তোমাতে করিব বাস

এবছরে একটিই ভালো কাজ করেছি আমি, আর তা হলো মিলির টুঁটি চেপে ধরা।

না, বাস্তবিক গলাটা তার হাতের নাগালে আসেনি। আসার সম্ভাবনাও নেই জীবনভর। তবু তাকে ফেসবুকে ব্লক করে দিয়ে, টুঁটি চেপে ধরারই আনন্দ হয়েছে। মনে হয়েছে, তার যে প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত, সেটিসহ শ্বাস আটকে ফেলে মেরে ফেলতে পেরেছি তাকে।

ঘটনাটা প্রথম ঘটেছিল করোনার সময়।

অফিস বন্ধ। থাকতে হচ্ছে বাসাতেই। থাকতে থাকতে আমি আক্রান্ত হলাম বিবমিষায়। এভাবে একে একে কাটল ছয় দিন। সপ্তম দিন প্রথম মনে হলো মিলিকে আমি আসলে ঘৃণা করি। একটা মানুষকে ঘৃণা না করলে তার সব খারাপ লাগে কীভাবে?

অথচ মিলির সঙ্গে আমার যাচ্ছে চমৎকার সম্পর্ক। দুই বছর প্রেমের পর বিয়ে…বিয়ের বয়সও এমন কোনো যুগ ছাড়িয়ে যায়নি। মাত্র তো বছর তিনেক। সকালে দুজনে একসঙ্গে নাশতা করি; বিকেলে কফি খাই বারান্দায় বসে। রাতে খাবার খেয়ে চুপি চুপি গলিটাতে হাঁটতে বের হই—একসঙ্গেই। কিন্তু এরই মধ্যে মনে হলো, মিলির তাকানো, কিছু একটা অনুরোধ, এমনকি কটাক্ষ…ধীরে ধীরে আমি সবকিছুকেই অপছন্দ করছি।

প্রথমে ব্যাপারটা অপছন্দই ছিল।

সে বলছে, ‘চলো আজকে সিনেমা দেখি।’

এমনকি আমারও সিনেমা দেখতেই ইচ্ছা করছিল। কিন্তু মিলি বলার পর থেকেই মনে হওয়া শুরু করল, পৃথিবী এক চরম অনিশ্চয়তার ভেতর। আমরা বাঁচব নাকি মারা যাব—কেউই জানি না, কিন্তু সে পড়ে আছে সিনেমা নিয়ে!

এমন ঘিলুহীন মানুষ কীভাবে আমার সঙ্গী হয়?

পরের দিনই সে একটা নতুন রেসিপি বানাতে বসল।

ইউটিউব দেখে দেখে শিখেছে। চিতল মাছের সঙ্গে বেশি করে পেঁয়াজ দিয়ে ভুনার মতো কিছু একটা। কিন্তু এর সঙ্গে টমেটো সসের একটা ব্যাপার আছে। খেতে খারাপ হয়নি। কিন্তু আমার মনে হলো, এ সময়ে পেঁয়াজের এমন অপচয় না করলেই তো হতো। অপচয়কারী শয়তানের বোন!

তৃতীয় ঘটনা ঘটল রাতে। শুয়েছিলাম। মিলি পাশ ফিরে ছিল। হঠাৎই আমাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘কী ব্যাপার, তোমাকে কয়েক দিন থেকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মনও মনে হচ্ছে খারাপ…’

‘না ঠিক আছে।’

‘তুমি তো আর ঠিকমতো তাকাও না আমার দিকে দেখছি।’

‘ঘুমাও মিলি।’

‘ঘুম আসছে না। গান শুনবে? গান গাই?’

মিলি উঠে বসল তক্ষুনি। শুরু করল গান। রবীন্দ্রসংগীত। একসময় এই গান মধুর মতো কানে বাজত। এখন মনে হলো প্রলাপ শুনছি। দেখতে খুবই খারাপ লাগে, নয়তো বালিশ কানে চাপা দিতাম। মিলি কিছুই বুঝল না। নিজের মতো করে গান গেয়ে যেতে থাকল।

মেয়েটার এতটাই কমনসেন্সের অভাব, বলার মতো না!

বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। মোবাইলে দেখছিলাম করোনার খবর। বিদেশে লাশের স্তূপ নাকি পাওয়া যাচ্ছে… তাহলে এভাবেই আমরা মারা যাচ্ছি? একটা অসম্ভব ভীতি ছড়িয়ে যাচ্ছিল মনের ভেতর। তখনই কফি নিয়ে হাজির মিলি। আমাকে কাপটা দিয়ে নিজেরটাতে চুমুক দিল। সরাসরি তাকাল আমার দিকে। বলল, ‘তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?’

‘আমি? না তো। কী বলব?’

‘কিছুই বলার নেই?’

‘কফিটা ভালো হয়েছে।’

‘কফির কথা না। আমার মনে হয়, তুমি আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছ!’

মিলিকে জড়িয়ে ‘ঘৃণা’ শব্দটা সেই প্রথম মনে গাঁথল আমার। কাপটা ফেরত দিতে দিতে বললাম, ‘না। আমি কাউকে ঘৃণা করি না।’

কিন্তু মনে মনে বললাম, ‘সত্যিই, আমি তোমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছি। ব্যাপারটা স্বীকার করা কঠিন, কিন্তু করছি!’

দুজনের মধ্যে এত দিন যে সৌজন্যতার আড়াল ছিল, সেদিনের পর থেকে সেটা ভাঙল। মিলি আমাকে, আমি মিলিকে এড়িয়ে চলা শুরু করলাম। কিন্তু তাতে কি, ১২০০ ফিটের বাসায় চাইলেও একে অন্যকে এড়িয়ে থাকা যায় না। লাঞ্চ করতে করতে একদিন মিলি বলেই বসল, ‘তুমি তাহলে তোমার অফিসকেই মিস করছ, তাই না?’

উত্তর দেওয়ার মতো সম্পর্ক আর ছিল না আমাদের। আমি চুপচাপ খেয়ে গেলাম। কিন্তু মিলি মাঝেমধ্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। সে বলতেই থাকল, ‘একটা কথা জানার ছিল শুধু… তুমি কি অন্য কাউকে ভালোবাসো? তোমার অফিসের কোনো কলিগ? যার কাছে যেতে না পেরে তোমার জীবন এমন ব্যর্থ মনে হচ্ছে?’

এবার উত্তর করতে হয়, কিন্তু কী উত্তর করব, সেটাও ভেবে পেলাম না। মনোযোগ না থাকলেও তাই খেয়েই গেলাম।

মিলি বলল, ‘আমাকে বলতে পারো। প্রেম সে তো হতেই পারে!’

খাওয়া শেষ আমার। উঠেই যাচ্ছিলাম। মিলি বলল, ‘তোমাকে এখনো কেউ ভালোবাসতে পেরে ভেবে ভালো লাগছে। কে ওই মেয়ে…ওই যে অফিসের ওই ফাত্রাটা…কী যেন নাম…নিলুফার?’

জানি না কী হলো, হাতটা সটান চলে গেল। হাতে ভাত ছিল, সেটা লাগল মিলির গালে। মিলিও ছিটকে গেল। ডাইনিং থেকে আমার জীবন পর্যন্ত।

করোনার শেষে কাগজপত্রের ব্যাপার সম্পন্ন হলেও আমরা আগেই আলাদা থাকতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু তারপরও মিলিকে দেখতাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতিবারই আমার মনের মধ্যে বিবমিষা তৈরি হতো। কিন্তু চেষ্টা করেও তাকে ব্লক করতে পারিনি।

এ বছর পেরেছি। মনে হয়েছে এ বছরের সেরা অ্যাচিভমেন্ট এটিই আমার। কিন্তু সমস্যা হয়েছে, ফেসবুকে ব্লক করার পর কী জানি কোন জাদুমন্ত্রবলে সে ঠাঁই পেয়েছে মনে। আগে যেখানে তাকে মনেই করতে চাইতাম না, এখন তাকে মন থেকে মুছেও ফেলতে পারি না। একটা ফেক আইডি খুলে আমি আবার মিলির বন্ধু হয়েছি। মাঝেমধ্যে তার ইনবক্সে লিখতে ইচ্ছা করে, ‘নিলুফারের সঙ্গে আমার কিছু ছিল না!’