জলপাথরের মন

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

‘প্রেমের গল্প লিখতে কী লাগে?’ এক ঠোঁটে হাসি আর ঠোঁটে কৌতুক মিশিয়ে প্রশ্নটা করেছিল অর্পা। মনে আছে।

সদ্যই আমার নির্বাচিত প্রেমের গল্প প্রকাশিত হয়েছে তখন। বরাবরের মতো বিক্রিও হচ্ছে খুব। যত হচ্ছে, তত দাঁত চিবুচ্ছে নিন্দুক আর অন্য লেখকেরা। ফেসবুকে, টুইটারে তাদের গা–জ্বলা মন্তব্য মিম আর ফোড়নের ঢেউ। তাতে দক্ষভাবে আমার নাও বেয়ে যাচ্ছে প্রকাশক আর ভক্ত-পাঠক। ব্যাপারটা বেশ উপভোগই করছি। মানুষ চেনার এই তো সুযোগ!

সেই সুযোগেই আমাকেও চিনে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল মেয়েটা। বলেছিল, ইন্টারভিউ নেবে।

ফ্রেন্ডলিস্ট উপচে পড়ছে বন্ধু-স্বজনে, নতুন কারও স্থান সেখানে হয় না সহজে। ফলো অপশন আছে, তবু বহু লোক রিকোয়েস্ট পাঠায় মেসেঞ্জারে। তাদের অনুনয়–বিনয় দেখে বিচলিত হই। অমন একটা মেসেজেই হেসে উঠেছিল মেয়েটা। ইন্টারভিউয়ের কথায় ভেবেছিলাম, হয়তো কোনো পত্রিকা বা পোর্টাল থেকে আসবে। তবে না, মেয়েটা এসেছিল নিজের কাছ থেকেই। আমার সব কটা বই–ই নাকি পড়েছে। ভেতরে তার জিজ্ঞাসা অনেক।

অথচ করল ওই একটা প্রশ্নই। প্রশ্নটা সহজও ছিল। নানা বয়সী নারীর সঙ্গে প্রেম খেলেছি। বন্ধুবান্ধবের হৃদয়ের খোঁজখবর রাখারও চেষ্টা করি। ফলে বিচিত্র যে অভিজ্ঞতা, তাতে ছিটে রং আর ফোঁটা ঢং মেলালেই বই। ফলে আমার বিশ্বাস ছিল, ও পাঠ আমি রপ্তই করেছি। কিন্তু ফেল করে বসলাম ডাহা।

যে উত্তরই দিই, শুনে চাবি দেওয়া পুতুলের মতোই মাথা নাড়ে সে।

বিরক্ত লাগে না? ইন্টারভিউ দেওয়ার নামে পরীক্ষা দেওয়ার সময় কি আমার আছে? একটা ফেসবুক লাইভের সময় হয়ে যাচ্ছিল। প্রি-অর্ডার্ড বইয়ের স্তূপ থেকে গেছে তখনো, অটোগ্রাফ দিতে হবে। উঠতেই হলো। তবে জেদও চেপেছিল একটু।

বললাম, ‘আপনিই না হয় বলুন, কী লাগে প্রেমের গল্প লিখতে?’

‘আপনার মতো এতগুলো প্রেমের গল্প লিখলে আমিই বলতাম।’

রাগ হলো খুব। স্বরটা যথেষ্ট কড়া আর সুরটা খানিক বাঁকা করে বললাম, ‘তাহলে নিজেই একটা লিখে দেখান।’ শুনে ঠোঁটের কোনায় আলো ফুটিয়ে বেরিয়ে গেল সে।

পরের প্রশ্ন এল পরদিনই।

‘সাপের কোথায় বিষ থাকে, বলুন তো!’

‘দাঁতে।’

‘উঁহু। খোঁজ নিয়েন।’

পরদিন প্রশ্ন আবার।

‘যে রং টেকে না এক কাপড়ে, তা-ই অন্য কাপড়ে লাগলে আবার ওঠে না। জানেন!’

‘এভাবে ভাবিনি তো!’

‘ভাববেন। জানাবেন।’

কদিন যেতেই বুঝলাম, এ আমাকে ছাড়ছে না শিগগিরই। একটু খোঁজখবর নিতে হলো। বুঝলাম, শামুকের মতো ও। মেলানকোলির আবরণে ঢেকে রাখে ভেতরের উচ্ছলতা। বন্ধুসংখ্যা সামান্য, ফলোয়ার আরও কম। ওয়ালজুড়ে এটা–সেটা বই; এ শিল্প, সে কলা; এ দর্শন, সে জ্ঞান। আর মেসেঞ্জারে প্রশ্নবোধক চিহ্নের ছড়াছড়ি।

‘বলুন তো, সৌন্দর্যের জন্য আকাশ কার কাছে ঋণী?’

