এটা একটা প্রেমের গল্প হতে পারত

‘আমার চাকরি হয়েছে!’

রুমানা বসে ছিল লখিন্দরের মেধের ভাঙা লাল ইটের সিঁড়িগুলোর একেবারে ওপরের স্তুপটায়। এতখানি ওপরে হেঁটে উঠতে উঠতে খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছিল সে। বিকেলের রোদ এখনো কুসুম নরম হয়নি, ফাল্গুনের হাওয়াটাও বেশ উষ্ণ। তাই বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল তার কপালে আর ঠোঁটের ওপর। ঘর্মাক্ত কপালের ওপর কোঁকড়া খুচরো চুলগুলো উড়ছিল বসন্তের বাউলি বাতাসে। পতপত করে উড়ছিল তার শাড়ির আঁচলও। সালাউদ্দিনের কথা শুনে চমকে উঠে একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছিল সে, ‘তোমার চাকরি হয়েছে?’

তিন ধাপ নিচে, সবুজ ঘাসের পাশে বেহুলার বাসরঘরের লালরঙা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দুই হাত আকাশের দিকে তুলে সালাউদ্দিন হা হা করে হাসছিল, ‘হ্যাঁ রুমি। আমার চাকরি হইছে। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসে। মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। শুনতে অত ভালো না লাগলেও স্যালারি কিন্তু কম নয়। আর অফিস থেকে একটা বাইক দেবে। আর তিন বছর পর প্রমোশন, যদি ভালো কাজ দেখাতে পারি। বুঝছো বেলা বোস? এই কথাটা বলার জন্য আজ তোমাকে এখানে ডেকে আনছি! হা হা হা।’
উফ, সত্যি! আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠেছিল রুমানা। এত আনন্দ অনেক দিন হয়নি তার।

এবার গরমটা একটু আগেভাগেই পড়তে শুরু করেছে এদিকে। উত্তরবঙ্গে ঠান্ডা যেমন পড়ে মারাত্মক, গরমটাও তেমন। এই ভ্যাপসা গরমে বহুবার দেখা বেহুলার বাসরঘরে বেড়াতে আসার কোনো ইচ্ছাই ছিল না তার আজ। বগুড়ার মেয়ে হিসেবে বনভোজনে, শিক্ষাভ্রমণে, ঘুরতে অনেকবারই এখানে আসা হয়েছে। সালাউদ্দিনের সঙ্গেই এসেছে কয়েকবার। নতুন করে আবার ওখানে কেন? কিন্তু সালাউদ্দিন জেদ ধরেছিল। আজ দূরে কোথাও বেড়াতে যাবেই। ফেরার পথে ভালো কোনো কাবাবের রেস্টুরেন্টে কাবাব আর নান খাবে। কারণ, আজ একটা বিশেষ দিন। ইশ্‌, এতক্ষণ এত বড় খবরটা পেটের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল সালাউদ্দিন!
