স্মৃতির গোলকধাঁধা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এহসান অবাক চোখে ওর কুকুরটির দিকে তাকিয়ে আছে। সে আশা করছিল একটা আঘাত আসবে। ভয়ংকর এক আঘাত। কিন্তু সেই আঘাত যে ওর প্রিয় অ্যালসেশিয়ান টাফির মারফত আসবে, তা কেই–বা ভেবেছিল?

কল্পনার পাগলা ঘোড়ারও তো লাগাম থাকে, নাকি?

টাফি আচমকা লাফ দেওয়ায় ঠিক টাল সামলাতে পারেনি। টাফিসহ পড়ে গেছে মেঝেয়। শক্ত মেঝেতে মাথা ঠুকে যাওয়ায় মাথাটা ঝিমঝিম করছে এহসানের।

তার আদুরে টাফির মুখটা এখন আর আদুরে নেই। এখন সেটা ভয়ানক। দানবীয়।

টাফির নাকের পাটা ফুলছে। চোখ লাল। যেন চোখ নয়, কোটরভর্তি তাজা রক্ত নিয়ে তাকিয়ে আছে। মুখ হাঁ করতেই লম্বা শ্বদন্ত চোখে পড়ে। লম্বা ধারালো শ্বদন্ত। ধারালো ফলার এক পোঁচে কেল্লা ফতে।

ভয়ের ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। এহসানের ঝিমঝিমানো মাথায় একের পর এক ফ্ল্যাশব্যাক খেলে। যার একটি মাসখানেক আগের। ওই দিন জাকার্তার শহরতলিতে হাঁটছিল সে।

পাশের এক রেস্তোরাঁ থেকে কফি সাঁটিয়ে এসেছিল এহসান। সন্ধ্যা হয় হয়। রাস্তার বাতিগুলো একে একে জ্বলছে।

হঠাৎই এক বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপন দৃষ্টি কাড়ে এহসানের। মেমরি গেমের সাউথ এশিয়া–প্রধান মার্ভিন গ্রেগরি হিউজের ছবি। বুলডগ আকৃতির গোল মুখ লোকটার। তাগড়া গোঁফ পুরু ঠোঁটের পুরোটাই বলতে গেলে ঢেকে ফেলেছে।

হিউজের একটা উক্তি বিলবোর্ডে জ্বলছে, নিভছে। জ্বলছে, নিভছে—‘স্মৃতি উইকিপিডিয়ার পাতার মতো কাজ করে। আপনি চাইলে উইকিপিডিয়ায় গিয়ে যেকোনো সময় পাল্টাতে পারেন, আবার অন্যরাও তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে।’

যদিও হোটেল রুমে পৌঁছে এহসান আবিষ্কার করবে যে উক্তিটা হিউজের নয়। এলিজাবেথ লফটাস নামের এক আমেরিকান মনস্তত্ত্ববিদের। কিন্তু ওটাকে সে গুরুত্ব দেবে না। যেমন সে গুরুত্ব দেবে না দরজায় মৃদু করাঘাত করতে থাকা রুম সার্ভিসকে। ওরা রুম সাফসুতরো করতে এসেছে। দরজার ওপাশ থেকেই ওদের ঝেটিয়ে বিদায় করে দেবে।

এর কারণ একটাই—শহরতলির ওই বিলবোর্ড।

মেমরি গেমের সাউথ এশিয়া প্রধান মার্ভিন গ্রেগরি হিউজের বাঁ কাঁধ ঘেঁষে যে মহিলাটি দাঁড়িয়ে আছে তাকে এহসান চেনে। যদিও বেশভূষা আমূল পাল্টে গেছে মহিলার। আগের ঢেউখেলানো রেশমি চুল নেই। চুল এখন ববকাট। স্ট্রেইট। চুলের রংও পাল্টে গেছে। কুচকুচে কালোর জায়গায় এখন ক্যাটকেটে সোনালি।

পরনে সাদামাটা সালোয়ার–কামিজ নয়, বাদামি বিজনেস স্যুট। চোখে গোল রোদচশমা। কানে সোনালি দুল। কাঁধে যে ব্যাগটা ঝুলছে, তার গায়ে এলভি ছাপ মারা।

ল্যুই ভিঁতো।

এই মহিলাকে এহসান চেনে না। আবার চেনেও।

চলুন, এই চেনাজানার দোলাচলে দুলতে থাকা এহসানের স্মৃতিটা একটু ঝালাই করি। পিছিয়ে যাই বছর সাতেক।

২.

