ছায়া

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

জামগাছটার নিচে রিজিয়া বানু শুয়ে আছেন।

তার চারপাশে লোকজনের ভিড়। সেই ভিড়ে তার দুই ছেলেও আছে। সূর্য মাথার ওপর তেতে উঠেছে। গনগনে রোদ। তবে তাতে রিজিয়া বানুর সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি শান্ত ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন। তার ওপর জামগাছের নরম ছায়া। রিজিয়া বানুর দুই ছেলে চিৎকার করে ঝগড়া করছে। ছোট ছেলে শহিদুল লোকজন এনেছে। সে গাছ কাটবে। বড় ছেলে মফিদুলের বিষয় উল্টো। সে কিছুতেই গাছ কাটতে দেবে না।

রিজিয়া বানুর স্বামী চৌচালা এক টিনের ঘর রেখে মরেছিলেন। ছেলেরা সেই ঘর ভেঙে উঠানের দুই পাশে দুখানা দোচালা ঘর তুলেছে। এতে অবশ্য একটা সমস্যা হয়েছে। এত দিন উঠোনের একপাশে থাকা জামগাছখানা এবার পড়ে গেছে মধ্যখানে।

বড় ছেলে মফিদুল করাতকলে কাজ করে। প্রায়ই সে সেখান থেকে তক্তা, কাঠের গুঁড়ো নিয়ে আসে। গুঁড়োগুলো রোদে শুকালে বেশ একটা ফুরফুরে ভাব হয়। চুলোয় দেওয়ামাত্র দাউ দাউ করে জ্বলে। বউয়ের রান্নাবান্নায় তাতে ভারি সুবিধা হয়।

ছোট ছেলে শহিদুল কাজ করে রাইসমিলে। গাঁয়ে নতুন রাইসমিল এসেছে। মেশিনের ভেতর ধান দিলেই ছুঁমন্তর চাল বেরিয়ে আসে। এতে অবশ্য গাঁয়ের গৃহস্থ বাড়ির বউ–ঝিদের কোমরের গেঁটে বাত জেঁকে বসেছে। এত দিন যারা রাতভর ঢেঁকি পাড় দিয়ে মণকে মণ ধান ভেনেছে, তারা এখন আর সোজা হয়েই দাঁড়াতে পারে না। মিলের অবস্থা তাই ভরভরন্ত।

শহিদুল রাতে গামছার ভেতরে ধানের ভুসি-কুঁড়ো নিয়ে বাড়ি ফেরে। কখনো কখনো বৃষ্টি–বাদলায় ভেজা, নষ্ট ধান চালও থাকে। সেই বারো রকমের ধান, চাল, কুঁড়ো সকাল হলেই তার বউ উঠোনে শুকাতে দেয়। কিন্তু উঠোন মোটে একখানা। বড় বউয়ের কাঠের গুঁড়ো, ব্যাঁকাত্যাড়া তক্তা আর ছোট বউয়ের ধান, চাল, ভুসি রোদে শুকাতে দেওয়া নিয়েই ঝগড়ার শুরু। উঠোনে কে কতটুকু জায়গা পাবে, কোথায় রোদ বেশি—এই নিয়ে দুই বউয়ের ঝগড়ায় কোমর বেঁধে নামে মফিদুল, শহিদুলও।

সে এক কুরুক্ষেত্র বটে!

গ্রামের লোকজন, পাড়া–প্রতিবেশী ছুটে আসে, ভাইয়ে ভাইয়ে না খুনোখুনি হয়ে যায়! শেষ পর্যন্ত অবশ্য মাপজোখ করে উঠোন ভাগ হয়। কিন্তু গোল বাধাল দুষ্টের ‘শিরোমণি’ জামগাছটা। এত দিন তা–ও জামের ভাগ–বাঁটোয়ারা নিয়ে বাড়িখানা তেতে থাকত। এবার খেল দেখাল জামগাছের ছায়াও। দিনভর ছোট ছেলে শহিদুলের অংশের উঠোনজুড়ে ছায়া ফেলে রাখে সে।

বাড়িতে এই একটাই গাছ। এর ফল, পাতা, ডাল দুই ভাই ভাগ করে নেয়। তবে তা নিয়েও বিস্তর খটোমটো। তার চেয়ে গাছখানা বেচে দিলেই হয়!