‘আচ্ছা, বিয়ে কি ধর্মের প্রথা, না সমাজের?’

‘সেজাম ডা’রুই মানে কী, জানেন?’

‘গডস মাস্ট বি ক্রেজি মুভিতে কোন গডদের ক্রেজি বলা হয়েছে?’

এমন এমন প্রশ্ন, মনে হয় উত্তর জানি। কিন্তু আসলে জানি না। তাই জানার চেষ্টা করি। এভাবেই জানা হলো, গ্রিক পুরাণের নিয়তি দেবীর নাম অ্যাট্রপস। অদ্ভুত একটা চরকা আছে তাঁর। তাতে তিনি সুতা বুনে রেখেছেন সবার নামে। যখন যার সুতা কাটা যায়, তখনই তার মৃত্যু। জেনেছি, আফ্রিকার বহু উপজাতি আছে, যারা তেষ্টা মেটায় দুধ খেয়ে। আর শিক্ষিত চায়নিজ মেয়েদের দুটো করে নাম থাকে। আর আমার সব বইয়ের শেষ শব্দ হয় ‘না’। আরও কত কী!

জেনে কী লাভ জানি না; তবে জানতে ভালো লাগে। জানি আর চমকে উঠি। ওকেও আমি চমকে দিতে চাই। পারি না। ওর মেসেঞ্জার পুকুরের পানির মতো নিস্তরঙ্গ।

কোনো কোনো দিন ওখান থেকে উঠে ও হুট করে চলে আসে বাসায়। আমার মা তো আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য খুবই ব্যস্ত, উপযুক্ত কেউ এলে তাই পেয়ে বসে একেবারে। অর্পার সঙ্গেও ভাব দারুণ। আমি না থাকলে ওরাই জমিয়ে নেয়। ফিরে দেখি স্নিগ্ধ দেয়াল, আর মুগ্ধ মায়ের চোখ।

নিজেও কি আমি কম মুগ্ধ? কথায় পেরে উঠি না, অস্বস্তি হয়। কিন্তু এত ভালো পাঠক সে, এত মনোলোভা ভঙ্গি তার, আর এমন করে তাকায়, মনে হয় সমুদ্রপাড়ে আছি।

তুমুল জোয়ার উঠবে, এমন মুহূর্তের দুটো সমুদ্র নিয়েই সেদিন বাসায় ঢুকেছিল ও। ঢুকেই বলল, ‘এই রঙ্গ সমুদ্দুরে, আজ আর কাল আপন তবু মেলে না একসুরে। অথচ আপন না হয়েও মানুষ এক তারে বাঁধা পড়ে। কীভাবে?’

‘জানি না।’

‘সত্যিই জানেন না কিছু, নাকি আমায় বোকা বানান?’

বোকা তো বনেছি আমি! কোনো কারণ নেই, কিন্তু ওর প্রশ্ন শুনতে ভালো লাগে। ওর মন খারাপ হলে আমারও হয়। ওর খুশিতে নিজেও লাফিয়ে উঠি। কাল রাতেই লিখেছি, ‘দাও বলে দাও কবে/ থাকবে সাথে তেমন করে, যেমন করে থাকছ অনুভবে।’ লিখে আবার মুছেও দিয়েছি। তবে জানি, এমনই কিছু একটা বলতে চাই ওকে। বলতে চাই এখনই। নইলে যেন ছুটে যাবে খসে যাওয়া তারা।

কিন্তু কী বলব? খুঁজতে খুঁজতেই দেখলাম চলে যাচ্ছে ও।

গেটের কাছে গিয়ে কী যেন একটা বলল। বলল এমনভাবে, যেন শুনতে না পাই। আমি তাই চোখ রাখলাম ঠোঁটে। আর বুঝলাম, ঠোঁট পড়ে আর যা–ই হোক, মন পড়া যায় না।

আমাকে নিরক্ষর সাব্যস্ত করে ও টুপ করে বেরিয়ে গেল। সন্ধ্যার চোখ গলে তখন সরে গেল শেষ আলোটুকুও।

তারপর থেকে সে আলোর খোঁজেই আমি দৃষ্টি ছড়িয়ে রাখি দিগ্​বিদিক। তাকিয়ে থাকি গেটের দিকে। বসে থাকি মেসেঞ্জার খুলে। কিন্তু ওর উদয় হয় না আর।

হলে বলতাম, ‘প্রেমের যে গল্পটা লিখে গেছ, পড়তে সেটা ভালো লাগে খুব। এত ভালো যে সহ্য করতে পারি না।’