দোলাচল

গ্লাসডোরটা খুলে অফিস থেকে লাঞ্চ করবে বলে বাইরে বের হয়ে এসে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল অনীতা। মেজাজটা খিঁচড়ে আছে। বাইরে ঝকঝকে রোদ্দুর। মাঝেমধ্যে অফিসটাকে মনে হয় যেন সোনার খাঁচা। ব্যস্ত মতিঝিলের এই নামকরা বিজ্ঞাপনী সংস্থার করপোরেট অফিসের ঝকঝকে তকতকে হিমশীতল আরামদায়ক এসি রুম, যেখানে হঠাৎ বাইরের কেউ ঢুকলে ভুল করে অ্যান্টার্কটিকার কোনো জায়গায় চলে এসেছি বলেও ভাবতে পারে; তো তেমন জায়গায় বসে কাজ করতে করতেও সে হাঁপিয়ে ওঠে।

চাকরিটা তাড়াতাড়ি পাল্টানো দরকার, ভাবল অনীতা। ওর চোখে লালমাটিয়ার গাছগাছালি ভরা নিরিবিলি পরিবেশের দোতলা, তিনতলা এনজিওর অফিসগুলোর ছবি ভেসে ওঠে। ভাবে, ওরা তো তা–ও গরিব মানুষগুলোর জন্য কাজ করে, ওই সব জায়গায় কাজ করার একটা অর্থ তবু দাঁড় করানো যায়। কিন্তু করপোরেট অফিসগুলোর নিজেদের লাভ–লোকসানের সারাক্ষণের হিসাব–নিকাশের এই জীবন ওর একেবারেই পোষাচ্ছে না। সব সময় মনে হচ্ছে অন্যের মুনাফা আর ব্যাংক ব্যালান্স বাড়ানোর জন্য নিজের গোটা জীবনের বিনিময়ে এই চাকরি করার জগতের মানুষ ও নয়, আরও একটু যেন অর্থপূর্ণ হওয়া দরকার জীবিকার ব্যাপারটা। শুধু মাস গুনে টাকা পেয়ে গেলেই যেন হলো না।

এসব ভাবতে ভাবতে শাপলা চত্বরের দিকে তাকাল সে, রায়হান আসছে কি না দেখার চেষ্টা করল। অন্য দিন আগেই আসে! আজ নির্ঘাত কাজে আটকেছে। দুজনের একই অবস্থা, ভাবল সে। তাদের চাকরির এক বছরও হয়নি। জীবন তো মাত্র শুরু। অনীতার তো মাস্টার্সের রেজাল্টটাও দেয়নি এখনো। তবুও চাকরিটা হয়ে গেল।

কিন্তু মাথার মধ্যে তো মাঝেমধ্যেই অন্য রকম কিছু ঝিঁঝিপোকা ঘোরে–ফেরে! কত দিন হয়ে গেল ছায়ানটে গানের রিহার্সেলে থাকতে পারছে না। চারণের কতগুলো আবৃত্তির প্রোগ্রামে এরই মধ্যে সে বাদ পড়ে গেছে সময় বের করতে পারেনি বলে। অথচ চাকরিটা শুরু করতে হলো একেবারে আপাদমস্তক এক খোট্টা করপোরেট জায়গায়। টাকাপয়সার হিসাব ছাড়া যেখানে আর কিছুই নেই।

দূর থেকে লম্বা মানুষটার অবয়ব আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে লাগল। দুজনের কাছকাছি অফিস। হাঁটা দূরত্ব। সকালে মোহাম্মদপুরের যার যার বাসা থেকে বের হয়ে একসঙ্গে বাস ধরে অফিসে আসা, ওকে নামিয়ে দিয়ে রায়হান চলে যায় তার জায়গায়। কাজের বেশি চাপ না থাকলে চেষ্টা করে দুপুরের খাবারটা দুজনে বাইরে এসে কোনো রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার। কিছুটা সময় নিজেদের মতো করে পাওয়া আরকি।

‘আর বলিস না, ঠিক বের হওয়ার আগেই এমন একটা ঝামেলা এসে চাপল!’ কাছে এসে বলল রায়হান, ‘চল এগোই।’

দুজনে এগোল সামনেই কস্তুরীর দিকে। দারুণ বাংলা খাবার ওদের। দুজনেরই পছন্দের জায়গা।

‘কী খাবি বল!’ মতিঝিলের অফিসপাড়ায় এ সময় খাবারের দোকানগুলো গমগম করতে থাকে মানুষের ভিড়ে। দুপুরবেলা খাওয়ার অছিলাতে হলেও একটু বাইরে এসে দম ফেলতে পারে মানুষগুলো! চারদিক থেকে নানা রকম খাবারের গন্ধ ম–ম করছে। কত রকম মানুষ তাদের জীবনের কত রকম গল্প নিয়ে যে এক একটা টেবিলে বসে আছে! ভাবল অনীতা।

