ঘাম ও ঘাসের গন্ধ

টেলিভিশন অফিসগুলোতে সন্ধ্যা সাতটার প্রাইম নিউজ শুরুর আগে মুষলধারে বৃষ্টির মতো কুকুর–বিড়াল টাইপের ব্যস্ততা শুরু হয়। প্রোডিউসার মাথা খারাপ মানুষের মতো এলোমেলো পায়ে এডিট প্যানেল আর পিসিআরে ছোটাছুটি করে, নিউজ এডিটর জগৎসংসার ভুলে ঝুঁকে থাকে কম্পিউটরের স্ক্রিনে, কি-বোর্ডে সতর্ক আঙুলে চলে শেষ মুহূর্তের সংশোধনী। প্রেজেন্টার মেকআপ শেষ করে আখেরিবারের মতো আরেকবার অসন্তুষ্ট চোখে আয়নায় নিজেকে দেখে শাড়ির আঁচল টেনেটুনে ঠিকঠাক করে স্টুডিওর দিকে পা বাড়ায়। ঠিক সময়ে প্যাকেজ ধরাতে রিপোর্টারের টেনশন বাড়তে থাকে। ওই সময়টায় অফিসে সাধারণত বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবু যখন ইন্টারকমে রিসিপশন থেকে জানায়, এই অসময়ে কেউ একজন আমার সাথে দেখা করতে এসেছে, স্বভাবতই তখন বিরক্ত হই।

‘কে? কোথা থেকে এসেছে? নাম কী? দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। বসতে বলেন।’

অনেকগুলো দশ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর মনে করানোর জন্য আবার ফোন আসে।

ততক্ষণে নিউজ প্রায় শেষের দিকে, ব্যস্ততা নিভে এসেছে। পরবর্তী নিউজের আগে দুই ঘণ্টার ঢিলেঢালা সময় আছে হাতে। আগন্তুককে কক্ষে আসার অনুমতি দিয়ে তার পাঠানো ভিজিটিং কার্ডে নিরুত্তাপ চোখ বোলাই।

ফেরদৌস মামুন

প্রফেসর, ডিপার্টমেন্ট অব পলিটিক্যাল স্টাডিজ

ইউনিভার্সিটি অব সাস্কাচেওয়ান, কানাডা।

নামটা তাৎক্ষণিক কোনো অর্থ বহন করল না, কোনো ছবিও চোখে ভাসল না, কে এই প্রফেসর? কী চান আমার কাছে? হুম, মনে হচ্ছে বিদ্বান লোক, জ্ঞানবৃক্ষের সব ফল খেয়ে এবার হালকা–চটুল মিডিয়া জগতে সেই জ্ঞান বিতরণ করতে এসেছেন। এ রকম অহরহই অনেকে আসেন। ফলে কফির কাপে চুমুক দিয়ে নিস্পৃহ উদাসীনতা নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করি আমি। কোট–টাই পরা মাথায় কাঁচা–পাকা চুল, প্রায় মধ্যবয়সী, যেন অনেকটা পথ দৌড়ে এসেছেন—এমন ক্লান্ত চেহারার একজন ভারী চশমা পরা মানুষ এসে সামনে বসে।

‘কেমন আছ? চিনতে পেরেছ আমাকে?’

মস্তিষ্ক অতি দ্রুত তার সার্চ ইঞ্জিন চালু করে দিল, চশমার আড়ালে অধ্যাপকের ভাবুক চোখের দিকে তাকিয়ে অতর্কিতে আমি ফিরে গেলাম পঁচিশ বছর আগের গ্রীষ্মকালের এক বিকেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির দোতলায়, যেখানে আমি আর ঝুমু পেছন দিককার একটা টেবিলে একগাদা বই সামনে ছড়িয়ে নিচু গলায় টুকটুক করে গল্প করছিলাম। তখন সেকেন্ড ইয়ার মাত্র শুরু, মাথামুণ্ডু ছাড়া আজগুবি গল্পে দুজন এমন ডুবে আছি যে আশপাশে খেয়ালই নেই, অনেকটা আপনাতেই আপনি বিভোর অবস্থা।

হঠাৎ তাকিয়ে দেখি আমাদের টেবিলের সামনে এক সুদর্শন তরুণ দাঁড়িয়ে। তার চোখে কেমন বিভ্রান্ত চাউনি, এলোমেলো চুল, ফরসা মুখে সবুজ রঙের খোঁচা খোঁচা দাড়ি–গোঁফ। ঝুমু আর আমি একটু ভড়কে যাই।

‘যদি কিছু মনে না করেন, আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন?’ তরুণ সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে।

‘মানে কী?’ আমি রীতিমতো তোতলাই। ভয়ে আঁকড়ে ধরি ঝুমুর হাত।

‘উইল ইউ ম্যারি মি?’

তরুণ আবার অনুনয় করে। ঝুমু এবার ধমকে ওঠে।

‘আরে, কী বলছেন এসব?’

