম ভোর। কুয়াশার ঝালর সরিয়ে ফরসা হচ্ছে প্রকৃতি। রোজকার মতো ঘুমন্ত ছেলেমেয়েদের পাশ থেকে উঠে দাঁড়ায় জমেলা। গোয়ালঘর থেকে ধলি-লালিকে বের করতে হবে। হাঁস-মুরগির খোঁয়াড়টা খুলে দিতে হবে। এগুলোই তার নিদানের সম্বল। মানুষটা মরে যাওয়ার আগে জমেলার ঘরে নগদ কিছুই রেখে যায়নি, এ দুটো গাই গরু আর চার-পাঁচটা হাঁস-মুরগি ছাড়া। জমেলা তাই এগুলো আগলে আগলে রাখে। যত্ন করে খাবারদাবার দেয়।

নিজের শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুলে গোয়ালঘরের দিকে যায় জমেলা। গোয়ালঘরটা উঠানের অপর প্রান্তে। দশ কদমের হাঁটাপথ। ঘুমজড়ানো টলমল শরীর নিয়ে থপথপ করে হাঁটে জমেলা। চোখ থেকে ঘুম যায়নি তখনো। কিন্তু গোয়ালঘরের সামনে এসে একলহমায় ঘুম ছুটে যায় তার চোখ থেকে। গোয়ালঘরের দরজা ভাঙা! ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে ধলি-লালি নেই! খাঁ খাঁ গোয়ালঘর পড়ে আছে শূন্য! মুহূর্তে জমেলার বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যায়। মাথাটাও শূন্য হয়ে যায়। সে আর কিছু ভাবতে পারে না। তার চোখের সামনে সমগ্র দুনিয়া চরকির মতো চক্কর দিয়ে ঘুরতে থাকে। সে গোয়ালঘরের মেঝেতেই ধপ করে বসে পড়ে।

একি সর্বনাশ হলো তার! একি গজব নাজিল হলো ভোরবেলা! দরজা ভেঙে গরু দুটো চুরি করে নিয়ে গেল, তবু কিছুই টের পেল না সে! কোনো শব্দ শুনতে পেল না? গরু দুটোও কোনো চিৎকার করল না? নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল চোরের হাত ধরে? এত আদর-যত্ন করে খইল-ভুষি খাওয়ানোর এই প্রতিদান?

ডুকরে কেঁদে ওঠে জমেলা।