এসবই কয়েক মাস আগের কথা। যখন সালাউদ্দিন বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে রসায়নে মাস্টার্স পাসের পর হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছিল। সোনালী ব্যাংক, গ্রামীণ ডানোন, ইনস্যুরেন্স, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, প্রাণ-আরএফএল একের পর এক পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিল সবখানে। কোথাও লিখিতটাই পার হয়নি, কোথাও ভাইভায় আটকে দিয়েছে। বাবা রিটায়ার করেছেন বগুড়া জিলা স্কুলের লাইব্রেরিয়ানের পদ থেকে। ছোট আরও তিন ভাইবোন পড়াশোনা করে, সে–ই পরিবারের বড় সন্তান। চাকরিটা তার যাচ্ছেতাই রকম দরকার হয়ে পড়েছিল।

আর ওদিকে বেহুলার মতোই রুমানা সেই শৈশব থেকেই জানত যে প্রাপ্তবয়স্ক হলে সালাউদ্দিনের সঙ্গেই তার বিয়ে হবে। বগুড়ার নুনগোলায় একই পাড়ায় খেলতে খেলতে বড় হওয়া, একসঙ্গে কোচিংয়ে পড়তে যাওয়া, আর একই সঙ্গে কলেজের গেট থেকে রিকশা করে বাড়ি ফেরা—দুজনের মা–বাবাও হয়তো তা আঁচ করতে পারতেন। এই মেলামেশায় তাঁরা কখনো বাধা দেননি। দুই পরিবারে হৃদ্যতাও ছিল যথেষ্ট। সালাউদ্দিনের মাকে রুমানার মা বুবু ডাকেন, মুরুব্বি মানেন। সালাউদ্দিনের বাবার সঙ্গে আসরের নামাজ পড়ে হাঁটতে বেরোন রুমানার বাবা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনসার বিষ হয়ে উঠেছিল সালাউদ্দিনের এই অসহনীয় বেকারত্ব! উফ, এই চাকরিটা রুমানার জন্যও যে কী জরুরি হয়ে উঠেছিল!
কারণ, রুমানাও তখন প্রায় একই সময়ে মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স শেষ করেছে। অনার্সে দুর্দান্ত রেজাল্ট করার কারণে তার বাবার ইচ্ছা মাস্টার্সটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই হোক। দরখাস্ত করা, যোগাযোগ, ভর্তিপ্রক্রিয়া সবই সম্পন্ন। কিন্তু এর মধ্যে বেঁকে বসেছিলেন রুমানার মা। অত দূরে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করবে মেয়ে, দিনকাল খারাপ, হোস্টেলে নাকি রাজনীতি না করলে টেকা মুশকিল—এই সব নানান ভাবনা তাঁকে অস্থির করে তুলছিল। আর এর মধ্যে গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো ভালো কয়েকটা বিয়ের প্রস্তাবও এসে হাজির। রুমানার মামির চাচাতো বোনের ছেলের প্রস্তাবটা তো বেশ আকর্ষণীয়। পাত্র রাজশাহীতেই ব্যবসা করে, পৈতৃক ব্যবসা, লেখাপড়া জানা বনেদি পরিবার, তার চেয়ে বড় কথা স্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দিতে তার কোনো আপত্তি নেই। বাসা থেকেই গাড়ি করে দিব্যি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারবে। এসব নিয়ে মা–বাবার সঙ্গে মামা–মামির কথাবার্তা ও আলাপ–আলোচনা কানে আসায় রুমানা অবাক হচ্ছিল খুব। সালাউদ্দিনের সঙ্গে যে তার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, সেটা আঁচ করতে পেরেও মা–বাবা এমন কেন করছেন, সে ভেবে পাচ্ছিল না কিছুতেই। নাকি এটা তাঁদের কাছে অপরিণত সম্পর্কের উদাহরণমাত্র, যেমনটা অল্প বয়সে অনেকেরই থাকে, বড় হয়ে গেলে আর যেগুলো আমলে আনতে নেই? রুমানার মামি নাকি তেমনটাই বলেছেন।
: আরে, ওইলান পাড়ার রোমিও সক্কলের থাকে বুবু। তাই কামটাম নাই, ইনকা এডা চ্যাংড়ার লগে বিয়া দিমু নাকি হামরা? হামগো ছেড়ি জুয়ান অইছে, তই বুজায় কইলেই তো বুজবু।
রুমানা রাগারাগি, কান্নাকাটি করেছিল অনেক। মা তখন আপাতত আর বেশি কিছু বলেননি। খালি বলেছেন, ‘ভাইবা দ্যাখ। ওই চ্যাংড়া, সালাউদ্দিন, অখনি এডা বালা কাম পাইতে!’

