দুনিয়াতেই নেই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমরা আলো নিভিয়েছি আধঘণ্টা আগে। আর ১৫ মিনিট পর ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যাবে মিষ্টি। মিষ্টি আমার বউ। তখন দেখে মনে হবে এই দুনিয়াতেই ও নেই। মাস কয়েক আগেও প্রতিদিন সারা রাত বিছানায় এপাশ–ওপাশ করত। দুজনের একজনও দুই চোখের পাতা এক করতে পারতাম না। তারপর ওর পরিচিত এক ডাক্তারের কাছে গেছি, একটা ওষুধ লিখে দিয়েছেন তিনি, আর তাতেই ওই যন্ত্রণা থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি।

ওই ম্যাজিক পিল টানা আট ঘণ্টা মিষ্টিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। আহ্, আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের কথা আর কী বলব। আমি যদি মিষ্টির কানের কাছে ড্রাম পেটাই, তবু ওর ঘুম ভাঙবে না। সত্যি ঠাট্টা করছি না।

আপনি ভাবছেন আজকাল আমি সারা রাত ভোঁশ ভোঁশ করে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছি, না? ভুল। ঘুমের বদলে করার মতো আরও ইন্টারেস্টিং কাজ আছে আমার—ছেঁচড়ামি, প্রতারণা। তবে ইংরেজি নামটাই আমার বেশি পছন্দ চিটিং।

মিষ্টিকে বিয়ে করে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি, কিন্তু আমি ওকে ডিভোর্স দেব না, অন্তত এখনই নয়। কারণ, এখন ডিভোর্স দিলে ওকে নগদ দিতে হবে ১ কোটি টাকা। বিয়ে রেজিস্ট্রি করার সময় নয়, বা এটা এমনকি দেনমোহরও নয়, পরে একটা চুক্তিপত্রে আমরা দুজন সই করেছিলাম, তাতে এই টাকা দেওয়ার কথা লেখা আছে। তাতে আরও লেখা আছে, আমি যদি স্বামী হিসেবে দুই বছর বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে পারি, তাহলে আমি ওর ব্যবসা আর সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক হব এবং নগদ ওই ১ কোটিও আর আমাকে দিতে হবে না। সেই সময়সীমা পার হতে আর মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি। তারপর আমি মুক্ত ও স্বাধীন। ওর সবকিছুর অর্ধেক নিয়ে হেঁটে চলে যাব।

ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল সপ্তাহে শুধু এক রাত দিয়ে। শহরের ভালো কোনো হোটেলে কচি পুঁইডগার মতো তাজা এক তরুণী আমার জন্য অপেক্ষায় থাকত, আমি তার সঙ্গে দেখা করতাম ওখানে, তারপর এখানে ফিরে এসে দুই ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাজে চলে যেতাম। কাজে যেতাম মানে এই নয় যে আমি কাজ করতাম।

কোম্পানির মালিক মিষ্টি, ও আমাকে স্পেশাল প্রজেক্টগুলোর ভাইস প্রেসিডেন্ট বানিয়েছে। কী সেগুলো? কী আবার, আমি যা বা যেমন চাই তাই, আপাতত ওয়েস্ট বিনে মোচড়ানো কাগজ ছুড়ে টার্গেট প্র্যাকটিস।

একসময় সপ্তাহে একটা একঘেয়ে হয়ে উঠল। একটু বাড়িয়ে সপ্তাহে দুটো করলাম, তারপর তিনটে। আজকাল আমি সপ্তাহের প্রতি রাতে আলাদা একজন করে নটী-বিনোদিনীর সঙ্গ উপভোগ করি। এটাকে আপনি যদি জিয়ো তো অ্যায়সে জিয়ো বলতে না চান, আমার কিছু বলার নেই। সবচেয়ে বড় কথা, মিষ্টি ঘুণাক্ষরে কিচ্ছুটি টের পায় না। কী বোকাসোকা বউ আমার!

কী? বউকে এভাবে ঠকিয়ে আমি গিল্টি ফিল করি কি না? আরে, ওর বোকামির জন্য আমি দায়ী? আমাকে বিয়ে করাটা উচিত নয়—এটা যদি মিষ্টি বুঝতে না পারে, সেটা আমার অপরাধ হতে পারে? তবে এ–ও ঠিক, হে হে, আমাকে বিয়ে না করে ওর উপায়ও ছিল না—এমন সুপুরুষ আর সেক্সি পুরুষ আর কোথায় পাবে?

