ক্যাসেলস করিডর

এই গল্প আলো-আঁধারময়, এ গল্প রহস্যঘেরা। জুপিটার আর ভেনাসের গল্প এটি, বাস্তব আর পরাবাস্তব যেখানে মিলেমিশে আছে।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

সকালে ঘুম ভেঙেই জুপিটার তার মোবাইলে দেখে নয়টা বেজে গেছে। তাকে হাসপাতালে যেতে হবে এগারোটায়। বিছানা থেকে উঠেই দেয়ালে ঝোলানো ছবিটা দেখে সে—তার বাবার ছবি। বাঁধাই করা ছয় ফুট লম্বা কালো ফ্রেমে। জুপিটার কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ছবিটার দিকে। তারপর ধীরপায়ে হেঁটে বাইরে যায়।

বিশাল একটা করিডর। করিডরের দুই পাশে মোট সাতখানা ঘর। করিডরটা মোড়ানো ধূসর রঙের কার্পেটে। নীল দেয়ালের নিচের অর্ধেকে লাল ফুল আর সবুজ পাতার নকশা করা। দেখলে মনে হয় খোলা আকাশের নিচে একটুকরো বাগান। ছাদে সাতখানা বাতি জ্বলে আছে। রোজ এই বাড়িতে ধূপ দেওয়া হয়। ধূপের গন্ধ আর ধোঁয়ায় জুপিটারের দোতলা বাড়ির আলো-ছায়ায় ভর্তি করিডর হয়ে ওঠে ফ্যানটম অব দ্য অপেরা মঞ্চের মতোই—আলো-আঁধার-ধোঁয়ার জালে ঘেরা এক বর্ণনাতীত সৌন্দর্য। কিন্তু তার করিডরে একাধিক ফ্যানটম থাকে, একটা নয়।

জুপিটার দোতলার সিঁড়ির কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে, মতিন চাচা, কফি দাও। বলেই সে দোতলার সিঁড়ির পাশে একমাত্র বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসে। তার যমজ বোন ভেনাস পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, আকাশে আজ মেঘ করেছে। অনেক বৃষ্টি হবে। চল আজকে বৃষ্টিতে ভিজি।

বোনের দিকে তাকিয়ে জুপিটার বলে, আমার পেশেন্টগুলোও কি আমাদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজবে?

তুই আর তোর পেশেন্ট সব মর, বলেই ঘরের ভেতরে চলে যায় ভেনাস। একটু পর তার পাশে এসে দাঁড়ায় পোষা ময়ূর দুটি। জুপিটার ওদের দেখে হাসে। তার নীল জিনসে ওরা মাথা ঘষে। ওদের মাথায় হাত রেখে আদর করে জুপিটার।

পুরান ঢাকার এই সাদা দোতলা বাড়িটিকে বাইরে থেকে দেখলে ছোট একটা রাজপ্রাসাদের মতো মনে হয়। তাই স্থানীয়রা একে রাজবাড়ি বলে। এই বাড়ির সদর দরজার সামনের দুই পাশে দুটো বড় ময়ূরের মূর্তি আছে। কালো একটা বিশাল দরজার ওপর দুটো রঙিন ময়ূর বসে আছে। কালো দরজার ওপর খোদাই করা গোল একটা বৃত্তের নকশা। জুপিটারের দাদা বানিয়েছিল বাড়িটা। তার আদরের যমজ নাতনি হওয়ার পর গেটের ওপর ময়ূর দুটি বসিয়েছিল। ময়ূর দুটির নাম ছিল নাতনিদের নামে—জুপিটার ও ভেনাস। দাদা মারা গেলে এই বাড়ির মালিক হয় জুপিটার আর ভেনাস।
মতিন চাচা কফির মগ টেবিলে রেখে প্রশ্ন করে, আম্মা, আজকেও দেরি হবে বাসায় আসতে?

হতে পারে, উত্তর দেয় জুপিটার।
মতিন চাচা আর কিছু না বলে চলে যায়। এই বাড়ির বর্তমান বাসিন্দা জুপিটার, তার যমজ বোন ভেনাস, মতিন চাচা, দুটি ময়ূর আর কিছু ঘর।

জুপিটার রেডি হওয়ার সময় ভেনাস তার ঘরে আসে এক জোড়া কানের দুল নিয়ে। দেখ, আমি কানে ময়ূরের পালক পরেছি, বলেই সে নিজের কানে ঝুলতে থাকা পালক দেখায়।

জুপিটার বলে, সুন্দর লাগছে। ভেনাস তার হাতে থাকা পালক দুটি জোর করে জুপিটারের কানে পরিয়ে দেয়। বলে, চল আজকে আমরা ঘুরতে যাই। তারপর তোকে একটা শাড়ি কিনে দেব, চল…

আজ না, কালকে যাব, বলে জুপিটার জুতা পরতে শুরু করে। ভেনাস মুখ বাঁকা করে ‘বিকেলে দেখা হবে’ বলে নিজের কাজে চলে যায়।

ড. জুপিটার আহমেদ যখন হাসপাতালে ঢোকে, তখন তাকে দেখলে মনে হয় না সে ডাক্তার। ছেঁড়া জিনস আর সাদা টি-শার্ট, লম্বা খোলা এলোমেলো চুলের জুপিটারকে দেখলে ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট মনে হলেও তার বয়স পঁয়ত্রিশের ঘরে।

হাসপাতালে ঢুকেই নিজের ঘরে ব্যাগ রেখে বের হয়ে ৯ নম্বর কেবিনে যায় জুপিটার। তাকে দেখে বিছানায় সোয়া দশ বছরের পেশেন্ট উঠে বসে। বোন ক্যানসারের পেশেন্ট অহনা তাকে দেখে খুশিতে দাঁত দেখিয়ে দেয়। বিছানার কাছে গিয়ে অহনাকে কোলে নেয় জুপিটার। কোলে করেই হাসপাতালের ছাদে যায়। অনেকক্ষণ কথা বলে তারা। আকাশ, পাখি, মানুষ দেখিয়ে অহনাকে আবার ওর রুমে রেখে নিজের ঘরে বসে জুপিটার। ছোট বাচ্চা হলেও অহনার মানসিক চিকিৎসা দরকার।

একে একে জুপিটারের অন্য পেশেন্টরা আসতে থাকে। তাদের মানসিক সমস্যার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে সে। তাদের মস্তিষ্কে বসবাসরত বিভিন্ন রকম বাসিন্দা। চিন্তা, দানব, হতাশা, অপ্রাপ্তি, শূন্যতা, দ্বন্দ্ব, লজ্জা, অপরাধ—এমন বিবিধ বাসিন্দার সঙ্গে লড়তে হয় জুপিটারকে। শুধু ওষুধেই এই সব যুদ্ধ জেতা যায় না। লাগে কৌশল। লাগে মনোবল। আর দরকার হয় অসীম ধৈর্য।

একবার জুপিটারের এক পেশেন্ট সঙ্গে করে ব্লেড নিয়ে এসেছিল। সেই ব্লেড দিয়ে সে জুপিটারের হাত কেটে দেয়। হাতে তখন পাঁচটা সেলাই লেগেছিল। আর ওই পেশেন্ট হাসপাতালে থাকা অবস্থায় আত্মহত্যা করেছিল। এমন আরও কিছু ভয়ংকর রোগী জুপিটারের আছে। তাদের দেখলে অনুমান করা যায় না যে তারা কী কী কর্ম, অপকর্ম ও কুকর্ম করতে পারে। তাই ভয়ংকরের সঙ্গেই জুপিটারের সকাল-সন্ধ্যা, দিন-রাত্রি।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে জুপিটার বেশ সফল। কারণ, মস্তিষ্কের অপ্রত্যাশিত বাসিন্দাদের ঘরে ঢুকে তাদের সঙ্গে কীভাবে চা খেতে হয়, সেটা সে ভালোই জানে। মাঝেমধ্যে চা খেতে খেতেই তাদের খুন করে কবর দিয়ে ফেলে। অথবা তাদের মুক্ত করে দেয় খোলা আকাশের নিচে। এভাবেই একজনের মস্তিষ্কের কৌশল জয়ী হয় আরেকজনের মস্তিষ্কের দৈত্যের সঙ্গে।

ড. সেন ঘরের দরজা খুলেই বলে, কিরে বৃহস্পতি, আজকে কয়টা শনির সঙ্গে যুদ্ধ করলি?

