এলা

অলংকরণ: আরাফাত করিম

গুলশান এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে তারা মুখোমুখি বসে আছে প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক ধরে। বাইরে পাখির কূজন নয়, ঘরফেরা গাড়ির আর্তনাদ আর ঝকঝকে স্ট্রিট আলোয় সন্ধ্যা নেমে গেছে। অথচ এলা এসেছিল ঘণ্টা দেড়েক সময় হাতে নিয়ে। সে জানত উনি সিনিয়র মানুষ। দেখা হওয়ার পর বুঝেছে সিনিয়র; কিন্তু কতটা তা দেখে ঠিক বোঝা যায় না। এখন তার সুগঠিত শরীর আর হাতের বাইসেপ ট্রাইসেপে চোখ রেখে মনে হচ্ছে বোঝার দরকারটা কি?

তিনি পৌঁছানোর চার মিনিট আগে নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টে পৌঁছে যায় এলা। সরাসরি কোনো টেবিলে না বসে সোফায় বসে অপেক্ষা করতে থাকে। মিনিট চারেক পরেই শার্শির ওপাশে ব্ল্যাক টি–শার্টের একটি আবছায়া ক্ষিপ্রগতি চোখের কোণে ধরা পড়ে। মনে মনে ভাবে, আচ্ছা আগন্তুক কি এ রকম কেউ হবে! ওহ গড! তা–ই যেন হয়। সেই লগ্নে হয়তো ঈশ্বর হেসেছিল।

এলা যার অপেক্ষায় ছিল তিনিই দরজা ঠেলে ঢোকেন। পরস্পরকে চিনতে এতটুকু বেগ পেতে হয় না, অথচ আজই তাদের প্রথম দেখা।

অপেক্ষার ওই চার মিনিট এলা মনে মনে খুব প্রার্থনা করছিল, সুদর্শন নাহোক অন্তত প্রেজেন্টেবল যেন হয়। এলা তো নিজেকে চেনে, হোক না শুধু লাঞ্চের সময়টুকু, তবুও ওর কাছে সুন্দর হওয়া চাই। সুন্দর, সুন্দর বাতিক এলার স্বভাবজাত। এ জন্য বাবা কত বকে। বলে, ‘যা–ই বলিস, এটা তোর দোষ এলা। তুই তো রেসিজম পছন্দ করিস না। তাহলে নিজে করিস কেন! তোর এমন দৃষ্টিভঙ্গি কি রেসিজম নয়? তোর বাবাও তো কালোকুষ্টি।’ সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে ঝাঁজিয়ে ওঠে, ‘একদম না। আমার বাবা সবার চেয়ে হ্যান্ডসাম।’ কথা সত্য। কৃষ্ণ গাত্রবর্ণ, ঝাড়া ছয় ফুট দীর্ঘ এলার বাবাকে খুব আকর্ষণীয় লাগে।

এলা ফ্রিল্যান্সিং করে। আর করে লেখালেখি। নানা প্রিন্ট এবং ওয়েব পত্রপত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়। পত্রিকার লেখা পড়ে এক ভদ্রলোকের এতটাই ভালো লাগে যে তিনি এলার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অনেক পাঠকই এলার সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে মেসেঞ্জারে তার লিখিত কথা হয়।

বাঙালি বাবা ও বিদেশি মায়ের কন্যা আইলিন খান এলা। মা নিজের দেশ ছেড়ে এ দেশে আসেননি; আর বাবাও সে দেশে শিকড় গাড়তে চাননি, কাজেই কন্যা বাবার সঙ্গে নিজের দেশে থাকে। মাঝেমধ্যে মায়ের কাছে বেড়াতে যায়। মায়ের ভাষা ও কালচার যেমন তার রপ্ত, দেশের কালচার ও ভাষাতেও সে সুপটু।

এলা একজন লেখক। স্বাধীনচেতা। কেউ চাইলে বলতে পারে বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে; কিন্তু সে ওই পথ মাড়ায়নি। ইচ্ছাও নেই। কেবল এলা নয়, ওদের জেনারেশনের বহু তরুণ–তরুণী ক্যারিয়ার, ব্যস্ততা আর যাপনের মুঠোভর্তি স্বাধীনতা নিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে জীবন। তাতে ওদের নিজেদের কোনো সমস্যা না থাকলেও সমাজের আছে বৈকি।

এলা ফ্রিল্যান্সিং করে। আর করে লেখালেখি। নানা প্রিন্ট এবং ওয়েব পত্রপত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়। পত্রিকার লেখা পড়ে এক ভদ্রলোকের এতটাই ভালো লাগে যে তিনি এলার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অনেক পাঠকই এলার সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকেন।

ভদ্রলোকের সঙ্গে মেসেঞ্জারে তার লিখিত কথা হয়। লেখা নিয়ে তিনি নানা রকম আলোচনা করেন। করতে করতে একসময় এলাও একেকটা লেখা শেষ করে পড়ার জন্য তাকে মেইল করে। এভাবে দিনে দিনে একটি বন্ধুত্ব তৈরি হয়। কিছুদিন যাওয়ার পরে একদিন ভদ্রলোক বলেন—

