ঘুড়ি প্রজাপতি

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

গরিবের ঘরে সবচেয়ে বেশি যেটা থাকে, সেটা ‘নেই’। তরকারি খুঁজতে খুঁজতেই সকাল গেল। না পেয়ে একটা আলু পুড়িয়েছেন দিপালী সমজদার। পুড়িয়ে নিয়েছেন শুকনো দুটো মরিচ। তারপর পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে দেখেন ঝুড়ি খালি। দেখেই গলা ছাড়লেন, ‘বাবু, ও কুমারেশ, যা তো বাপ...’

বলা শেষ হয়নি, দেখলেন ছেলেরা দৌড়াচ্ছে। দেখতেই বুকে ধক। অগত্যা শুধু ওই পান্তাই খেয়ে যেতে ডাকলেন তাদের।

উত্তরে হাসিমাখা মুখটা সামান্য ঘোরাল শঙ্কু। বলল, ‘আগে মিছিলে যাওং, মা। পরে আসি খাইম অ্যালাই...’।

শরিফুল ভাই এসেছিল সন্ধ্যায়। বাপ রেডিও শোনে, পত্রিকা পড়ে; তার কাছ থেকে শোনা খবর সে রিলে করে শোনাল শঙ্কুদের, ‘আজ সারা দিন হরতাল হইছে ঢাকায়। কাল সারা দেশে, দোকানপাট সব বন্ধ থাকপি।’ উত্তেজিত স্বর তার, চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। ‘তা বিহারিরা কওছে মানবে লাই। আমরাও ফির দেখিম কেমনে না মানে!’

দেখতে শঙ্কুও চায়; কিন্তু দাদা কি সঙ্গে নেবে? অঙ্ক খাতায় চোখ রেখে তাই মন রেখেছিল কুমারেশের দিকে। তবে তার ভাবান্তর নেই কোনো। পড়ছে তো পড়ছেই। না নিয়ে যাওয়ার ধান্দা। ওদিকে কাছিয়ে আসছে তুমুল আওয়াজ। স্লোগানে স্লোগানে কেঁপে উঠছে হাওয়া। এখন মনে হয় জাহাজ কোম্পানির মোড়ে। নাকি প্রেসক্লাব? ভাবতে ভাবতে শঙ্কু ভুল করছে অঙ্ক।

এর মধ্যেই ডাকতে এল শরিফুল ভাই। আর পড়া ফেলে দৌড় দিল শঙ্কুরা।

দৌড়াতে দৌড়াতেই গায়ে পরে নিল জামা। শঙ্কুর পকেটে একটা ঘুড়ি, ফ্রেমে বাঁধলেই উড়বে। রেখে আসতে হতো, মিছিলে মিছিলে হারিয়ে যায় যদি! ভাবতে ভাবতে সে উঠে এল রাস্তায়। তার চোখ গেল আগুয়ান মিছিলের দিকে। ওরেব্বাবা, এত মানুষ! গেলবর্ষায় চিকলির বিলে মাছ ধরতে গিয়ে যেমন ঢেউ দেখেছিল, মনে হচ্ছে তার চেয়েও বড় এই ঢেউ।

ঢেউয়ের ডগায় গমগম আওয়াজ, পায়ে পায়ে ধুলোর ঝড়।

সে ঝড় তাকে ডেকে নিল জয় বাংলার স্রোতে।

ভাঙাগলায় কে যেন চিৎকার করে বলছে, ‘ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা’, সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠছে জনস্রোতের গলা, ‘মানি না, মানব না।’

প্রতিবার স্লোগান দিচ্ছে আর শঙ্কুর মনে হচ্ছে এঁড়ে বাছুরের জোর ভর করেছে গলায়।

গলা ভাঙতে ভাঙতে কখন ওরা চলে এসেছে তেঁতুলতলা মোড়ে, খেয়াল হয়নি। পেট্রলপাম্পটা পার হতেই তাকে টেনে অজগরের পেট থেকে বের করে নিল দাদা। দাঁড়ানোর উপায় নেই। কোনোমতে একটা দেয়ালের ফাঁকে সেঁধিয়ে গিয়ে বলল, ‘এটেয় দাঁড়ে থাক।’

‘ক্যান দাঁড়াইম? মিছিল চলে যাচ্ছে তো।’

‘যাক, আমরা যাব না। অবস্থা দেখছিস? পড়লি পরে পার চাপে আউলে যাবি।’

‘তা যাই যাব।’ বলেই শঙ্কু ছুটে গেল আবার।

নূরপুর কাছারিঘর পার হচ্ছে, হঠাৎ কেমন দুলে উঠল মাথাটা। আর দুপ করে যেমন নিভে যায় ল্যাম্পো, তেমন অন্ধকার হয়ে এল চোখ। পলকপরেই আলো ফুটল আবার। তবে সব ঝাপসা, আর অচেনা। যেন এখানে না, আছে অন্য কোনো শহরে। হালকা হয়ে এসেছে মিছিল; গতিও কম। মনে হচ্ছে নিজেও সে ছোট। গায়ে এতক্ষণ নীল জামা ছিল, এখন দেখছে সাদা। গোঁফের ওপর পশমঘাসের বুনোট।

এ কীভাবে সম্ভব!

