কার্তিকের কুয়াশায়

অলংকরণ: আরাফাত করিম

কার্তিক মাসের এক রাতে স্কুলের মাঠে তাকে পেয়েছিলাম। ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেছে ধানখেত। খেতের পাশে দেয়াল। কুঁজো হয়ে সে বসেছিল দেয়ালে। মনে করেছিলাম কুয়াশার রেখা। আসলে তা নয়। ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে ‘হেহেম’ শব্দ করলাম। মুখ তুলে সে তাকাল। বেদনায় জর্জরিত মুখ; এমন মুখ কখনো দেখিনি।

তুমি কে? তোমার কিসের এত কষ্ট?

ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে সে বলল, আমি এসেছি অনেক অনেক দূর থেকে।

তার কথা কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না। তাকে মায়ের কাছে নিয়ে গেলাম। ততক্ষণে সে অপরূপ এক তরুণী। কষ্ট নেই, মুখে মৃদু লাজ।

তার হাসি দেখে মার মনটা গলে গেল। যাকে এত দিন খুঁজছিল, তাকেই যেন পেয়ে গেল। বলল, ইবে ত ফরি।

ওর নাম পরি। মা-ই দিয়েছিল এই নাম। তারপর পরি আর আমি পাড়ি দিলাম বহু পথ। কত–কী দেখলাম, চোখের তারায় চোখ রেখে কত–কী করলাম, তা কি বলে শেষ করা যাবে!

শ্যামলা রং। জোছনারাতে মাঝেমধ্যে ডানা দুটি মেলে দেয়। গুটিয়ে নিলে অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। একদিন সে বলল, খালি খালি লাগছে।

আমারও মনে হলো, কী যেন নেই। কার যেন আসার কথা।

একদিন আমরা শহরে বেড়াতে গেলাম। টাইগারপাসের পাশে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ালাম। পাহাড় থেকে সমুদ্র দেখতে দেখতে ঠিক করলাম, তাকে আনব।

পরি চায় ফুটফুটে একটা মেয়ে। স্বপ্নের মতো তাকে গড়ে তুলবে। দীর্ঘদিন বুনে চলি স্বপ্ন। একদিন ভোরে ঘুম ভেঙে দেখি, সেই স্বপ্ন ডানা মেলেছে। ডানা দেখে পরির কেমন লজ্জা লাগে। সে মুখ ঢেকে বসে থাকে। একটু পর আঙুল ফাঁক করে আমার দিকে তাকায়।

আমি তাকে চিমটি কাটি। বলি, সে এসেছে।

পরি মুখ তুলে তাকায়। তার মুখে রংধনুর মতো রং। রংগুলো এক হয়ে পৌঁছে যায় স্বপ্নের কাছে। স্বপ্ন তখন জেগে ওঠে। জাগরণের মধ্যে আমাদের দিন কাটে। দিন গুনি আমরা। দিনগুলো, আহা! উৎকণ্ঠা, আশা আর আনন্দে পার হতে থাকে।

একদিন পেটে হাত রেখে স্বপ্নকে ছুঁয়ে পরি বলল, একটা কথা।

কী?

ভাবছি একবার ঘুরে আসব।

তোমাদের দেশে?

মাথা নাড়ে সে।

আমি ভাবি, একটা পরি পৃথিবীতে এসে জীবনযাপন করছে। মানুষের সন্তান ধারণ করেছে। তারা এটা কীভাবে নেবে? থাক, অত ভেবে কাজ নেই। আমি পরির কপালে, নাকের আগায় মুমু খাই। চুমুকে আমরা বলি মুমু।

খুশিতে ঝিকমিক করে পরির চোখ। স্বপ্নকে বলল, দারুণ এক দেশে নিয়ে যাব তোকে। স্বপ্নময় সেই দেশ। সে দেশের বাতাস আর গাছের ভালোবাসা তুই টের পাবি। সেখানকার আলো, ফুল আর পাখি সোনালি স্বপ্নের ডালা নিয়ে তোকে বরণ করবে।