বন্ধুর কথা শুনে জুপিটার হাসে, শনি থেকে বৃহস্পতির দূরত্বে যতগুলো গ্রহ-ধূমকেতু-উল্কা-গ্রহাণু আছে, সব কটির সঙ্গে।

সেনও হেসে বলে, রাতে টিয়ার বাসায় দাওয়াতে আসার সময় আমার জন্য দান্তের ‘ইনফারনো’ বইটা নিয়ে আসিস। আর তোর ক্যাসেলস করিডরে বসে থেকে থেকে দাওয়াতে আসতে আবার দেরি করে ফেলিস না, বলেই সেন চলে যায়।

শেষ রোগী চলে যাওয়ার পর জুপিটার ল্যাপটপ বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার জন্য বের হতে গেলেই নার্স শেফালি এসে তাকে জানায়, ৯ নম্বরের পেশেন্টের অবস্থা খারাপ। শুনেই দৌড় দেয় জুপিটার। ৯ নম্বর ঘরে গিয়ে শোনে অহনাকে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছে। সিসিইউতে গিয়ে জুপিটার শুনতে পায়, ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধরত অহনা হার্টের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গেছে। সে মুহূর্তে অহনার মা-বাবার চিৎকার আর জুপিটারের কানে যায় না।

নিথর শুয়ে থাকা অহনার মাথায় হাত রাখে সে। কানে ভাসে অহনার সেই ট্রেনের হুইসেলের মতো হাসি। অহনা নামের ট্রেনটা আজকে জীবনের প্ল্যাটফর্ম থেকে মৃত্যুর লাইনের ওপর দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে চলে গেছে তার নির্দিষ্ট অ্যাডভেঞ্চারে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে যে জুপিটার হাত নেড়েছিল, কেঁদেছিল, ভালোবাসি বলেছিল, সেগুলো কি অহনা একবার পেছন ফিরে দেখে নিয়েছিল?

তৃতীয় ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে জুপিটার হাসে। এই ঘরের দরজায় চারটি বৃত্তের নকশা। দরজা খুলে ভেতরে যায়, খাটে বসে দেয়ালে ঝোলানো ভেনাসের ও তার সঙ্গে তাদের দাদার হাস্যোজ্জ্বল ছবিটা দেখে। এই সময়টাতে ফিরে যেতে চায় সে, এ সময়ের প্রতি তার খুব লোভ। লোভীর মতো ছেলেবেলার ওই সময়টা খুঁজে ফেরে সে—যখন সে, ভেনাস আর দাদা এই বাসায় থাকত। দাদার প্রতি তাদের ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। খাটে রাখা বালিশের একটাতে মাথা রাখে জুপিটার, ওর চোখ দেয়ালের ছবিতে স্থির। ধীরে ধীরে তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে, জুপিটার ঘুমিয়ে পড়ে।

সন্ধ্যায় বিধ্বস্ত জুপিটার বাসায় ফেরে। বাসার সামনের বাগানে রাখা দোলনা দুটির একটায় ভেনাস বসে আছে। গিয়ে তার পাশের দোলনায় বসে সে।
ভেনাস প্রশ্ন করে, দিন কেমন গেল?
ভালো না, উত্তর দেয় জুপিটার।

একটা কবিতা শুনবি, বলেই ভেনাস তার কোলের ওপর রাখা জুপিটারের ডায়েরিটা খুলে পড়তে শুরু করে।

তোমাকে কল্পনায় গড়া—
আমার না-লেখা অসংখ্য গল্পের ভেতর,
সেই সব রঙে যার অস্তিত্ব কোথাও নেই;
ধাঁধার মতোই প্রতি সূর্যাস্তে একটুকরো।
অল্প অল্প করে—
তোমার নকশা, ছায়া, স্তর, কায়া গড়ি;
লুকিয়ে রাখা নিজের অসংখ্য টুকরো দিয়ে,
এত টুকরো দেখে অবাক হয়ে যায় হিমালয়।
সৃষ্টি—
তোমাকে বড় হতে দিই বছর থেকে বছর,
তোমার নাম দিই ভালোবাসা, ঢেকে দিই ভালোবাসায়;
তোমার হাতে দিই মাটি-আকাশ-আলো-মহাকাল।
ভালোবাসা—
তোমার জন্য তৈরি করি আকাশসমান দুর্গ
জাদু-কবচ-মন্ত্র স্পর্শ করে না এমন উচ্চতায়;
অন্ধকার কক্ষে রেখে দিই প্রাচীন পরীক্ষিত সব দানব।
আমার—
ভালোবাসা তোমাকে অভিশাপ দিই তোমার সৃষ্টির পূর্বে;
ইচ্ছেপূরণ অথবা পরীক্ষা, সৃষ্টি তোমার রক্ষা, সুরক্ষায়;
আসুক কৃষক, মাঝি, মন্ত্রী, রাজা; দানবের হত্যাকারী হলেই সে পাবে—
তোমাকে কল্পনায় গড়া অল্প অল্প করে নিজের সৃষ্টি ভালোবাসা আমার।

