ঘুরপাক

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘আপা, আপা, আপা ও আপা, আপা...!’—ডাকের ঘুড়িটা উড়ছে। একতলা থেকে চারতলায়, এক বিল্ডিংয়ের জানালা থেকে পাশের বিল্ডিংয়ের জামা ঝোলানো বারান্দায়। ঠোকর খেয়ে নিচে নামছে আর ওপরে উঠছে।

সকালবেলা পাশের নির্মীয়মাণ ভবনের জেনারেটরের শব্দ চালু হয়ে থেমে গেছে।

চারদিকের শব্দ পরিষ্কার শোনা যায়। মেপে মেপে তিন সেকেন্ড বিরতি দিয়ে ডেকে চলছে আম্বিয়া, যেন ছাদের কার্নিশে আটকে পড়া বিড়াল তীক্ষ্ণ মিউ মিউ ডাক দিয়ে আত্মরক্ষা করতে চাইছে।

কয়েক দিন হলো এ বিল্ডিংয়ের দারোয়ান ছুটিতে গেছে। দরজা খোলার কেউ নেই।

আমি বালিশে কান চেপে ধরি, আরেকটা মাথার ওপরে চাপিয়ে দিই। নৈঃশব্দ্যময় কোথাও ঢুকে পড়তে ইচ্ছা করে, যেখানে সবুজ শেওলাভর্তি নিটল হ্রদ ও অজস্র গোলাপ। কিন্তু কিছুই স্পষ্ট নয়। আমি জোরে দুই কানে হাত চেপে চোখ বন্ধ করে থাকি। ডাক্তার যেমন বলেছে, স্পষ্ট দেখার চেষ্টা করে যেতে হবে। চারপাশের ঘটনাবলি আমি বদলে দিতে পারব না। আমার কাজ শুধু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। কঠিন কাজ। হাল ছেড়ে আবার হাল ধরার মধ্যকার সময় কয়েক মুহূর্তের বেশি দীর্ঘ হতে চায় না।

বালিশ ভেদ করে বাইরের শব্দ টের পাই। কোনো শিশু তীব্রস্বরে কেঁদে ওঠে। চোখের পাতা ভেদ করে কমলা রং ঝলসে উঠে রোদে ভেসে যায় ঘরের মেঝে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে চাই, কিন্তু এ কাজটা বহুদিন হলো আমাকে দিয়ে আর হয় না।

মা মাঝেমধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে ধড়মড়িয়ে ওঠে।

আম্বিয়ার ডাকে মায়ের ঘুম ভেঙেছে। এখন গেটের চাবি কাপড়ের বটুয়ায় ভরে চারতলার জানালার গ্রিল দিয়ে হাত বাড়িয়ে নিচে রাস্তায় ছুড়ে দেবে মা। তার ফরসা হাতের বলিরেখা রোদ লেগে বিদ্যুচ্চমকের মতো দেখাবে।

আমার মন দুভাগ হয়ে একটা ভাগ শরীরকে বিছানামুখী করে রাখে, আরেক মন ঠেলে উঠিয়ে দিতে চায়। নিজের সঙ্গে দোটানায় পড়ে আবারও কানে হাত চেপে রাখি, বাথরুমের বিকল ট্যাপ থেকে পানি পড়ার আওয়াজ মগজের কোষে এসে ধাক্কা দেয়। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না।

আম্বিয়ার সঙ্গে যতক্ষণ কথা না বলব, ততক্ষণ সে পাথরের ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করবে। ওর চুপ থাকা অনুনয় হয়ে আমাকে তাড়া দিতে থাকবে।

এক বছর সে কাজ করেছে। তারপর আমাদের দরকার না থাকলেও কয়েক দিন পরপর আসে মেয়েটা। শুরুতে মা ওর জন্য সব জায়গায় ফোন করত। তারপর আমাকে দায়িত্ব হস্তান্তর করে দিল। সারা দিনে আমার নিজেকে ব্যস্ত রাখা দরকার। অথচ মা তার নিজের ফোন করা, সব জায়গায় ধরনা দেওয়া—এসবে আমাকে জড়ায় না।

আম্বিয়া ফোন নম্বর লেখা কাগজটা বাড়িয়ে দেয়। প্রথমে দুটো নম্বর ছিল, এখন ১১টা ফোন নম্বরের পাশে বিভিন্ন নাম ও পদের নাম আমিই লিখেছি।

নিজের সমস্যা সে সংযত কণ্ঠে অল্প কথায় বলে। আমিই বরং ফোনের ওপাশে যিনি থাকেন, তাকে বোঝাতে গিয়ে অসহিষ্ণু হয়ে উঠি।

যেসব লোকের সঙ্গে আমি কথা বলি, তাদের অধিকাংশের কথা আমি বুঝি না। ওদের প্রত্যেককে আম্বিয়ার নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র, ফোন করার কারণ, তাকে এত দিন ঘোরানোর বিবরণ—সব এতবার বলেছি যে আমার আর বলার সময় কিছু ভাবতে হয় না।