শেষ পর্যন্ত তাহলে সালাউদ্দিনের চাকরিটা হলো! লখিন্দরের মেধ থেকে নেমে আসতে আসতে সোনাগলা এক আশ্চর্য সন্ধ্যা উপুড় হয়ে আসছিল বেহুলার বাসরঘরের ছাদজুড়ে। টকটকে কমলা আলোয় পর্যটকেরা ইতস্তত ঘুরছিলেন তখনো। সেলফি তুলছিলেন এদিক–ওদিক। আর রুমানা ভাবছিল, বেহুলা যখন লখিন্দরকে হারাতে মোটেও রাজি নয়, এক দুর্দমনীয় জেদ আর সাধ্যাতীত সাধ মেয়েটাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল যখন, তখন কে ছিল বেহুলার পাশে? কেউ না। গৌরবিত দূরে যাউক, যাহার স্বামী সেই চাউক, ইহাতে আরের দায় কী?
কী আশ্চর্য! এ জগতে চিরকাল মেয়েদের লড়াইটা একাই লড়ে যেতে হয়, আপনজনেরা কেউ পাশে দাঁড়ায় না!
তবে রুমানার জেদের কাছে আপনজনদের পরাস্ত হতেই হলো। এ যে তার ছোটবেলার ঘটি–বাটি খেলার প্রেম নয়, সালাউদ্দিনের বিষয়ে সে যে সত্যি সিরিয়াস, আর এ নিয়ে দ্বিতীয় আর কোনো কথা শুনতে রাজি নয় সে, এসব বাসায় ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছিল রুমানা। মা–বাবাও শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিলেন ওর কথা। তা ছাড়া এ পাড়ায় সালাউদ্দিনের বাবা সবচেয়ে সজ্জন আর ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত। আর তাঁদের চোখের সামনে বেড়ে ওঠা সালাউদ্দিন ছেলেটাও শান্ত, ভদ্র, কোনো বদভ্যাস নেই, দুর্নাম নেই। এত সব যুক্তির কাছে মামির ভাগ্নের পিছু হটা ছাড়া উপায় রইল না। তবে কিনা রুমানা আর সালাউদ্দিন দুজনই এবার বিসিএস লিখিত পার করেছে। সামনেই মৌখিক পরীক্ষা। সালাউদ্দিনের সরকারি চাকরিটা হয়ে গেলে আত্মীয়স্বজনকে গলা উঁচু করে একটা পরিচয় দেওয়া যাবে। তাই আর কটা দিন সবুর করাই ভালো। রুমানা তাই রাজশাহী গিয়ে হোস্টেলেই উঠল।

কিন্তু দেব–দেবীদেরও তো জানা ছিল, বেহুলা যতই নিশ্ছিদ্র বাসরঘর সাজাক, যতই গুছিয়ে নিক নিজের চারপাশ, দেবী মনসা যেন ঠিকই পিছে ধায় তাদের সুখ–শান্তি বিনষ্ট করতে। এর পাঁচ মাস পর আবার একদিন সালাউদ্দিনের বাইকের পেছনে চড়ে বেহুলার বাসরঘরে বেড়াতে এসে ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে সে কথাই ভাবছিল রুমানা। সেদিনও বিকেলবেলার কমলা রঙের আলোয় রুমানার মুখ লালচে দেখাচ্ছিল, খুচরো কোঁকড়া চুলগুলো খুব উড়ছিল বাতাসে। সেদিনও এখানে–ওখানে সেলফি তুলতে ব্যস্ত ছিল প্রেমিক–প্রেমিকারা। বাগানজুড়ে ফুটেছিল হলুদ–কমলা গাঁদা ফুল। আর যদিও নতুন চাকরির সুসংবাদই টেনে এনেছিল তাদের দুজনকে বেড়ানোর প্রিয় জায়গাটায়, কিন্তু কেন যেন আগের মতো উচ্ছ্বসিত হতে পারছিল না কেউ।
সালাউদ্দিন হেলমেটটা ঘাসের ওপর নামিয়ে রেখে অস্থিরভাবে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী করবে তুমি এখন?’