ওই সময়টায় আন্ডারগ্রাউন্ডে বিস্তর কানাঘুষা চলছিল।

নতুন একটা গেম এসেছে। দারুণ জিনিস। একেবারে মাখন। নামটা একটু সাদামাটা। মেমরি গেম। অর্থের বিনিময়ে নিজের জীবনের স্মৃতি বেচার লাভজনক ব্যবসা। ধরা যাক কেউ একজন সামরিক কর্মকর্তা ছিল। দেশে-বিদেশে মিশনে গেছে। সম্মুখসমরে গেছে। যুদ্ধ করেছে। সে সিদ্ধান্ত নিল তার জীবনের ঘটনাবহুল দশ বছরের স্মৃতি বেঁচে দেওয়ার। কিংবা আরও কম। বছর পাঁচেকের স্মৃতি।

স্মৃতি নেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ মজাদার।

ছোট্ট একটা ডিভাইস মাথার পেছনে লাগানো হয়। ডিভাইসটাতে তারিখ ইনপুট করার ব্যবস্থা আছে। তারিখ ইনপুট করতেই একেবারে দিনক্ষণ হিসাব করে সেই ডিভাইস স্মৃতি নেওয়া শুরু করে, অনেকটা ফ্ল্যাশ ড্রাইভে ডেটা ট্রান্সফারের মতো। মগজ থেকে ওই স্মৃতি হাপিশ হয়ে যায়, চলে যায় ছোট্ট ডিভাইসটিতে। তারপর ওই স্মৃতির কপি করা হয়। কপি থেকে হয় আরও কপি। যে যত বিখ্যাত, তার স্মৃতির দামও তত বেশি। যে যত বিখ্যাত, তার কপির সংখ্যাও বেশি। যেমন সেলিব্রিটিদের স্মৃতির দাম আকাশচুম্বী। শ্যারন এলিজাবেথের স্মৃতির কথাই ধরা যাক। শ্যারন তার পনেরো বছরের সেলিব্রিটি জীবনের পুরো স্মৃতিটাই বেঁচে দিয়েছে।

মেমরি গেমের কারবারিরাও ভালোই সেয়ানা। তারা পনেরো বছরকে আবার কয়েক ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। তারপর খণ্ড খণ্ড আকারে তা বিক্রি করছে। যারা পুরোটা চাচ্ছে, তাদের খরচ করতে হবে লাখ পাঁচেক টাকা!

মানুষজনও টাকার অঙ্ক দেখে পেছাচ্ছে না। খরচ করে কিনছে।

এহসান শুনে অত পাত্তা দেয়নি। মনে করেছিল কয়েক দিন পর সবার আগ্রহ উবে যাবে। যে রকমটা হয় আরকি। তারপর হয়তোবা অন্য কিছু আসবে, অন্য কোনো চটকদার গেম। এবার হয়তো এমন কোনো গেম বের হবে, যা মানুষের চিন্তাভাবনা পড়তে পারবে। প্রতি ন্যানো সেকেন্ডে মানুষ যা ভাবে, সবই ডিভাইসের পর্দায় ভেসে উঠবে।

তা ছাড়া পুরো মেমরি গেম জিনিসটাই ওর কাছে বাকওয়াজ লাগছিল। বাকওয়াজ না, বলেন?

আরেকজনের স্মৃতি দেখে আমি কী করব? মানুষের জীবন ভয়াবহ বিরক্তিকর। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ওই তো একই রুটিন মেনে চলে সবাই। হাতমুখ ধোয়। টুথপেস্টের টিউব টিপে পেস্ট বের করে। দাঁত মাজে। জুতা-মোজা-টাই পরে। চুল আঁচড়ায়। গাড়িতে চড়ে কিংবা বাসে চেপে অফিস কিংবা ব্যবসায় যায়। সকালে হালকা নাশতা খায়, দুপুরে খায় ভারী খাবার।

এসব দেখার মধ্যে আদৌ কি কোনো মাহাত্ম্য আছে? সে কি ঝরঝরে সাদা চালের ভাত আর গরুর মাংস দিয়ে খেলো নাকি রুটি-সবজি সাঁটাল? তার রুটি কি তেলহীন স্বাস্থ্যসম্মত রুটি নাকি তেলে ডোবানো অস্বাস্থ্যকর রুটি?

পাশের ডেস্কের বকাবাজি করতে থাকা সেলেনা বলছিল, ওর মেমরি গেম হেব্বি লেগেছে। সমস্যা স্রেফ একটাই। দামটা একটু চড়া।

সেলেনার বক্তব্যকে অত পাত্তা দেয় না এহসান। সাম্প্রতিক সমস্ত ট্রেন্ড সেলেনার ‘হেব্বি পছন্দ’। যেমন গেলবার ট্রেন্ড বের হলো সবাই যার যার চোখের মণির রং পাল্টে ফেলছে। বাঁ চোখ ধূসর হলে, ডান চোখ বানাচ্ছে নীল দরিয়ার নীলে। সেই ট্রেন্ড অনুসরণ করে সেলেনাও তার কালো চোখের রং নীল করে ফেলল। এক চোখ কালো, আরেক চোখ নীল। ওর চোখে চোখে তাকাতে তখন মারাত্মক অস্বস্তি হতো এহসানের।

এই ট্রেন্ড টিকেছিল মোটে দুই সপ্তাহ। তারপর আবার পুরোনো কালো রঙে ফিরে আসে সেলেনা।

‘আমি যার মেমরি পেয়েছি সে মানুষও না। সে একটা বিড়াল। সেই বিড়াল ঘুরে বেড়াইতেছে ঘর থেকে ঘরে। রাস্তার নেড়ি কুত্তার সাথে ঝগড়া করতেছে। ওর বাসার মালিকের গা ঘেঁষে শুয়ে আছে। টিভি দেখতেছে। মিউমিউ করতেছে। মনে হইতেছে আমিই ওই বিড়াল। এক্সাইটিং না জিনিসটা?’ সেলেনার গলা উত্তেজনায় কাঁপছে রীতিমতো।

