করোনাধারার চক্করে

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

মর্ত্যে আজ বসন্ত। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, অরণ্যের অগ্নিশিখারা দুলছে। কৃষ্ণচূড়া, কনকচাঁপাও আছে। দখিনা বাতাসের দস্যিপনাও চাপা থাকছে না। হঠাৎ এলোমেলো করে দিচ্ছে খোলা চুল, শাড়ির আঁচল। বনে বনে কোকিলের কুউউউ শোনা যাচ্ছে। মন থেকেই শুধু কু সরছে না।

বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধেও এই বসন্তে বড় ভয়! অন্ধের মতো দরজা-জানালা বন্ধ করে অন্তর্জাল খুলে বসে আছি। কিন্তু ভ্রমটাকে কিছুতেই রোখা যাচ্ছে না। অথচ প্রাণভোমরার সুরক্ষা বলে কথা!

টাইমলাইনে বিশেষজ্ঞের ছড়াছড়ি। কর্তার কড়াকড়িও কম নেই। ব্যস্ত ভঙ্গিতে তর্জনি নাকের মধ্যে ঢুকিয়ে প্যাঁচ কষিয়ে কাজের লোকের হাত ধোয়ার হিসাব নিচ্ছেন। অথচ বেচারা প্রতিদিন হাত-পা ধোয়ার চেয়ে মাসে একবার বিছানার চাদর ধুতেই বেশি আগ্রহী। 

এদিকে গিন্নিমার হয়েছে জ্বালা। আদেশ হয়েছে, ঘরেও মাস্ক পরে থাকতে হবে! তথাস্তু। কিন্তু পানের পিক ফেলতে গিয়ে জেরবার। হাত ধোয়ার বদলে মাস্ক বারবার ধুতে হচ্ছে। তারপরও মেনে নিয়েছেন। এত দিন নাকে-মুখে আঁচল চাপা দিয়ে সংসার সামলেছেন, এখন মাস্ক পরে করোনা সামলাচ্ছেন। তবুও তিষ্ঠোতে পারছেন না। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলেই ‘ধ্যাত্তেরি’ বলে মাস্ক ছুড়ে ফেলছেন ঘরের কোনায়। 

তার ছোট মেয়েটা ঘরকুনো নয়। ফড়িং স্বভাব। ধার ধারে না। মনে অচলায়তন ভাঙার স্বপ্ন। মুখ সব সময় আয়নায়। বিদ্রোহী কবির ‘চল্ চল্ চল্’ তার প্রিয়। যদিও এর পরের পঙ্‌ক্তি কিছুতেই মনে থাকে না। সে চেষ্টাও নেই। মাস্ক পরা মুখগুলোকে তার মুখ পোড়া হনুমানের মতো লাগে! সেদিন ক্যাম্পাসে বয়ফ্রেন্ডকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, মাস্ক পরে তার সামনে না আসতে।

ছেলেটি রা করেনি। সাচ্চা প্রেমিক। সে জানে, প্রেমের কাছে জীবনের মূল্য নস্যি। সো নো টেনশন, নো টেনশন, অনলি অ্যাটেনশন। এমনও বসন্ত দিনে বেচারা সেদিন ঘরে ফিরেছিল স্যানিটাইজার কিনে। ওই স্যানিটাইজারই পরদিন কাল হলো। নিভৃতে করতলে প্রেয়সীর মুখ তুলে ধরতেই প্রেমাবেগ প্রপাতধরণীতল।

তোমার হাতে এমন গন্ধ ক্যান?

কেমন গন্ধ!

এই যে! মেয়েটি তালুতে নাক ঘষে। পরক্ষণইে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলে।

ধুর! ছেলেটি পাত্তা দেয় না। 

বললেই হলো। কেমন বোঁটকা গন্ধ!

ও, স্যানিটাইজার। ছেলেটি হো হো করে হাসে। 

মেয়ের মেজাজ ততক্ষণে তুঙ্গে। তুমি জানো না, ডেটলের গন্ধ আমার সহ্য হয় না! গা গোলায়।

ডেটল, স্যানিটাইজারের পিসতুতো ভাই হলেও এক নয়, কে বোঝাবে তাকে! দুই মেরুতে জমে থাকা হাজার বছরের বরফ গলতে শুরু করে, তবু মেয়ের মন গলে না। রাতে শুয়ে শুয়ে ছেলেটি ভাবে, ভুলটা কার?