রুমানা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘কী করব মানে কী?’
: মানে চাকরিতে জয়েন করবে? আকুল হয়ে প্রশ্ন করেছিল সালাউদ্দিন।
: তুমি হলে কী করতে? রুমানাও প্রশ্ন করেছিল উল্টো। সালাউদ্দিন তখন কিছু না বলে চোখ নামিয়ে অন্য দিকে চেয়ে ছিল। চারদিকে তখন কোলাহল করছিলেন পর্যটকরা। পাখিরা উড়ে যাচ্ছিল মাথার ওপর দিয়ে কলরব করে। আর ঘাসের ওপর চুপচাপ বসে আনমনে ঘাস ছিঁড়ছিল রুমানা।
বিসিএস অ্যাডমিন ক্যাডার! নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছিল না রুমানার। ঘোর কাটার আগেই বাড়ি থেকে বাবা ফোন করে কেঁদে ফেলেছিলেন, ‘মা, মা রে! তুই হামার স্বপ্ন পূরণ করছু। হগল পাড়ার লোক হামার বাড়িত আইছে। তুই কত দিন আইবু। হখনি টিকেট করবু তুই।’
রুমমেটরা তাকে জড়িয়ে ধরে নাচতে শুরু করেছিল। চাইনিজ খাওয়াতে হবে, শর্ত দিয়েছিল তারা। আর বগুড়ায় বাস থেকে নেমে বাবার সঙ্গে সিএনজি নিয়ে পাড়ায় ঢুকতেই রীতিমতো সংবর্ধনা। ছোট ভাইবোনেরা হইহই করে ঘিরে ধরেছিল চারদিকে। দাদি গালে চুমু খেয়ে বলছিল, চেংড়িডা বলে হাকিম হছু? সত্য?
এমনকি মামা–মামি সব রাগ ভুলে ছুটে এসেছিলেন ফুল আর মিষ্টি নিয়ে। অনেক রাত অব্দি তাদের নুনগোলার বাসায় কত মানুষের আসা–যাওয়া চেয়ে চেয়ে দেখেছিল রুমানা। কেবল সালাউদ্দিনের বাড়ি থেকেই কেউ আসেনি।

বাবার এত কালের সান্ধ্যকালীন হাঁটার সঙ্গী, মায়ের পুরোনো বান্ধবী ও প্রতিবেশী, যাঁকে তিনি বুবু বলে ডাকতেন, বা তাঁদের ভদ্র, শান্ত, সুন্দর ছেলেটি, যার সঙ্গে বিয়ের কেনাকাটা, কার্ড ছাপানোর কাজশুদ্ধ এর মধ্যে শুরু হয়ে গেছে, কেউ না! পাড়ার মধ্যে ওই বাড়িটাই কেমন আশ্চর্য রকম নিশ্চুপ আর অন্ধকার, বিমর্ষ হয়ে ছিল সেদিন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেহুলার বাসরঘরের ছাদের ওপর দিয়ে ওপারে দিগন্তবিস্তৃত আকাশের টকটকে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিল রুমানা। লখিন্দরের সঙ্গে বেহুলার বিবাহে আকাশ থেকে দেব–দেবীরাও এসেছিলেন উৎসব করতে। হংসপৃষ্ঠে ভর করে এসেছিলেন প্রজাপতি, শঙ্খ–চক্র–গদা হাতে গোবিন্দ গরুড়, রথে তাঁর দুই পাশে ছিলেন লক্ষী–সরস্বতী। ময়ূরে করে কার্তিক, সিংহবাহনে এসেছিলেন মহামায়া। তাঁরা সবাই জানতেন, বেহুলার সর্বনাশ আসন্ন। তবু আনন্দ–উৎসবে ভাটা পড়েনি। এত আনন্দের মধ্যে আরেকজনও এসেছিলেন বিবাহের খবর শুনে। তিনি মনসা। পদ্মাবতী।