এহসান নীরস কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ। বেশ এক্সাইটিং।’

সেলেনার মুখ মুহূর্তে কালো হয়ে যায়। এহসানের নীরস গলায় বলা ‘এক্সাইটিং’ কথাটা ঠিক হজম করতে পারেনি। নিজের কিউবিকল ছেড়ে মিটিং রুমের দিকে গটগট করে এগোয় সেলেনা। কাঁধে ঝুলছে দামি ব্যাগ। প্রাদা না প্রাদো ঠিক নিশ্চিত হতে পারে না এহসান। হবে কিছু একটা। ওর প্রাক্তন উপস্থিত থাকলে নিশ্চিত মুখ বাঁকাত। বলত, এহসান ভং করছে। জানে ঠিকই কোন ব্র্যান্ডের ব্যাগ, তবু না জানার ভান ধরে আছে।

মিটিং রুমের কাচের দরজা বন্ধ হয়। হয়তোবা ভিডিও কলে ইয়ার দোস্তের সঙ্গে মেমরি গেম নিয়ে প্যাঁচাল পাড়বে সেলেনা। আর প্রাণভরে গালি দেবে গেঁয়ো আন-কুল এহসানকে।

ব্যাপারটা নিয়ে অত চিন্তিত হয় না সে। মাথায় তখন অন্য কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। এহসানের জানা ছিল না যে পশুপাখির স্মৃতিও দেদার বাজারে বিক্রি হচ্ছে। পশুপাখির স্মৃতি বিক্রি নিশ্চয়ই আরও লাভজনক। ওদের তো কানাকড়িও দেওয়া লাগে না গেমওয়ালাদের। পুরোটাই লাভ।

হঠাৎ উসকে ওঠা আগ্রহ থেকেই গেম কিনে নিয়ে আসে এহসান। স্মৃতিটি এক চিতাবাঘের। কাভারে লেখা, ‘কেনিয়ার দুর্গম অরণ্য থেকে পাকড়াও করে আনা দুর্ধর্ষ এক চিতাবাঘের টাটকা স্মৃতি।’

ওই টাটকা স্মৃতি রাতভর দেখে এহসান। গেমে ফাস্ট ফরোয়ার্ড করার অপশন আছে। কোনো স্মৃতি একঘেয়ে লাগলে তা ফাস্ট ফরোয়ার্ড বাটন চেপে দ্রুত পেরোনো যায়।

অদ্ভুত লাগে এহসানের। এ যেন এক নেশা!

চিতাবাঘ দৌড়াচ্ছে। ধাওয়া করছে। তৃণভূমিতে লম্বা লম্বা ঘাস। সাঁই সাঁই করে ঘাস পেরিয়ে যাচ্ছে। সামনে চিত্রল হরিণের পাল। আরেকটু এগোলেই মিলবে কাঙ্ক্ষিত শিকার। আরেকটু...

লাফ দেবে চিতাটা। তার পিঠ, পা আর কাঁধের পেশিগুলো শক্ত হয়ে যায়। স্প্রিংয়ের মতো টানটান হয়। বেচারা হরিণের আর বাঁচার পথ নেই।

কখন সকাল হয়েছে বুঝতেও পারে না এহসান। মাথা থেকে গেমিং কনসোল নামাতে মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে ওর। চোখেমুখে রাতজাগার ক্লান্তি।

নেশাগ্রস্তের মতো এভাবে কয়েক দিন উড়িয়ে দেয় এহসান। চিতাবাঘ দিয়ে শুরু। তারপর একে একে ভালুক, হাতি, ইগল, পেঙ্গুইন, নীলতিমি। মানুষের বোরিং জীবন ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যায়।

মেমরি গেমের সঙ্গে এভাবেই সময় কাটছিল এহসানের। এর মধ্যে মেমরি গেমের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীও বের হয়ে যায়। অ্যান্টি–মেমরি। তারাও স্মৃতি বেচাকেনায় লেগে যায়। মেমরি গেমের চেয়ে আরও সস্তায়। কারও যদি বলার মতো স্মৃতি না থাকে তাহলে তারা নতুনভাবে স্মৃতি উৎপাদন পর্যন্ত করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। অর্থাৎ কারও ছেলেবেলা যদি স্মরণীয় না হয়ে থাকে, অ্যান্টি–মেমরি তা স্মরণীয় করে বানিয়ে দেবে। কারও ছেলেবেলায় বন্ধু না থাকলে তার শৈশব বন্ধুতে ভরিয়ে দেবে, দুঃখের হলে সুখের বানাবে।

মেমরি আর অ্যান্টি–মেমরির ক্যাঁচালে করপোরেট দুনিয়া টালমাটাল হলেও সাধারণ মানুষ এর সুবিধা উপভোগ করে। কারণ, এক প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারাতে নিত্যনতুন ফিচার নিয়ে আসছিল। অফারও দিচ্ছিল তুখোড়। এতে আখেরে লাভ সাধারণ মানুষেরই।