বাসার গেট খোলে মতিন চাচা, ভেনাস তখনো দোলনায় বসে আছে। মতিন চাচার হাতে নিজের ব্যাগ দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় চলে যায় জুপিটার। করিডরে দাঁড়িয়ে দেখে আজকেও ধূপ দিতে ভুলে যায়নি মতিন চাচা।

জুপিটার প্রথম ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায়। দরজার মধ্যে দুটি বৃত্তের নকশা। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে সে। ঘরে একটা বিছানা ছাড়া আর কিছুই নেই। বিছানার উল্টো দিকের দেয়ালে ঝুলছে ছয় ফুটের একটা ছবি। ছবিটার মধ্যবয়সী লোকটা হাসছেন। আবিদ আহমেদ—জুপিটারের বাবা হাসছেন। জুপিটারের বাবা শখ করে যমজ মেয়েদের নাম জুপিটার আর ভেনাস রেখেছিলেন। ওদের বাবার প্রিয় কাজ ছিল টেলিস্কোপ দিয়ে রাতের আকাশ দেখা। বাবা তাদের নিয়ে রাতের আকাশ দেখতেন।

তাদের চেনাতেন, দেখাতেন ও শেখাতেন কোনটা গ্রহ-নক্ষত্র-উল্কা আর ছায়াপথ।
জুপিটারের জীবনে দশ বছর পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু তারপর শুরু হয় উল্কাঝড়। বাবা তাদের মা-সহ তাদের এই বাড়িতে রেখে চলে যান আরেকজনের কাছে। খাটে বসে কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে বের হয়ে যায় জুপিটার।

দ্বিতীয় ঘরের দরজায় তিনটি বৃত্তের নকশা। সে দরজা খুলে ভেতরে যায়। এ ঘরের মধ্যেও খাটে গিয়ে বসে। দেয়ালে ঝোলানো কুশলের ছবি—তার আর কুশলের বিয়ের ছবি। জুপিটার এমবিবিএস শেষ করেই কুশলকে বিয়ে করেছিল। বছর দুয়েক পর্যন্ত সব ভালোই ছিল, কিন্তু কুশলের অতিরিক্ত মদ্যপান আর নিতে পারছিল না সে। এটা ঠিক যে কুশল কখনোই তার গায়ে হাত তোলেনি। কিন্তু ড. জ্যাকল অ্যান্ড মি. হাইড ছিল কুশল, দিনে এক রকম, রাতে আরেক রকম, দিনে শান্ত, রাতে অস্থির, দিনে বরফের পাহাড়, রাতে আগ্নেয়গিরি। এসব মেনে নিতে পারেনি জুপিটার। অনেক চেষ্টা করেও তার আসক্তি ছাড়াতে পারেনি।

জুপিটার খাট থেকে উঠে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
তৃতীয় ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে জুপিটার হাসে। এই ঘরের দরজায় চারটি বৃত্তের নকশা। দরজা খুলে ভেতরে যায়, খাটে বসে দেয়ালে ঝোলানো ভেনাসের ও তার সঙ্গে তাদের দাদার হাস্যোজ্জ্বল ছবিটা দেখে। এই সময়টাতে ফিরে যেতে চায় সে, এ সময়ের প্রতি তার খুব লোভ। লোভীর মতো ছেলেবেলার ওই সময়টা খুঁজে ফেরে সে—যখন সে, ভেনাস আর দাদা এই বাসায় থাকত। দাদার প্রতি তাদের ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। খাটে রাখা বালিশের একটাতে মাথা রাখে জুপিটার, ওর চোখ দেয়ালের ছবিতে স্থির। ধীরে ধীরে তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে, জুপিটার ঘুমিয়ে পড়ে।
আম্মা…আম্মা...