‘একটা পা অল্প লুলা আছিল। ঠিক সময় দৌড়ায়া রাস্তা পার হইতে পারে নাই। একসিডেন্টের পরে এক মাস পঙ্গু হাসপাতালে আছিল।’ আম্বিয়া দিশাহারা হয়ে বলে।

ফোন করলে উত্তর পাই, ‘এসব কেসে ডেথ সার্টিফিকেট খুব গুরুত্বপূর্ণ। কী লেখা আছে এতে? দুর্ঘটনার কথা তো লেখা নাই। এসব জটিলতা আমাদেরকে সামলাতে হয়। ট্রাক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি। তারপর মারা গেল কীভাবে? আপনারা সাথে সাথে যোগাযোগ করেননি কেন?’

ওড়নার খুট দাঁতে চেপে দাঁড়িয়ে আছে আম্বিয়া। বলে, ‘আজকে চাইর বচ্ছর হইল আপা আর ইমনের জন্মের হইল পাঁচ বচ্ছর। ট্যাকাগুলি পাইলে ছেলেটার পড়ালেখার কত সুবিধা হইত।’

ওর এসব কথা দাঁড়ি–কমাসহ আমার মুখস্থ। একসময় আম্বিয়া না হলে আমার খাওয়া–গোসল কিছুই সম্ভব ছিল না। হাড় গুঁড়িয়ে যাওয়া আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে বিনবিন করে কথা বলত।

সবখানে একই রকমের কথা, ‘কয় জোড়া স্যান্ডেলের তলা ক্ষয় করেছ? ক্ষতিপূরণের টাকা কি এক দিনে পাওয়া যায়?’

মা বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি। বেরোনোর তাড়া তার চোখেমুখে। ব্যাগ হাতড়ে টাকা বের করে, ‘যাওয়ার আগে একটু কাঁচাবাজার করে দিয়ে যেয়ো আম্বিয়া। বাকি টাকা দিয়ে তোমার ছেলেকে কিছু কিনে দিয়ো।’

মায়ের হাতের চুড়িটা ঢলঢল করছে। আমাকে ইশারা করে, আমি যেন আম্বিয়ার ফোনগুলো ঠিকঠাক করি। তারপর বেরিয়ে যায়। আমি জানি, মা কোথায় যাবে। অফিসটার সামনে গিয়ে কপালের ঘাম মুছে রোদ এড়াতে ঘোমটা দেবে মা। তার গভীর দীর্ঘ নিশ্বাস উঠে চশমা ঘোলা করে তুলবে। ধীরপায়ে ওই অফিসের ভেতর ঢুকে ফ্যানের নিচে বেঞ্চিটায় একটু বসবে।

অফিসার ভদ্রলোক বরাবরের মতো মাকে বলবেন, ‘আপা, ক্ষতিপূরণের টাকার ব্যবস্থা করে দিতে চাচ্ছি সেই কবে থেকে, আপনি কেন যে সেই এক জেদ ধরে আছেন? এই মামলায় আসামি শুধু যে পলাতক তা তো না, তার নামধাম, গাড়ির নাম্বার কিছুই ঠিকমতো দিতে পারেন নাই। বাসমালিক পক্ষ কত ক্ষমতা রাখে, আপনার কোনো আইডিয়া আছে?’

‘একটা খুনের বিচার হবে না!’

‘দুর্ঘটনাকে খুন বললে হয়, আপা? আর কার বিচার চাচ্ছেন? চিনেন কাউকে? হাওয়ার সাথে যুদ্ধ করে গাত্রে হলো ব্যথা। দেখেন, যত দিন যাচ্ছে, ততই আপনার গ্রাউন্ড দুর্বল হচ্ছে। কাজেই আপনাকে মনস্থির করতে হবে।’ কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক শরীর শিথিল করে হাসবেন।

‘আমার তো মনস্থির করাই আছে। চাইলে কি খুনিকে খুঁজে বের করা যায় না? আমার স্বামীকে বাসচাপা দিয়ে যে খুন করা হলো, তার বিচার চাই—এটা কি অন্যায়?’ মায়ের কথা শুনে ভদ্রলোক সামান্য অসহিষ্ণু হয়ে উঠবেন। কিন্তু তার হাসি মুছে যাবে না।

‘আপনি যদি কোর্ট ফি দিতে দিতে ফতুর হতে চান, তাহলে কিছু বলার নাই।’

তাতানো রোদের মধ্যে বেরিয়ে নিজের অফিসে পৌঁছানোর জন্য রিকশা খুঁজবে মা। না পেলে হাঁটতে থাকবে।

আম্বিয়াও নাকি শুরুতে এ রকম হেঁটে হেঁটে দিনের পর দিন ঘুরেছে। সরকারি অফিস, এনজিও—সবখানে একই রকমের কথা, ‘কয় জোড়া স্যান্ডেলের তলা ক্ষয় করেছ? ক্ষতিপূরণের টাকা কি এক দিনে পাওয়া যায়?’