তারপর হঠাৎই ছন্দপতন। মেমরি কিংবা অ্যান্টি–মেমরির না। এহসানের জীবনের।

ওর এক ফুফাতো ভাই আছে। ফয়সাল। একেবারেই অকস্মাৎ সে খুন হয়। তাও আবার নিজের স্ত্রীর হাতে।

মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে এহসানের। মাত্র বছর দেড়েক আগে ওদের বিয়ে খেয়েছে। উপহার দিয়েছিল ওর ছাদবাগানের একটি মাঝারি আকৃতির বনসাই।

এহসানের মা অবশ্য চাচ্ছিলেন অন্য কিছু দিতে। হাল ফ্যাশনের শাড়ি কিংবা দামি গহনা টাইপের কিছু। এহসান বনসাই দিয়েছে বলে কয়েক দিন ওর সঙ্গে ঠিকমতো কথাও বলেননি ভদ্রমহিলা। চোখাচোখি হলে মুখ ঘুরিয়ে নিতেন। এহসান নাকি তার ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে দিয়েছে। আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখানোর জো নেই।

তো যা–ই হোক। খুব জাঁকজমকের বিয়ে হলো দুজনের। হানিমুন করতে ইউরোপ গেল ওরা। ঝকঝকে শহরের ছবি, গুচ্ছের ভিডিও। সারাজীবন একসঙ্গে কাটাবে, এ ধরনের গালভরা ক্যাপশন চোখে পড়েছিল এহসানের।

এর মধ্যে কী এমন হলো!

রেবেকা ভাবির মতে, ওটা নাকি ছিল সেলফ ডিফেন্স। আত্মরক্ষা। ফয়সাল ভাই নাকি ভাবির ওপর খুব নির্যাতন চালাত।

ভাবির গা ভর্তি নির্যাতনের দাগ নীরব সাক্ষ্য দেয়। গরম খুন্তির দগদগে ক্ষত, জ্বলন্ত সিগারেট ঠেসে ধরার চিহ্ন, বেল্টের কালচে দাগ—কী নেই শরীরে!

এ রকমই এক রাতে রেবেকা ভাবি নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পাথরের মস্ত ফুলদানি দিয়ে ভাইয়ের মাথায় আঘাত করে বসে। আঘাতটা মারাত্মক ছিল। পড়ে যাওয়ার সময় মাথাটা ঠুকে যায় টেবিলের কোনায়। ব্যস!

তৎক্ষণাৎ মৃত্যু।

এ সবই ছিল ভাবির স্বীকারোক্তি।

খবরটা নজর কাড়ে সবার। স্যোশাল মিডিয়া তোলপাড়। ইউটিউবে হাজারো ভিডিও। টক শোতে রাতভর আলোচনা। চুলচেরা বিশ্লেষণ।

দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে এক বিবাহিত মেয়ে এ ধরনের পরিস্থিতিতে আর কী করতে পারে? খুন ছাড়া বিকল্প কী? ডিভোর্স? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কি একজন ডিভোর্সি মেয়েকে মেনে নেবে? ইত্যাদি ইত্যাদি।

পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকল পরবর্তী কয়েকটা দিন। নারীরা এই আধুনিক যুগে এসেও পুরুষের দাস ছাড়া আর কিছুই নয়—এ ধরনের আলোচনায় মুখর তখন সব মিডিয়া আউটলেট।

প্রথম কয়েক দিন এহসানের এসব হজম করতে কষ্ট হচ্ছিল। ফয়সাল ভাই খুব নিরীহ ধরনের মানুষ। তাকে দেখে কখনো বউ–পেটানো লোক মনে হয়নি। কোনোমতেই তার হিসাব মেলে না।

এহসানের মা অবশ্য রেবেকা ভাবির পক্ষ নেন, ‘পুরুষ মানুষ চেনা সহজ না। ওদের পক্ষে সবই সম্ভব।’

এহসান মুখ ফুটে বলে না যে ফুফাতো ভাই ফয়সালের জায়গায় আজ যদি মামাতো ভাই তামজিদ থাকত তাহলে মুহূর্তেই অসহায় রেবেকা ভাবি হয়ে পড়ত ডাইনি রেবেকা!

মুখ ফুটে বলার অবশ্য উপায় থাকে না। টাফি লাফ দিয়ে কোলে উঠে পড়েছে। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে হয় এহসানের।

মা ওদিকে সমানে গজগজ করে যান। কী রকম নির্যাতনের শিকার হলে কেউ এ রকম কিছু করে বসতে পারে।

পাষণ্ড। ইতর। চামার। এ রকম কাউকে বিয়ে করার চেয়ে কুকুর পোষা ভালো।

শেষোক্ত কথাটি শুনে কিনা জানি না, টাফি ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। খুশির ঘেউ ঘেউ। উৎসাহের ঘেউ ঘেউ।

শুধু ওর মা-ই না, রেবেকা ভাবির পক্ষে দাঁড়িয়ে যায় অনেকেই। ভাবির ঘনিষ্ঠজনদের মতে রেবেকা জাহান খুবই লক্ষ্মী এক মেয়ে। সংসারী। যেকোনো মূল্যে সংসার টিকিয়ে রাখার পক্ষে। তাই তো বছরখানেক মুখ বুজে সব অত্যাচার সহ্য করে গেছে। যখন আর পারেনি তখন নেহাত বাধ্য হয়ে...