কয়েক মিনিট হয়ে গেল মিষ্টি একদম নড়াচড়া করছে না। বিছানা ছাড়ার আগে আরও দুই মিনিট সময় দিই ওকে, ওর ঘুমটা যাতে আরও গভীর হয়। তারপর কাপড় পাল্টে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। আজকের বিনোদিনী আনকোরা নতুন।

৩৩০ নম্বর কামরা। আর অপেক্ষা করতে পারছি না।

ঠিক আছে, এবার উঠতে হয়। দাঁড়ান। আলো জ্বলল। মিষ্টি জেগে। এটা কীভাবে ঘটল? ওর তো গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার কথা। আরে, মিষ্টি ফোন করছে। চুপ থাকি, নড়ি না, ভান করি ঘুমাচ্ছি।

‘এই। কাজটা করেছি।’

এত রাতে কার সঙ্গে কথা বলছে মিষ্টি?

‘ভয় পেয়ো না ও আমার কথা শুনতে পাবে না।’

কিন্তু আমি শুনতে পাচ্ছি। ও যা বলছে, সব আমি শুনতে পাচ্ছি।

‘আমি জানি। কাজটা যে করতে পেরেছি, সেটা আমার নিজেরও বিশ্বাস হচ্ছে না।’

মিষ্টি কী কাজ করতে পেরেছে?

‘কিন্তু আমাকে ঠকাচ্ছিল ও।’

ওরে সর্বনাশ। মিষ্টি জানে।

‘এবং বোকার অভিনয় করতে করতে নিজের ওপর আমার ঘৃণা ধরে যাচ্ছিল।’

এসব কী বলছে মিষ্টি। ও কি সত্যি মনে করে, আমি ওর কথা শুনতে পাচ্ছি না?

‘হ্যাঁ, আমি কল করতে যাচ্ছি এই এক মিনিটের মধ্যে।’

কী ঘটছে আসলে?

‘ওটা ছিল একটা জোশ আইডিয়া, ওর হুইস্কিতে আমার স্লিপিং পিল মিশিয়ে দেওয়াটা। তুমি যেভাবে বলে দিয়েছ, প্রথমে ওগুলো আমি গুঁড়িয়ে আটা বানিয়ে নিয়েছি। ...নাহ্, কিছুই টের পায়নি ও। তিনটে পিলেই কম্ম কাবার।’ খিক খিক করে হাসল মিষ্টি।

ওরে ডাইনি! তুমিই হাসির পাত্রী হতে যাচ্ছ। তোমার পিলে কাজ হয়নি। আমি বেঁচে আছি, এবং তোমার সব কথা আমি শুনতে পাচ্ছি। এটা অ্যাটেম্পট টু মার্ডার। তোমাকে জেলখানায় পচতে হবে। এখন আমি তোমার সব টাকার মালিক হব। হা হা!

এবার মিষ্টিকে বড় সারপ্রাইজটা দিতে যাচ্ছি। ওর চেহারাটা কেমন হবে দেখার জন্য আমার তর সইছে না...কিন্তু আমি নড়তে পারছি না কেন?...আমি এমনকি চোখও খুলতে পারছি না।...কিন্তু আমার চোখ যদি বন্ধ থাকে, আমি তাহলে সবকিছু দেখতে পাচ্ছি কীভাবে?

‘আমি অতিরিক্ত আরও কয়েকটা মিনিট অপেক্ষা করছি, ও সত্যি মারা গেছে কি না নিশ্চিত হওয়ার জন্য।’

আমি মারা যাইনি।

‘হাসপাতালে ডাক্তাররা ওকে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলে প্রাণ ফিরে পাবে, এটা তো আমি চাইতে পারি না।’

অ্যাঁ?

‘আচ্ছা, ধরো, শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মতো একটা অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে ও। সেটা মজার একটা ব্যাপার না? ও হয়তো ওপর থেকে তাকিয়ে আছে, শুনতে পাচ্ছে আমি ওকে কীভাবে খুন করেছি, দেখতে পাচ্ছে মরা দেহটা আমার পাশে পড়ে রয়েছে, ইচ্ছে হচ্ছে একঝটকায় উঠে বসুক, দুহাতে চেপে ধরুক আমার গলাটা।’ সিলিংয়ের দিকে তাকাল মিষ্টি, একটা আঙুল তাক করল সেদিকে।

না!

‘ভারি একটা রগড় হয় তাহলে, কী বলো?’

এ রকম কিছু তুমি করতে চাও না, মিষ্টি। আমি তোমাকে ভালোবাসি, সোনামণি। এখন তুমি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করো—৯৯৯। প্লিজ!

‘কিন্তু থামো, আমার এখনই কল করার দরকার নেই। মৃত্যুর সময় নিয়ে আমার উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন কী। আমি জানব কীভাবে যে মারা গেছে ও। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। আমি সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব, তারপর ৯৯৯–তে ফোন করব। তখন আমার নিশ্চিতভাবে জানা হবে সত্যি মারা গেছে ও।’

না, প্লিজ! আমি মিলিয়ে যাচ্ছি, মিষ্টি। আমি এখন তোমাকে কোনো রকমে দেখতে পাচ্ছি। প্লিজ, ফোন করো...তা না হলে...দেরি...

বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে।