পয়সা

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

শাউরিয়ার মেলা শেষ। সূর্যাস্তের পর মেলায় থাকার নিয়ম নেই। তার ওপর মেঘে আকাশ অন্ধকার। ক্রেতা-বিক্রেতারা বাড়ির ঘাটা ধরেছে অনেকক্ষণ। শুধু পড়ে থাকা মিষ্টির লোভে মাটি চেটে বেড়াচ্ছে মণ্ডলবাড়ির মোটা কুকুরটা। এই ঘোর সাঁঝে, বজ্র ঝলসানো মাঠে একটা পরিচিত মুখ দেখে নাসরিন স্বস্তি পায়।

নাসরিনের হাতে একটা কুপি। বাতাসে শিখা বারবার নেভার উপক্রম হচ্ছে। ডান হাতে সেটা আড়াল করে মাটিতে বসে ইতিউতি পয়সা খোঁজে নাসরিন। এখানে জুয়ার আড্ডা বসেছিল। কিছু খুচরা পয়সা পড়ে থাকা বিচিত্র নয়। এমনকি কড়কড়ে নোটও জুটতে পারে। গতবারই তো মাঝিপাড়ার নগেন বুড়ো তারা মসজিদের ছবিওয়ালা দুটো পাঁচ শ টাকার নোট এখানে কুড়িয়ে পেয়েছিল। টাকা পেয়ে বুড়োর বেটি শ্রীমতীর সেকি দেমাগ! ভাবখানা এমন যে এক হাজার টাকা পেয়ে বড়লোক হয়ে গেছে। বাবরি মসজিদের ঘটনার পর মাঝিপাড়ার কেউ মেলামুখো হয়নি। সেই সুযোগটাই নাসরিন নিয়েছে। শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে মাটিতে খুঁজে বেড়াচ্ছে টাকাপয়সা।

জুয়ার আড্ডা চষে নাসরিনের খুব একটা লাভ হলো না। কয়েকটা সিকি আর আধুলি পেয়েছে। নোট দূরের কথা, একটা গোটা টাকাও পায়নি। আজকাল জুয়াড়িরাও খুব সেয়ানা। ‘জ্ঞানের নাড়ি টনটনা’, মনে মনে হাউজি খেলা লোকগুলোকে গালি দেয় সে। 

পয়সা খুঁজতে খুঁজতে মেলার প্রান্তবিন্দুতে চলে এসেছে নাসরিন। এখানে এক জাদুকর খুব ভয়ের খেলা দেখিয়েছিল। নিজের ছেলেকে একটা বাক্সে ঢুকিয়ে দুই টুকরো করে কেটে আবার জোড়া দিয়েছিল। সেদিকে যেতে যেতে শরীর শিরশির করে। এমন সময় চারপাশ বজ্রের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলে সে লক্ষ্য করে, মাটিতে একটা পয়সা পড়ে আছে। সে তাড়াতাড়ি পয়সাটা কুড়িয়ে নেয়। এক টাকার একটা কয়েন। কিছুক্ষণ মুঠোবন্দী রেখে নাসরিন অনুভব করে, টাকাটা বেজায় গরম হয়ে উঠছে। উহ্! করে উঠে সে টাকাটা ফেলে দেয়। অবাক হয়ে লক্ষ করে, টাকাটা মাটিতে পড়ামাত্র দ্বিখণ্ডিত হয়ে দুটো টাকায় পরিণত হলো। পড়িমরি করে টাকা দুটোকে কুড়িয়ে নিল সে। 

অবাক ব্যাপার! দুটো টাকাই গরম। আগের টাকাটা বোধ হয় বেশি গরম। নতুন টাকাটা এখনো অপরিণত, এক পাশের মানুষ ও অন্য পাশের শাপলার আদল এখনো স্পষ্ট হয়নি।

‘ট্যাকাটার ছাওয়া হইছে’, বিড়বিড় করে নাসরিন। তাড়াতাড়ি কয়েনগুলো কামিজের কোঁচড়ে বন্দী করে বাড়ি ফিরতে উদ্যোগী হয়। নাসরিনের দেখাদেখি ধুমসো কুকুরটাও পিছু নেয়। চাপা আনন্দে নাসরিন ভেতরে ভেতরে উড়তে থাকে। 