চোখ খুলে মতিন চাচাকে দরজায় দাঁড়ানো দেখে জুপিটার।
আম্মা...মতিন চাচা কাঁদছে।
মতিন চাচা ধীরে ধীরে জুপিটারের খাটের কাছে এসে দাঁড়ায়। বলে, আম্মা, ময়ূর দুটোকে পাড়ার ছেলেরা বাদামের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে দিয়েছে। তারা বাড়ির সামনে মরে পড়ে আছে।

শুনে জুপিটার চোখ বন্ধ করে। কিছুক্ষণ পর বলে, চাচা, তুমি জুপিটার আর ভেনাসকে বসার ঘরে রেখে বাসায় চলে যাও, বলেই সে বিছানা থেকে উঠে বসে।

চতুর্থ ঘরের দরজায় পাঁচটা বৃত্তের নকশা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জুপিটার একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে খাটের ওপর গিয়ে বসে। দেয়ালে ঝুলন্ত ছবিটা দেখে। ছবিতে তার মা গলায় দড়ি দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছেন। জুপিটারের বাবার দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে পারেননি শায়লা আহমেদ। তাই মেয়েদের কথা না ভেবেই এক রাতে গলায় দড়ি দিয়ে চলে গেলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে মাকে খুঁজতে গিয়ে তাকে ঝুলন্ত দেখে জুপিটার অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফিরলে দেখে, সে শুয়ে আছে দাদার কোলে আর মতিন চাচা পানি ঢালছে তার মাথায়। আর তার হাত ধরে বসে আছে ভেনাস। দাদা যখন মারা যান, জুপিটারের বয়স তখন ত্রিশ। ময়ূর দুটি ছিল তার দাদার।

মতিন চাচা রোজ সকালে এসে এ বাড়ির সব কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যায়। জুপিটারের চোখ দিয়ে জল গড়ায়। মাকে তার খুব বোকা মনে হয়। একটা মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য কেউ এভাবে নিজের জীবন নিয়ে নেয়?

খাট থেকে উঠে মায়ের ছবিতে হাত রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় জুপিটার।
পঞ্চম ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে জুপিটার ভেনাসকে ডাকে। ভেনাস, এই ভেনাস, এদিকে আয়।

এই ঘরের দরজায় ছয়টা বৃত্তের নকশা। ভেনাস না আসায় ঘরের দরজা খুলে জুপিটার আবারও খাটের ওপর গিয়ে বসে। দেয়ালে ঝোলানো তার আর ভেনাসের আঠারো বছর বয়সের ছবি। ছবিতে সে আর ভেনাস বাগানের দোলনায় বসা। ভেনাস ছোটবেলা থেকেই অহংকারী, কিন্তু এটা তার দোষ নয়। নামের দোষ। সুন্দরী ভেনাসকে কল্পনা করেই হয়তো সান্দ্র বতিচেল্লি তাঁর বিখ্যাত কিছু সৃষ্টির নাম রেখেছিলেন। ভেনাস অনেক বেশি উজ্জ্বল জুপিটারের চেয়ে, কিন্তু এটা তার দোষ নয়, সূর্যের দোষ। সূর্যের চেয়ে দূরত্ব বেশি হওয়ার জন্য জুপিটারে আলো কম পড়ে, তাই জুপিটার আলো কম ছড়ায়; জুপিটার তার ঠান্ডা অস্তিত্ব নিয়ে দূর অন্ধকারেই থাকে। অহংকারী ভেনাস সূর্যের কাছের। আলোর কাছের। সুন্দরের কাছের। রেনেসাঁর কাছের।

ষষ্ঠ ঘরের দরজায় সাতটা বৃত্তের নকশা। জুপিটার হাতঘড়িতে সময় দেখে। ভেনাস এসে জুপিটারের কাঁধে হাত রেখে বলে, আমি তোকে ভালোবাসি জুপিটার। বলেই সে উল্টো দিকের বারান্দায় চলে যায়। ঘরের দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে খাটে বসে। এ ঘরেও একটি খাট আর একটি ছবি ঠিক আগের ঘরগুলোর মতোই। দেয়ালে ঝুলছে তার প্রথম ব্যর্থতার ছবি, কাঞ্চনার ছবি। জুপিটার তখন সদ্য ডাক্তারি শুরু করেছে। তার প্রথম কিছু পেশেন্টের মধ্যে একজন ছিল কাঞ্চনা। বাইপোলার ডিজঅর্ডার ছিল তার।