নারীবাদীদের সংঘটন ‘নন্দিনী’ তার সব আইনি খরচের দায়িত্ব নেয়। পক্ষে নামজাদা এক উকিল দাঁড়িয়ে যায়। রেয়ান কবির। লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে আসা চৌকস উকিল। তার কথাবার্তা কয়েক দিন খুব শোনা যায়। টিভিতে, সোশ্যাল মিডিয়ায়। বেঁটেখাটো, দৃঢ় শরীরের এক মধ্যবয়স্ক লোক। তার কথার শুরুতে একবার জাস্টিস থাকে, শেষেও নিদেনপক্ষে একবার থাকে। কখনো কখনো বার কয়েক। যেন জাস্টিসের দোকান খুলে বসা একজন লোক।

কিন্তু সমস্যা হলো ভাবি ছাড়া ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কেউ নেই। ওই দিন বাসায় কেউ ছিল না। প্রতিবেশীরাও দম্পতিটিকে সুখী দম্পতি হিসেবেই জানে। দাম্পত্য কলহের কথা তারা আগে কখনো শোনেনি। ফয়সাল ভাইয়ের অফিসও ভাই সম্পর্কে পজিটিভ রায় দেয়। ঠান্ডা মাথার মানুষ, কুশলী অফিসার। মাথা গরম করতে দেখা যায়নি কখনো।

তাহলে?

সময় গড়ায়। আইনি লড়াইও চলতে থাকে। চটকদার খবরের ভিড়ে হারিয়ে যায় ফয়সাল ভাই আর রেবেকা ভাবির খবর।

আর তখনই মোড় ঘুরে যায়।

৩.

মোড় ঘুরিয়ে দেয় স্বয়ং মেমরি গেম।

প্রত্যক্ষদর্শী কেউ নেই কে বলেছে? আছে তো!

তবে দুপেয়ে মানুষ নয়। জন্তুটি চারপেয়ে। ভাই-ভাবিদের এক পোষা কুকুর ছিল। রকি। ধূসর রঙের এক ল্যাব্রাডর রিট্রিভার। মাস দুয়েক হলো রকিকে কিনে আনা হয়েছে। এর মধ্যেই রকি বেশ নেওটা হয়ে গেছে। দম্পতির পায়ে পায়ে ঘোরে। টিভি দেখে। কোলে গুটিসুটি মেরে ঘুমোয়।

ওই রাতে অকুস্থলে রকি ছিল।

রকির স্মৃতি ঘেঁটে দেখা হয়। স্মৃতি ঘাঁটতেই বেরিয়ে পড়ে ভয়ংকর কিছু সত্য।

রেবেকা ভাবি ঠিকই বলছিল। রকিকে দুই মাস হলো আনা হয়েছে। এই দুই মাসের প্রায় প্রতিদিনই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে ভাবিকে। ঘেউ ঘেউ করে রকি প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হতো।

কিন্তু ওই রাতের পুরোটাই রকির স্মৃতিতে উজ্জ্বল। মাতাল ছিল ফয়সাল ভাই। টলছিল। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। দুই-তিনবার ছ্যাঁকা দিতে ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে রেবেকা ভাবি। বিশাল এক চড় খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে বিছানায়।

বিছানার ঠিক গা ঘেঁষে টি-টেবিল। টি-টেবিলের ওপরে রাখা মস্ত ফুলদানি।

হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে এগিয়ে আসছে ফয়সাল ভাই। যেন বিদ্যুৎ খেলে যায় রেবেকা ভাবির শরীরে। হাত বাড়িয়ে ফুলদানি নেয়। তারপর ধড়াম করে বসিয়ে দেয় ফয়সাল ভাইয়ের মাথায়।

কয়েক মুহূর্তের ঘটনা।

কীভাবে কীভাবে পুরো আন্ডারগ্রাউন্ডে ছড়িয়ে পড়ে রকির স্মৃতির কপিতে। আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায়। পুরো দেশ তোলপাড়। সবাই এক বাক্যে রায় দিয়ে দেয়।

বউ–পেটানো ফয়সালের উচিত শিক্ষা হয়েছে।

সসম্মানে ছেড়ে দেওয়া হয় ভাবিকে। আত্মরক্ষার অধিকার সবারই আছে, বিচারকের অন্তিম ফয়সালা।

লন্ডনি ব্যারিস্টার রেয়ান কবির ভিক্টরি সাইন দেখায়। পরনে কালো গাউন। ক্লিন শেভড চেহারা। হাস্যোজ্জ্বল মুখ। তার এই ছবি প্রতিটি মিডিয়া আউটলেটের কাভারে স্থান পায়। সঙ্গে তার একটা ইংরেজি বাণী, ‘জাস্টিস হ্যাজ বিন সার্ভড।’

রেবেকা ভাবিকে কোন একটা প্রতিষ্ঠান চাকরি দেয়। সেও নতুন জীবন শুরু করে।

তারপর যা হয় আরকি। আস্তে আস্তে সবাই সবকিছু ভুলে যায়।

এহসান ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চাকরি সূত্রে নিয়মিত দেশের বাইরে যাওয়া লাগে। পরবর্তী কয়েক বছর এভাবে ট্যুরে ট্যুরেই কেটে যায়। আজ টরন্টো তো আগামী সপ্তাহে সিডনি। পরের মাসে ম্যানিলা। এভাবেই জীবন চলছিল।

স্মৃতি ফাস্ট ফরোয়ার্ড করি। এগিয়ে যাই বছর সাতেক। হাজির হই জাকার্তার শহরতলিতে, যেখানে হঠাৎ দেখা এক বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপন দেখে তব্দা খেয়ে যায় আমাদের গল্পের নায়ক।

সেদিন জাকার্তার শহরতলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এহসান। আগের দিন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে হাই প্রোফাইল মিটিং ছিল। সেটা বেশ ভালোভাবে সেরেছে। সবকিছু পজিটিভ মনে হচ্ছে। দু–এক দিনের মধ্যে তারাও সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবে। বিজনেস ডিলটা সম্ভবত পাকা। আজ সকালেই ফিরতি ফ্লাইটে দেশে চলে যেত। কিন্তু বিমানের স্টাফদের হঠাৎ ডাকা ধর্মঘটে ফ্লাইট ক্যানসেল হয়। থেকে যেতে হয়।

দিনভর বিছানায় গড়াগড়ি শেষে বিকেলের দিকে হোটেল ছেড়ে বের হয় এহসান। তাও বের হতো না। মায়ের ফোন পেয়ে বিছানা ছাড়ে। হঠাৎ ভিডিও কল দিয়ে বসেছিলেন মা। এহসান কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল। ঘুম ঘুম চোখে কল রিসিভ করতেই স্ক্রিনের ওপাশে মা আর ওর প্রিয় অ্যালসেশিয়ান টাফি উদয় হয়। মনিবকে দেখে টাফি খুশিতে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। তিড়িংবিড়িং করে লাফায় বারদুয়েক। মা ওর খাওয়াদাওয়ার খবর নেন। শঙ্কিত গলায় জানতে চান, জাকার্তায় ভাত পাওয়া যায় নাকি?

হাসে এহসান।

তারপর হোটেল রুম থেকে বের হয়ে কফি খায়। হাঁটে জাকার্তার শহরতলিতে। তখনই চোখ পড়ে হতচ্ছাড়া ওই বিলবোর্ডে। আর বিলবোর্ডে চোখ আটকাতেই সবকিছু ভজঘট পাকিয়ে যায়।

গড়বড় আছে। খুব গড়বড়।

হোটেলে ফিরে নেট থেকে বিজ্ঞাপনের বেশ কয়েকটি স্যাম্পল নামায়। তারপর জুম করে মেয়েটির ছবি দেখে। বাঁ দিক থেকে, ডান দিক থেকে। বাতির নিচে নিয়ে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।

একটা আর্টিকেলে মেয়েটার নামও উল্লেখ করা আছে লক্ষ করে এহসান।

শেহনাজ গিল।

অবশ্য এহসান ততক্ষণে মোটামুটি নিশ্চিত যে এটা ছদ্মনাম, আসল নাম না।

সোনালি স্ট্রেইট চুল, বাদামি বিজনেস স্যুট আর ভারী মেকআপের আড়ালে বুকভরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে সে মোটেই শেহনাজ গিল নয়।

সে রেবেকা জাহান। ফয়সাল ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী।

৪.

তারপরের যাত্রা সত্য উদ্‌ঘাটনের।

নির্দোষ রায় পেয়ে বেকসুর খালাস পাওয়া রেবেকা ভাবি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফ্রিডমে চাকরি পেয়েছিল। খোঁজ নেয় এহসান। জানা যায়, ফ্রিডম আদতে মেমরি গেমেরই একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। ভাবি ওখানে চাকরি করেছিল মাত্র মাস ছয়েক। তারপর চাকরি ছেড়ে দেয়।

এরপর কী হয় তা কেউ জানে না। ভাবির বাবা বেঁচে নেই। মা আছেন। থাকেন তাঁর ছোট ভাইয়ের বাসায়। যোগাযোগ করে একবার ঢুঁ মারে এহসান।

ভাবির মা বয়োবৃদ্ধ মহিলা। শরীরে নানা রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে। বেশ কয়েক দিন হলো শয্যাশায়ী। এহসান গিয়ে দেখে ধবধবে সাদা বিছানার বিশাল গহ্বরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছেন তিনি। গুমোট এক ঘর। দিনের বেলায়ও ঘুটঘুটে অন্ধকার।

বাতি জ্বালতে হয়। বাঁ দিকের টি-টেবিলে পানির গ্লাস আর বোতল রাখা। এক পাশে আলনা। আলনার গা ঘেঁষে অতি পরিচিত এক জিনিস।

বনসাই!

কাছে গিয়ে নিশ্চিত হয় এহসান। এটাই ফয়সাল ভাইদের বিয়েতে সে গিফট হিসেবে দিয়েছিল। কিন্তু এটা এখানে কীভাবে এল?

ভাবির মাকে জিজ্ঞেস করে এহসান। কিন্তু সমস্যা হলো, অনেক কিছুর খেই হারিয়ে ফেলেছেন ভদ্রমহিলা। স্মৃতি তাঁর মধ্যে একটা। স্মৃতি তাঁর কাছে এখন এক জটিল গোলকধাঁধার নাম। যে গোলকধাঁধায় ঢুকে আর বের হতে পারছেন না তিনি।

রেবেকার নাম শুনে খানিকক্ষণ ইতিউতি তাকালেন ভদ্রমহিলা। হয়তোবা আশা করছিলেন মেয়ে ফিরে এসেছে। ‘অ ফয়জুর। রেবেকা স্কুল থিকা ফিরে নাই?’

তাঁর ছোট ভাই ফয়জুর বাসায়ই ছিলেন। উনি জানালেন, দীর্ঘদিন হলো দেশে নেই রেবেকা। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় কানাডার ভিসা জোগাড় করে। তারপর চাকরি ছেড়ে ওখানে পাড়ি জমায়। কথা ছিল কানাডায় একটু থিতু হলে মাকেও নিয়ে যাবে। কানাডায় যাওয়ার পর প্রথম কয়েক দিন খোঁজখবর নিত। তারপর হঠাৎ করেই সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যায় মেয়েটা। দীর্ঘদিন হলো ওর আর কোনো খোঁজখবর নেই।

ফয়সাল ভাইয়ের সংসার থেকে তেমন কিছুই নিয়ে আসেনি রেবেকা ভাবি। কিছু কাপড়চোপড়। ব্যবহার্য কিছু জিনিস। আর এই বনসাই গাছ। এটা নাকি ভাবির খুব পছন্দের ছিল।

ফয়জুর সাহেবকে শেহনাজ গিলের ছবি দেখায় এহসান। একপলক দেখে রীতিমতো আঁতকে ওঠেন উনি। ‘এই-ই তো রেবেকা!’

ফিরে আসছিল এহসান, হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যায়। কথাটি বছর সাতেক আগের। সেদিন মেমরি গেম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির সময় পুনরায় উক্তিটি নজরে পড়ে। মেমরি গেমের চিফ রোয়াল্ড ডাল বলেছিলেন কথাটা। প্ল্যান্ট মেমরি নিয়ে।

শুধু মানুষ কিংবা জীবজন্তু না। গাছপালারও স্মৃতি আছে।

গাছপালাও মনে রাখতে পারে!

৫.

ঘরে ফিরে বনসাইয়ের স্মৃতির অলিগলি ঢুঁড়ে দেখে এহসান। ওটা ফয়সাল ভাইদের শোবার ঘরের একপাশে রাখা থাকত।

ওই দিন রাতে ফয়সাল ভাই মোটেও মাতাল ছিল না। অফিস থেকে বাসায় আসে। কাপড়চোপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়। খানিকক্ষণ টিভি দেখে।

এই পুরো সময়টায় কেমন জানি অন্যমনস্ক রেবেকা ভাবি। কী জানি ভাবছে। কী নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করছে।

ভাই হালকা কথাবার্তা বলার চেষ্টা চালালেও ভাবি একেবারেই নিষ্প্রভ। তার শরীরী ভাষা দায়সারা গোছের। যেন নেহাত কথা বলতে হচ্ছে বলেই বলা।

সময় গড়ায়। ভাই খেয়েদেয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। ভাবিও বালিশে মাথা ঠেকায়। ভাইয়ের নাক ডাকার আওয়াজ ভেসে আসে।

তারও বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎই রুমে উদয় হয় এক ছায়ামূর্তি। কোথাও এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল সম্ভবত। পরিবেশ–পরিস্থিতি অনুকূল ভেবে বেরিয়ে এসেছে।

লোকটার হাতে লম্বা মতো একটা জিনিস।

ভাবি এতক্ষণ জেগেই ছিল। লোকটাকে দেখে উঠে বসে। তাদের মধ্যে ইশারায় কথা হয়।

তারপরের কাহিনি একেবারে হিসাব কষা। মেপে মেপে সাজানো। এতটা ঠান্ডা মাথায় কাউকে খুন করতে দেখেনি এহসান।

প্রথম আঘাত মাথার পেছনের সংবেদনশীল জায়গাটিতে। তারপরেরটা কপালের এক পাশে।

ফয়সাল ভাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই শেষ। চিৎকারমতো দিয়েছিল। অন্তিম চিৎকার। কিন্তু মুখটা বালিশের সঙ্গে ঠেসে ধরে রেখেছিল আততায়ী। তাই চিৎকার চাপা পড়ে যায়।

তারপর কাহিনি জোরালো করার জন্য কিছু পরিবর্তন আনা হয়। ফুলদানিটা থেঁতলানো হয়। যে আসবাবে মাথা ঠুকে যায়, ওটাও একটু ঘেষটে দেওয়া হয়। যেন বোঝা যায় মাথাটা এখানেই ঠুকেছে।

সব জোগাড়যন্ত্র করে ছায়ামূর্তিটি নিষ্ক্রান্ত হয়। যেভাবে হঠাৎ উদয় হয়েছিল সেভাবেই।

তারপর কান্নাভেজা গলায় ভাবি কাউকে ফোন করে।

৬.