আজ দুপুরে মুজিবুর রহমান কলেজের শিক্ষকেরা ডেকে নিয়েছিলেন রুমানাকে। রুকাইয়া আপা কপালে চুমু খেয়ে আদর করে দিয়েছেন অনেক। রুকাইয়া আপা রুমানার প্রিয় শিক্ষক। কী সুন্দর করেই না ‘মনসামঙ্গল’ পড়াতেন আপা। ‘পদ্মাবতী সুবদনী, চলিল শিবনন্দিনী, সর্ব অঙ্গে নাগ আভরণ। রক্তবস্ত্র পরিধান রক্তপুষ্প বিভূষণ, রক্তজবায় শোভিছে চরণ।’
রুকাইয়া আপা বলতেন, রথ থেকে পদ্মাকে নামতে দেখেই শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন দেব–দেবীগণ। চণ্ডী আর্তনাদ করে উঠেছিলেন—‘না করিও গন্ডগোল, শুনোহ আমার বোল, দেবগণ আছে যতক্ষণ। আর কী কহিব আমি, পাষাণ অধিক তুমি, ইহা আমি জানি চিরকাল। বিজয়গুপ্ত বলে বাণী, শুনো মাতা হররাণী, পদ্মা ভালোবাসে যে জঞ্জাল!’
জঞ্জাল! হ্যাঁ, ঠিক এই শব্দটাই কেন মনে এল সালাউদ্দিনের?
: এসব ঝুটঝামেলা, জঞ্জাল আর ভালো লাগছে না রুমি। সালাউদ্দিন আস্তে করে বলেছিল, ‘তোমার চাকরিতে আমি খুব খুশি। বিশ্বাস করো, তোমার নামটা দেখে আমারও নাচতে ইচ্ছা করতেছিল খুশিতে। কিন্তু তারপর বাসায় সবাই ভয় পাইল। আম্মা বলল, এত বড় চাকরি পাইল মেয়েটা, আল্লাহ ওকে আরও বড় করুক। কিন্তু তুই কি এখন ওকে বিয়ে করতে পারবি বেটা? সেটা কি ঠিক হবে?’
রুমানার চোখ ভরে পানি আসে, দরদর করে সেই পানি গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। সে বলে, ‘আমি কি বলছি তোমাকে বিয়ে করব না?’
: না, তা বলো নাই। কিন্তু...! সালাউদ্দিন কথা শেষ করে না।
তারপর এই কিন্তুটা বাড়িতে, বাইরে, পাড়ায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে উড়তে লাগল দিনকে দিন। মামি এ বাড়িতে আসা ছেড়েছিলেন, এবার আবার আসতে শুরু করলেন।
: বুবু, হামার ভাগ্নের কথা না–ই কইলাম। হামাগোর ম্যাসটেট বেটির জন্য আরা বালা দামান লাগবু। জজ–বারিস্টার এসপি ত হইবুলই।
রুকাইয়া আপাকে একদিন মা–ই ডেকে আনলেন বাড়িতে। তিনি প্রিয় ছাত্রীর হাত ধরে বললেন, ‘তুমি আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছ, রুমানা। আরও করবে। এখন বলি, ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবো। আগে চাকরিতে জয়েন করো, বনিয়াদি ট্রেনিং নাও। বড় বড় মানুষের সঙ্গে মেশো। এখনই বিয়ে নিয়ে ভেবো না।’
মা–ও ঠারেঠুরে তাই বললেন, ‘বিয়া লইয়া এত দাপাদাপির কী আছে? বিয়ার টাইম আরও অয়া আছে।’

রুমানা অবাক হয়ে ভাবল, বিয়ে নিয়ে তাড়াহুড়া কি সে করেছিল, নাকি মা–বাবা?
