ওহ্​ চিল

প্রতীকী ছবি

‘আচ্ছা বাবা, করোনা মানে কী?’

ক্লাস ফোরে পড়া মেয়ের এ প্রশ্ন শাহাবের ভাবনার ভাটিতে যেন উজানি বইঠা মারে। মাথায় তার হরদম লাফাচ্ছে—কী খাবে, কী পরবে, কোথায়ই–বা যাবে? আর্নিং সোর্স হ্যাকড বাই করোনা। দুদিন আগের চনমনে জীবন এখন গাল বাঁকা করে মোরব্বার মতো ক্যাঁচা-ক্যাঁচা করে বলছে, গো টু হেল।

‘বাবা, বলো না করোনা মানে কী?’

চাকরিটা ঘ্যাচাং হওয়ার পর থেকে শাহাবের কাছে করোনার সহজ মানে হচ্ছে মোড়ের মাংসবিক্রেতা রজব আলীর ধারালো চাপাতি। রজব যেমন চপাচপ মাংস কাটে, এই করোনাও তার চাকরিটা কপাত করে নামিয়ে দিয়েছে। শাহাব আসলে এখন শূন্যে ভাসা উদাস ফানুস।

মেয়েটা আবার তাড়া দেয়, ‘কী বাবা, বলছ না যে?’

শাহাব জানে, অর্থী কী জানতে চায়। কিন্তু করোনার সরল অর্থটা মেয়েকে বলতে চায় না ও। ভয়ানক বাধে। একটা প্রাণঘাতী ভাইরাস দুনিয়াজুড়ে বিষাক্ত তির ছুড়ে একের পর এক মানুষ ফেলে দিচ্ছে, তার নাম হবে রাজমুকুট? না, তা হতে পারে না। শাহাব খোলা জানালা দিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকায়। একটা নিঃসঙ্গ চিল নিশ্চল ডানায় ভর করে পলকা হাওয়ায় ভাসছে। উড়ুক্কু চিলের ডানায় ও কিসের ছায়া? শাহাব আনমনে বলে, ‘করোনা মানে রজব আলীর চাপাতি!’

অর্থী ফিক করে হেসে বলে,‘বাবা, এসব কী বলছ! তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?’

বাপ-বেটির আলাপে এসে বাগড়া দেয় মৌলি। ওকে বিয়ে করার পর শাহাবের মনে হয়েছিল, আকাশ থেকে ভরা পূর্ণিমার পূর্ণচাঁদ পেড়ে এনেছে। সে চাঁদ ক্ষয়ে ক্ষয়ে এখন ঘাড়ের ওপর ঝুলন্ত গিলোটিন, সেখানে কটুকাটব্যের কর্তন ছাড়া যেন কিছু নেই।

মৌলি এসেই গায়ের ছালে ঝামা ডলে, ‘মেয়ের সঙ্গে এত প্যাটর-প্যাটর কী? সংসারের হাঁড়ি যে শিকায় উঠতে বসেছে, সে খেয়াল আছে!’

সকালের নাশতাটা মোটেও জুতের হয়নি শাহাবের। আটার রুটির সঙ্গে কৌটার কোটরে অনেক দিন ঘাপটি মেরে থাকা মধু কি আর জমে? ভেবেছিল, কড়া এক কাপ আদা-চা দিয়ে জিবটা পলিশ করবে। সে জো আর কই?