সংবিৎ ফেরে এহসানের।

লম্বা ফ্ল্যাশব্যাক শেষে সবকিছু এলোমেলো লাগছে। নিজের ঘরটাকেও মনে হচ্ছে অচেনা।

আচ্ছা, মেমরি গেমওয়ালারা কী করেছে টাফির?

সব স্মৃতি সরিয়ে ওর শূন্য মস্তিষ্কে নতুন স্মৃতি বসিয়েছে, যে স্মৃতিতে এহসান একজন মন্দ মানুষ। ভিলেন। যাকে দেখামাত্র আক্রমণ করতে হবে। গলায় বসাতে হবে মরণকামড়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলে তবেই শান্তি।

আচ্ছা, মা কোথায়? এখন একমাত্র মা-ই পারেন ওকে উদ্ধার করতে...

মরিয়া হয়ে এদিক–ওদিক তাকায় এহসান। কিন্তু মাকে কোথাও দেখা যায় না।

এহসান ভুল করে ফেলেছে। মারাত্মক ভুল। মেমরি গেমওয়ালাদের সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়া উচিত হয়নি।

রেবেকা ভাবি মেমরি গেমওয়ালাদের কারও সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়েছিল সম্ভবত, যে জন্য পথের কাঁটা ফয়সাল ভাইকে এভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়। প্ল্যান্ট মেমরি, বিলবোর্ডের ছবি আর মেমরি গেমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ফ্রিডমে চাকরি—এসব কিছু ওদিকেই ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু ঘটনার সাত বছর পর এগুলো নিয়ে কথা বলার কী দরকার ছিল ওর?

ফয়সাল ভাই মারা গেছে সাত-সাতটি বছর আগে। এত দিনে তার হাড়-মাংসের কিছুই অবশিষ্ট নেই। মাটিতে সব ঝুরঝুর হয়ে মিলেমিশে একাকার।

তাহলে? কী দরকার ছিল খাল কেটে কুমির আনার? আফসোস করে এহসান।

গত পরশু ফোনটা এসেছিল। ফ্যাঁসফেঁসে গলার স্বর, কথাগুলো কাটা কাটা, ‘তুমি ভুল করছ এহসান। যে যে মাধ্যমে বনসাইয়ের ওই কপি ছড়াতে চাচ্ছ সেই মাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রক আমরা। এখানে আমরাই সরকার, আমরাই জনগণ। বুঝতে পেরেছ? তুমি আমাদের কীভাবে হারাবে বলো, যখন আমরা তোমাদের স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ করি?’

এহসান কথা বাড়ায়নি। ফোন কেটে দিয়েছিল। সত্যিই তো, মেমরি গেমওয়ালাদের মতো প্রবল প্রতিপক্ষকে কীভাবে হারাবে ও? ওর কি সেই ক্ষমতা আছে?

টাফি ওর মুখ নামিয়ে আনে এহসানের গলা বরাবর। আর মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত।

ঠিক তখনই এহসানের ডান হাতটা নড়ে ওঠে।

না, উপায় একটা আছে।

ওর ডান কানের পেছনে ছোট্ট একটা বাটন আছে। মেমরি গেমের এক নম্বর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্টি-মেমরিওয়ালারা বানিয়ে দিয়েছে। পরশু ফোন পেয়ে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল এহসান। ওরাই তখন তরিকা বাতলে দেয়।

ডান কানের পেছনের বাটনটা অন করলে ওর স্মৃতির কপি স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাখো সাবস্ক্রাইবারের মস্তিষ্কে যোগ হয়ে যাবে। সাবস্ক্রাইবার অর্থাৎ যারা অ্যান্টি–মেমরি কোম্পানির খদ্দের। এরা সবাই তখন মুফতে ওর স্মৃতি দেখে ফেলতে পারবে।

ছোট্ট এই বাটনটির জন্য ওর গুনতে হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা।

এটাই ওর অন্তিম চাল। মেমরি গেমওয়ালারা জানা-অজানা সব মাধ্যম হয়তো আটকে ফেলতে পারে। সব কপি ধ্বংস করে ফেলতে পারে।

কিন্তু একটা জিনিস এখনো ওদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আর তা হলো মানুষের মস্তিষ্ক।

ওর ডান হাতটা বাটনের সামনে আসতেই পদশব্দ শোনা যায়। পরিচিত পায়ের আওয়াজ। ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে।

মা?

‘মা। ম আ আ আ...’ চিৎকার করে ওঠে এহসান। আঙুলটা আর বাটনে পড়ে না ওর।

পায়ের আওয়াজের মালিক একজন নারী। দৃষ্টিসীমায় আসতেই খুশি হয়ে ওঠে এহসান। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে, ‘মা। এতক্ষণ তুমি কোথায় ছিলে?’

মা কোনো জবাব দেন না। ভাবলেশহীন মুখে কেবল টাফিকে নির্দেশ দেন। ‘টাফি। কামড় দাও।’

বিচ্ছিরি এক আওয়াজ হয়। আওয়াজটি এহসানের নরম গলায় টাফির তীক্ষ্ণ দাঁত বসানোর।