জুপিটার অনেক চেষ্টা করেছে। তবে পরের দিকে হাল ছেড়ে দিয়েছিল। পরে কাঞ্চনা একদিন ছাদ থেকে ঝাঁপ দেয়। ওর মৃত্যুর পর জুপিটার আর কখনো কোনো রোগীর বেলায় হাল ছেড়ে দেয় না, সে শেষের শেষ রাস্তায় হাঁটে, চেষ্টা করে এবং বেশির ভাগ সময় সফল হয়। কাঞ্চনার ছবির দিকে তাকিয়ে জুপিটার ফিসফিসিয়ে বলে, দুঃখিত…ভীষণ দুঃখিত কাঞ্চনা, বলেই দরজা খুলে বেরিয়ে যায় সে।

সপ্তম ঘরের দরজায় আটটা বৃত্তের নকশা। জুপিটার দরজা খুলে ভেতরে যায়। দেয়ালে ঝোলানো ছবিটার সামনে দাঁড়ায়। ড. অনিরুদ্ধ সেনের ছবি। সেন তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হলেও তাকে সে হিংসা করে প্রথম দিন থেকেই। সেনের প্রায় সবকিছুই আছে, যার অনেকটাই তার নেই। সেনকে সে তার হিংসার কথা বলেছেও। শুনে সেন হাসে।

ভেনাসকে ছেড়ে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা জুপিটার করেছিল সেই ছোটবেলায়। দোতলার সাতটি রুম থেকে চিৎকার ভেসে আসে। নিজ নিজ ঘরের জানালায় এসে দাঁড়ায় পুড়তে থাকা তার বাবা, মা, সেন, কুশল, কাঞ্চনা, দাদা, দুটি ময়ূর ও ভেনাস। জ্বলন্ত ভেনাসের চিৎকারে আর ভেসে আসা পোড়া মাংসের গন্ধে সে চোখ বন্ধ করে। চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে জুপিটারের। জ্বলতে থাকে নরকের স্তর-ঘর-বাসিন্দা। দান্তে বেঁচে থাকলে জুপিটার তাঁকে বলত যে নরকের স্তর শুধু মৃত্যুর পরই সীমাবদ্ধ নয়, জীবিত থেকেও সেই স্তর দেখা যায়। জুপিটারের চোখের সামনে জ্বলতে থাকে তার ঘরগুলোকে একসঙ্গে যুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ স্থান, তার নরকের-বাড়ির-মস্তিষ্কের ক্যাসেলস করিডর।

জুপিটার ডা. সেনকে যতটা হিংসা করে, ততটা শ্রদ্ধাও তার আছে ওর প্রতি। তাকে সে খুব ভালোও বাসে। জুপিটারের সব জানে সেন, বৃত্তের ভেতর বৃত্তদের কথা জানে। সেনকে অনেকবার চেষ্টা করেও ক্লাসে-কাজে-জীবনে সে হারাতে পারেনি। বন্ধু হয়ে বন্ধুকে হিংসা করা প্রতারণা। কিন্তু এ ব্যাপারে জুপিটার যে প্রতারক, সেন এটা জানে।
জুপিটার হাসে। সেনের ছবিকে বলে, একদিন ঠিক ঠিক আমি জিতে যাব দেখিস, বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে।

ধীরে ধীরে করিডরের দেয়ালে হাত রেখে হাঁটতে থাকে জুপিটার। সিঁড়িতে এসে বসে, হাঁটুতে মাথা রেখে কিছুটা সময় চোখ বন্ধ করে থাকে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়। বসার ঘরের মাটিতে দুটি মৃত ময়ূরকে পাশে নিয়ে ভেনাস কাঁদছে। জুপিটার বোনকে দেখে, সামনে গিয়ে বোনের মাথায় হাত রাখে। ভেনাসও জুপিটারকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। বোনকে জুপিটার ধরে রাখে কিছুক্ষণ, তারপর দুটি ময়ূর থেকে দুটি পালক ছিঁড়ে নিয়ে রান্নাঘরে যায়। চুলার পাশে রাখা ম্যাচটা পকেটে ভরে। স্টোররুমে গিয়ে কেরোসিনের গ্যালনটা হাতে নিয়ে বাড়ির এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত কেরোসিন ঢালে। বসার ঘরে মাটিতে বসে কান্নারত ভেনাসকে একবার দেখে বাসার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ম্যাচের একটি কাঠি জ্বালিয়ে বাসার ভেতরে ফেলে দরজা আটকিয়ে দেয় বাইরে থেকে।