‘কী হলো বল কী খাবি!’ সংবিৎ ফিরল অনীতার রায়হানের কথা শুনে। তাকিয়ে দেখল ওয়েটার ছেলেটা দাঁড়িয়ে অর্ডারের জন্য।

‘আরে হালকা কিছু একটা বললেই হয়।’ অনীতার জন্য একটা চিকেন ঝাল ঝাল কারি আর নিজের জন্য একটা কাতলা মাছের ঝোল, টাকি মাছ ভর্তা আর পাতলা ডাল অর্ডার দিয়ে ছেলেটাকে বিদায় করে দিয়ে ওর দিকে ভালো করে তাকাল রায়হান।

‘কী রে, কী হয়েছে? কোনো সমস্যা? মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে, কিছু একটা হয়েছে।’

‘ওই আরকি! তেমন কিছু না’, বলল অনীতা। ‘বাইরে গেছিলি কোথাও?’ রায়হান জিজ্ঞাসা করল আবার। ‘হুঁ,’ মাথা ঝাঁকাল অনীতা। ক্লায়েন্ট সার্ভিসে এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করে সে। প্রায়ই ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কাজের কারণে দেখা করার জন্য বাইরে যেতে হয়। যেহেতু নতুন এখনো, তাই বড় ক্লায়েন্ট হলে প্রথমবার সিনিয়ররা কেউ কেউ থাকে সঙ্গে, পরিচিত হয়ে গেলে এরপর থেকে অনীতা একাই যায় প্রয়োজনমতো।

‘কী হয়েছে বল না?’ আবার বলে রায়হান।

‘আরে, আজকে পিকলু ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের এক বড় ক্লায়েন্টের অফিসে গেছিলাম’, বলল অনীতা। ‘এমন একটা ঘটনা ঘটল, মেজাজটা সেই থেকে চড়ে আছে একদম। ওদের একটা বড় রিপোর্টের কাজ চলছে আমাদের সঙ্গে, কাজটায় ‌অনেক ভুল রয়ে যাওয়াতে সেগুলো সব ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। ডেডলা‌ইন শেষ, আজকে লাস্ট ড্রাফটটা দেখানোর জন্য গেছি। পিকলু ভাই হঠাৎ বলে কিনা, আপনি গিয়ে কথা বলেন, আমি নিচে আছি। শুনে তো আমি অবাক! কাজটা নিয়ে সে আমাকে কোনো ব্রিফও করেনি যে সেটা কী অবস্থায় আছে। আমি সঙ্গে এসেছি আজকে কাজটা বুঝে নেব বলে, যেন এরপর থেকে আমি বিষয়টা ডিল করতে পারি। আচ্ছা, এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্টের সঙ্গে এ রকম করার মানে কী বল তো? ভদ্রমহিলা বিদেশি। আমি রুমে ঢুকে তাকে পরিচয় দিয়ে ড্রাফটটা দেখাতেই সে তো রাগে ফেটে পড়ল। কোনো বিদেশি মহিলার এ রকম চেহারা তো কখনো দেখিইনি, দেখব তা কল্পনাও করিনি, তা–ও এভাবে! কাজের মান নিয়ে খুব অখুশি, নানান ভুল আমাকে দেখিয়ে দিল! অথচ এটা আজকালের মধ্যেই প্রেসে যাবে। কেমন লাগে বল! যা–ই হোক, আমি মহিলাকে পুরো বিষয়টা ভালো করে দেখিয়েছি এবং আর এ রকম হবে না বলেটলে কাজটা ভালোমতো বুঝে নিয়ে বের হলাম।

নিচে এসে দেখি, পিকলু ভাই দাঁড়িয়ে আরামসে সিগারেট টানছে! এমন রাগ হলো দেখে। আমার কী ধারণা জানিস, পিকলু ভাই ভালো ইংরেজি বলতে পারে না, সে ইচ্ছা করেই আমাকে ঠেলে দিয়েছে এভাবে।’

হো হো করে হেসে উঠল রায়হান এ কথা শুনে!