মৌলির হাত গলে সাপের সুচালো লেঙুড়ের মতো বাজারের একখান ফর্দ শাহাবের হাতে গ্যাঁট হতেই ওর মন বলে, দে ছুট। ন্যাতন্যাতা হাওয়াই শার্টটা গায়ে চাপিয়ে মুখে মাস্ক নামের কুলুপ এঁটে নেয় শাহাব। তারপর হাওয়ার বেগে পালাতে থাকে।

পেছন থেকে মৌলির কণ্ঠ যেন শুকনো কাঠে করাত চালায়, ‘একটা জিনিসও যেন বাদ না থাকে। সবই লাগবে।’

তলা বসে যাওয়া চপ্পলজোড়া বগলদাবা করে মদনটাকের মতো লম্বা কদমে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে শাহাব। ছয়তলা বাড়ির টপ ফ্লোর থেকে নামতে নামতে ওর খবর হয়ে যায়। দোতলায় থাকেন মালিক। দেখামাত্র ছাইমাখা পাকা হাতে খপ করে পাকড়াবেন তড়পাতে থাকা চুনোপুঁটি। খরখরে রেতের মতো এক ডলায় ঝালিয়ে দেবেন একঘেয়ে নোটিশটা, মাস ফুরালে বকেয়াসহ হালনাগাদ ভাড়া ফেলো, বাছাধন। নইলে গলাধাক্কা!

নিরাপদে রাস্তায় এসে আটকে রাখা নিশ্বাস ছাড়তে গিয়ে কেশে ওঠে শাহাব। কাশিতে কেঁপে কেঁপে ওঠে করোনার করুণ বাঁশি। শাহাব এখনো মৌলিকে বলেনি, তার চাকরিটা লোপাট। মোটের ওপর স্রোতের শেওলা এখন সে। এত দিন পকেটে যা ছিল, ফুরাতে ফুরাতে কিঞ্চিতে এসে ঠেকেছে। তারপর কী হবে, জানা নেই।

এদিকে ঘরের ভেতর মৌলির মন আনচান। সে জানে, আজও খালি হাতে ফিরে নয়া বৈরাগীর বেসুরো সারিন্দা বাজাবে শাহাব। ঘরকন্নার নিভু নিভু চুল্লির ফুঁকনিটা আজও ফুঁ দেওয়ার বাতাস খুঁজে পাবে না।

মৌলি কয়েক দিন আগে ওর অফিসে ফোন দিয়েছিল। রিং হয়, ধরে না কেউ। শেষে একদিন নিজেই চুপিসারে ঢুঁ মেরে এসেছে। অফিসে তালা। আর তখন মানেটা পরিষ্কার। শাহাব আসলে কাজের ধান্দায় সারাটা দিন টো টো করে ঘোরে। এই লকডাউনের মধ্যে ওকে কাজ দেবে কে?

তবু শিহাব মৌলিকে বলবে না যে করোনার কূটচালে জুতার কারখানায় লালবাত্তি। তার চাকরিটা ফুড়ুৎ! বরাবরই সে পাকা বিলেতি গাব। ওপরে লালটুস ফল, অথচ ভেতরটা একেবারে সাদা! বেচারা আজও বুঝল না, পাশাপাশি দুটো হৃদয় থাকলে একটার সুর আরেকটায় গিয়ে বাজে। কান পাতলেই তা শোনা যায়। কিন্তু মৌলিও তো এ কথা শাহাবকে মুখ ফুটে বলতে পারবে না। এই বুকচাপা কষ্টের কথা বলা যায়?

সাতপাঁচ ভেবে পাশের ফ্ল্যাটের ভাবির কাছ থেকে নেওয়া ফোন নম্বরে ফোন দেয় মৌলি। পরিচয় প্রকাশ না করে আর্তি জানায়, ‘ভাই, আমার বড় বিপদ!’

ওপাশ থেকে জবাব আসে, ‘আপনি যেহেতু ভদ্রমহিলা, তাই আপনার বাড়িতে গেলে মান যাবে আপনার। আবার দিনের বেলা যে এখানে আসবেন, সেটিও তো ভালো দেখাবে না। এর চেয়ে বরং সন্ধ্যার পর একফাঁকে আসেন। কেউ জানবে না। যা দেওয়ার দিয়ে দেব।’

মৌলি কী বলবে, ভেবে পায় না। জানালা দিয়ে উদাস চোখে বাইরে তাকায় সে। দূর আকাশে সেই চিলটা এখনো উড়ছে।