অবাক চোখদুটো বারবার ডলছে শঙ্কু, বারবার ফেলছে পলক। এর মধ্যেই একবার ভেসে উঠল মিষ্টি মায়ের মুখ।

‘আয় রে অহি, ভাত খাই ল।’

মনে হচ্ছে শঙ্কুই অহি, সে একটা প্রজাপতি আঁকছিল। কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে এগোল রান্নাঘরের দিকে। খাবার দেখেই তারপর বলে উঠল, ‘পত্যেকদিন আলু ভত্তা! খামু না।’ বলেই খানিক হাসি আনল মুখে, তারপর ‘ডিম ভাইজা দ্যাও না মা...’

শুনেই মা দিল একটা চড়, ‘ভাত যে দুডো জুটতাছে, তা–ই কত! আবার এইড্যা দ্যাও ওইড্যা দ্যাও!’ বলতে বলতে চলে গেল রান্নাঘরে। কান্নাচোখে অহি তাকিয়ে আছে সেদিকে, এমন সময় কাঁধের ওপর প্রশ্রয়ের হাত।

কুন্নি, উশো, ওলোন, পাশলে—দরকারি সরঞ্জাম সব ব্যাগের ভেতর আছে কি না, দেখে নিলেন হাবিবুর রহমান। ব্যাগটা সাইকেলের পেছনে বেঁধে ছেলেকে বসিয়ে নিলেন রডে। তারপর খোশমহল রেস্টুরেন্ট, ‘যা, দুইডা পরাটা খায়া যা। কবি ট্যাহা আব্বায় দিবে।’ বলে চলে গেলেন কাজে।

মুগ্ধচোখে সেই সাইকেলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই অহি দেখল মিছিল আসছে। প্ল্যাকার্ডে প্ল্যাকার্ডে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।

আচ্ছা, এ তো একুশের মিছিল! কিন্তু আজ না তিন মার্চের হরতাল?

অবাক চোখদুটো আবার খানিক ডলে নিল শঙ্কু। ডলতেই ফিরে এল রংপুরে। আগের তেজ আর আগের জোর নিয়েই এগিয়ে চলছে মিছিল।

‘ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মারো...’ গলা বাজিয়ে শঙ্কু বলল, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ কিন্তু মনে হচ্ছে সে বলেছে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। জনস্রোত বলছে, ‘তোমার নেতা আমার নেতা/ শেখ মুজিব শেখ মুজিব।’ উত্তরে শঙ্কু যেন বলছে, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না।’

এই দোলাচলে দুলতে দুলতেই এগিয়ে চলছে সে। এক পা তার এগিয়ে যাচ্ছে সামনে, অন্যটা পড়ছে পিছিয়ে। একপলকে দেখছে নূরপুরের স্টেশন রোড, পরক্ষণেই নবাবপুরের রাস্তা।

ঘোড়াপিরের মাজারের আগে ওরা এখন, ডানদিকে সরফরাজ খানের একতলা বাড়ি। হঠাৎই তার চোখ পড়ল দেয়ালে টাঙানো উর্দু সাইনবোর্ডে। পড়তেই কানে বাজল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। অমনি মিছিল থেকে বেরিয়ে গেল শঙ্কু। লাফিয়ে লাফিয়ে সাইনবোর্ডটা নামাতে চেষ্টা করল। তাকে থামাতে এগিয়ে গেল কুমারেশ আর শরিফুলও। নাগাল না পেয়ে শঙ্কু ততক্ষণে উঠতে ধরেছে জানলা বেয়ে। নিচ থেকে দাদা টানছে পা ধরে, শরিফুল ডাকছে, ‘নামি আয়।’

সাঁই করে এসে কী যেন তখন ঢুকে গেল কাঁধের নিচটায়। নাকি মাথায়? বুঝে উঠবার আগেই পড়ে গেল সে। মনে হলো দূরে দাঁড়িয়ে একদল সৈন্য গুলি ছুড়েছে, সে পড়ে আছে নবাবপুরের রাস্তায়। মুহূর্তেই আবার দেখল, না, ছাদের ওপর একটা লোক। গালি দিচ্ছে। হাতে বন্দুক। তার মানে সে পড়ে আছে ঘোড়াপিরের মাজারের বিপরীতে।

চোখের ওপর রক্তের পর্দা, যা কিছু শঙ্কু দেখছে, সব লাল। মিছিল ছত্রভঙ্গ। চারদিকে চিৎকার আর আহাজারি। শরিফুলও পড়ে আছে পাশে, গায়ে রক্ত। কে যেন হঠাৎ পাঁজাকোলা করে তুলে নিল শঙ্কুকে। তার বুকের স্পন্দন যেন বুঝতে পারছে শঙ্কু। স্পন্দনে স্পন্দনে বেজে চলেছে, ‘তোমার নেতা আমার নেতা/ শেখ মুজিব শেখ মুজিব।’ আবার কেউ যেন বলছে, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না।’ শঙ্কুর দাদার গলা শোনা যাচ্ছে। চিৎকার করে সে মাকে ডাকছে। ডাকছে বাবাকে। পাগল দাদা, বাবা যে কবেই মরে গেছে জানে না নাকি! না, না, কিছুক্ষণ আগে বাবা–ই তো তাকে নিয়ে এসেছিল এখানে।

ওই তো খোশমহল রেস্টুরেন্ট।

ওই তো রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।

দেখতে দেখতে বুঝল বুকপকেট থেকে উড়ে গেল ঘুড়িটা তার।

নাকি উড়ল রঙিন প্রজাপতি অহিউল্লার?