প্রকৃতির কাছে মানুষের পাপ কম নয়! কৃষক গরুর মুখে ঠুলি পরিয়ে রাখে, যাতে অন্যের খেতে মুখ না দেয়। মানুষের দে দে খাই খাই স্বভাব যায় না। বগুড়ার দই থেকে বিসমিল্লাহ্ খাঁর সানাই হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে খায়। মাগনা আলকাতরা উহ্য রইল। এক্ষণে গরু যদি সৃষ্টিকর্তার পায়ে মাথা কুটে বলে, প্রভু, এ অবিচার। এ অসহ্য। সৃষ্টিকর্তাই–বা কেন এত সহ্য করবেন? তিনি কি আর জানেন না, তারই সৃষ্টির সেরা জীব কতটা ধূর্ত, কত বাটপার, কত ছল ওদের, কত মুখোশ! 

সুতরাং তারই নির্দেশ, নে, এবার মাস্ক পরে থাক।

স্বজাতিকে দূর থেকে সালাম দিতেও মানুষের কত অনীহা। এখন এগিয়ে গিয়ে হ্যান্ডশেক করতেও ভয়! এর বদলে উহানশেক, এলবো, ফুটশেক—কত পায়তারা! ভাগ্যিস বাঙালির হাঁটু ভাঁজ করে মোরগ লড়াইয়ের কথা ওরা জানে না। জানলে হ্যান্ডশেকের বদলে ককশেকের পরামর্শ দিত।

হ্যাঁ, এই বসন্তে একমাত্র পরামর্শই মুফতে মিলছে। সমাজ দিচ্ছে, সংগঠন দিচ্ছে, অফিস দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও সোচ্চার। যন্ত্রণায় এখন উত্তমমধ্যম বাকি। গুজব ডালপালা ছড়াচ্ছে। কর্তার মাথায় চেপে বসছে দুশ্চিন্তা। বিপি বাড়ছে, সুগারও হাই। ওই নিয়ে ছুটছেন সুপার শপে। গিয়েই খাচ্ছেন শক! বিশ টাকার মাস্ক দেড় শ। দেড় কদম সরলেই সর্বনাশ! অন্যজন ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। 

চাকরিপ্রার্থীর লাইনকেও হার মানিয়েছে স্যানিটাইজার কেনার লাইন। অনলাইনেও মিলছে না হ্যান্ডওয়াশ। বিষ খাওয়ার পর স্টমাক ওয়াশের মতো গোডাউন ধুয়েমুছে পরিষ্কার। যিনি দুহাত ভরে কিনছেন, তিরস্কার তার প্রাপ্য। কারণ, পৃথিবীতে একা বেঁচে থাকা যায় না। সবাইকে নিয়ে বাঁচার মধ্যেই মানবের সার্থকতা।

সেদিন পরিচিত একজনের বাসায় গিয়েছি। ড্রইংরুমে বসতেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার এনে সামনে রাখলেন। হাঁচি-কাশির স্বাধীনতা আমরা হারিয়েছি। এবার বুঝি চা-নাশতার রেওয়াজও হারালাম। ভেতরটা ফুঁসে উঠল। অচেতনে হাত ঢুকে গেল পকেটে। সার্জিক্যাল মাস্ক বের করে নাকে চাপালাম; ঘরের মধ্যেই। মনে মনে ভাবলাম, যাক, গোল অন্তত শোধ হলো।

ভদ্রলোক মাস্ক দেখেই স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠলেন। ভাবটা এমন, উহান থেকে পোর্ট গলিয়ে থার্মাল স্ক্যানার ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়েছি তার ড্রইংরুমে। মানে লাগল। করণীয় ভাবতে ভাবতেই তার আতঙ্কিত প্রশ্ন, ভাই, আপনার কি ঠান্ডা–কাশির সমস্যা আছে?

কঁই, নাঁ তোঁ! মাস্কের কারণে কথাটা নিজের কাছেই ভুতুড়ে মনে হলো। হেসে পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে চাইলাম।

ভদ্রলোক কূলে ভিড়তেই রাজি নন! দূর থেকেই বললেন, তাহলে মাস্কের নীল অংশ বাইরে রেখেছেন কেন?

তাই তো! মাস্কের সাদা-নীলের হট্টগোল এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। তালগোল পাকাবেই। সামান্য ভুলে গোল শোধ দেওয়ার বদলে উল্টো গোল খেয়ে গেলাম!

এরপর আর কথা জমল না। দ্রুত কাজ শেষে বেরিয়ে আসার সময় ভদ্রলোক দরজা খুলে দিলেন; ভদ্রতার খাতিরেই। আমি ধার দিয়েও গেলাম না। আমার তখনো গোল শোধ দেওয়া বাকি। মুখে ‘চলি তাহলে’ বলেই হাঁটু ভাঁজ করে পশ্চাদ্দেশে চালিয়ে দিলাম। 

করোনা ঠেকাতে করণীয় যার জানা, সেই করিৎকর্মার কিংকর্তব্যবিমূঢ় চেহারা লিফটের দরজা আটকে যেতে যেতে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। ককশেকের কথাটা আর বলা হলো না।