ও বাড়ি থেকে কেউ না এলেও একদিন সালাম করতে আর দোয়া চাইতে মিষ্টি নিয়ে সালাউদ্দিনদের বাসায়ও গিয়েছিল সে। তার এত দিনের চেনা–জানা আদুরে খালাম্মা কেমন আড়ষ্ট হয়ে উঠেছিলেন তাকে দেখে। আগের মতো বুকে জড়িয়ে ধরলেন না, পাশে বসিয়ে রাজ্যির গল্পও করলেন না। মনে হলো, সে এই পরিবারটিকে ছোট করে দিয়েছে। লজ্জায় তারা কেউ আর চাইতে পারছে না তার দিকে! সে আর তাদের প্রিয় ছোট্ট রুমিটা নেই, একটা সরকারি চাকরি তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে অনেক।
বেহুলা আর লখিন্দরের মনোহর জুটি দেখে আনন্দে উদ্বেল হয়েছিলেন স্বয়ং দেব–দেবীরাও। স্বামী বটে লক্ষীন্দর, যেমন কন্যা যেমন বর, প্রশংসা করে দেবগণ।
চারপাশে যখন এত হাস্য, এত আনন্দ, তখনই ঘটল অঘটন। হাস–পরিহাসে সবে ছিল আনন্দিত। হেনকালে মাথার ছত্র পড়িল ভূমিতে। ভাঙিল কনক ছত্র শুন্য হইল শির। ঘরে থাকি সুমিত্রা যে ছাড়িল নিশ্বাস। শুভ কাজে ছত্রভঙ্গ এ কী সর্বনাশ!
লখিন্দরের মতো সালাউদ্দিনেরও কি ছত্রভঙ্গ হয়ে সমস্ত সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়ে গেল আজ? শুন্য হয়ে হেঁট হয়ে গেছে তার শির? তবে কেন সে তাকে এড়িয়ে চলে আজকাল? রুমানা যাবে জেনেও সে কেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সেদিন?
নুনগোলার একতলা বাড়িতে জানালার পাশে নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সারা বিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবীদের সঙ্গে চ্যাট করে রুমানা। রুমমেট নাজিয়া লেখে, এমন কিছু করিস না যে পরে পস্তাতে হয়! ভালো করে ভেবে দ্যাখ রুমানা।
রুমানা চ্যাটবক্স থেকে বেরিয়ে আসে মন খারাপ করে। সালাউদ্দিনকে দেখতে, কথা বলতে তার মন চায়। কিন্তু সে তখন তার বাইক নিয়ে শহরের বড় বড় হাসপাতালে ঘুরতে ব্যস্ত। কোম্পানির ওষুধ বিক্রির কোটা পূরণ করতে পারলে হয়তো তিন বছর পর একটা প্রমোশন হবে।
দেখতে দেখতে রুমানার জয়েনিংয়ের সময় ঘনিয়ে আসে। মামিকে নিয়ে সপ্তপদী মার্কেটের অভিজাত দোকান থেকে দামি কিছু শাড়ি আর পোশাক কেনে রুমানা। কত প্রোগ্রাম অ্যাটেন্ড করতে হবে এখন থেকে। ব্লেজার বানাতে দিতে হবে একটা। ভালো দামি জুতা কিনতে হবে। রাজশাহী পিএটিসিতে বনিয়াদি প্রশিক্ষণ হবে ওর। সেখানে ড্রেস আর গেটআপের নানা প্রটোকল। সাপার ড্রেস এক রকম, ব্রেকফাস্টের আরেক রকম। ভোরে উঠে শরীরচর্চা করার পোশাক আরেক রকম। প্রশিক্ষণ শেষে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাদের হাতে সার্টিফিকেট তুলে দেবেন। সেদিন কোন শাড়িটা পরা হবে, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হলো বাড়িতে। মামি বললেন, রাজশাহীতে গিয়ে সপুরা থেকে একটা ভালো সিল্ক কিনতে হবে। বাবা খাবার টেবিলে হাসতে হাসতে বললেন, ‘কাইটাচামছ–ছোরা দিয়া খাবার চেষ্টা করবু। হগগলই অভ্যাস।’

গর্বে, খুশিতে বাবার চোখ চকচক করে। খাবার টেবিলে সবাই হাসিতে যোগ দেয়। আনন্দের বন্যা বয়ে যায় বাড়িতে। এই সুখের দিনে সব বিষয়েই কথাবার্তা হয়, কেবল একটা বিষয় ছাড়া। সালাউদ্দিনদের বাড়ি থেকেও কোনো উচ্চবাচ্য নেই, এ বাড়িতেও যেন তার আসন্ন বিয়ের কথা সবাই ভুলে গেছে। কী আশ্চর্য!