আকাশের বজ্র ততক্ষণে অনেক কাছে চলে এসেছে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। নাসরিন বুঝতে পারে, কুপিটা যেকোনো সময় নিভে যাবে। জমির আইল ধরে জোরে জোরে হাঁটতে থাকে সে। কিছুদূর হাঁটার পর তার মনে হয়, কে যেন আইল আটকে দাঁড়িয়ে আছে। ভুল ভাবেনি নাসরিন। একটা তিন ব্যাটারির টর্চ হঠাৎ তার চোখ লক্ষ্য করে জ্বলে ওঠে। 

‘কাঁই ওটা?’ একটা গমগমে পুরুষ কণ্ঠ লোভীর মতো বলে ওঠে।

নাসরিনের মুখে কথা সরে না। কাঁপা গলায় বলে, ‘মুই, নাসরিন।’

‘শমসেলের বেটি? মেলা বড় হয়া গেছিস দেখোঁ।’ টর্চের আলো ততক্ষণে স্থির হয়েছে নাসরিনের বুকে। 

নাসরিন লোকটাকে চিনতে পারে না। কিন্তু লোকটা তার বাবাকে চেনে। সে সাহস পেয়ে বলে, ‘হয় বাহে চাচামিয়া। মুই এলা বাড়িত যাঁও।’ 

লোকটা ঠা ঠা করে হেসে ওঠে, ‘যাইস এলা। এই ঝরির ভেতর ক্যামন করি যাবু? আয় একনা মেশিনের ঘরত যাই।’ 

নাসরিনের স্নায়ু টানটান হয়ে ওঠে। তার নারীসত্তা দ্রুত পালাতে বলে। সে সিদ্ধান্ত নেয় জোরে ছুট দেবে। লোকটা দ্রুত এগিয়ে আসছে। গলায় ছেলে ভোলানো তু তু স্বর। টর্চের আলো নাসরিনের শরীরের প্রতিটি ইঞ্চিজুড়ে ঘোরাফেরা করছে। সেটা এবারে চোখে এসে স্থির হয়। আকাশের বজ্রের সঙ্গে টর্চের আলো মিলিয়ে নাসরিন আলোকবিদ্ধ হয়। তার সমস্ত শরীর জমে যায়। দৌড়ানো ভুলে গিয়ে সে লোকটার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে।

মোটা কুকুরটা বারবার ভুকে নাসরিনকে সতর্ক করে দেয়। নাসরিন নিরুপায়। তার হাত-পা চলনশক্তিহীন। লোকটা একেবারে নিশ্বাসের দূরত্বে চলে এসেছে। শরীর থেকে বাংলা মদের গন্ধ ভকভক করে বেরোচ্ছে। একটা চিৎকার নাসরিনের গলা পর্যন্ত উঠে এসে আটকে যায়। লোকটা বলিষ্ঠ আলিঙ্গনে নাসরিনকে কাঁধে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে। 

‘মেলা পাইসা কুড়াছিস!’ লোকটার গলা খনখন করে ওঠে। সে এবারে নাসরিনকে পাঁজাকোলা করে তোলার চেষ্টা করে। আবারও ব্যর্থ হয়। ‘দেখি কতুগুলা পাইসা পাছিস?’ বলে লোকটা নাসরিনের কোঁচড়ে হাত দেয়। 

শ খানেক কয়েন ঝনাৎ করে কাদামাটিতে আছড়ে পড়ে। লোকটা লোভীর মতো পয়সাগুলো দিয়ে লুঙ্গির কোঁচড় ভরাতে চায়, ‘বাপ রে বাপ কতুগুলা পাইসা!’ 

এবারে নাসরিনের শরীরের বোধ ফিরে আসে। হাত-পা সচল হয়। সে সর্বশক্তি দিয়ে গ্রামের দিকে দৌড় দেয়। কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে পিছু নেয়। 

ছুটন্ত নাসরিনের দিকে লোকটা একবার মাত্র তাকায়। তারপর হামলে পড়ে পয়সার স্তূপে। পেটের খিদে মেটানোই এখন তার কাছে মুখ্য।