‘আমি এক বছর ধরে আপনাকে ফলো করেছি, অন্য কারও সাথে সম্পর্ক নেই আপনার...।’

‘তাতে কী হয়েছে? সম্পর্ক না থাকলেই আপনাকে বিয়ে করতে হবে নাকি?’

আমার হয়ে ঝুমুই পাল্টা প্রশ্ন করে, তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই ‘যত্তসব! চল তো মিঠু...’ বলে হ্যাঁচকা টানে আমাকে দাঁড় করিয়ে হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। বলে, ‘পাগল–ছাগলে দুনিয়া ভরে গেছে, দেখেছিস!’

তখনো আমার হতচকিত ভাব কাটেনি। লাইব্রেরির সামনে নিমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে শক্ত করে ঝুমুর হাত ধরে থাকি আমি।

‘বেচারা একেবারে দেওয়ানা মদিনা হয়ে গেছে...কেমন আপন ভোলা চোখ-মুখ,’ ঝুমু মুখ টিপে হাসে, ‘কিরে, রাজি হয়ে যাবি নাকি?’

জীবন নিয়ে আমার তখন কত পরিকল্পনা! চোখভর্তি কত স্বপ্নঘোর! তার মধ্যে বিয়ে নামের একটা যাচ্ছেতাই খাঁচায় স্বেচ্ছায় ঢুকে পড়ব! তা–ও এ রকম অচেনা–অজানা মতিচ্ছন্ন এক তরুণের সাথে? ওয়াক।

ঝুমুর হাত ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি সাড়ে পাঁচটার বাস ধরে বাসায় ছুটি।

আমাদের বাসা তখন মিরপুরে। তিন রুমের টিনশেড বাসা, সামনে একচিলতে উঠান। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটবিহীন শান্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তের রক্ষণশীল নিস্তরঙ্গ জীবন যেমন, তেমনই। নিরুত্তেজ বিকেলগুলো আমার কাটে গল্প–উপন্যাসের কালো অক্ষরঠাসা পৃষ্ঠার ওপর উপুড় হয়ে মুখ গুঁজে। তেমনই এক সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই অলস মৃদুমন্দ বিকেল ছিল সেটা। আম্মা এসে বলল, ‘মিঠু, একটা ছেলে আসছে, তোমার খোঁজে...।’

‘কী?’ আমি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠি। আমাদের বাসায় কখনোই কোনো ছেলে বন্ধুর প্রবেশাধিকার নেই। আব্বা জানতে পারলে মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেবে। আমার নিজস্ব গণ্ডির চেনাজানা সব ছেলেই আব্বার এই নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে অবহিত। তাহলে কোন বীরপুরুষ জেনেশুনে আমার সর্বনাশ করতে সেই অবরোধের প্রাচীর ভাঙতে এল? ভাগ্যিস আব্বা এখন বাসায় নেই! থাকলে খবর হয়ে যেত!

তড়িঘড়ি ওড়না আর চুল ঠিকঠাক করে বেরিয়ে দেখি লাইব্রেরির সেই পাগলাটা উষ্কখুষ্ক চুলে উঠানে দাঁড়ানো, আমার তখন অধিক শোকে পাথর অবস্থা। আম্মা শক্ত মুখে ভদ্রতা করে তাকে বাইরের ঘরে বসতে দিলেন। তারপর আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা কণ্ঠে বললেন, ‘আপদ বিদায় করো তাড়াতাড়ি, তোমার আব্বা বাসায় আসতে আর বেশি দেরি নাই।’

‘উফ্! আম্মা, এইটারে বাসায় ঢুকতে দিলা কেন? আমি তো এরে ভালোমতো চিনিই না!’ আমিও ফিসফিস করি।

‘কিন্তু ও তোমার নাম বলল যে, বলল তোমার নাকি পরিচিত...’ আম্মার চোখে সরল বিশ্বাস!

এবার আমি বেশ একটা যুদ্ধংদেহী ভাব নিয়ে তার মুখোমুখি হলাম, ‘আপনার কত বড় সাহস আমার বাসায় এসে হাজির হয়েছেন? বুঝতে পারছেন না আপনার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নাই।’

‘তুমি কি তাহলে অন্য কাউকে ভালোবাসো?’ সে কাতর কণ্ঠে জানতে চায়।

‘ওহ্! সেই কথা আপনাকে কেন জানাব? তাতে কী আসে–যাবে?’