মনে দুর্ভাবনার কাঁটা। তবু ভাবি, তাদের সমাজ তো গ্রহণ করতে জানে। বৈচিত্র্যকে, ভিন্ন কিছুকে নিশ্চয় তারা গ্রহণ করে। কিছুটা আশ্বস্ত হই। আমি তাকে জড়িয়ে ধরি। আমার চোখ বেয়ে পানি গড়ায়। তার চোখেও পানি। আমার ভেজা চোখে সে মুমু দেয়। আর দেয় অভয়।

ও যেহেতু অন্তঃসত্ত্বা, মা-ও ওর ইচ্ছাকে সম্মান জানায়। সে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।

প্রিয় সেই ময়নাকে অনেক দিন পর মনে পড়ল। ইচ্ছা হয় এখনই তাকে ডেকে আনি। পরির হাতে বসাই। তার ডাক শোনাই স্বপ্নকে। স্বপ্ন সেই সুরে চোখ মেলে তাকাবে।

ময়নাকে তো খাঁচায় আটকে রাখতাম। সে বেরোনোর জন্য ছটফট করত। সেই কথা মনে পড়ায় মনটা আনচান করে।

ছোট বোন সাজু টেলিভিশনে দেখল, কোত্থেকে যেন পড়ল একটা শিশু। ডাস্টবিনে তাকে খুঁজে পেল টোকাইয়ের দল। তারা তাকে নিয়ে গেল রাস্তার মোড়ে। কয়েকজন লোক তাকে পুলিশের কাছে নিল। তারপর আদালত হলো। এক দম্পতি দায়িত্ব পেল শিশুটির। ২১ ফেব্রুয়ারি পাওয়া গেল বলে তার নাম রাখা হলো ‘একুশ’।

ওই নামটুকু কুয়াশা হয়ে জমা হলো মনে।

মানুষ নিজেকে ভালো করে জানে না। আমিও কি জানি? যে পরি আমার কাছে ছিল, সে আজ কোথায়? পৃথিবীর বাইরে কোথায় কেমন জগৎ আছে, একবার যদি দেখতে পারতাম! হয়তো, আমি কোথাও যাব। স্বপ্নকে খুঁজে পাব।

ঘুম ভেঙে গেছে, কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। সূর্যের আলো দেখলে সবকিছু মনে পড়বে! বেদনায়, ক্রোধে ছটফট করব! বহুদিনের পুরোনো এই পৃথিবীকে ভেঙেচুরে নতুন এক পৃথিবী বানাতে ইচ্ছা করবে!

তবু আমি উঠি। উঠতে হয়। গাছে গাছে রোদ, পাতায় পাতায় হাসি। কিন্তু মনে হাহাকার। দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। আমি গড়াতে দিই।

কত দিন? কত বছর? পরি যে আর আসেনি! আর স্বপ্ন? তাকে আমি কীভাবে খুঁজব?

কার্তিক মাসের সেই রাতে ছিল ঘন কুয়াশা। পরির মায়াময় মুখটাও আমার মনে পড়ে। মনে হয়, এই দুনিয়া কিছু স্বপ্ন ও কুয়াশা দিয়ে সাজানো। এখানে আর কেউ নেই। আছে শুধু ধানখেত। আলে বসে আছি। কুয়াশায় ভিজে ভিজে আমিও হয়ে উঠছি কুয়াশা।

কিছুটা ভয়ার্ত কণ্ঠে হঠাৎ একটা শিশু ডাকে, বাবা, বা-বা-আ-আ...

আমি লাফিয়ে উঠি। এদিক-ওদিক খুঁজি। না, কেউ নেই। কুয়াশা ছাড়া আর কিছুই নেই। আমার চোখ দিয়ে ঝরঝরিয়ে পানি ঝরে। আমি কাঁদি, হাউমাউ করে কাঁদি।