‘করপোরেটদের ভেতরে এসব হরদমই হয়। আমাদেরও এ রকম বহু ঘটনা ঘটতেই থাকে। চাকরি মানেই এসব মেনে নিয়েই তো করা। চাকরের কাজ পুরাই, বুঝলা? মাস শেষে কতগুলো কড়কড়ে টাকা ব্যাংকে ঢুকে যাবে, ব্যস, সারা মাসে একটু গুছিয়ে চললে আর নো চিন্তা। কিছু বাড়তি সুযোগ–সুবিধা... এই তো। এর বিনিময়ে হয়ে গেলাম আমরা কেনা গোলাম, বুঝলেন বেগম সাহেবা?’ হাসতে হাসতে বলে রায়হান।

>‘যাহোক এত চিন্তা করে কী হবে! এভাবেই চলবে, তুই শুধু আমার পাশে থাক, তাহলেই সব ঠিকঠাক...।’ একটু হেসে অনীতার দিকে তাকিয়ে হাতের ওপর ওর হাতটা রেখে আলতো করে চাপ দিল, সারা দিনের অক্সিজেন যেন।

অথচ কত মানুষ এ রকম একটা চাকরি পাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করছে! কিন্তু আমাদের কেন এ রকম অদ্ভুত ভাবনা হয়! ভাবে অনীতা।

খাবার এসে গেল ওরা কথা বলতে বলতে। একেবারে ধোঁয়া ওঠা খাবার। ঠিক এই টাটকা গরম খাবারের আকর্ষণেই মানুষের এত ভিড় এখানে।

‘তোর কী অবস্থা?’ অনীতা বলল। ‘ওই একই’, রায়হান তাকায় খেতে খেতে ওর দিকে। ‘কাজের জায়গার চেহারা সব জায়গায় কমবেশি একই! এগুলো নিয়েই চলতে হবে। কে কতটা কীভাবে মানিয়ে চলতে পারে, সেটাই আসল কথা। আমারও মাঝেমধ্যে খুব ‌অস্থির লাগে! এত কাজের ভিড়ে নিজের আসল কাজের আর কোনো সময়ই পাচ্ছি না। আমার উপন্যাসটা অর্ধেক লিখে ফেলে রেখেছি আজ কত দিন হলো। রাতে বাসায় গিয়ে ক্লান্ত লাগে। মাথায় আর কিছু আসে না। জানি না কত দিন এভাবে পারব! মাত্র তো শুরু! সকাল থেকে সন্ধ্যা পুরো দিনই কত কত অহেতুক কাজের ভিড়ে আমার আসল কাজ চাপা পড়ে যায়, মাস শেষে টাকাগুলো পাব সে জন্য। এই চিন্তাই আমাকে অস্থির করে মারে। অথচ টাকারও কত দরকার। আর ছয় মাসের মধ্যে আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি...’

অনীতারও ‌অস্থির লাগে রায়হানের কথা শুনতে শুনতে। ওর খাওয়া শেষ আগেই, রায়হানের কথা শুনতে শুনতে ওর খাওয়া দেখে, মাছ খাওয়ার পোকা। খুব আরাম করে ফিশ কারিটা খেয়ে ডাল নিয়ে খাওয়াটা শেষ করে। হাত ধুয়ে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘চল, তাড়াতাড়ি অফিসে ফিরেই মিটিং ধরতে হবে একটা।’

‘যা–ই হোক, এত চিন্তা করে কী হবে! এভাবেই চলবে। তুই শুধু আমার পাশে থাক, তাহলেই সব ঠিকঠাক’, একটু হেসে অনীতার দিকে তাকিয়ে হাতের ওপর ওর হাতটা রেখে আলতো করে চাপ দিল, সারা দিনের অক্সিজেন যেন। অনীতার কথা ভেবে ওরও খারাপ লাগে। চমৎকার একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল আছে অনীতার। এত ভালো গান গায়, আবৃত্তি করে; অথচ চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই সেগুলো সবই যেন কত দূরের ব্যাপার হয়ে গেছে! কয়েক দিন আগেও খুব ভালো একটা কাজের প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হলো অফিসের টাইমের সঙ্গে মেলাতে পারল না বলে। কীভাবে এরপর সেগুলো এগিয়ে নিতে পারবে, গোটা দিন এই চাকরি নামক দানবের পেটে দিয়ে, সেটাই ভাবল। বিয়ের পর দুজনের নতুন সংসার, দায়দায়িত্বের আরও নানান রকম চেহারা বের হতে থাকবে।

অনীতার একটু চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর চিন্তাগুলোও যেন সিগারেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো জট পাকিয়ে যেতে থাকে!

অন্য আলোতে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]