আমার ঝাঁজালো গলার সামনে আর কোনো শব্দ না করে চুপচাপ মাথাটা বুকের দিকে নামিয়ে বসে রইল সে।

‘প্লিজ, চলে যান। আপনাকে দেখলে আব্বা খুব রাগ করবেন।’ আমি বললাম।

এই কথায় ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর পরাজিত মানুষের মতো টলমল পায়ে এগোল দরজার দিকে। যেতে যেতে ফিরে তাকাল একবার, সন্ধ্যার আবছা আলোতে মনে হলো বিহ্বল চোখ দুটোতে উপচে পড়ছে বেদনা। আমি তার পিছু পিছু যাচ্ছি উঠান পেরিয়ে দরজা বন্ধ করতে, দরজা পেরোনোর ঠিক আগমুহূর্তে সাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল সে, আচমকা দুই হাতে জড়িয়ে ধরল আমাকে নিজের বুকের সাথে, ঘাম আর ঘাসের একটা ভেজা ঝিম ধরা গন্ধে হঠাৎ যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল, ছটফট করে উঠলাম, হয়তো চিৎকারই করতাম, কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র, তারপরই সে ছেড়ে দিল, প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল রাস্তায়। আমি ঝড়ে ডানাভাঙা পাখির মতো হতভম্ব—নির্বাক হয়ে বসে পড়লাম।

এই মুহূর্তে তার চশমা ঢাকা চোখের দিকে তাকিয়ে বহুদিনের পুরোনো সেই ঘাম–ঘাসের ভেজা গন্ধের স্মৃতি কোথা থেকে উড়ে এসে নাকে ঝাপটা দিল আবার। একটু ধাতস্থ হতেই মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই বনলতা সেনের মতো বেরিয়ে এল, ‘তারপর...বলেন, এত দিন কোথায় ছিলেন?’

কাঁধ ঝাঁকাল লোকটা, ‘এই তো ছিলাম...ঘুরলাম, ভাসলাম কচুরিপানার মতো দেশ–বিদেশ। কানাডায় আছি ছয় বছর...ছাত্র পড়াই...।’

কিছুক্ষণ আর কথা খুঁজে পাই না। কী বলব? কীই–বা বলার আছে? এই লোকটা সম্পর্কে সত্যি বলতে আমার কোনো কৌতূহল নেই। অনেক দিন একটা চাপা রাগ পুষে ছিলাম তার প্রতি, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই রাগও ফিকে হয়ে গেছে। মিরপুরের গাঢ় সন্ধ্যার সেই অপ্রত্যাশিত আলিঙ্গনের স্মৃতি ভুলে জীবন দিয়েছে পাড়ি বহু বহু পথ। তবু সৌজন্য করে কফি আনাই। দেশ–জাতি, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে খুচরা কিছু কথা হয়। কফির কাপে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবেই সে বলে, ‘তুমি তো দিব্যি আছ। ভালো ক্যারিয়ার। সুখী সংসার। স্বামী–সন্তান।’

টেবিলের এপাশ থেকে একরাশ অস্বস্তি নিয়ে তার চশমার বাদামি ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে থাকি। একটা চাপা অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ্য যেন পাক খেয়ে ঘুরতে থাকে আমাদের দুজনের মধ্যে। তার বলার ভঙ্গিতে মনে হয় যেন বড্ড অন্যায় হয়ে গেছে এ রকম ভালো থেকে, বরং একটু খারাপ, একটু ভঙ্গুর থাকলেই বোধ হয় মানাত আমাকে। যদিও জানি কোনো মানুষই নিরবচ্ছিন্ন সুখে বা দুঃখে থাকতে পারে না, তবু তার কথায় আমার বেশ বিব্রত বোধ হতে থাকে।

সামনে বসে থাকা ভদ্রলোককে তাড়ানোর জন্য এবার আমি মিথ্যা করে বলতেই পারি, ‘ইয়ে, মানে আমি একটু ব্যস্ত...এক্ষুনি নিউজের মিটিংয়ে ঢুকতে হবে। আপনি কি আরও বসবেন?’

কিন্তু সে কথা না বলে উল্টো জিজ্ঞেস করি, ‘আপনার ফ্যামিলি নিয়ে তো কিছু বললেন না! সবাই বুঝি বিদেশে থাকে?’

ভদ্রলোক কেমন অদ্ভুতভাবে হাসেন,

‘ফ্যামিলি? হা হা হা, ফ্যামিলি হলো কই? একাই থাকি। তুমি তো রাজি হইলা না! হা হা হা...।’

কফির কাপ টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ায় সে। একটু ঝুঁকে বলে, ‘চলি। আসলে, সেই যে পঁচিশ বছর আগে তোমার পিছু নিয়েছিলাম, সেই অভ্যাস আর যায়নি আমার। এখনো অনুসরণ করেই যাচ্ছি। ঈর্ষা লাগে মাঝেমধ্যে। অবশ্য শান্তিও লাগে—তোমার আনন্দের ছবি দেখে। মাঝেমধ্যে ভাবি, এই সুখ কি আমার সাথে থাকলে পেতে?’

উত্তরের অপেক্ষা না করেই সোজা হয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে যায় সে। আমার একবার ইচ্ছা করে সেই সন্ধ্যার মতো তার পেছনে পেছনে যাই, অন্তত লিফট পর্যন্ত সৌজন্যবশত একজন অতিথিকে তো এগিয়ে দিতেই পারি। কিন্তু যাওয়া হয় না।

ঘরের ভেতর শুকনা ঘাস আর দামি পারফিউমের মিলিত গন্ধ ঘুরপাক খেতে থাকে।