‘আমার কাছে খুব ভালো মানের কিছু সাহিত্য পত্রপত্রিকা ও বই আছে। আপনি একদিন আসুন, কোথাও লাঞ্চ করে এগুলো নিয়ে যাবেন।’

ওই দিন প্রথম এলা ভদ্রলোকের ফেসবুক প্রোফাইলে যায়; কিন্তু সেখানে একাডেমিক ও কর্মক্ষেত্রের কিছু বিবরণ ছাড়া তেমন কিছুই নেই। ফেসবুকে তেমন কোনো পোস্টও নেই। পরিচ্ছন্ন এই গাম্ভীর্য, এই ভারীক্কি ভাবটা এলার মনে ধরে। সে মেসেঞ্জারে জানায়, পরের সপ্তাহে দেখা করে বই নেবে। পরের সপ্তাহ আসে কিন্তু এলার আগ্রহ আর কাজ করে না। অবশ্য ব্যস্ততাও থাকে। সাক্ষাতের পরিকল্পনা মেসেঞ্জারেই মারা যায়। যোগাযোগ কমে আসে।

এরপর আসে সেই ‘প্যানডেমিক সময়’। পৃথিবী কেঁপে ওঠা ঘটনাবলি ঘটতে থাকে। আর সম্পর্কটাও ক্ষীণ হতে হতে একসময় বিলীন হয়ে যায়।

২.

করোনাভাইরাস পৃথিবীব্যাপী তার তাণ্ডবলীলা চালিয়ে অতঃপর মানব উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের কাছে পরাজয় মেনে ফিরে গেছে নিজ ঠিকানায়। পৃথিবী শান্ত হয়েছে। মানুষ আবার চলমান আর জীবন বেগবান হয়েছে। এলার আরও দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। ‘গ্রেয়িশ মুনলাইট’ নামে উপন্যাসটি বেশ সাড়া ফেলেছে।

একদিন সেই মানুষটির কাছ থেকে আবার একটি ই–মেইল আসে। সেখানে এলার বইটির একটি রিভিউ লিখেছেন তিনি। কয়েক বছর আগের স্মৃতি সামনে চলে আসে এলার। যতটা অবাক হয়, ততটাই ভালো লাগে। আশ্চর্য, কর্মব্যস্ত রাশভারী মানুষটি ওকে মনে রেখেছেন! বইটি ওর বড় পরিশ্রমের ফসল। এটি এলার মায়ের দেশেও সমাদৃত হয়েছে।

‘সময় সাগরে’ ডুবে যাওয়া সম্পর্কটি আবার ভেসে ওঠে। পুনরায় ভদ্রলোকের সঙ্গে লেখালেখি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। কথা হয় নানা বিষয়ে। তবে বেশিটাই লেখালেখিকেন্দ্রিক। আর বাকিটা রবীন্দ্রকেন্দ্রিক। ভদ্রলোক রবি ঠাকুরকে গুলে খেয়ে বসে আছেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর তার স্মরণশক্তি। একেবারে চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। এদিকে এলা জীবনানন্দের ভক্ত। ওর বাবা এই কবিকে লিকুইড বানিয়ে কন্যাকে পান করিয়েছে সেই ছোটকাল থেকে।

ভদ্রলোকের সঙ্গে মাঝেমধে৵ ঠাকুর এবং জীবনবাবুকে নিয়ে বিবিধ কথাবার্তা হয়, সবই হয় মেসেঞ্জারে লিখে লিখে। গল্পে গল্পে অনেক কিছু জানা যায়। তার নাকি ১৫ হাজার বইয়ের একটি লাইব্রেরি আছে। এরপর তিনি আবার প্রস্তাব দেন, ‘চার বছর আগের লাঞ্চের প্রোগ্রামটি কী হতে পারে?’ এলা কোনোকিছু চিন্তা না করে সঙ্গে সঙ্গে লিখে দেয়, ‘ইয়েস, টুমোরো।’ মনে মনে ঠিক করে রাখে পরদিন অবশ্যই যাবে। কারণ, এর আগে কথা দিয়েও রাখেনি, একটা অস্বস্তিবোধ ছিলই।

অপেক্ষার ওই চার মিনিট এলা মনে মনে খুব প্রার্থনা করছিল, সুদর্শন নাহোক অন্তত প্রেজেন্টেবল যেন হয়। এলা তো নিজেকে চেনে, হোক না শুধু লাঞ্চের সময়টুকু, তবুও ওর কাছে সুন্দর হওয়া চাই। সুন্দর, সুন্দর বাতিক এলার স্বভাবজাত। এ জন্য বাবা কত বকে। বলে, ‘যা–ই বলিস, এটা তোর দোষ এলা।