চলে যাওয়ার আগের বৃহস্পতিবার রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে সালাউদ্দিনকে ফোন করে। সালাউদ্দিন তখন হাসপাতাল আর ডাক্তারদের চেম্বারে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে মাত্র শুয়েছে। তার সহকর্মীরা মাঝেমধ্যে হাসপাতালের সামনে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তার কাছে শোনা তার প্রেমিকার কথা জানতে চায়, আসন্ন বিয়ের খবর জানতে চেয়ে রসিকতা করে। সালাউদ্দিন রুমানার কথা গোপন করে তাদের কাছে, এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে বিয়ের প্রসঙ্গ। কিন্তু তার কলেজের আর পাড়ার পুরোনো বন্ধুদের এড়ানো যায় না।
: শালা, তুই সরকারি ডুপ্লেক্স ভবনে থাকবি। সরকারি জিপে চড়বি। বাসার নিচে থাকবে পুলিশ পাোরা। ম্যাডাম যেদিন ইন্সপেকশনে বের হবেন, সেদিন আমরা যে যেদিকে পারি, ছুটে পালাব। হা হা হা। কী বলিস।
: অ্যাই শোন, ম্যাডামকে আমাদের গোপন তাসের আড্ডা আর বিয়ারের আসরের ঠিকানাটা দিস না দোস্ত। সোজা হাজতে না চালান করে দেয়! হা হা হা!
সালাউদ্দিন তাই আজকাল বন্ধুদের আড্ডায়ও যায় না। বাড়ি ফিরেও কারও সঙ্গে কথা বলে না। যেন তাকে বিষধর সাপে কেটেছে, যেন তার দেহে আর প্রাণ নেই। কেহ বলে আছে লখাই, কেহ বলে নাই। সালাউদ্দিনের নিজের কাছে মনে হয়, এই পৃথিবীতে সে সত্যি নেই। সে ভেসে বেড়াচ্ছে একটা শব হয়ে, নীল, জর্জরিত, অভিশপ্ত একটা শব। পৃথিবীটা কয়েক মাসেই কেমন বদলে গেছে তার কাছে। সে কেবল বিষণ্ন মনে বাইকে পা চেপে শহরময় ছুটে বেড়ায়।
: পরশু আমি চলে যাব। কাল একবার বেহুলার বাসরঘরে যাবা? রুমানা মুঠোফোনে ফিসফিস করে বলে।
সালাউদ্দিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রুমানা বুঝতে পারছে না। এখন আর হয় না। এখন সব বদলে গেছে। সে মৃদু স্বরে বলে, ‘কাল থাক। তুমি বরং বিশ্রাম নাও। পরে একসময় যাব।’
রুমানাও দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আর বোধ হয় কখনো যাওয়া হবে না। সত্যি সব বদলে গেছে। দেব–দেবীরা সবই জানতেন। সেই কালে বলেছিল দৈবজ্ঞ গোসাঞি। নিশ্চয় বলিয়াছিল দৈবজ্ঞ গোসাঞি।