নার্স বা আয়া রাখার জন্য যে বেতন দেওয়া লাগে, তা আমাদের ছিল না। আর ২৩ বছর বয়সের একটা মেয়েকে খাওয়ানো, গোসল করানো তো সোজা কাজ নয়। আম্বিয়ার মতো সমর্থ একজনের দরকার ছিল। হুইলচেয়ার আসার আগপর্যন্ত ও আমাকে কোলে করে বাথরুমে নিয়েছে। শিশুর যত্নে খাইয়েছে। ফিজিওথেরাপিস্টের দেখানো ব্যায়ামগুলো নিয়মিত করিয়েছে। আমি বিরক্ত হতাম, রেগে জিনিসপত্রও ভেঙেছি। কিন্তু আম্বিয়া পুকুরের শান্ত পানিতে ভাসিয়ে রাখার মতো বাধ্য করেছে আমাকে। ফলাফল এক বছরের মাথায় আমি ক্রাচে ভর দিয়ে ঘরময় হেঁটে বেড়াচ্ছি।

খুব ভোরে আসতে পারত না ও। ছেলেকে স্কুলের জন্য তৈরি করে তারপর বাস ধরত। আসতে আসতে সকাল নয়টা। আমার তখন প্রতিটি অঘুমা রাতে চোখের সামনে আতঙ্কের বাক্স খুলে যেত। কড়া ডোজ ঘুমের ওষুধ খেয়ে মশারির ছিদ্র গুনতাম। সরু সাপের মতো দুঃস্বপ্নেরা তাড়া করত। বিছানায় এপাশ থেকে ওপাশে ফিরলে যে ব্যথা বোধ হতো, তার চেয়ে বহুগুণ দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে ওই দিনটার মুখোমুখি হতাম।

ছুটির দিনের ঝকঝকে সকাল ছিল সেটা। ফোন কিনতে যাব। বাবা খেলার পাতায় ডুব দিয়ে গড়িমসি করছে। বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখার কথা। এখনই ফোনটা না আনলে হবে না। আবার সকালটাও বাবার সঙ্গে কাটাতে হবে। তা না হলে লোকটা মুখ গোমড়া করে টিপ্পনি দিতেই থাকবে, ‘আজকাল বন্ধুই সব। বুড়া বাপের কে খোঁজ নেয়!’

আমি দাঁড়িয়ে একপায়ে ঘোড়ার খুরের শব্দ করছি।

মা আমাকে বকতে গিয়ে বাবার দিকে ফেরে, ‘যাও না। কাছেই তো। আমি ততক্ষণে রান্না শেষ করি।’

নতুন ফোন পেয়ে আমি বাবার বাহু জড়িয়ে প্রায় দুলে দুলে রাস্তার মোড়ে এসে রিকশা নিলাম। প্রায় ফাঁকা রাস্তা। বাতাসে বাবার হাফহাতা শার্ট ফুলে ফুলে উঠছিল। আমাকে আদর করে বাবা বলল, ‘আমার মামণিটা এখন খুশি?’

আমি বাবার দিকে ঝুঁকে কিছু বলতে না বলতেই বিকট শব্দটা হলো। আমার হাত থেকে বাবার বাহুটা ছিটকে দূরে কোন নীহারিকার দিকে ছুটে গেল। মনে হলো ধাক্কাটা আমাদের রিকশায় নয়, পেছনের কোনো রিকশায় বা গাড়িতে। আমার নাকে ছুরির ফলার মতো কিছু একটা ঢুকিয়ে দিয়ে রং চলটা ওঠা বাসটা উড়ে চলে গেল। আমি কি রাস্তায় পড়ে ছিলাম?

কিছু মনে নেই।

‘একটা হাত রাস্তার অন্যদিকে গিয়া পড়ছিল। ইমনের তখন ১১ মাস। জন্ডিস হইছে। ওরে নিয়া হাসপাতালে যাইতাম। হাতছাড়া মানুষটারে খাওয়া দেওয়া লাগে।’ আম্বিয়া নির্বিকার হতে চায়। ক্ষতিপূরণে লাখ পাঁচেক টাকা পাওয়ার সম্ভাবনার পেছনে দৌড়ে চলছে সে।

দিনের পর দিন আমি যন্ত্রচালিতের মতো আম্বিয়ার ফোনকলগুলো করে দিই। ওর জন্য আরেকটা দিন নির্ধারিত হয়। লোকজন ফোনের ওপারে ভরসা দেয়, হতে পারে। তবে সময় লাগবে।

আম্বিয়া শান্ত মুখে ফিরে যায়, আমি জানি ও দিন কয়েক পর আবার আসবে। আবারও আমাদের বিল্ডিংয়ের দারোয়ান না থাকলে নিচ থেকে ডাকবে, ‘আপা, আপা, আপা ও আপা, আপা...!’ আর সেই ডাকটা উত্তাল ঘুড়ি হয়ে উড়তে থাকবে।