তারপর গুলশানের রেস্টুরেন্টে এই সাক্ষাৎ। দেড় ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে এসে সে পাঁচ ঘণ্টা ধরে সামনের ভদ্রলোকের অসম্ভব মার্জিত, রুচিশীল আলাপচারিতায় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে আছে। তার শব্দচয়ন, গ্রামার মেনে শুদ্ধ বাক্যগঠন কিছুটা অন্য রকম লাগে। তার রিমলেস গ্লাসের ওপাশে অন্তর্ভেদি দৃষ্টি অত্যন্ত গভীর। এদিকে এলারা সবাই তো জগাখিচুড়ি, বাংলিশ বা কোড ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলে এবং টেক্সট করে। আজ শেষ বিকেলে বন্ধু সিলভিয়ার সঙ্গে ওদের এক আড্ডায় যাওয়ার কথা আছে। এলা ঠিক করে বন্ধুদের আড্ডায় যাবে না। সে ফোনের রিংটোন অফ করে রাখে।

‘রূপ আর গুণ নাকি একসাথে হাত ধরে হাঁটে না।’ এসব কথা উড়িয়ে দিয়ে এলা রূপবতী এবং গুণবতী। এলার গুণমুগ্ধ ভক্তের সংখ্যা একেবারে কম নয়। আবার প্রেমপ্রার্থীও আছে কিছু। মজার ব্যাপার হচ্ছে কোনো কোনো প্রেমপ্রার্থীর অনুনয়ে এলা চেষ্টা করে তার প্রতি বন্ধুত্ব বাড়াতে; কিন্তু প্রেম বা বন্ধুত্ব কি চেষ্টা করে হয়!

অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা, স্বভাবজাত পছন্দ–অপছন্দের তীব্রতায় সে এখন পর্যন্ত একাই রয়ে গেছে। বাবা ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন, প্রায় সময় জানতে চান ‘তুই কি সিদ্ধান্ত বদলাবি না?’ আজও বেরোবার মুখে, ‘কোথায় যাচ্ছিস’ জিজ্ঞাসার উত্তরে এলা বলেছিল, ‘ফিরে এসে বলি বাবা।’ বাবা স্মিত হেসে বলেছিলেন, ‘বঁ ভোইয়াজ মাই বেবি। ভালো একটি খবরের অন্য অপেক্ষা করছি, বাই।’

এদিকে জানের বন্ধু সিলভিয়া মাঝেমধে৵ বলে, ‘উচানাকি হ্যাবিট চেঞ্জ না করলে তোর কিন্তু দুর্গতি আছে রে এলানি। তুই শালা হারামি, কাউকে যে পছন্দ করিস না, তোর হবেটা কী! স্বামীর ভাত আর তোর কপালে জুটবে না।’ আবার ফিসফিস করে বলে, ‘হ্যাঁ রে, মানুষের নাকি প্রেম হয়, ব্রেক আপ হয়, আবার প্রেম হয়, ব্রেক আপ হয়, আমাদের তো শালা কিছুই হয় না।’ এলা বলে, ‘ধুস! প্রেমে পড়ার মতো কেউ থাকলে তো।’

এসব বলে দুজনে স্বামীর ভাতের জায়গায় চিকেন উইংস খেতে খেতে প্রাণ খুলে হাসে। ওদিকে সিলভিয়া নিজেও ‘একা’। সে জিগরি দোস্ত এলাকে এলানি বলে ডাকে। সিলভিয়ারও অমন কিছু নাম এলার কাছে আছে।

৩.

সামনের ব্ল্যাক টি–শার্ট, টল, ব্ল্যাক হ্যান্ডসাম মানুষটার মধ্যে কী যেন একটা আছে। তার সম্মোহনী শক্তিকে কিছুতেই ইগনোর করতে পারছে না এলা। সে বরাবর জিনস ফতুয়া বা তাগা পরে, আজও তা–ই পরেছে; কিন্তু সামনের মানুষটির পছন্দ শেষের কবিতার লাবণ্যকে। জীবনে আজ প্রথমবার নিজের পরিহিত ড্রেস নিয়ে আফসোস হয় এলার, নাহ! শাড়ি না পরে আসাটা সমীচীন হয়নি। অবশ্য ওর বাবাও চায় এলা শাড়ি পরুক।

আপাদমস্তক একটা অচেনা অনুভূতি, চেনা আফটার শেভ আর ডিওর ঘ্রাণে আচ্ছন্ন হয়ে আছে এলা। একই সঙ্গে কিছুটা বিপর্যস্তও লাগছে। ওর মনোদৈহিক ভূমিতে কেউ যেন পুঁতে দিয়েছে অজানা অচেনা কুহকের বীজ। তার শিরা–উপশিরায় চলতে থাকে বীজ ফোটার নৃত্য। এলা কি চায় কোনো অঙ্কুরোদ্‌গম হোক?

কিন্তু বীজ কারও চাওয়া না–চাওয়ার অপেক্ষা করে না।