জুপিটার ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে বাড়ির সামনে থাকা দোলনায় বসে। চোখের সামনে পুরো বাড়িতে আগুন ছড়িয়ে যায়। দোলনায় দোল খেতে খেতে আগুনে পুড়তে থাকা নিজের বাড়িটা দেখে জুপিটার। চোখের সামনে সে তার প্রিয় দান্তের ‘ইনফারনো’ দেখে—জীবন্ত-জটিল-জ্বলন্ত। বাড়িটা নরকের প্রথম বৃত্ত। একে একে সাতখানা ঘর একেকটা স্তর, নরকের বৃত্ত। নরকের শেষ বৃত্তটি সে মাত্র রচনা করেছে ভেনাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে।

ভেনাসকে ছেড়ে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা জুপিটার করেছিল সেই ছোটবেলায়। দোতলার সাতটি রুম থেকে চিৎকার ভেসে আসে। নিজ নিজ ঘরের জানালায় এসে দাঁড়ায় পুড়তে থাকা তার বাবা, মা, সেন, কুশল, কাঞ্চনা, দাদা, দুটি ময়ূর ও ভেনাস। জ্বলন্ত ভেনাসের চিৎকারে আর ভেসে আসা পোড়া মাংসের গন্ধে সে চোখ বন্ধ করে। চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে জুপিটারের। জ্বলতে থাকে নরকের স্তর-ঘর-বাসিন্দা। দান্তে বেঁচে থাকলে জুপিটার তাঁকে বলত যে নরকের স্তর শুধু মৃত্যুর পরই সীমাবদ্ধ নয়, জীবিত থেকেও সেই স্তর দেখা যায়। জুপিটারের চোখের সামনে জ্বলতে থাকে তার ঘরগুলোকে একসঙ্গে যুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ স্থান, তার নরকের-বাড়ির-মস্তিষ্কের ক্যাসেলস করিডর।

জুপিটারের ঘুম ভাঙে মতিন চাচার হাঁড়ি-পাতিল ধোয়ার শব্দে। এক চোখ খুলে সে বলে, মতিন চাচা, কফি দাও।

খানিক পর কফির মগ এনে দেয় মতিন চাচা। বিছানায় বসে কফি খেতে থাকে সে। তার এই নতুন বারোতলার দুই হাজার স্কয়ার ফিটের বাসায় একটাই রুম। এখানেই তার বিছানা, বসার জায়গা, রান্নাঘর। বাড়তি ঘর রাখেনি, এখন আর বাড়তি ঘরের প্রয়োজন নেই। মতিন চাচা এখনো সকালে এসে কাজ করে বিকেলে চলে যায়।

কফি শেষ করে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি হয় জুপিটার। বের হওয়ার সময় মতিন চাচাকে জানিয়ে দেয়, আজ রাতে সেনের বাসায় খাবে। রান্না করার প্রয়োজন নেই, বলেই সে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যায়।

মতিন চাচা তাকিয়ে থাকে জুপিটারের চলে যাওয়ার দিকে। তার মনে পড়ে যায়, সেই রাতে বাসায় আগুন লাগলে পাড়ার ছেলেরা তাকে বাসা থেকে ডেকে আনে। বাসাটা তার চোখের সামনে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সে ডান দিকে তাকিয়ে দেখে দোলনায় বসে বাসার দিকে তাকিয়ে আছে জুপিটার, তার হাতে ধরা দুটি ময়ূরের পালক।

জুপিটারকে সে পাগলামির জাহাজে করে অনিশ্চয়তার ঝড়ের ভেতর দিয়ে শূন্যতার দ্বীপে যেতে দেখেছে বহুবার। কিন্তু সেই দিনের মতো শূন্যতা জুপিটারের চোখে মতিন চাচা কখনো দেখেনি। এমনকি যেদিন ভেনাস দোলনা থেকে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়ে মারা যায়, সেদিনও না।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]