কিন্তু শহিদুল একা চাইলেই তো হবে না। অন্যজনেরও তো চাইতে হবে। তবে সে যে রাজি হবে না, তা শহিদুল জানে। কারণ, তার চ্যাংড়া দুটো ছেলে। তারা সারা দিন টইটই করে পাড়া বেড়ায়। এ বাড়ির জাম্বুরা, ও বাড়ির নারকেল পেড়ে খায়। তো নিজেদের ভিটেয় একখানা জামগাছ থাকলে ভাগ যত সমান-সমানই হোক, এমন চোরচোট্টা ছেলের বাপ আখেরে তো ষোলো আনার বারো আনাই পাবে! তা বড় ভাই কেন রাজি হবে? একটা উপায় অবশ্য আছে। কোনোভাবে যদি মাকে রাজি করানো যায়।

মাসের ১৫ দিন করে মায়ের ভাগ। দুই ছেলের ঘরে সমানভাগে থাকেন রিজিয়া বানু। সমস্যা হয় ৩১ দিনে মাস হলে। ওই এক দিনের হিসাব মেলানো কঠিন। কে নেবে ওই দিনের ভাগ? এই নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে শীতলযুদ্ধ চলতেই থাকে।

তবে শহিদুল এবার তড়িঘড়ি করে এক দিন আগেই মাকে নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় মায়ের পাশে বসে ইনিয়ে–বিনিয়ে বলে, ‘মা, বোহের ব্যাতাডা কি বাড়ছে?’

রিজিয়া বানু খুকখুক করে কাশেন। কাশি শুনে শহিদুল খুশি হয়। লক্ষণ ভালো। মায়ের বুকের ব্যথা বেড়েছে। গাছ না বেচলে মায়ের চিকিৎসা হবে কী করে! সে দুহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে, ‘মা, এই দ্যাহো তোমার জন্য ঘিয়া রঙের চাদর আনছি। গায় পেঁচাইয়া জুত কইরা বইয়া থাকবা।’

রিজিয়া বানু হাত বাড়িয়ে চাদরটা নেন। তবে কাশির দমকে তার হাড় জিরজিরে শরীর ঝনঝন করে বাজে। শহিদুলের চোখ চকচক করে ওঠে। সে এরপর জামগাছের কথাটা তোলে।

পরদিন ভোরে শহিদুল করাতকলে যায়। দশজনের সামনেই সে বড় ভাইকে বলে কথাটা, ‘মায়র শইলতো ভালো না। ডাক্তারও দেখান লাগে। কিন্তু আমাগো কারো হাতেই তো টাকাপয়সা নাই। মায় কইল, তাইলে জামগাছটা বেইচ্যা দে।’

কথা শুনে মফিদুল ভ্রু কোঁচকায়। তার দৃঢ়বিশ্বাস, শহিদুল নতুন কোনো চাল চালছে। কিন্তু এত সহজে হেরে যাওয়ার মানুষ সে না। মায়ের মুখ থেকেই কথাটা শুনতে চায় সে। হাতের কাজ ফেলেই বাতাসের আগে বাড়ি ফেরে মফিদুল। সঙ্গে শহিদুলও। সঙ্গে গণ্যমান্য কিছু লোকও। এবার আর পেছাতে পারবে না মফিদুল। কিন্তু অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে রিজিয়া বানু কোনো সাড়া দেন না। দরজা খোলার পরও না। শহিদুলের দেওয়া ঘিয়েরঙা চাদরটা তার বিছানার পাশে পড়ে আছে। তিনি ঘুমাচ্ছেন। নিঃসাড়। নিথর।

কারও কোনো ডাকেই আর সাড়া দেন না তিনি। কোনো উত্তরও না।

দুপুর গড়ায়। একটা হোগলা পাতার মাদুরে রিজিয়া বানুর লাশ পড়ে থাকে জামগাছটার নিচে। চারপাশে লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে। শহিদুল আর মফিদুলের গলার স্বর উচ্চকিত হতে থাকে। কিন্তু জামগাছের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয় না। সিদ্ধান্ত হয় না রিজিয়া বানুর লাশের ব্যাপারেও। যেন রিজিয়া বানুর কাছ থেকে উত্তর না পাওয়া অব্দি ওই খোলা উঠোনে, ওই তেতে ওঠা গনগনে রোদের ভেতরই ওভাবে শুয়ে থাকতে হবে তাকে।

কবরের সামান্য ছায়াও জুটবে না তার।

কে জানে, এ কারণেই গাছটা খানিক ন্যুব্জ হয়ে আসে কি না! প্রখর রোদ থেকে আড়াল করতে চায় কি না রিজিয়া বানুকে।